দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ১৩ জানুয়ারি। এ দিনে মরণব্যাধি ক্যান্সার (অস্টিও সারকোমা) ধরা পড়ে তাঁর ডান পায়ে। একই বছরের ২০ মার্চ অস্ত্রোপাচার করে ডাক্তাররা কেটে ফেলেন তাঁর সম্পূর্ণ ডান পা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন তিনি প্রহর গুণছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর–যখন এই সুন্দর পৃথিবীকে চিরবিদায় জানাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি চোখ বুঁজে–যখন প্রিয় সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি বারবার ভিজে উঠছিল গোপন কান্নায়–ঠিক তখনই কলকাতা থেকে সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ভূষিত করা হলো আনন্দবাজার পুরস্কারে। নিশ্চিত মৃত্যুর কঠিন বাহুবন্ধনে থেকেও যিনি এ পুরস্কার গ্রহণে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান, তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
পূুঁজিবাদ তথা প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাবের কারণেই তিনি এ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। কেননা, জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন সমাজবাদী চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী একজন রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মী। লেখক, শিল্পী ও সমাজকর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সব সময় সোচ্চার। আনন্দবাজার পাবলিকেসন্স লিমিটেডের দেয়া পুরস্কার তাই ইলিয়াস সচেতনভাবেই গ্রহণ করতে চাননি। অবশ্য পরে চিকিত্সা খরচের কথা ভেবে, পুরস্কার কমিটির সদস্য ড. আনিসুজ্জামানসহ বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধে তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শুধু বাংলাদেশের কথাসাহিত্যেই নয়, সমগ্র বাংলাসাহিত্যেরই একজন অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক। তিনি কখনোই লেখার সংখ্যা বৃদ্ধিতে মনোযোগী ছিলেন না। ভিন্ন আঙ্গিক ও প্রকরণে মনোযোগী এ লেখক তাই খুব বেশি লেখেননি জীবনে। কিন্তু যা লিখেছেন শিল্প-বিচারে তা এখনও বিশ্বমানের, এমনটিই মনে করেন সাহিত্যের বিদগ্ধ সমালোচকেরা। জীবনের গভীরতম শাঁস পর্যন্ত অশেষ কৌতূহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে শিল্পকর্মে তা দ্বিধাহীন প্রকাশ করার বিরল ক্ষমতা যাঁর লেখায় পাওয়া যায় তিনিই কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। যদিও প্রকৃতি তাঁকে এই বিশ্ব পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির জন্য বেশি সময় দেয়নি। হয়ত সেজন্যই এই নাজুক ও স্বল্পায়ু সময়ে তিনি মর্মভেদী দৃষ্টিকে শাণিত করে দেখেছেন তাঁর চেনা বিশ্বকে। যাপিতজীবনের বাহিরেও যে আরো কিছু দেখবার ও বুঝবার দিক আছে তা আমরা ইলিয়াসের গল্প ও উপন্যাস পড়ে আবিষ্কার করতে পারি। তাঁর লেখায় আমরা পাই গভীর জীবনবোধ ও তীক্ষ্ণ হাস্যকৌতুকের সাক্ষাত্। সাধারণ নিম্নবর্ণের মানুষের মুখের ভাষাও তাঁর রচনায় মর্যাদা পায়। লেখায় তিনি শুধু গল্প বলেন না, পাঠককে ভেতর থেকে নাড়া দেন, ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়েও রাখেন।
একটি প্রবন্ধের বই, ৫টি গল্পগ্রন্থ ও দুটি কালজয়ী উপন্যাস ছাড়াও ইলিয়াস আমাদের জন্য রেখে গেছেন বেশ কিছু প্রবন্ধ, সাক্ষাত্কার, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু- বান্ধব ও পাঠক-সম্পাদকের কাছে লেখা চিঠিপত্র, শখ করে লেখা কিছু কবিতা এবং স্কুল পাঠ্যবইয়ের জন্য লেখা চিরায়ত সাহিত্যের রি-টোলড গল্প। এ সব রচনায় তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি স্ব-মহিমায় ভাস্বর। তাঁর লেখা প্রবন্ধে তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা ও সামঞ্জস্য এবং বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।বর্তমান গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে মাতামহের বাড়িতে ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এ প্রতিভাবান লেখকের জন্ম। বাবা-মা তাঁকে আদর করে ডাকতেন মঞ্জু। পুরো নাম আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস। মা মরিয়ম ইলিয়াস ও বাবা বিএম ইলিয়াসের প্রথম সন্তান তিনি। মা ছিলেন গৃহিণী। বাবা ছিলেন বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি ইলিয়াসের বাবা রাজনীতি করতেন।
ইলিয়াসের জন্মের সময় তিনি ছিলেন পূর্ববাংলা মুসলিম লিগের বগুড়া জেলার সেক্রেটারি। ইলিয়াসের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার চন্দনবাইশা গ্রামে। সেখান থেকে এসে ইলিয়াসের দাদা বাড়ি করেন বগুড়া শহরের উপকন্ঠে করতোয়া নদীর তীরে, গ্রামের নাম নারুলি। নারুলি গ্রামেই কাটে ইলিয়াসের শৈশবের প্রথম চারটি বছর। তাঁর ছোট তিন ভাইয়ের নাম শহীদুজ্জামান ইলিয়াস, নূরুজ্জামান ইলিয়াস ও খালেকুজ্জামান ইলিয়াস। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ইলিয়াসের বাবা বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং দেশ বিভাগের দু’বছর পর প্রাদেশিক আইন পরিষদের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এ সময় ইলিয়াসের বাবা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। পিতার সক্রিয় রাজনীতির সূত্রে ইলিয়াসের শৈশব কাটে একটি রাজনৈতিক পরিমন্ডলে।ইলিয়াসের বাবা রাজনীতি করতেন বলে তাঁদের বাড়িতে অনেক লোকের আসা-যাওয়া ছিল। এঁদেরকে তাঁরা চাচা বলে ডাকতেন। এ রকমই একজন ছিলেন সিদ্দিক চাচা। ১৯৪৯ সালে সেই সিদ্দিক চাচাকে দিয়েই ইলিয়াসদের দুই ভাইকে ঢাকার একটি স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন তাঁর মা। সিদ্দিক চাচা তাঁদের ভর্তি করিয়েই খালাস। পরের দিন তাঁদেরকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার ভার নিলেন আর এক চাচা। কিন্তু তিনি ভাল করে জানতেন না তাঁদেরকে কোন স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। ওই এলাকায় তখন বহু স্কুল ছিল। নওয়াবপুর প্রিয়নাথ স্কুল ছাড়া অন্য সব স্কুলই লক্ষ্মীবাজার এলাকায়। সেই চাচা ইলিয়াসকে আর তাঁর ভাই শহীদুজ্জামানকে নিয়ে একটার পর একটা স্কুলে খোঁজ নিতে শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত সেন্ট ফ্যান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলের মেমসাহেবরা খাতাপত্রে তাঁদের নাম খুঁজে পেলেন।
১৯৫০ সালে এ স্কুলটি ছেড়ে ঢাকার কেএল জুবিলি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ইলিয়াস। তৃতীয় শ্রেণীতে না পড়েই ১৯৫১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে তাঁর পরিবার ঢাকা থেকে বগুড়াতে চলে যায়। তখন আবার ইলিয়াসকে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়। বগুড়াতে গিয়ে তিনি ভর্তি হন বগুড়া জেলা স্কুলে। ১৯৫৮ সালে বগুড়া জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করার পর আবার ঢাকায় চলে আসেন ইলিয়াস এবং ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। তখন পরিবারের সবাই বগুড়াতে থাকার কারণে ঢাকা কলেজের নর্থ ছাত্রাবাসে থাকতেন তিনি। ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বে পড়ার আগ্রহ ছিল ইলিয়াসের। কিন্তু সে বছর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমাজতত্ত্বে কোনো ছাত্র ভর্তি করলেন না। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে ভর্তি হতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। থাকতেন ফজলুল হক মুসলিম ছাত্রাবাসে।
১৯৬৪ সালে ইলিয়াস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ. পাস করেন।১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ইলিয়াস প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। অবশ্য এর আগে যোগ দিয়েছিলেন করটিয়া সাদত কলেজে। কিন্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় দু-তিন দিন পর চাকরিটি ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করার পর সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে তাঁর উপরও বাকশালে যোগ দেয়ার চাপ পড়ে। কিন্তু তিনি বাকশালে যোগ দেননি। ১৯৮৪ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে ইলিয়াস প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং ডিসেম্বরে সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।বিয়ে করেন ১৯৭৩ সালে, স্ত্রীর নাম সুরাইয়া৷ ডাকনাম তুতুল। স্ত্রী তুতুলও ছিলেন পেশায় একজন শিক্ষিকা। বিয়ের পর তুতুল সিরাজগঞ্জের মহিলা কলেজ থেকে চাকরি ছেড়ে ইলিয়াসের কাছে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭৪ সালে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান আন্দালিব।শিক্ষক হিসেবে ইলিয়াস ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকসুলভ দূরত্ব ছিল না তাঁর একটুও৷ ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন তিনি।
অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ক্লাস নিতে পারেননি, তাই কলকাতা থেকে ফিরে ক্রাচে ভর করেই সপ্তাহে দুই-তিন দিন যেতেন ঢাকা কলেজে। ক্রাচে ভর করে কলেজের উঁচুসিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে রীতিমত ঘেমে যেতেন তিনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর কথা ভেবে বাংলা বিভাগকে নিচের তলায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইলিয়াস রাজি হননি তাতে, কারণ এতে নাকি খারাপ নজির সৃষ্টি হবে। এরই মধ্যে একদিন বাথরুমে পড়ে গিয়ে ডান হাতটা কাঁধের কাছে স্থানচ্যুত হয়ে গেল, তখন আর ক্রাচে ভর করেও হাঁটতে পারতেন না ইলিয়াস। তবুও ক্লাস নেয়া থেকে বিরত হন নি তিনি। তাঁর চাওয়া অনুযায়ী তখন বাসার মধ্যেই ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছাত্ররা তাঁর বাসায় যেতেন, তিনি হুইল চেয়ারে বসে ক্লাস নিতেন। ছাত্রদের উদ্দেশে উচ্চকন্ঠে দু’তিন ঘন্টা লেকচার দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। কারো কথাই শুনতেন না তিনি। বলতেন, ‘ছাত্রদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, বেশি বেশি ক্লাস নিয়ে তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে।’স্কুলে পড়ার সময় থেকেই প্রচুর পড়ার নেশা ছিল ইলিয়াসের। আর লেখালেখিতে হাতেখড়ি হয় স্কুলে পড়ার সময়ই। এসময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত সত্যযুগ ও আজাদ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় তাঁর লেখা ছাপা হতো।
দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় সওগাত এ ইলিয়াসের প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয়। ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজে পড়ার সময় অবিরাম গল্প লিখতেন এবং বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতেন। পাঠানো গল্পের অধিকাংশই ফেরত আসত৷ ছাপা হতো দু’একটা। ১৯৬১ সালে চিকেন পক্স আক্রান্ত হলে বেশ কিছুদিন তাঁকে থাকতে হয়েছিল মিডফোর্ড হাসপাতালে। হাসপাতালের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে অতন্দ্র নামের একটি গল্প লেখেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা স্বাক্ষর এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ বছরই আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সাম্প্রতিক ধারার গল্প নামক একটি গ্রন্থে ইলিয়াসের স্বগত মৃত্যুর পটভূমি নামে একটি গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে লিটল ম্যাগাজিন আসন্নতে চিলেকোঠায় নামে তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালে চিলেকোঠায় নামে তাঁর প্রথম উপন্যাস দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়। কিন্তু ওই সময় সরকার পরিবর্তন হওয়ায় সংবাদ কর্তৃপক্ষ উপন্যাসটি প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। তখন ইলিয়াস সংবাদ কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, ‘পাঠকরা এটাকে লেখকের দায়িত্বহীনতা ভাবতে পারে, আপনারা যে ছাপতে পারছেন না সেটা লিখে দিন।’ ওরা তা লিখে দিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্য ঘরে অন্য স্বর। তিনি গ্রন্থটির নামকরণ করেন ট্রুম্যান কেপোটের ‘আদার রুম আদার ভয়েস্’ নামে উপন্যাসটির নাম অবলম্বনে। প্রচুর প্রশংসা পায় বইটি। ওই বছরের জুলাই মাসে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সংবত শীর্ষক একটি লিটল ম্যাগাজিনে গল্পকার হাসান আজিজুল হক গ্রন্থটির সমালোচনা লেখেন। এছাড়া মাহবুবুল আলম, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, মুনতাসীর মামুন, আবুল হাসানাত এবং মাজহারুল ইসলাম বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় গ্রন্থটির উপর আলোচনা করেন। সৈয়দ শামসুল হকও টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে তখন বইটির প্রশংসা করেন।
১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় তাঁর প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক রোববার-এ চিলেকোঠার সেপাই ছাপা শেষ হয়। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহীর তরঙ্গ প্রকাশনী হতে তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘খোঁয়ারি’ প্রকাশিত হয় ৷ ১৯৮৫ সালে ‘দুধ ভাতে উত্পাত’ শিরোনামে তাঁর আরেকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড হতে বই আকারে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক মহলে বেশ সাড়া পড়ে। তাঁর আরেকটি গল্পগ্রন্থ ‘দোজখের ওম’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। ১৯৯২ সালে এবছরই ইলিয়াসকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে এজাজ ইউসুফ সম্পাদিত লিরিক সাহিত্য পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা বের হয়। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইলিয়াসের পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে কলকাতার একুশে প্রকাশনী প্রকাশ করে তাঁর একটি গল্প সংগ্রহ গ্রন্থ।
এপ্রিল মাসে কলকাতার বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক আয়োজিত গ্রন্থমেলায় অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে তিনি কলকাতা সফরে যান। এ বছর জুন মাসে কলকাতার প্রতিভাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসটি। ১৯৯৪ সালে দৈনিক জনকন্ঠের সাহিত্যপাতায় ইলিয়াসের উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে শুরু হয়। যদিও পুরো উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার আগে জনকন্ঠ কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক কারণে ‘খোয়াবনামা’ ছাপা বন্ধ করে দেয়।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ইলিয়াস পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। সে সময় তাঁর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন তিনি। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ইলিয়াস তাঁর জগন্নাথ কলেজের সহকর্মী কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর বাসায় ভাড়া থাকতেন। আটষট্টি-ঊনসত্তরের গণআন্দোলন একনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন ইলিয়াস। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক মিটিংয়ে তিনি ছিলেন মনোযোগী শ্রোতা। বিশেষত মওলানা ভাসানীর প্রায় প্রতিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। আর বিভিন্ন মিছিলেও যেতেন তিনি। সেই সময় চীনের তত্কালীন সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং পরে ভারতের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ অনুধাবন করেছেন তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে। ১৯৮৪ সালে ইলিয়াস বাংলাদেশ লেখক শিবিরে যোগ দেন এবং লেখক শিল্পীদের অধিকারপ্রতিষ্ঠা আন্দোলনে আমৃত্যু সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় যখন চারদিকে বন্যার্তদের হাহাকার তখন তিনি সরাসরি ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় তিন দিনব্যাপী জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন। এ সম্মেলনেও মূখ্যভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে লেখক-শিল্পীদের উপর ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণ ও ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান, নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের।১৯৭৭ সাল ছিল ইলিয়াসের জন্য স্মরণীয়। কারণ জীবনের প্রথম পুরস্কার হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি এই সালে। বাংলাদেশ লেখক শিবির সংঘ তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে ইলিয়াস বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে ‘খোয়াবনামা’-এর জন্য পান প্রফুল্ল কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার এবং সাদাত আলী আকন্দ পুরস্কার। এবছর কাজী মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক নামে আরেকটি পুরষ্কার পান তিনি।আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করতেন ইলিয়াস। ঢাকা কলেজের নর্থ হোস্টেলে থাকার সময় হোস্টেলের রুমে বসেই ইলিয়াস আড্ডা দিতেন বন্ধু শহিদুর রহমান ও আব্দুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে। আড্ডায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতো গল্প লেখার বিভিন্ন প্রকরণ ও ভাষা বিষয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও আড্ডা ও সাহিত্যচর্চা আর সাহিত্যবিষয়ক পড়াশোনা চালাতেন সমানভাবে। তখন শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে আড্ডা দিতেন ইলিয়াস। তাঁর আড্ডার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন মুহম্মদ মুজাদ্দেদ, চিত্তরঞ্জন হালদার, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, ইকবাল রুমি ও আসাদ চৌধুরী। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পাশাপাশি তখন ইলিয়াস ব্রিটিশ কাউন্সিল ও পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়মিত সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। ১৯৬৫ সালের দিকে ইলিয়াস তদানীন্তন জিন্নাহ এভেনিউ-এর রেস্টুরেন্ট রেকস্ ও নবাবপুরের হোটেল আরজুতে আড্ডা দিতেন। এছাড়াও আড্ডা দিতেন বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং ও কাপ্তান বাজারের নাইল ভ্যালি রেস্টুরেন্টে । এসব স্থানে তাঁর আড্ডার সঙ্গী ছিলেন খালেদ চৌধুরী, বুড়ো ভাই (মুশাররফ রসুল), শহীদ কাদরী, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, নির্মলেন্দু গুণ, বিপ্লব দাশ, রণজিত্ পাল চৌধুরী, জামাল খান, মোহাম্মদ খসরু, ইয়াসিন আমিন, রফিক আজাদ, প্রশান্ত ঘোষাল, মাজহারুল ইসলাম,ও মাহবুবুল আলমসহ আরো অনেকেই।
১৯৯৫ সালের ফেবু্রয়ারি মাসে স্ত্রীর চিকিত্সার উদ্দেশ্যে তিনি সস্ত্রীক কলকাতায় যান এবং শান্তিনিকেতন ভ্রমণ করেন। অক্টোবরে মাকে হারান ইলিয়াস। মায়ের মৃত্যুর পর পরই ইলিয়াস অসুস্থ হয়ে পড়েন। পায়ের তীব্র ব্যথা উপেক্ষা করে তখন দিনরাত ‘খোয়াবনামা’ লিখছিলেন। ক্যান্সারকে বাত ভেবে ডাক্তাররা তখন ভুল চিকিত্সা দিচ্ছিলেন ইলিয়াসকে। প্রচন্ড পায়ের ব্যথা নিয়েই তিনি ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসটি লেখা শেষ করেন ৩১ ডিসেম্বর। ১৯৯৬ সালে ১৩ জানুয়ারি তাঁর পায়ের হাড়ে ধরা পড়ে ক্যান্সার৷ ক্যান্সারের কারণে ২০ মার্চ তাঁর ডান পা সম্পূর্ণ কেটে ফেলা হয়। এবছর বই আকারে প্রকাশিত হয় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’। ২৭ এপ্রিল কলকাতা থেকে দেশে ফেরেন ইলিয়াস।১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি। পাখিডাকা সিগ্ধ ভোর। ঢাকার মালিবাগ কমিউনিটি হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে কালজয়ী এ লেখক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। তাঁর মৃত্যুর পর তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজিমপুরে তাঁর বাসভবনে গিয়ে শোক প্রকাশ করেন। ওই দিন বিকালেই ইলিয়াসের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়ার জ্বলেশ্বরীতলার বাসায়। তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুর পরের দিন বগুড়া শহরের দক্ষিণ বগুড়া গোরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সেদিন থেকে বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী পাঠকরা হারান একজন জীবনঘনিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে। নিজের সম্পর্কে যিনি বলতেন, ‘আমি চব্বিশ ঘন্টার লেখক…’।
একনজরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
নাম: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস:
মা: মরিয়ম ইলিয়াস ও বাবা: বিএম ইলিয়াস
জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩৷
পড়াশুনা:
মাধ্যমিক: ১৯৫৮ সাল, বগুড়া জিলা স্কুল উচ্চমাধ্যমিক: ১৯৬০ সাল, ঢাকা কলেজ এম.এ.: ১৯৬৪ সাল (বাংলা সাহিত্য), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কর্মজীবন
১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ইলিয়াস প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। অবশ্য এর আগে যোগ দিয়েছিলেন করটিয়া সাদত কলেজে। যদিও দু’তিন দিন পর চাকরিটি ছেড়ে দেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলেন না বলে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করার পর সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে তাঁর উপরও বাকশালে যোগ দেয়ার চাপ পড়ে। কিন্তু তিনি বাকশালে যোগ দেননি। ১৯৮৪ জগন্নাথ কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৮৭’র জানুয়ারিতে ইলিয়াস প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং ডিসেম্বরে সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন।
পুরস্কার
১৯৭৭ সালে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাদেশ লেখক শিবির সংঘ তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করেন। ১৯৮৩ সালে ইলিয়াস বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মাসে ‘খোয়াবনামা’-এর জন্য পান প্রফুল্ল কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার এবং ‘সাদাত আলী আকন্দ’ পুরস্কার। এবছর ‘কাজী মাহবুবউল্লাহ’ স্বর্ণপদক নামে আরেকটি পুরষ্কার পান তিনি।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ:
অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উত্পাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত), দোজখের ওম। প্রবন্ধের বই: সংস্কৃতির ভাঙা সেতু (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত) উপন্যাস: চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা।মৃত্যু: ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭।তথ্যসূত্র: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সমগ্র, দ্বিতীয় খন্ড, মওলা ব্রাদার্স আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্মারকগ্রন্থ, ফিরে দেখা সারাজীবন, দ্বিতীয় খন্ড (সম্পাদক-মুজিবুল কবীর ও মাহবুব কামরান) ও খালেকুজ্জামান ইলিয়াস (ভাই)।
লেখক: আপন মাহমুদ