১৯৫৪ সালের এক শীতের সকাল। ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ ১৮ বছরের এক যুবক। পরনে তাঁর খদ্দরের জামা ও পাজামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল আর বগলের নিচে ভাঙা টিনের একটা সুটকেস, যার গায়ে গোলাপ ফুল আঁকা। এক ঝলক তাকালেই বুঝা যায় নিতান্তই মফস্বলের এক যুবক কোন এক দুর্বিপাকের তাড়া খেয়ে এখানে এসে উঠেছে। তাঁর মুখের রেখায় ফুটে উঠেছে শ্রান্তির চিহ্ন কিন্তু চোখ জোড়া সাক্ষ্য দিচ্ছে যুবকের পেছনে কোন সেনাবাহিনী থাকলে তাঁর নির্ভীক দৃষ্টিই ঘোষণা করত বিজয় বার্তা।
তখন ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের উত্তুঙ্গ সময়। এ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলো আপামর বাংলা ভাষাভাষী বিশেষ করে বাংলার শিক্ষিত শ্রেণি। তবে ছাত্ররাই ছিলো এ আন্দোলনের পুরোধা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে যাঁরা জড়িয়ে পড়েছে, পাকিস্তান সরকারের পুলিশ তাঁদেরকে দমিয়ে রাখবার চেষ্টা করছে, বিভিন্নভাবে মামলা দিয়ে তাঁদেরকে হয়রানি করার চেষ্টা করছে। যুবক তাঁদেরই একজন। যুবকের অপরাধ তিনি একজন কবি এবং ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের ঢেউ মফস্বল শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আছড়ে পড়লে যুবক এতে নিজেকে জড়িয়ে নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও গঠিত হয়েছিলো ভাষা কমিটি এবং ভাষা কমিটির একটি লিফলেটে তাঁর চার লাইন কবিতা উদ্ধৃত করা হয়। আর সেই অপরাধে মীর আব্দুশ শাকুর আল মাহমুদের ফেরার হয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় ঢাকায় আগমন এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি।
ঢাকায় এসে আল মাহমুদ তাঁর এক পূর্ব পরিচিত’র মাধ্যমে পরিচিত হন রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের সাথে। তারও পূর্বে ঢাকা এবং কলকাতার পত্র পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি কবিতা প্রকাশ হলে তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। আল মাহমুদের যখন জীবিকার প্রয়োজনে একটি চাকুরি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে দাদাভাই তখন আল মাহমুদকে ১৯৫৪ সালে দৈনিক মিল্লাত’র প্রুফ সেকশনে প্রুফ রিডারের চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তীতে তিনি নিজের চেষ্টায় ‘সাপ্তাহিক কাফেলা’-য় সহসম্পাদক পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে মফস্বল বিভাগে বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পর আসে ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের জন্ম যন্ত্রণার বছর। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক গণকন্ঠ’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন। ‘৭১-র পরবর্তী বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ, সর্বহারা আন্দোলন ও রক্ষীবাহিনী ইত্যাকার পরিস্থিতিতে দেশ যখন বিপর্যস্ত তখন ‘গণকন্ঠ’-এর নিঃশঙ্ক সাংবাদিকতা এ দেশের পাঠক সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়। বিশেষ করে আল মাহমুদের সংবাদ প্রকাশের স্টাইল ও সাহসী সম্পাদকীয় দেশবাসীর হৃদয় স্পর্শ করে। বিপরীত দিকে পত্রিকাটি পরিণত হয় শাসক গোষ্ঠীর চক্ষুশূলে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালে তিনি কারাবরণ করেন। তাঁর আটকাবস্থায় সরকার দৈনিকটিও বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৫ এ তিনি মুক্তি পান। তাঁর কবি খ্যাতি ততদিনে পৌঁছে গিয়েছিলো রাষ্ট্রপতির বাসভবন পর্যন্ত। কারামুক্তির পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ডেকে শিল্পকলা একাডেমীর প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। ১৯৯৩ সালে তিনি ওই বিভাগের পরিচালকরূপে অবসর নেন। চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে তিনি আবার ফিরে যান সাংবাদিকতা পেশায়। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক কর্ণফুলি’-র সম্পাদক হিসেবে বেশ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। বার্ধক্যে উপনীত কবি বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন।
আল মাহমুদ জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই এক বর্ষণমুখর রাতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মৌড়াইল গ্রামের মাতুলালয় মোল্লা বাড়িতে। আল মাহমুদের পূর্বপুরুষগণ ১৫০০ খৃষ্টাব্দের দিকে একটি ইসলাম প্রচারক দলের সাথে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাইতলায় আসেন। বৃটিশ আমলে কাইতলার মীরবাড়ির মীর মুনশী নোয়াব আলী পরিবারের অসম্মতিতে পিতৃপুরুষের প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতি ও খানকার বাইরে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন এবং পড়াশোনা শেষ করে স্থানীয় আদালতে একটি চাকুরী গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর তাঁর কর্মস্থল অর্থাত্ এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রয়োজন হওয়ায় মীর মুনশী নোয়াব আলী স্থানীয় ধনী ব্যবসায়ী মাক্কু মোল্লার এক কন্যাকে বিয়ে করেন। যদিও এই বিয়ে প্রাচীন পিতৃপরিবারের সাথে তাঁর বিচ্ছিন্নতাকে চিরস্থায়ী করে দেয়। মাত্র পঁচিশ তিরিশ মাইলের ব্যবধানে থেকেও তিনি কাইতলার মীর বাড়ির সাথে, তাঁর পিতৃপুরুষদের সাথে আর সম্পর্ক রাখতে পারেননি। মুনশী নোয়াব আলী তার পিতার মৃত্যুশয্যায় পিতাকে শেষবারের মত দেখতে কাইতলার মীরবাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু অবাধ্য সন্তানের উপর নারাজ পিতা মীর আব্দুল গনি ইংরেজি শিক্ষিত পুত্রের হাতে এক চামচ পানিও গ্রহণে অসম্মতি জানিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মুনশী নোয়াব আলী আর কাইতলায় ফিরে যাননি। স্ত্রী, পুত্র নিয়ে শ্বশুর বাড়িতেই অবস্থান করেন। আর দয়ালু শ্বশুর, কন্যা এবং জামাতাকে তাঁর অন্যান্য পুত্রদের সমান মর্যাদা এবং তাঁর বিপুল সম্পত্তির অংশ দিয়ে মোল্লাবাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেন। এই হলো আল মাহমুদের প্রপিতামহ মুনশী নোয়াব আলীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল মোল্লাবাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইতিহাস।
পিতা আব্দুর রব মীরের ছিল কাপড়ের ব্যবসা। পরবর্তীতে বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিসের অফিসার। মা রৌশন আরা বেগম ছিলেন গৃহিনী। একদিকে ধর্মীয় চেতনার কারণে ইংরেজি ভাষার প্রতি বিদ্বেষ অন্যদিকে পারিবারিক ঐতিহ্যের আলোকে কবিতার প্রতি অসাধারণ অনুরাগ- এমনি এক দ্বন্দ্বমুখর পরিবেশে আল মাহমুদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আল মাহমুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি তাঁর ছেলেবেলার গৃহশিক্ষক শফিউদ্দিন আহমদের হাতে। প্রকৃত অর্থে এই শফিউদ্দিন আহমদই তাঁকে নিয়ে যান পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অনাস্বাদিত এক গ্রন্থভূবনে। সেই খুব ছোটবেলায় যখন তিনি স্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি, এমনকি ঠিকমতো পড়তেও পারেন না, বানান করে করে সবেমাত্র পড়তে শিখছেন, তখনই শফিউদ্দিন আহমদ তাঁকে রাত জেগে জেগে পড়ে শোনাতেন ঠাকুরমার ঝুলি। আর আল মাহমুদ ছোটবেলাতেই আস্তে আস্তে উপলব্ধি করেন বাল্যশিক্ষার জঞ্জালের বাইরেও বইয়ের একটি বিশাল জগত্ রয়েছে। এই উপলব্ধিই পরবর্তীতে তাঁকে বানিয়েছে কবি, ভাবুক, পাখির মতো বন্য৷ ফলে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই শিখে ফেলেছিলেন স্কুল পালানো। স্কুল পালিয়ে লোকনাথ পার্কের বিশাল কড়ই গাছের নিচে শুয়ে শুয়ে দেখতেন পাখিদের খুনসুটি, নীলিমার নীল, বৃষ্টির পতন। জর্জ হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর অবশ্য তাঁর স্কুল পালিয়ে সময় কাটানোর জায়গা পরিবর্তন হয়ে যায়। একদিন তাঁর পাঠতৃষ্ণা তাঁকে পায়ে পায়ে নিয়ে যায় লালমোহন পাঠাগারে। এর পেছনেও রয়েছে এক মজাদার ঘটনা। আল মাহমুদের বাড়িটি ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন লাগোয়া। স্টেশনে গভীর রাত অব্দি ট্রেন চলাচল করত। আর বালক আল মাহমুদ বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলায় কী এক আকর্ষণে পায়ে পায়ে চলে আসত স্টেশনে।
রাতের স্টেশনের চাঞ্চল্য, বিচিত্র সব মানুষের আনাগোনা তাঁর মনে এক ধরণের রোমাঞ্চের সঞ্চার করত। স্টেশনের চায়ের দোকানে বসে বড়দের মত গম্ভীর ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিতেন। একদিন এক ঝড়বৃষ্টির রাতে স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন দু’জন মহিলা। মহিলাদের বেশভূষা আর আচরণ আভিজাত্যের স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। কিন্তু তাঁদের চোখেমুখে এক ধরণের উত্কন্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁদের গন্তব্য স্টেশন থেকে অনেক দূরে এবং সেখানে যাওয়ার জন্য কোন উপযুক্ত বাহনও মিলছে না। এখন তাঁরা যাবে কোথায়? এমত উদ্বেগ উত্কন্ঠার সময় আল মাহমুদ কিছু না বুঝেই তাঁদেরকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। এই সহোদর দুই মহিলা প্রকৃতপক্ষে ছিলেন তখনকার নিষিদ্ধ ঘোষিত কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। তাঁদেরকে থাকতে দেয়া হয়েছিলো আল মাহমুদের শোবার ঘরে। আল মাহমুদের ঘরের তাকে রক্ষিত ছিলো ছোটদের অনেক বই। তাঁর বইয়ের প্রতি এই আকাঙ্ক্ষা দেখে সহোদরার ছোট বোন শুভা আল মাহমুদকে লালমোহন পাঠাগারের খোঁজ দেন। এই পাঠাগারটি আল মাহমুদের জীবনের সত্যিকার শিক্ষা, গবেষণা ও অনুসন্ধিত্সা স্বভাব এবং রুচি নির্মাণে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিলো। লালমোহন পাঠাগারটি ছিলো মূলত তখনকার নিষিদ্ধ ঘোষিত কম্যুনিস্ট পার্টির একটি পাঠকেন্দ্র। শহরের প্রগতিশীল চিন্তাধারার লোকেরা এই পাঠাগারে এসে ভাব বিনিময় করত। আবার মার্কসবাদী আন্দোলনও পরিচালিত হত এখান থেকেই। এই পাঠাগারেই আল মাহমুদ কিশোর বয়সেই পড়েন ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, ইতিহাসের ধারা ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ বিষয়ক বইগুলি। এই লাইব্রেরিই আল মাহমুদকে সচেতনভাবে রাজনীতি তথা মার্কসবাদের দিকে নিয়ে যায়। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা রক্ষায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে ভাষা কমিটি গঠিত হয়েছিল সেই কমিটির অনেকেই ছিলেন লালমোহন পাঠাগারের সদস্য। আর সেই সূত্র ধরেই ভাষা কমিটির লিফলেটে তাঁর চার লাইন কবিতা উদ্ধৃত হয়েছিল।
তিরিশোত্তর বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা আগমনের পূর্বেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো কলকাতার ‘সাহিত্য’, ‘চতুষ্কোণ’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ময়ুখ ও কৃত্তিবাসে’। সেই সুবাদে ঢাকা ও কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে। কবি আল মাহমুদের কবি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে একটি চিঠি। কলকাতার রাসবিহারী এভিন্যুর কবিতাভবনের স্মৃতিচিহ্ন আঁকা সাদা পোস্টকার্ডটির প্রেরক ছিলেন ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক কবি বুদ্ধদেব বসু। ‘কবিতা’ পত্রিকার জন্য আল মাহমুদ তিনটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন তারই প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব এভাবে- “প্রীতিভাজনেষু, তোমার একটি বা দু’টি কবিতা ছাপা যাবে বলে মনে হচ্ছে।” একটি মাত্র বাক্য। কিন্তু ১৯৫৫ সালে বাংলাভাষার একজন নবীন কবির জন্য এটি ছিলো অসাধারণ প্রেরণা ও স্বীকৃতির বিষয়। যেন এক দৈববাণী। পরবর্তীতে চৈত্র সংখ্যায় আল মাহমুদের তিনটি কবিতাই ছাপা হয়েছিলো। একই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিলো শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, ওমর আলী, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ, পঞ্চাশের শক্তিমান কবিদের কবিতা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি আল মাহমুদকে।
বাংলা কবিতার ভাঁড়ারে আল মাহমুদ একের পর এক যুক্ত করে গেছেন, যাচ্ছেন অজস্র সোনালি শস্য, সাফল্যের পালক। আধুনিক বাংলা কবিতায় তিনি তিরিশ দশকীয় প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীন দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবন চাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে আল মাহমুদ কাব্যরসিকদের মধ্যে নতুন পুলক সৃষ্টি করেন। সমালোচকগণ তাঁকে জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রধারার এক নতুন কবিপ্রতিভা বলে উল্লেখ করতে থাকেন। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ এবং ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্য ‘কালের কলস’। এ দু’টি কাব্যের ভেতর দিয়ে আল মাহমুদ নিজেকে প্রকাশ করেন সম্পূর্ণ মৌলিক ও নিজস্ব ঘরানার কবি হিসেবে। তাঁর কবি জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে- তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’-এর প্রকাশ।
এদেশের প্রকাশকরা সেই সময় তরুণ কবিদের কবিতার বই প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তখন কয়েকজন তরুণ কবি ও সাংবাদিক নিজেদের পকেট থেকে চাঁদা দিয়ে ‘কপোতাক্ষ’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গঠন করে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশ করেছিলেন। এটি ছিল একজন কবির জীবনে অনেক বড় প্রাপ্তি। তাঁর তৃতীয় কাব্য ‘সোনালী কাবিন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। সমগ্র বাংলা কবিতার ইতিহাসে ‘সোনালী কাবিন’ একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যে আল মাহমুদ লোকজ ও আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে উদ্ভাবন করেন এক ধরণের শব্দ জাদুময়তার। ‘আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?/ গলায় গৃঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,/ কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল/ নিয়ে এসো চন্দ্রালোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।/ ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনবো না/ নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে? এই শব্দ জাদুময়তার ভেতর দিয়ে আল মাহমুদ তাঁর পাঠকদেরকে চমকিত করে যাচ্ছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ‘সোনালী কাবিন’ আল মাহমুদকে এনে দিয়েছে তুমুল কবি খ্যাতি।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে পৃথিবীর সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর হৃদয়ে এই কাব্যটি সোনালি হরফে খোদাই করা আছে। তাঁর কবি জীবনের সফল উত্তোরণও এই কাব্য দিয়ে। এরপর আল মাহমুদের কবিতা একটি ভিন্ন বাঁক নেয় ‘মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো’-র ভেতর দিয়ে। মূলত আল মাহমুদের আদর্শগত চেতনারও পরিবর্তন হয় এসময়। ‘মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো’-তে তিনি মোহামেডানিজম বা ইসলামের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই কাব্যে। পরবর্তীতে ‘প্রহরান্তের পাশ ফেরা’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ প্রভৃতি কাব্যেও তিনি এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘দ্বিতীয় ভাঙন’। এই কাব্যে কবি আরো একবার নিজেকে পরিবর্তন করেছেন, ভেঙেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা বিশের অধিক।
কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যে আল মাহমুদের আবির্ভাব এ দেশের গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। অবশ্য তাঁর সাহিত্য জীবন শুরুই হয়েছিলো গল্প দিয়ে৷ ১৯৫৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। তারপর দীর্ঘদিন গল্প লেখায় বিরতি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তীকালে দৈনিক ‘গণকন্ঠ’ সম্পাদনার সময় তিনি বেশ কিছু গল্প লিখেছিলেন। গল্পগুলো প্রকাশিত হলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নেন তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ কবিই নন, অন্যতম গল্পকারও। এ সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘কালোনৌকা’, ‘জলবেশ্যা’ প্রভৃতি গল্পগুলি প্রকাশ পায়। ১৯৭৫-এ তাঁর প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয় এবং বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। আল মাহমুদ গল্প লিখেছেন ধীরে সুস্থে। খ্যাতি ও প্রশংসা গল্প রচনার ক্ষেত্রে তাঁকে টলাতে পারেনি। তিনি এ পর্যন্ত যে কয়টি গল্প লিখেছেন সবই পরিকল্পিত ও সুচিন্তিত৷ গল্প হিসেবে সার্থকও বটে। ‘পানকৌড়ির রক্ত’-র পর তিনি ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’, ‘গন্ধবণিক’, ‘ময়ূরীর মুখ’ সহ প্রায় দশটি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন। শুধু গল্প নয়, তিনি আমাদেরকে বেশ কিছু উপন্যাসও উপহার দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা তাঁর উপন্যাস ‘কাবিলের বোন ও উপমহাদেশ’ উপন্যাস দু’টি বাংলা উপন্যাস সাহিত্যকে শুধু ঋদ্ধই করেনি সংযোজনও করেছে ভিন্নমাত্রা। এছাড়া আল মাহমুদ তাঁর উপন্যাসের ভেতর দিয়ে ফ্রয়েডিয় যৌন চেতনাকে দিয়েছেন শিল্পরূপ। আল মাহমুদের উপন্যাসের সংখ্যাও বিশের অধিক
কবিতার ডালপালায় চড়ে বেড়াতে ভালোবাসেন আল মাহমুদ। কবিতার শব্দরাজি আহরণের জন্য তিনি ডুব সাঁতার দিয়েছেন বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোতে। শব্দের সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছেন লোক থেকে লোকান্তরে। তেমনি অন্য ভাষার রূপ রস গন্ধ নিতে উড়োজাহাজের বিস্তৃত ডানায় ভর করে উড়ে বেড়িয়েছেন ফ্রান্সের ভার্সাই, প্যারিস, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেস্টার, গ্লাসগো, বেডফোর্ড, ওল্ডহাম, ইরানের তেহরান, ইস্পাহান, মাশহাদ, আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবি, শারজাহ, বনিয়াস, সৌদি আরবের মক্কা, মদিনা, জেদ্দা ভারতসহ আরো নাম না জানা কত কত ক্ষুদ্র নগর জনপদ। এই ভ্রমণ, অর্জন, মনন, অভিজ্ঞতা, এইসবের সমন্বয়ে আল মাহমুদ বাংলা কবিতাকে পূর্ণ করে তুলেছেন কানায় কানায়।
১৯৫৪ সালে যে যুবকটি রাবারের স্যান্ডেল পায়ে ঢাকায় পদার্পণ করেছিলেন কেবল কবিতাকে অবলম্বন করে, সে আজ বার্ধক্যে নুয়ে পড়া এক জ্ঞানবৃদ্ধ। জীবনের কত কিছুকে তিনি পেছনে ফেলে এসেছেন, কত কিছু তাঁকে ফেলে রেখে চলে গেছে। কিন্তু কবিতাকে তিনি যেমন ফেলে দেননি তেমনি কবিতাও তাঁকে ফেলে দেয়নি। আল মাহমুদ আর কবিতা একই সংসারে বাস করছেন আজ পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময় ধরে। আর সেই সংসারে আরও আছেন কবির স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা বেগম৷ কবি দম্পতির পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা৷
এক নজরে আল মাহমুদ
জন্ম : ১১ জুলাই, ১৯৩৬, মোল্লাবাড়ি, মৌড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া৷
পিতা : আব্দুর রব মীর৷
মা : রৌশন আরা বেগম৷
স্ত্রী : সৈয়দা নাদিরা বেগম৷
পুত্রকন্যা : পাঁচ পুত্র, তিন কন্যা৷
পেশা : অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী৷
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ :
কবিতা : লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, প্রহরান্তরের পাশ ফেরা, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, মিথ্যেবাদী রাখাল, আমি দূরগামী, বখতিয়ারের ঘোড়া, দ্বিতীয় ভাঙন, নদীর ভেতরে নদী, উড়াল কাব্য, বিরামপুরের যাত্রী, না কোন শূন্যতা মানি না প্রভৃতি৷
ছোটগল্প : পান কৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধবনিক, ময়ূরীর মুখ প্রভৃতি৷
উপন্যাস : কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, পুরুষ সুন্দর, চেহারার চতুরঙ্গ, আগুনের মেয়ে, নিশিন্দা নারী প্রভৃতি৷
শিশুতোষ : পাখির কাছে ফুলের কাছে৷
প্রবন্ধ : কবির আত্মবিশ্বাস, কবির সৃজন বেদন., আল মাহমুদের প্রবন্ধ সমগ্র৷
ভ্রমণ : কবিতার জন্য বহুদূর, কবিতার জন্য সাত সমুদ্র প্রভৃতি৷
এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে আল মাহমুদ রচনাবলী৷পুরস্কার :
বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরষ্কার (১৯৭৪), সুফী মোতাহের হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৭৬), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭),নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক- ২০০৪ প্রভৃতি৷
মৃত্যু-ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : এহসান হাবীব