ছোট্ট একটা কক্ষ। ভেতরে ভারি চশমাপড়া ছোটখাটো গোছের একজন লোক বসা। তাঁর চুলের রং ধবধবে সাদা। সিগারেট হাতে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছেন। কখনো কখনো আয়েশ করে হাতের সিগারেটটি মুখে নিয়ে টেবিলের উপর কাগজগুলোতে নিবিষ্টমনে চোখ রাখছেন। কক্ষের ভেতরের ফ্যানের বাতাসে দরোজার পর্দাটা মাঝে মধ্যে নির্ধারিত স্থান থেকে সরে ভেতরটাকে স্পষ্ট করে তুলছে। পর্দার এই সামান্য ফাঁক ফোঁকরের মধ্যে দিয়ে দেখা লোকটাকে মনে হয় ঋষি। টেবিলের উপরের কাগজের স্তুপ আর লোকটার ভাবগাম্ভীর্যসুলভ চেহারা ভেতরের পরিবেশটাকে অনেক বেশি গভীর করে তুলছে। কিন্তু কেউ কেউ এই গভীরতাকে পাশ কেটে পর্দার ফাঁক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন। তখন পরিবেশটা আর আগের মতো নীরব থাকে না। ক্রমাগত সাহিত্যের নানা আলোচনায় সরব হয়ে উঠে কক্ষটি। সামনে বসা ঋষিগোছের লোকটাকে সেই সময় আর বর্ষীয়ান কিংবা গম্ভীর প্রকৃতির মনে হয় না। চশমার পুরো লেন্সের কাঁচ মুছতে মুছতে সে গলা ছেড়ে ডাকে- “কালাম, দুকাপ চা”। কালাম যথারীতি চা দিয়ে যায়। জমে উঠে তুমুল আড্ডা। ক্রমে দীর্ঘ হয় সে আড্ডা, আর সিগারেটের ধোয়ায় পুরো কক্ষটা সাদা হয়ে আসে।
এই দৃশ্যটা ঊনিশ শতকের সত্তর দশকের ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকা অফিসের চারতলার ছোট্ট একটি কক্ষের। ভারি চশমাপড়া সাদা চুলের ব্যক্তিটি হচ্ছেন স্বয়ং আহসান হাবীব। দেশভাগের পর তাঁর নেতৃত্বে এই কক্ষটি হয়ে উঠেছিল নতুন দেশের সাহিত্যের সূতিকাগার। নবীন প্রবীণ কবিদের পদচারণায় এই স্থানটি মুখরিত হয়ে উঠতো প্রতিমূর্হুত। সে সময় ‘দৈনিক বাংলা’ ও আহসান হাবীবকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। অসাধারণ ব্যক্তিত্ববোধ, মনন, রুচি ও আচার আচরণে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন কিংবদন্তি সম্পাদক। সেদিন আহসান হাবীব অভিভাবকের মতো সাহিত্যের মূলধারায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর কল্যাণে বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখক মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছিলেন। আজকের বাংলা কবিতার অনেক প্রতিষ্ঠিত কবির প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে আহসান হাবীবের হাত ধরে। তাঁর রুচি ও নিষ্ঠায় তখন ‘দৈনিক বাংলা’-র সাহিত্য পাতা একটি আদর্শ সাহিত্য পাতার মর্যাদা অর্জন করেছিল। সম্পাদক হিসেবে ছিলেন একেবারেই নির্মোহ প্রকৃতির। সেই সময় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা যখন অনুরোধ আর স্বজনপ্রীতিতে ভরপুর হয়ে উঠেছিল ঠিক তখন তিনি স্থাপন করেছেন অনন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত। লেখা প্রকাশে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা কোনো সূত্রের চেয়ে নিজের রুচি ও বিচারবোধকে প্রাধান্য দিতেন তিনি। আর এই বিচারবোধ হলো গুণগত মান। আহসান হাবীবের উপর সত্তর দশকের কবি মাহবুব সাদিকের একটি লেখায় এ সম্পর্কে চমত্কার ধারণা পাওয়া যায়। লেখালেখির সূত্রে আহসান হাবীবের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়েছিল। তিনি লিখেন- “শোনা যায়, ‘দৈনিক বাংলা’-র সাহিত্য সম্পাদক থাকা অবস্থায় একই পত্রিকার সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান একবার কবিতা পাঠালে তিনি সে কবিতা বদলে দিতে বলেছিলেন। সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান আহসান হাবীবের এই অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই যে কত বড়মাপের মানুষ ছিলেন এবং সাহিত্যের গুণগত মানকে সর্বোচ্চ সম্মান করতেন, তা এসব ঘটনায় অবহিত হওয়া যায়। যাদের লেখা ছাপতে পারেননি তারা প্রথমে খামে করে কবিতা পাঠালেও পরবর্তীকালে খামে ভরে অশ্লীল গালিগালাজ পাঠাতেন। রিকশায় করে অফিসে যেতেন তিনি। যেতে যেতে পথে কখনো কখনো অশ্লীল ধ্বনি শুনেছেন। কিন্তু শিল্পের বিচারক হিসেবে তিনি ছিলেন নির্বিকার। তিনি সাহিত্যের সত্যিকার অভিভাবক ও জ্ঞানতাপস”। এ ঘটনাই প্রমাণ করে সম্পাদক হিসাবে তিনি ছিলেন কতটা নির্মোহ এবং আপোষহীন। তাঁর এই আপোষহীন মানসিকতা তাঁকে এমন এক স্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে তাঁর প্রতিতূল্য ব্যক্তি একমাত্র তিনি নিজেই। অনবদ্য এই গুণের জন্য দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদনার ইতিহাসে তাঁর বিকল্প খুঁজে পাওয়া বিরল।
আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে। পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার। মাতা জমিলা খাতুন। তাঁর পাঁচ ভাই চার বোন। অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল পিতা মাতার প্রথম সন্তান তিনি। বিবাহিত জীবনে তিনি ছিলেন চার সন্তানের জনক। শ্বশুড় বাড়ি বগুড়া সদর থানার নামাজগড়। স্ত্রীর নাম খাতুন সুফিয়া। সন্তানদের মধ্যে বড় মেয়ে কেয়া চৌধুরী বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বল মুখ। দ্বিতীয় মেয়ে জোহরা নাসরিন গৃহিণী। ছেলে মঈনুল আহসান সাবের পেশায় সাংবাদিক। তিনি বাংলা মূলধারার কথা সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় কথাশিল্পী। এছাড়া প্রকাশক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। ছোট ছেলে মঞ্জুরুল আহসান জাবেদ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
পারিবারিক ভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন। সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। সেইসময় তাঁর বাড়িতে ছিল আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুঁথি। যেমন আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি। এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেন। তখন তাঁর বয়স ১২/১৩ বছর। স্কুলে পড়ার সময়ই ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর একটি প্রবন্ধ ‘ধরম’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হলে নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায়। স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। সাহিত্যের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি চলে আসেন বরিশালে। ভর্তি হন সেখানকার বিখ্যাত বিএম কলেজে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কলেজের পড়াশোনার পাঠ শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত রাখতে হয় তাঁকে। বিএম কলেজে দেড় বছর পড়ার পর ১৯৩৬ সালের শেষার্ধে কাজের খোঁজে তিনি রাজধানী কলকাতায় পাড়ি জমান। এভাবেই কবি আহসান হাবীবের বরিশাল থেকে তত্কালীন রাজধানী কলকাতায় পদার্পণ। ততদিনে অবশ্য ‘দেশ’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বিচিত্রা’র মতো নামি দামি পত্রপত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে। কলকাতা গিয়ে শুরু হয় আহসান হাবীবের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা। সেখানে যেয়ে ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথমে চাকরি নেন ফজলুল হক সেলবর্ষী সম্পাদিত ‘দৈনিক তকবীর’ পত্রিকায়। বেতন মাত্র ১৭ টাকা। পরবর্তীতে তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার ‘বুলবুল’ পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকায় কাজ করেন। এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন।
কবি হিসেবে আহসান হাবীবের যাত্রা শুরু হয় অবিভক্ত বাংলায়। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল তখনো ছিল অখণ্ড আকাশের মতো। ধূর্ত ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর কূটচালে তখনও সীমান্তে আজকের মতো কাটাতাঁরের বেড়া কিংবা সীমানা চিহ্ন বসেনি। তবে রাজনীতির মঞ্চে তখন বিভাজনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। ঠিক সে সময় যে কজন মুসলমান তরুণ আধুনিকতাকে আত্মস্থ করে বাংলা কবিতার গতিপথে ঢুকে পড়েছেন তার মধ্যে আহসান হাবীবের নাম অগ্রগণ্য। পরবর্তীকালে (১৯৪৭ সাল) ধূর্ত ইংরেজ শাসকদের কূটচালে বাংলা দ্বিখন্ডিত হলো। তিনি ফিরে এলেন ঢাকায়। ঢাকা হলো তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। স্বাভাবিক ভাবেই নতুন দেশের সাহিত্য নতুন স্রোতধারায় বিকশিত হবে এবং তা হয়েছিলও। কিন্তু সেই স্রোত আহসান হাবীবের অনুকূলে ছিল না। ইংরেজদের কূটচাল আর ধর্মের ঐক্যে বিভাজিত হওয়া রাষ্ট্রে সাহিত্যও ধর্মীয়করণ প্রক্রিয়া শুরু হলো। কলকাতা থেকে সাহিত্যের নিবিড় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন (পূর্ব পাকিস্তানে) হওয়ার পর মননের ক্ষেত্রে নেমে আসে নৈরাজ্যের ছায়া। সেই সময় কাব্য ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়া তরুণদের অধিকাংশই নিমজ্জিত হয়ে পড়েন পুরানুকরণ প্রিয়তায়। তরুণরা কি নিয়ে কাব্য সৃষ্টি করবে বার বার তারই পথ নির্দেশ করেছেন তথাকথিত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা। আর সেই নির্দেশিত পথ ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ। তখন রাষ্ট্র যন্ত্রের সাহায্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। প্রতিক্রিয়াশীলদের সেদিনের অবস্থা কবি গোলাম মুস্তাফার একটি লেখায় দারুণভাবে প্রকাশ পায়। তিনি লিখেছেন- “তরুণ লেখকদের কাছে তাই আমার আহবান তারা সুস্থ হউন, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস করুন; সাধনা করলে পাকিস্তানের মাল মশলা দিয়ে তারা এমন সাহিত্য রচনা করতে পারবেন, যা বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে অনায়াসেই পরিবেশন করা যাবে। আল্লাহর নামে ড. আর্নল্ড যদি ‘পার্লস অব দি ফেইথ’ নামক সুন্দর কাব্য রচনা করতে পারেন, আ্যলান পো যদি কোরআন শরীফের সূরা আল আরাফ নিয়ে কাব্য লিখতে পারেন, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখা, আলিফ-লায়লা নিয়ে যদি ইউরোপীয় লেখকেরা কাব্য রচনা করতে পারেন, হাফিজ, রুমি, ওমর খৈয়াম, ইকবাল এরা যদি নিজস্ব রূপ রং রস বজায় রেখে বিশ্বসাহিত্য রচনা করতে পারেন তবে আমরা কেন পারব না। যে বিশ্বে আমি নেই সে বিশ্বের মূল্য কী?”
ঠিক এরকম অসুস্থ সময়ে আহসান হাবীব নিজের বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়েননি। আপন বিশ্বাসে অটল থেকে নিজের লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন। উপমহাদেশের রাজনীতির টালমাটাল করা পাগলা হাওয়ার কবলে তিনি পতিত হননি। অথচ তত্কালীন মধ্যবিত্ত সমাজ সেদিন স্বাধীনতার স্বপ্ন আর ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। স্ব স্ব ধর্মের কবিরা সচেতন ভাবে রাজনীতি ও ধর্ম উত্সারিত কবিতা লিখতে শুরু করেন। এমন পরিস্থিতিতে আহসান হাবীব সরাসরি রাজনীতি কিংবা ধর্ম উত্সারিত একটি লাইনও রচনা করেননি। দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়েও তাঁর এই নির্বিকার মনোভাব অব্যাহত ছিল। সাহিত্য, রাজনীতি, দলবাজিতা কিংবা ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি তিনি পছন্দ করতেন না। সচেতন ভাবেই তিনি এ ধরনের প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে রেখেছেন মুক্ত। অন্যদিকে নিজের কবিতাকেও রেখেছেন নিরাপদ দূরত্বে। তাঁর এমন নির্মোহতা প্রচণ্ড প্রাণ শক্তির পরিচয় বহন করে।
আত্মপ্রচারণামুখর হৈচৈয়ের সময়ে আহসান হাবীব অন্তর্গত জগতেই নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। কলেজ জীবনে পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্যই কলকাতায় যাননি তিনি। অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে ছিল সাহিত্যের প্রতি আজন্ম ভালবাসা। সমস্ত জীবন কাটিয়েছেন কাব্যচর্চা আর সাহিত্য সাধনায়। গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, এমনকি গানও লিখেছেন। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় বেশ কিছু উত্কৃষ্ট দেশাত্নবোধক গান রচিত হয়েছিল। আহসান হাবীবের – ‘দুর্গম এ যাত্রাপথে কোনো বাধা মানব না’ এ গানটি সে সময়েরই লেখা এবং তাঁর লেখা এই গানটি বেশ সুনাম কেড়েছিল।
তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস , ছড়াগান ও অনুবাদকার্য ছড়িয়ে থাকলেও আহসান হাবীব মূলত কবি। সময়ের প্রয়োজনে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলোয় আগ্রহী হয়ে উঠলেও কবিতায়ই ছিল তার মূল আগ্রহের জায়গা। শৈশবে, কৈশোরে ও পারিবারিক অনুকূল আবহে সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালবাসা ছিল এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই ভালবাসা ছিল মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘রাত্রি শেষে’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে কমরেড পাবলিশার্স থেকে। প্রকাশক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।
আহসান হাবীবকে বলা হয় মৃদুভাষী কবি। কিন্তু স্বয়ং কবি এ ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) শুরুর দিকে অস্থির সময়ে তিনি লেখালেখি করেছেন একাগ্রতার সঙ্গে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বারবার স্থান বদল করলেও শেকড়ের প্রতি তিনি ছিলেন আজন্ম দায়বদ্ধ। আর তাই সাহিত্যের বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন দেশ, মাটি, মানুষ, নিসর্গ ও প্রেম। শৈশবে বেড়ে ওঠা জন্মগ্রাম শংকরপাশা আর পারিবারিক অর্থনৈতিক দূরাবস্থার প্রভাব তাঁর সাহিত্যে ছাপ ফেলেছে। মানুষের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন মিলিয়ে দেখেছেন তিনি। নিরীহ মানুষের জীবন, বৈষম্য, বন্টন, পরাধীনতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের দায় প্রভৃতি বিষয় ফুটে উঠেছে তাঁর ‘রাত্রি শেষে’ নামক প্রথম গ্রন্থে (কবিতা)। পরবর্তী সময়ে ‘ছায়া হরিণ’, ‘সারা দুপুর’, ‘আশায় বসতি’, ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’, ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’ এবং ‘প্রেমের কবিতা’সহ বিভিন্ন গ্রন্থে তিনি তাঁর কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। এসব গ্রন্থে ঐতিহ্য, চেতনা, দেশপ্রেম ও মধ্যবিত্ত সুলভ আশাবাদের বিশ্বাস রয়েছে। বিষয়গত বৈশিষ্ট্য ছাড়া কবিতায় শব্দের নিজস্ব ভঙ্গি লক্ষণীয়। নদী মাতৃক গ্রাম বাংলার নিসর্গ সৌন্দর্যকে তিনি ওই শব্দের ব্যাবহারে চিত্রময়তা দিয়েছেন। প্রকৃতি ও মানবজীবন ঘিরে যে বৈপরীত্য রয়েছে তা চমত্কার ভাবে তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে।
শিশুতোষ লেখায়ও আহসান হাবীবের সাবলীল বিচরণ ছিল। সত্তর দশকে শিশু সাহিত্য রচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শিশুকিশোর রচনার ঢং, বক্তব্য ও চিন্তা-চেতনায় তিনি নিয়ে আসেন নতুন ব্যঞ্জনা। ‘ছুটির দিনদুপুরে’, ‘পাখিরা ফিরে আসে’ এ দুটি বাংলা শিশু সাহিত্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া শিশুকিশোরদের জন্য লেখা তাঁর অন্য গ্রন্থগুলি হলো ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝমে’, ‘রাণীখালের সাঁকো’, ‘জো্ত্স্না রাতের গল্প’, ‘ছোট মামা দি গ্রেট’ ইত্যাদি।
সাহিত্য সাধনায় স্বীকৃতি স্বরূপ আহসান হাবীব ১৯৬১ সালে ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার ও একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। আদমজী পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৬৪ সালে, ১৯৭৭ সালে অর্জন করেন নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, ১৯৭৮ সালে লাভ করেন একুশে পদক এবং আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৮০ সালে।
পিরোজপুর থেকে রাজধানী কলকাতা। আবার সেখান থেকে রাজধানী ঢাকা আসেন আহসান হাবীব ঊনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে। এখানে এসেও চাকরি নেন দৈনিক আজাদ ও মাসিক মোহাম্মদীতে। পরে দৈনিক ইত্তেহাদ, সাপ্তাহিক প্রবাহেও কাজ করেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ‘ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগামস’-এ উপদেষ্টা হিসেবে চাকরি করেন। এক সময় তিনি নিজে একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সর্বশেষ কাজ করেছেন ‘দৈনিক বাংলা’-য় (সাবেক ‘দৈনিক পাকিস্তান’)। এ পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই (১৯৬৪) এর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং জীবনের বাকি সময়টা এখানেই কাজ করেছেন তিনি।
দিনটি ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই। এদিনটিতেই ৬৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য এই কবি।
সংক্ষেপে আহসান হাবীব
জন্ম:
আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে। পিতার নাম হামিজুদ্দীন। মাতা জমিলা খাতুন। তাঁর পাঁচ ভাই চার বোন। অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল পিতা মাতার প্রথম সন্তান তিনি। ।
শৈশব ও পড়ালেখা:
আহসান হাবীবের শৈশব কাটে শংকর পাশা গ্রামেই। পড়ালেখা করেন পিরোজপুর জেলার গভর্নমেন্ট স্কুলে। তিনি ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরিক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে ভর্তি হন বরিশালের বিখ্যাত বিএম কলেজে। অর্থনৈতিক সংকটের জন্য তিনি এরপর আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি। কাজের খোঁজে পাড়ি জমান তত্কালীন রাজধানী কলকাতায়।
পরিবার:
বিবাহিত জীবনে তিনি ছিলেন চার সন্তানের জনক। শ্বশুড় বাড়ি বগুড়া সদর থানার নামাজগড়। স্ত্রীর নাম খাতুন সুফিয়া। সন্তানদের মধ্যে বড় মেয়ে কেয়া চৌধুরী বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বল মুখ। দ্বিতীয় মেয়ে জোহরা নাসরিন গৃহিণী। ছেলে মঈনুল আহসান সাবের পেশায় সাংবাদিক। বাবার মতো তিনিও লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। তিনি বাংলা মূলধারার কথাসাহিত্যের একজন জনপ্রিয় কথাশিল্পী। এছাড়া প্রকাশক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। ছোট ছেলে মঞ্জুরুল আহসান জাবেদ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ।
পেশা:
কলকাতায় যেয়ে তিনি প্রথমে কাজ শুরু করেন ফজলুল হক সেলবর্ষী সম্পাদিত দৈনিক ‘তকবীর পত্রিকা’-য়। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতাতেই কাজ করেন ‘তকবীর’, (১৯৩৭ ) ‘বুলবুল’, (১৯৩৭- ৩৮ ) ‘মাসিক সওগাত’, (১৯৩৯-৪৩ ) প্রভৃকি পত্রিকায়। এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ‘৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। দেশভাগের পর আহসান হাবীব রাজধানী ঢাকা আসেন ১৯৫০ এর দশকে। এখানে এসেও চাকরি নেন ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে। পরে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’, ‘সাপ্তাহিক প্রবাহ’-ও কাজ করেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ‘ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগামস’-এ উপদেষ্টা হিসেবে চাকরি করেন। এক সময় তিনি নিজেও একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সর্বশেষ কাজ করেছেন ‘দৈনিক বাংলা’-য় (সাবেক ‘দৈনিক পাকিস্তান’)। এ পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই (১৯৬৪) এর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মৃত্যু: ১০ জুলাই ১৯৮৫ সালে আহসান হাবীব মৃত্যুবরণ করেন।
আহসান হাবীবের প্রকাশিত গ্রন্থাবলি
কবিতা
রাত্রি শেষে
ছায়া হরিণ
সারাদুপুর
আশায় বসতি
মেঘ বলে চৈত্রে যাবো
দুই হাতে আদিম পাথর
প্রেমের কবিতা
বির্দীণ দর্পনে মুখ
খসড়া (কাব্যানুবাদ: হুয়ান র্যামন হিমেনেথ এর পস্নাতেরো এ্যা- আই এবং শাহেদ সোহরাওয়ার্দির এসেজ ইন ভার্স এর অনুবাদ )
উপন্যাস
আরণ্য নীলিমা
শিশু কিশোর:
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
ছুটির দিন দুপুরে
রেলগাড়ি ঝমামমে
রাণীখালের সাঁকো
জ্যোত্স্না রাতের গল্প
ছোট মামা দি গ্রেট
পাখিরা ফিরে আসে
রত্নদ্বীপ ( ট্রেজার আইল্যান্ডর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ )
হাজীবাবা
প্রবাল দ্বীপে অভিযান ( কোরাল আইল্যান্ডর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ )
সম্পাদিত গ্রন্থ:
কাব্যলোক
বিদেশের সেরা গল্প
পুরস্কার
সাহিত্য সাধনায় স্বীকৃতি স্বরূপ আহসান হাবীব ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার, (১৯৬১) একাডেমী পুরস্কার, ( ১৯৬১), আদমজী পুরসকার, (১৯৬৪) , নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, (১৯৭৭ ) একুশে পদক (১৯৭৮) ও আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কারে, (১৯৮০) ভূষিত হন। ।
লেখক : এহসানুল ইয়াছিন