আলোকিত মানুষ চাই শ্লোগানকে সামনে রেখে যে মানুষটি আলোকিত মানুষ গড়ার ব্রত নিয়েছেন তাঁকে আমরা সবাই চিনি। তিনি আমাদের সবার প্রিয় সায়ীদ স্যার। পুরো নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ‘আলোকিত মানুষ চাই’ আন্দোলনের পুরোধা হিসাবে সত্তরের দশকের শেষ পর্বে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এই কেন্দ্র পরিচালিত মূলত বই পড়া কর্মসূচীর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের হাজার হাজার স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। এছাড়াও কেন্দ্র পরিচালিত আরো নানারকম সামাজিক কাজ দেশে এবং বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিনোদনমূলক ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় তিনি পথিকৃত্। বিনোদন ও সৃজনশীলতার গুণে টিভি উপস্থাপনাকে তিনি নিয়ে গেছেন মননশীলতার উচ্চতর স্তরে। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, জার্নাল অনুবাদসহ সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি তাঁর সৃজনশীলতা ও মননের পরিচয় রেখেছেন।
জন্ম
১৯৪০ সালের ২৫ জুলাই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস ছিল বাগেরহাট জেলার কামারগতির কচুয়ায়। তাঁর পিতা মরহুম আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন কলেজ শিক্ষক ও অধ্যক্ষ। তাঁর কর্মসূত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের নানা জায়গায়।
শিক্ষা
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৫৫ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন বাগেরহাট প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে। তিনি ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ. (অনার্স) ও ১৯৬১ সালে একই বিষয়ে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিয়ে
১৯৬৫ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
পিতার প্রভাব
আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ খুব অল্প বয়সে মাকে হারান। তিনি ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয়। আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদের জীবনে তাঁর পিতার শিক্ষা ও আদর্শের প্রভাব সুস্পষ্ট। পিতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষক হিসাবে আব্বা ছিলেন খ্যাতিমান। ১৯৫০ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র, আব্বা তখন পাবনা এডোয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কথা উঠলে এমন সশ্রদ্ধ উদ্বেলতায় উপচে পড়ত যে মনে হত কোনো মানুষ নয়, কোনো দেবতা নিয়ে তারা কথা বলছে। একজন ভালো শিক্ষক ছাত্রদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ভালোবাসার যে কী দুর্লভ বেদিতে অধিষ্ঠিত থাকেন আব্বাকে দেখে তা টের পেতাম। একজন মানুষের এর চেয়ে বড় আর কী চাওয়ার থাকতে পারে। তখন থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম এই পৃথিবীতে যদি কিছু হতেই হয় তবে তা হবে শিক্ষক হওয়া, আব্বার মতোন শিক্ষক।
ধন নয় মান নয়, খ্যাতি, বিত্ত বিছুই নয়, একজন নাম পরিচয়হীন শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের মাঝখানে জীবন কাটিয়ে দেবার এই সিদ্ধান্তটি যেসব কারণে ছেলেবেলাতেই নিতে পেরেছিলাম, আব্বার ব্যক্তিত্বের প্রভাবটাই তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। প্রায় সব পিতাই চায় তাঁর স্বপ্নের মশালটা নিজের সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে যেতে, কিন্তু সুযোগ হয় অল্প মানুষেরই। সবার বাবার মত আমার বাবাও নিশ্চয় চাইতেন তাঁর সন্তানদের মধ্যে এক বা দু’জন তাঁর সাহিত্য ও শিক্ষকতার আদর্শকে উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করুক। শিক্ষক হবার কোনো প্ররোচনা তিনি আমাকে সরাসরি দেননি। আমার ধারণা শিক্ষকতা আমার রক্তে মিশে ছিল। তাই আমি এভাবে অমোঘ বিধিলিপি মেনে নেয়ার মতো ঐ রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম।’
শিক্ষাজীবন ও শিক্ষকদের প্রভাব
আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ যখন প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন তখন তাঁরা ছিলেন টাঙ্গাইল থেকে মাইল চারেক দূরে, করটিয়ায়। পাঁচ ছয় বছরের সেই শিশুকে পড়ানোর দায়িত্ব পান শরদিন্দু বাবু। শৈশবের এই শিক্ষক সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এমন, ‘আব্বা ছাড়া যে সব মানুষের নিবিড় ও শ্রদ্ধেয় মুখ আমাকে শিক্ষকতার পথে ডাক দিয়েছিল ছেলেবেলার শিক্ষক শরদিন্দু বাবু তাঁদের একজন। রোজ রোজ নতুন উপহার দিয়ে স্যার আমাকে পড়ার জগতের ভেতর আটকে রাখতেন। কবে কী উপহার আসবে এই নিয়ে সারাটা দিন কল্পনায় উত্তেজনায় রঙিন হয়ে থাকতাম। এমনি করে কখন যে একসময় পড়ার আনন্দ আর উপহার পাওয়ার আনন্দ এক হয়ে গিয়েছিল টের পাইনি। এক সময় অনুভব করেছিলাম স্যারের আদরের ভেতর থাকতে থাকতে আমি কখন যেন পড়াশুনাকে ভালবেসে ফেলেছি।’
আবদুল্লহ্ আবু সায়ীদের জীবনে তাঁর শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রভাব বিস্তর। শিক্ষকদের কাছ থেকেই তিনি জীবনকে চিনেছেন, জগতকে চিনেছেন। তাঁর স্কুল রাধানগর মজুমদার একাডেমি স্কুলের আর একজন শিক্ষক অমর পালকে তিনি স্মরণ করেছেন এভাবে,’স্যার স্নেহ আর প্রীতি ছাড়া ছাত্রদের কিছুই দিতে জানতেন না। আমাদের সব দোষ ও লজ্জাকে দুই হাতের আদরে ঢেকে অপর্যাপ্ত প্রীতিতে কেবলই আপ্লুত করে যেতেন তিনি। সেই স্নেহের ধারা আমার শৈশব থেকে যৌবন পেরিয়ে আজও আমাকে যেন স্নিগ্ধ করে চলেছে।’
নবম শ্রেণীতে ওঠার পর তিনি রাধানগর মজুমদার একাডেমি ছেড়ে পাবনা জেলা স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন। সেখানে যে সব শিক্ষক তাঁর কিশোর হৃদয়ে স্বপ্ন আর ভালবাসার পৃথিবী জাগিয়ে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্কুলের শিক্ষক মওলানা কসিমউদ্দিন আহমেদ। স্বপ্নে ভরা চোখ, উদ্দাম জীবনাবেগ, দৃপ্ত, প্রিয়দর্শন ও আপাদমস্তক আধুনিক কসিম উদ্দিন ছিলেন সারা স্কুলের তারুণ্যের প্রতীক। ক্লাশঘর থেকে স্কাউটিং, খেলার মাঠ থেকে বিতর্কসভা সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন ছাত্রদের নেতা ও সহযাত্রী। একাত্তরের স্বধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন।
১৯৫৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পরের দুই বছর তিনি বাগেরহাট প্রফু্ল্লচন্দ্র কলেজে পড়েন। কলেজের শিক্ষকদের কথা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ বলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল শিক্ষকদের দেখা পেয়েছিলাম আমার কলেজ জীবনের দিনগুলোয়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের হাতে গড়া এই কলেজের শিক্ষকদের ভেতর শিক্ষকতার যে জ্যোতির্ময় রূপ আমি দেখেছি তার সমমানের কোনকিছু আমি আর কখনো কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
তিনজন অসাধারণ ইংরেজির অধ্যাপককে পেয়েছিলাম কলেজে। তাঁদের দেখে আমি জেনেছি শিক্ষকের জীবনঐশ্বর্য কীভাবে একজন ছাত্রকে জীবনের উন্মূখ অনুসন্ধিত্সু ও প্রাথমিক দিন গুলোয় সারাজীবনের জন্যে তিলে তিলে গড়ে তোলে। এদের কাছে পড়ার পর ছাত্রদের জীবনকে আলোময় কিছু না দিয়ে কেবল রুটিনমাফিক সিলেবাস শেষ করা আর নোট মুখস্থ করিয়ে যাওয়াকে আমি আর কখনো শিক্ষকতা বলে ভাবতে পারিনি।’ বাংলার অধ্যাপক কালিদাস মুখার্জি, অর্থনীতির অধ্যাপক নারায়ণ সমাদ্দার এমনি আরো কয়েক জন শিক্ষক সারাজীবন তাঁর জীবন-প্রেরণার অংশ হয়ে রয়েছেন।
কলেজের স্মৃতিতে আরো একজন তাঁর কাছে চির ভাস্কর, তিনি হলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। তাঁর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বাগেরহাট কলেজে আমার একজন নীরব পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি। মূল ভবনটার সামনের দেয়াল ঘেষে সুদৃশ্য পামগাছের সারি ছিল। এর আঙিনার দরজা দিয়ে ঢুকলেই সিমেন্টের বেদির ওপর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটা চোখের সামনে দেখা যায়। বিকেলের দিকে যখন কলেজ নির্জন হয়ে আসত, পামগাছ, রেস্তোরাঁ, পুকুর, রাস্তা সবকিছু নিয়ে ক্যাম্পাসটাকে একটা ছোট্ট সুন্দর রূপকথার দেশের মতো মনে হত, তখন নিঃশব্দে আমি প্রফুল্লচন্দ্রের সেই ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। তারপর যিনি একদিন ছিলেন আজ নেই সেই মানুষটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তাঁর ভেতর থেকে জীবনের দুর্লভ শিক্ষা ও শ্রেয়োবোধকে নিজের ভেতর টেনে নিতে চাইতাম। আমি লক্ষ্য করতাম বিকেলের সেই স্তব্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভেতর আমার হৃদয় একটা দৃঢ় গভীর আত্মবিশ্বাসে সুস্থির হয়ে উঠেছে। বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজের অনেক শিক্ষকের কাছ থেকেই অনেক দুর্লভ প্রাপ্তি ঘটেছিল যা আমার জীবনকে, নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু এই নিঃশব্দ পথপ্রদর্শক তাঁর জীবনের কর্ম, সাধনা আর একাগ্রতার নিথর শীর্ষ থেকে আমাকে যে নিঃশব্দ নির্দেশ উপহার দিয়েছিলেন তার সমান আর কিছু ছিল না। আমাদের ছেলেবেলার শিক্ষায়তনগুলোর শিক্ষকদের মান গড়পড়তাভাবে ছিল যথেষ্ট উন্নত। এ ধরনের শিক্ষকেরা তখন প্রায় সবখানেই ছিলেন। এমন কিছু মূল্যবোধ সেই শিক্ষকরা ধারণ করতেন যা শ্রেয়জীবনের অনুকুল। আজকের স্কুল-কলেজ গুলোতে এই মাপের শিক্ষক কমে এসেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ বহু প্রথিতযশা শিক্ষকদের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। সমাজের গুণীজন হিসাবে পরিচিত এসব শিক্ষকরা তাঁর জীবনে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন মুনীর চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ। এসব শিক্ষকদের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে এখোনো শ্রদ্ধায় তাঁর মাথা নত হয়ে আসে।
মুনীর চৌধুরীর সাথে আবু সায়ীদের যখন পরিচয় হয় তখন তিনি একজন ভালো শিক্ষক এবং সেকালের প্রগতিশীল কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে দেশব্যাপী পরিচিত। বাগেরহাট ও পাবনায় থাকা অবস্থাতেই মুনীর চৌধুরীর আপোষহীন রাজনৈতিক ভূমিকা এবং তাঁর বোন নাদেরা চৌধুরীর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন। অবশ্য প্রথম দিনের দর্শনে মুনির চৌধুরীর নীরব নির্বিকার চেহারা দেখে তিনি কিছুটা যেন হতাশই হয়েছিলেন। এর কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন রাজনীতি থেকে সরে আসার পর সম্ভবত সংঘাতহীন নিস্তরঙ্গ জীবন বেছে নেওয়ায় তাঁর চৈতন্য ও বোধের জগত্ থেকে আগের সেই দীপ্তি ও সজীবতা ঝরে পড়েছিল। মুনির চৌধুরী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মুনীর স্যারের পড়ানো ছিল অনবদ্য। তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়িয়েছিলেন। পড়ানোর প্রাণবন্ত সরস উচ্ছলতার ভেতর দিয়ে ছোটগল্পের যে নিগূঢ় রস তিনি আমার ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা আজও আমার মনের ভেতরকার শিল্পভাবনাকে অনেকখানি প্রভাবিত করে রেখেছে। কিন্তু যে জায়গায় তিনি তাঁর যুগের সবাইকে অতিক্রম করেছিলেন সেটা হচ্ছে বক্তৃতা। তাঁর শ্রেষ্ঠ সাফল্য এসেছিল এখানেই। তরুণ বয়সে ‘কবর’ বা ‘মানুষ’ এর মতো নাটক বা রাজনীতির জ্বলজ্বলে সাফল্যের পর আর একবার তাঁর সাফল্য ঝিকিয়ে উঠেছিল এই জায়গায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ থেকে শুরু করে অন্তত দুই বছর পর্যন্ত তাঁর বাচনভঙ্গী আমার নিজের কথা বলার ধরন ধারণকেও প্রচ্ছন্নভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল।’ নানা বিষয় নিয়ে মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর উষ্ণ ও আন্তরঙ্গ আলোচনা হত। তাঁর শ্রদ্ধেয় মুনীর স্যারের যে গুণ আজও তাঁকে প্রভাবিত করে রেখেছে তা হচ্ছে তাঁর অপরিসীম উদারতা ও সহৃদয়তা। তিনি আরো বলেন, ‘অসামান্য প্রতিভার অধিকারী মুনীর স্যারের কাছ থেকে আমরা যতটা পেতে পারতাম তাঁর অনেক কিছুই হয়ত আমরা পাইনি আর সেই দুঃখ আজও আমি ভুলতে পারিনা। কিন্তু তাঁর অনবদ্য শিক্ষকতা, বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, অসাধারণ বক্তৃতা প্রতিভা, সুবিপুল মমত্ব, মানবিক দুর্বলতা, ক্ষমা করার অসীম ক্ষমতা, অপরিমেয় গুণগ্রাহিতা ও নাট্যামোদী সদা আনন্দিত হৃদয় এবং জীবনের প্রতিটি বিষয়ে প্রজ্জ্বলিত নিদ্রাহীন উত্সাহ আমার মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি আমাকে যতটা প্রভাবিত করেছিলেন, আর কেউ হয়ত ততটা করেননি।’
‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্যারকে শিক্ষক হিসাবে আমরা পাইনি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ছাত্র না হলেও আমরা সেকালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা মনোজগতে সবাই ছিলাম তাঁর ছাত্র।’ এভাবেই আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সেই সময় বিভিন্ন বিভাগের কর্ণধার হিসাবে অধিষ্ঠিত থেকে নিজ নিজ বিভাগের মর্যাদাকে লোকশ্রুত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও ছিলেন বাংলা বিভাগের এমনি এক অধ্যাপক। তাঁর একটি কথা এখনো আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, আমরা যে প্রতিদিন ছয় ঘন্টা ঘুমাই, জীবনের প্রেক্ষাপটে এই কথাটার মানে কী? মানে, প্রতিটা দিনের চার ভাগের একভাগ আমাদের জীবন থেকে বাদ পড়ে গেল। তাঁকে দু’একবারের দেখার সুযোগে তাঁর মধ্যে ব্যক্তিত্বের অনেকগুলো বড়দিকের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ হয়েছিল। ড. শহীদুল্লাহ ছিলেন আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত। তাঁর মেধা ক্ষুরধার, অসাধারণ ছিলনা। সাধনা ও শ্রমে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি সতেরটি ভাষা জানতেন। তাঁর কথা শোনার সবচেয়ে লাভজনক ছিল যে গড়পড়তা তিন-চার মিনিট পর পরই এমন একেকটা অসাধারণ ও বিস্ময়কর তথ্য তিনি আমাদের শোনাতেন যা আমাদের অবাক করত।’
বাংলা বিভাগের একজন অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর তরুণ চেতনাকে প্রায় পুরোপুরি অধিকার করে নিয়েছিলেন, তিনি অধ্যাপক আহমদ শরীফ। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষপর্যন্ত যাদেরকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে প্রগতিশীলতা ও বামপন্থী চিন্তাচেতনা দানা বেঁধেছিল, তিনি তাঁদের একজন। অধ্যাপক আহমদ শরীফ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জীবন, পৃথিবী, প্রেম, সমাজ সবকিছু সম্বন্ধে ক্লাশে তিনি এমন নির্মোহ কঠিন ও নেতিবাচক কথা বলতেন যা আমাকে আকৃষ্ট ও আতঙ্কিত করে তুলত। আমি তাঁর বাসায় নিয়মিত যেতাম এবং ভেতরকার উত্কন্ঠার হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁর সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক করতাম। তাঁর মধ্যে একটা প্রচন্ড নেতিবাচক মনোভাব কাজ করত। তাঁর নেতিবাচকতার কাছে আমি ঋণী। কোনো বিষয়ের দিকে ক্ষমাহীন নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকাবার এবং তার অন্তর্সত্যকে দুঃসাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করার শক্তি আমি তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম।’
তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, দর্শন বিভাগের প্রধান ও জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. হাসান জামান প্রমূখ স্বনামধন্য শিক্ষকদের সাহচর্যে আসার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। স্ব স্ব ক্ষেত্রে মহিমায় ভাস্কর এসব গুণীজনদের সাহচর্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদের জীবনকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে। এই সব মহান শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তিনি এই মহিমান্বিত পেশায় প্রবেশ করেছেন।
শিক্ষক জীবন
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৬১ সালে প্রথম শিক্ষকতায় যোগদান করেন মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে। তখন তাঁর বয়স ছিল বাইশ। এম.এ. পরীক্ষা দেবার পরপরই তিনি ঐ কলেজে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু মজার ব্যাপার হলো একই সময়ে মুন্সীগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁর বাবা আযীমউদ্দীন আহমদ। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার হিসাবে তিনি সেকালে দেশের সুধীমহলে সুপরিচিত ছিলেন। ছেলে একই কলেজে যোগ দিলে তাঁর জন্য প্রশাসনিক অস্বস্তির কারণ হবে মনে করে তিনি কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সভায় আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদকে অন্তর্ভূক্তি করার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল ভাল থাকায় কলেজের গভর্নিং বডির সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে কলেজের খন্ডকালীন প্রভাষক হিসাবে তাঁকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। গভর্নিং বডির সচিব হিসাবে তাঁর বাবাকেই তাঁর নিয়োগপত্র পাঠাতে হয়েছিল। সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি জমে উঠেছিল কলেজে তাঁর যোগদানের প্রথম দিনটিতে।
সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি এভাবে, ‘প্রথম ক্লাশে ছাত্রদের সঙ্গে নতুন শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব অধ্যক্ষই পালন করতেন এটাই ছিল নিয়ম। আমার ব্যাপারেও আব্বাকেও তাই করতে হলো। রুটিন মাফিক আব্বার পেছনে পেছনে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর একটি শাখায় গিয়ে হাজির হলাম। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তাঁর সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষণে আব্বা আমার একটা ছোটখাট পরিচয় তুলে ধরে সব শেষে বললেন, যেহেতু ওর শরীরে শিক্ষকের রক্ত আছে আমার মনে হয় ও ভাল শিক্ষকই হবে। আমার ধারণা ছিল, আমার নিয়োগের দ্বন্দ্বে পরাজয়ের ফলে উনি ভেতরে ভেতরে কিছুটা তেতে আছেন। হয়ত তাঁর সেদিনের বক্তব্যে সেই ক্রোধের কিছু প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু ঘটনা হলো ঠিক উল্টো। বক্তৃতার সময় আব্বার গলা কিছুটা ধরেই এল। মনে হল তাঁর উত্তরসূরির আসনে নিজ হাতে আমাকে বসিয়ে যেতে পেরে তিনি যেন ভেতরে ভেতরে গর্বিত এবং পরিতৃপ্ত।’
কলেজে যোগ দেয়ার পর তাঁকে পড়াতে দেয়া হয়েছিল ব্যাকরণ কিন্তু ব্যাকরণ ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বিরক্তির বিষয়। রুটিন দেখে তিনি একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু ব্যাকরণ পড়াতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি এক আশ্চর্য আনন্দ জগতের সন্ধান পান। তাঁর ভাষায়, ‘শতাব্দী শতাব্দী ধরে হাজার কোটি মানুষের সজীব চিত্তের দীপ্তি আর আলো দিয়ে তৈরি আমাদের যে ভাষা, ব্যাকরণতো সেই ভাষারই বর্ণনা। জীবনের প্রতিমুহূর্তের আবেগ, প্রেম, যন্ত্রণা, বিস্ময় উত্সাহ আর খুশিতে প্রাণ পেয়ে জনমানুষের মুখে মুখে রচিত উচ্চারিত বিচ্ছুরিত আমাদের অনিন্দ্যসুন্দর যে ভাষা, হীরের টুকরোর মত দীপ্ত অজস্র শব্দের প্রতিমুহূর্তের উত্প্রাণতায় যা উজ্জ্বল আর নৃত্যশীল, ব্যাকরণ তো সেই বৈভবেরই সজীব বিবরণ। ভাষার প্রাণোজ্জ্বলতার এই দীপ্র রহস্য যতই অনুভব করতে লাগলাম ততই অবাক হতে লাগলাম। আমার হৃদয়ের সেই জেগে ওঠা বিস্ময় এবং জীবনের প্রথম ছাত্রছাত্রীদের চোখের সামনে সেই অপার ঐশ্বর্য মেলে ধরার আনন্দেই আমার মুন্সীগঞ্জ কলেজের দিনগুলো একধরণের অলীক খুশির ভেতর দিয়ে পার হয়ে গেছে।’
এরপর তিনি সিলেট মহিলা কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন সেই সময় মহিলা কলেজে ঢোকা তরুণ অধ্যাপকের জন্য সহজ ছিল না। কারণ তখন সিলেটের সমাজ খুবই রক্ষণশীল ছিল। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় তাঁর চাকরিটা তখন হয়ে যায়। তবে এখানে তিনি বেশিদিন ছিলেন না। চাকরি পাওয়ার মাস দুয়েক পরই বাম ছাত্র আন্দোলনের মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়। সিলেটে অবস্থানকালে সেখানকার, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই সেখানে ছিল কঠোর ধার্মিক ও রক্ষণশীল কিন্তু তাঁরা সাম্প্রদায়িক ছিল না।
এরপর তিনি যোগ দেন রাজশাহী কলেজে। রাজশাহী কলেজে নিয়মনিষ্ঠ শিক্ষার একটা সুশৃঙ্খল পরিবেশ ছিল। অন্য দশটা সরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের মত কলেজের অধ্যাপক প্রভাষকদের কলেজে আসতে হত সকাল দশটায় আর যেতে হতো ঘড়ি ধরে বিকাল পাঁচটায়। এই সময়ের মধ্যে অধ্যাপনার যাবতীয় কাজ কলেজের ভেতর করতে হতো। তিনি এই কলেজে পাঁচ মাসের মত অধ্যাপনা করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলের অবিভক্ত বাংলার অন্যতম সেরা সরকারি কলেজ ছিল এই রাজশাহী কলেজ। একই সময়ে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ওই কলেজের শিক্ষক ছিলেন। পাবনা জেলা স্কুল থেকে তিন বছরের ব্যবধানে অধ্যাপক আবু সায়ীদ ও আবু হেনা মুস্তফা কামাল ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। আবু হেনার চিত্তাকর্ষক বক্তৃতার বহুল আলোচিত গুণগুলো উপভোগ ও আয়ত্তে আনার জন্য অধ্যাপক সায়ীদ মাঝে মাঝে অনার্সের ছাত্রদের সঙ্গে বসে তাঁর ক্লাশ করতেন। রাজশাহী কলেজের অত্যন্ত উচুমানের লাইব্রেরী তাঁকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল এবং সেখানে কলেজের শিক্ষকরা দল বেঁধে বসে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। এই প্রসঙ্গে আবু সায়ীদ বলেন, ‘রাজশাহী কলেজ ছেড়ে আসার পর কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের এভাবে পড়তে আমি আর কোথাও দেখিনি।’
রাজশাহী কলেজে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি যোগ দেন ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে। বর্তমানে এই কলেজটি বিজ্ঞান কলেজ নামে পরিচিত। একই সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগেও তিনি খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে বাংলা পড়িয়েছেন। ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা করার সময় বছর দুয়েক তিনি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র চব্বিশ বছর। সেই সময়ে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। মাত্র দুই নম্বর কম থাকায় বিরাট বিত্তশালী এক ব্যক্তির ছেলেকে কলেজে ভর্তি করা যায়নি। ছেলেকে ভর্তি করানোর জন্য তিনি শিক্ষা মন্ত্রীকে দিয়ে পর্যন্ত সুপারিশ করান। কিন্তু অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ সেই অনুরোধ রাখতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ভদ্রলোক রেগে গিয়ে তাঁকে বলেন, ‘আপনার মতো একশোটা মাষ্টারকে আমি কিনতে পারি।’ উত্তরে অধ্যাপক আবু সায়ীদ বলেন, ‘আপনার মত একশোটা অশিক্ষিতকে আমি লেখাপড়া শেখাতে পারি। যে ছাত্র একবার জানতে পারে তার শিক্ষকেরা তার বাবার টাকায় কেনা, সে কখোনো মানুষ হয়না। ওর লেখাপড়া হওয়ার কোনো কারণ নেই।’ শিক্ষকতার অহংকার যে কত বড় তাঁর এই উক্তি থেকেই সে কথাটি বোঝা যায়।
এর পর তিনি চলে আসেন ঢাকা কলেজে। তখনও সেরা কলেজ হিসাবে ঢাকা কলেজের খ্যাতি ছিল দেশজোড়া। ঢাকা কলেজে যোগ দেয়ার পেছনে কলেজের তখনকার প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিন আহমেদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। জালালউদ্দীন আহমেদ ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে গিয়ে তাঁকে ঢাকা কলেজে যোগ দেবার আহ্বান জানান। কলেজকে সবদিক দিয়ে ভালো করে তোলার জন্য একজন অধ্যক্ষ হিসাবে জালালউদ্দিন আহমেদ যে কতটা সচেতন ছিলেন তারই প্রমাণ ঢাকা কলেজে, তিনি অধ্যাপনা করেছেন সুদীর্ঘ তিরিশ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন ছাত্রদের মাঝে। অধ্যাপক আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শত্তকত ওসমান।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ব্যক্তিত্বের প্রায় সবগুলো দিক সমন্বিত হয়েছে তাঁর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক সত্তায়। তিনি অনুভব করেছেন যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত মানুষ। ‘আলোকিত মানুষ চাই’- সারা দেশে এই আন্দোলনের অগ্রযাত্রী হিসেবে প্রায় তিন দশক ধরে তিনি রয়েছেন সংগ্রামশীল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে একটু একটু করে, অনেক দিনে। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে নানা উথ্থান পতনের মধ্যদিয়ে তাঁকে এগোতে হয়েছে।
১৯৭৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্ম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, এই চিন্তাটি প্রথম আমার মনে জাগে ১৯৬৮ সালের দিকে। তখনই কিছু মেধাবী এবং প্রতিভাবান তরুণকে নিয়ে আমি একটি ঋদ্ধিধর্মী চক্র গড়ে তোলার চেষ্টা করি। কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাতে ছেদ পড়ে। তারপর স্বাধীনতা আসে। আমাদের সামনে এক বিপুল সম্ভাবনার জগৎ উন্মেচিত হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এক সার্বিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে সেই স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যেতে শুরু করে। কাজেই আবার নতুন করে আমাদের এ বিষয়ে চিন্তা শুরু করতে হয়। জাতীয় দুঃখের অর্থপূর্ণ আবাসন এবং সত্যিকার জাতীয় উন্নতি ক্ষুদ্র মানুষ দিয়ে সম্ভব নয়, এর জন্য চাই বড় মানুষ, আলোকিত মানুষ। এই ভাবনা থেকে আবার ১৯৭৮ সালে আমরা সমবেত হলাম সেই পরিপূর্ণ মানুষ গড়ে-তোলার চেষ্টায়- সেইসব মানুষদের, যারা একদিন তাদের যোগ্যতা এবং শক্তি দিয়ে, প্রায়স এবং আত্মদান দিয়ে এই জাতির নিয়তি পরিবর্তন করতে চেষ্টা করবে।
সব সমাজেই এমন কিছু মানুষ থাকেন সংখ্যায় যাঁরা অল্প; কিন্তু যাঁদের মধ্যে জ্ঞানের ব্যাপ্তি, মূল্যবোধের বিকাশ, জীবনের উৎকর্ষ, আত্মমর্যাদার মহিমা- এসবের বড়রকম বিকাশ ঘটে। এঁরা সেই ধরনের মানুষ যাঁদের কেনা যায় না, বেচা যায় না, সমাজের তরল স্রোত যাঁদের চারপাশ দিয়ে নিরন্তর প্রবাহিত হয়ে চলে; কিন্তু যাঁরা এর মাঝখানে থেকেও প্রবুদ্ধ বৃক্ষের মতো একটা জাতির ভারসাম্য সুস্থিত করে রাখেন। এঁরা তাঁরা – যাঁরা একটা জাতিকে রক্ষা করেন, এগিয়ে নেন, জাতিকে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখান। এক কথার বড়মানুষ বলতে যা বুঝি এঁরা হলেন তাঁরাই। যে কোনো উন্নত জাতির মধ্যে যত স্বল্প সংখ্যাতেই হোক, আমরা এই মানুষদের সন্ধান পাই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের জাতির মধ্যে এইসব সমৃদ্ধ মানুষের ঐতিহ্য এখনো গড়ে এঠেনি। আর গড়ে-ওঠার যা-ও বা কিছু সম্ভাবনা ছিল তা-ও এখন কঠিন হয়ে উঠছে।
ইতোমধ্যে শিক্ষাব্যবস্থার নিদারুণ অধঃপতন ঘটেছে, কাজেই আমাদের গতানুগতিকে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর থেকে এই মানুষদের জন্ম ঘটবে এমন আশা কঠিন। আমাদের পরিবারগুলো উৎকর্ষপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনো গড়ে ওঠেনি। আমাদের সমাজে সেই পরিবার কোথায় যেখান থেকে এই বড়মানুষেরা জন্মগ্রহণ করবেন%