“আমি বাংলা লিখতে শুরু করি ছাত্রাবস্থায় ইন্টারমিডিয়েট ক্লাশ থেকেই কিন্তু অত্যন্ত গোপনে। যাতে জানাজানি না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে আমি কসুর করিনি। তবুও একবার অঘটন ঘটে গেল। তখন কি একটা লেখা আমার ‘সওগাত’-এ বের হওয়ার পর বাবার পরিচিত স্থানীয় হাইস্কুলের জনৈক শিক্ষক লেখাটি পড়ে খুব খুশি হন, খুশির চোটে, হয়তো শুনে বাবাও খুশি হবেন মনে করে, তিনি খবরটি বাবাকেও জানান। কিন্তু ফল হল হিতে বিপরীত। শুনে বাবা অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। আরবি-ফার্সি বিদ্যায় আমার অনাগ্রহ ও অনগ্রসরতায় বাবা এর মধ্যে আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং এ কারণে আমার উপর ছিলেন অত্যন্ত নাখোশ। বাপ-দাদার পদাংক অনুসরণ করে আমিও ভালো আলেম হই গোড়া থেকে এ ছিল তাঁর ইচ্ছা ও সংকল্প। বাবা তখন চট্টগ্রাম জুমা মসজিদের ইমাম। সারা শহরে ইমাম সাহেব নামে পরিচিত আপামর জনসাধারণের সামনে সাধুতা ও পরহেজগারির এক উজ্জ্বল প্রতীক। এহেন ইমাম সাহেবের ছেলে বাংলা মাসিকে বাংলা লেখা ছাপাবে এ শুধু অকল্পনীয় নয় বাবার কাছে প্রায় ধর্মদ্রোহীতারই কাছাকাছি। উক্ত ভদ্রলোক আমার লেখা সম্বন্ধে খবর দিয়ে চলে যাওয়ার পর দুর্ভাগ্যবশত কি একটা জরুরি ব্যাপারে আমাকে বাবার সামনে যেতে হল। আমাকে দেখেই আমার আপাদমস্তক একবার দেখে নিলেন তিনি। দেখলাম তাঁর গম্ভীর মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গেল। ভিতরের উত্তেজনায় চোখমুখ প্রদীপ্ত। হঠাৎ ক্রুদ্ধ স্বরে ফেটে পড়লেন : তুমি নাকি মাসিকপত্রে কি লিখেছ?
প্রশ্নটা এতই আকস্মিক যে, আমি প্রায় হতভম্ব। তাঁর রক্তচক্ষু তখনো আমার মুখের উপর।
অগত্যা কাঁচুমাচু মুখে আমতা আমতা করলাম: না তো।
: এইমাত্র কবির সাহেব বলে গেলেন সওগাত নাকি এক মাসিক কাগজে তোমার কি এক বাংলা লেখা ছাপা হয়েছে?
আমি প্রায় আকাশ থেকে পড়ার মুখ করে বল্লাম: আমার লেখা? কাগজে ছাপা হয়েছে! মাস্টার সাহেব হয়তো ভুল করেছেন। এক এক কথার পর এক একবার ঢোক গিল্লাম।
: তিনিতো পরিষ্কার বলে গেলেন আপনার ছেলে আবুল ফজলের লেখা। এবার তাঁর গলায় রাগের সঙ্গে বিস্ময়েরও যোগ ঘটল। হঠাৎ আমার বুদ্ধির গোড়ায় যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠল। মুহূর্তে দেখতে পেলাম পলায়নের ফাঁক। ফিরে পেলাম আত্মবিশ্বাস আর মনের জোর। কিছুটা জোর গলায় বল্লাম: আমার নাম তো মোহাম্মদ আবুল ফজল। ও অন্য কোন আবুল ফজল হতে পারে। উত্তরটা এতই যুক্তিসঙ্গত যে বাবার কাছেও তা অবিশ্বাস্য বা অসমীচীন মনে হলো না।
রাগ পড়ে যাওয়ার পর বাবা সেদিন আমাকে শুধু এ উপদেশটুকু দিয়েই রেহাই দিয়েছিলেন: লিখতেই যদি চাও, আরবি-ফারসিতে না পারো, উর্দুতে লিখতে চেষ্টা কর”।
(রেখাচিত্র-আবুল ফজল, পৃষ্ঠা-১৩)
উপরের কথাগুলো বলেছেন বরেণ্য সাহিত্যিক আবুল ফজল। লেখা সম্পর্কে বাবার দেয়া উপদেশ তাঁর জীবনে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বাবার উপদেশ মতো উর্দূতে লেখেননি তিনি। লিখেছেন বাংলায়। আর সেকারণে সেই বয়স থেকেই বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিরন্তর লিখে গেছেন তিনি। তাঁর প্রথম বই প্রকাশের পূর্বেই বাবা মারা যান। ফলে সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত এদেশের অন্যতম সাহিত্যিক আবুল ফজল যে তাঁরই ছেলে মোহাম্মদ আবুল ফজল একথা জানার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর।
১৯০৩ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় বত্রিশ মাইল দক্ষিণে এক অখ্যাত অজপাড়াগাঁ কেঁওচিয়ায় আবুল ফজল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারের জন্য তাঁর জন্মটা ছিল বাড়তি আনন্দের। কারণ বাবা-মার ঘরে তিনিই প্রথম ছেলে হয়ে জন্মেছেন। পরবর্তীতে দেখা গেল ছেলে হিসেবে তিনি যে শুধু প্রথম তা নয়, তিনিই শেষ। কারণ তাঁর পরে আর কোন ছেলে জন্মগ্রহণ করেননি।
একরকম গোঁড়ামি পরিবেশেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন। তবে এ গোঁড়ামি শুধুমাত্র ধর্মের ক্ষেত্রে তথা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমিত ছিল। এছাড়া অন্য সব ব্যাপারে তাঁদের পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার। পরিচিত ও প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে তাঁর বাবার আন্তরিকতা ও সম্প্রীতি ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্তু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের গোঁড়ামি ও তার বাড়াবাড়ি শৈশব থেকেই তাঁর মনে একটা তীব্র প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করেছিল।
গ্রামে থাকার কারণে আবুল ফজলের ছেলেবেলা কিছুটা বেপরোয়াভাবেই কেটেছে। বাবা শহরে থাকতেন। মার সাথে তাঁরা তিন ভাই-বোন গ্রামে থাকতেন। তিনি একমাত্র ছেলে হওয়ায় তাঁর মুরুব্বি ছিলেন তিনি নিজেই। শাসন করার কেউ না থাকায় সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁদের ঘরটা ছিল পুকুর পাড়ে। গরমের দিনে ঐ পুকুরেই সারাদিন পড়ে থাকতেন। পুকুরের এপার থেকে ওপার সাঁতার কাটতেন সারাবেলা। মা শত ডাক দিয়েও তাঁকে পুকুর থেকে তুলতে পারতেন না। চাষাবাদ না থাকায় তাঁদের বাড়িতে গরু ছাগল ছিল না। তবে সমবয়সীদের সাথে গরু চরাতে মাঠে যেতেন। তাদের সঙ্গে সারা বিকেলটা ডাংগুলি খেলে সারা শরীরে কাদা মেখে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতেন। তাঁদের এলাকায় গ্রাম্য উৎসবের এক অপরিহার্য অঙ্গ ছিল বলি বা কুস্তিখেলা। চৈত্র-বৈশাখ মাসে গ্রামে গ্রামে এর সাড়া পড়ে যেত। ছেলেবেলায় সমবয়সীদের সঙ্গে সাত আট মাইল দূরে বলিখেলা দেখতে চলে যেতেন। একটু বড় হয়ে ওঠার পর দূর দূর গ্রামে যেতেন যাত্রা পালা আর কবির গান শুনতে। সারা রাত জেগে চোখ দু’টা প্রায় জবাফুলের মতো লাল করে যখন বাড়ি ফিরতেন তখন বেলা হয়ে যেত।
তাঁর বাবা ছিলেন আলেম। শুধু তিনি নন, তাঁর বাবা অর্থাৎ আবুল ফজলের দাদাও ছিলেন আলেম। তাঁরা ইংরেজি বাংলার ধার ধারতেন না, আরবি-ফারসি-উর্দুর চর্চা করতেন। মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষাকে তাঁরা খুব সুনজরে দেখতেন না। সামান্য ঘরোয়া চিঠিপত্র আর দলিল দস্তাবিজের বাইরে চর্চার ক্ষেত্রে বাংলাকে তাঁরা যোগ্য মনে করতেন না। এই আবহাওয়া ও পরিবেশ সে যুগের অধিকাংশ মুসলিম পরিবারে ছিল।
বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন মোহাম্মদ আবুল ফজল। কিন্তু আবুল ফজল নামেই তিনি লেখালেখি করেছেন। বাবাকে না জানিয়ে বাংলা লেখা চালিয়ে যাওয়া এবং সংক্ষিপ্ত নামের পক্ষপাতী হওয়ায় তিনি বাবার দেয়া নাম থেকে মোহাম্মদ শব্দটি বাদ দিয়েছেন।
ঘরে একজন মিয়াজি রেখে প্রথমে তাঁকে আমপারা পড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মিয়াজিকে তিনি কখনও আমল দিতেন না। মিয়াজি এলে তিনি বন্ধুদের সাথে খেলতে যেতেন। যে দেউড়ি (বাইরের ঘর) ঘরে মিয়াজি পড়াতেন তা একদিন পুড়ে য়ায়। এটি পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মিয়াজির চাকরি আর তাঁর পড়ার সমাপ্তি ঘটে। এরপর তিনি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। এটিই ছিল তাঁর প্রথম ও আদি স্কুল। এখানে অল্প কিছুদিন পড়ার পর বাবার সাথে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন।
এখানে আসার পর প্রথমে তাঁর বাবার বাসার কাছাকাছি নন্দন কাননে এক হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাইমারি স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেয়া হয়। মাদ্রাসা সেশন শুরু হতে দেরি ছিল বলে সাময়িকভাবে তাঁকে ঐ স্কুলে ভর্তি করা হয়। পরে ১৯১৩/১৪ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়া হয়। সুুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে মাদ্রাসাটি অবস্থিত ছিল। পূর্ব আর দক্ষিণ দিকে তাকালে দেখা যায় কর্ণফুলি নদী এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে। পশ্চিম আর উত্তর দিকে তাকালে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড় যা সবুজে সবুজে একাকার হয়ে দূর আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে।
এ মাদ্রাসাটি ছিল সাবেকী মাদ্রাসা। কিন্তু বছর পার না হতেই এক সরকারি নির্দেশে এই সাবেকী মাদ্রাসা রাতারাতি খোল বদলিয়ে হয়ে গেল নিউ স্কীম মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসারই বর্তমান নাম চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। স্কীম মাদ্রাসা হওয়ায় পাঠ্যতালিকায় আমূল পরিবর্তন ঘটল। সম্পূর্ণ বাদ পড়লো ফার্সী। শরিয়াৎ বা দীনয়াৎ অংশও ছাঁটাই হলো। আর সেসব জায়গায় স্থান পেলো কিছু কিছু ইংরেজি, বাংলা, অংক আর হাল আমলের ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের ছিটে ফোঁটা। মাদ্রাসার সাবেকী পাঠ্যতালিকার সঙ্গে এ যুগের হাই্ স্কুলের পাঠ্যতালিকার সমন্বয় ঘটিয়ে তৈরী করা হলো নতুন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা। মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতরে আধুনিক শিক্ষার কিছুটা আলো-হাওয়া ঢোকার পথ করে দেয়াই ছিল এ নতুন শিক্ষা রীতির উদ্দেশ্য।
নিউ স্কিম মাদ্রাসাতে বাংলা খুব বেশি পড়ানো হত না। তবে অনেকগুলো মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা মাদ্রাসায় নেয়া হত আর কেনা হত লাইব্রেরির জন্য দেদার বাংলা বই। ফলে পত্রপত্রিকা ও বাইরের বই পড়ার বড় একটি সুযোগ তিনি সেখানে পেয়েছিলেন। আর এ সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার তিনি করেছিলেন। অল্প বয়স থেকেই পড়ার ক্ষুধা বিশেষ করে বাংলা বই পড়ার ক্ষুধা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। তবে বাবার সঙ্গে যতদিন ছিলেন ততদিন বাংলা বই ও মাসিক লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হত। বাবার অবস্থা বিশেষ স্বচ্ছল ছিল না বলে তাঁকে বেশিদিন বাবার সঙ্গে থাকতে হয়নি। পঞ্চম শ্রেণী থেকেই তিনি জায়গীর থাকা শুরু করেন। জায়গীর মানে থাকা-খাওয়া ফ্রি বিনিময়ে গৃহকর্তার দু’একটি বংশধরকে আমপারা বা অ আ পড়াতে হতো। আর হয়তো মাঝে মাঝে হাঁস-মুরগি জবাই করে দিতে হতো। সেসময় জায়গীর প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
চন্দনপুরার এক বাড়িতে তিনি প্রথমে জায়গীর ছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর চাট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ির ‘মীর এহায়া’ বাড়িতে জায়গীর থাকেন। তাঁর বাবা সঙ্গে করে পৌঁছে দিলেন কাজীর দেউড়ির ‘কাজী বাড়ি’ যার পুরোনো নাম ‘মীর এহায়া বাড়ি’। পরবর্তীতে তিনি এ মহল্লারই স্থায়ী বাসিন্দা হন।
বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের যখন আবির্ভাব হয় তখন আবুল ফজল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তিনি রুদ্ধ নিশ্বাসে পড়লেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘হেনা’, সওগাতে প্রকাশিত তাঁর ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ আর মোসলেম ভারতে প্রকাশিত ‘বাঁধন হারা’ লেখাগুলো। এক একটা লেখা কতবার যে পড়েছেন তার কোন হিসেবে নেই।
১৯২২ সালে তিনি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই বের হল নজরুলের ‘ব্যথার দান’ ও ‘অগ্নিবীণা’। তিনি তখন জায়গীর থাকেন, হাতে তেমন কোন টাকা-পয়সা নেই। তবুও অর্ডার দিয়ে কলকাতা থেকে পার্সেলেই বই দু’টা আনালেন। যেদিন পার্সেল এসে পৌঁছল সেদিন তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। পার্সেলটি হাতে নিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল- তিনি সব থেকে আলাদা, তিনি বিশিষ্ট। তাঁর সঙ্গীরা কেউ কখনও অমন পার্সেল আনেননি। কলকাতা থেকে ভি.পি.পি.-তে অমনভাবে বই আনাবার খেয়াল বা সাহস সেদিন কয়জনের ছিল?
১৯২২ সালে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে ফাইনাল দেওয়ার অনুমতি পেয়েছেন। তখন ষোল বছরের কম হলে কেউ ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে পারতেন না, আর আঠারো বছরের বেশি হলে বৃত্তি পেতেন না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে দেখা গেল তাঁর বয়স ষোল বছরের অনেক কম। এ বিভ্রাটের কারণ হলো- যাঁর সঙ্গে তিনি মাদ্রাসায় প্রথম ভর্তি হতে যান, তিনি তাঁর বাবা অর্থ্যাৎ আবুল ফজলের বাবার সাথে কথা না বলে ভর্তির ফরমে তাঁর ইচ্ছা মতোই আবুল ফজলের জন্মের তারিখ আন্দাজি বসিয়ে দিয়েছিলেন। তার ফলেই এ অঘটন ঘটে। টেস্ট পরীক্ষায় পাস করেছেন অথচ পরীক্ষা দিতে পারবেন না। দেখা দিল সংকট। শিক্ষকরাও উদ্বিগ্ন হলেন। আবুল ফজলের বয়স ষোল বা তার চেয়ে দু’এক মাস বেশি এ মর্মে একটা এফিডেভিট দিতে অধ্যক্ষ খান বাহাদুর মুসা সাহেব তাঁর বাবাকে অনুরোধ জানালেন। তাঁর বাবা একটি বইয়ের পাতায় তাঁর সব ভাই বোনের জন্ম তারিখ লিখে রেখেছিলেন। তিনি সেখান থেকে আবুল ফজলের জন্মতারিখটি দেখে তা জানিয়ে দিলেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে। দেখা গেল সে হিসেবে তাঁর বয়স দাঁড়ায় উনিশ। ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার সময় স্বভাবতই আরো কয়েক মাস যাবে বেড়ে।
এ সমস্যার সমাধান করতে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা তাঁর বাবাকে অনুরোধ করলেন। তাঁর বয়স আরো কমিয়ে এফিডেভিট দিতে। কারণ ভবিষ্যতে তাঁর চাকরি পেতে অসুবিধা হবে আর ভাল ফলাফল করলে স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না। তাঁর বাবা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হলেন এবং গম্ভীর কণ্ঠে তা করতে শুধু অস্বীকার করলেন না, পরিষ্কার জানালেন, ‘ছেলের চাকরি বা বৃত্তির জন্য আমি মিথ্যা বলতে পারব না।’
তাঁর শিক্ষকদের আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো। খুব কম ছাত্রই সেবার প্রথম বিভাগে পাস করলেন। ফলে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেও তিনি বৃত্তি পাওয়ার কোটায় স্থান পেলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট বয়স সীমা পার হয়ে যাওয়ায় তা আর পেলেন না তিনি।
১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর তাঁর চট্টগ্রামে ছাত্র জীবনেরও ইতি ঘটে। ম্যাট্রিক মানে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট ও সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের হাই মাদ্রাসা পরীক্ষা। তখন চট্টগ্রামে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট ক্লাস খোলা হয়নি। তাই হাই মাদ্রাসা পাশ করার পর চট্টগ্রামের ছাত্রদের ঢাকায় যেতে হত। ১৯২৫ সালে ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ইন্টামিডিয়েটের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটল। বয়স বেশি হওয়ার কারণে এবারও বৃত্তি পাওয়ার হকদার হয়েও তা পেলেন না তিনি। চাকরির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল । বি.টি. পাস করে যখন বের হলেন তখন বয়স পঁচিশ পেরিয়ে গেছে। তাই বি.টি. পাস করার পর যে চাকরি পাওয়ার কথা তা তিনি পাননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে বি.এ. পাস করেন। এরপর বি.এল. পড়ে উকিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বি.এল. পড়তে তেমন অসুবিধা নেই, দিনের বেলায় ছোটখাটো একটা চাকরি করে সন্ধ্যায় ল’ ক্লাসে হাজিরা দিলেই হলো। তাই ল’ পড়ার ইচ্ছা তাঁর মনে প্রায় দুর্দমনীয় হয়ে উঠল।
ভয়ে ভয়ে তাঁর সংকল্পের কথা বাবাকে জানালেন। তিনি শুনে খুবই রেগে গেলেন। প্রায় মারমুখো হয়ে বললেন: ‘এ জন্যেই গোড়া থেকে আমি তোমার ইংরেজি পড়ার বিরোধী ছিলাম, সারাজীবন মিথ্যার ব্যবসা করার জন্য তোমার পেছনে আমি এতগুলো টাকা খরচ করিনি।’ তাঁর মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল- উকিল হলেই মিথ্যা বলতে হয়। আবুল ফজলকে চুপ থাকতে দেখে পুনরায় তিনি বললেন: ‘নিজের মক্কেলকে চোর-ডাকাত খুনি জেনেও যে উকিল শুধু টাকার লোভে তাকে সমর্থন করে থাকে, আমি তোমাকে তেমন উকিল বানাতে পারব না’। কিছুটা শান্ত হওয়ার পর বললেন: ‘আমি চাই তুমি মাস্টার হও, শিক্ষার চেয়ে ভালো পেশা আর নেই’।
কিন্তু আইন পড়ার অদম্য আগ্রহের কারণে বাবার কথা কানে তুললেন না তিনি। বাড়ি গিয়ে তাঁর মার কাছ থেকে সমান্য কিছু টাকা-পয়সা নিলেন এবং খোরাকির কিছু ধান বিক্রি করে উকিল হওয়ার আশায় একদিন গোপনে কলকাতার ট্রেনে চেপে বসলেন। তাঁর ধারণা ছিল একমাত্র পুত্রের জেদের কাছে তাঁর বাবা নিশ্চয়ই নতি স্বীকার করবেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি নোয়ালেন না। তিনি তাঁর কোন খোঁজ-খবর নিলেন না। তাঁর দুরবস্থার কথা জানিয়ে মাফ চেয়ে, অনুনয় বিনয় করে অনেক চিঠি লিখলেন আবুল ফজল। কিন্তু বাবার কাছ থেকে কোন উত্তরই পেলেন না। প্রায় সাত আট মাসের মতো তিনি ল’ কলেজে পড়াশুনা করেন। এ কয়মাস এখানে ওখানে চাকরি করে, এর ওর বাসায় থেকে, জায়গীর আর টিউশনি করে কোন রকমে কাটালেন। এসময় তিনি সওগাত অফিসে চাকরি নেন। হঠাৎ একদিন তিনি খবর পেলেন তাঁর বাবা খুব অসুস্থ। খবর পেয়ে তাঁকে দেখার জন্য তিনি বাড়িতে এলেন। বাবার পাশে দাঁড়াতেই রোগশয্যা থেকে তিনি বললেন- ‘ওকালতি পড়ো না। আমি চাই তুমি শিক্ষক হও, এর চেয়ে ভালো পেশা আর নেই’। এবার আবুল ফজল নোয়ালেন। ল’ পড়ার সংকল্প ছেড়ে দিলেন চিরকালের জন্য।
একটা বছর নষ্ট হওয়ার পর বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী শিক্ষক হওয়ার সংকল্প করলেন তিনি। পাকা শিক্ষক হওয়ার জন্য বি.টি. ডিগ্রি অপরিহার্য। তাই ১৯২৯ সালে বি.টি. পড়ার জন্য ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯২৯ সালেই তাঁর বাবা মারা গেলেন। বি. টি. পাস করার পর ১৯৩১ সালে চট্টগ্রাম ফিরে এলেন।
চট্টগ্রাম আসার পর সেখানকার কলেজিয়েট স্কুলে দ্বিতীয় মৌলবী হিসেবে দিন কুড়ি চাকরি করেন। এরপর তিনি চাট্টগ্রাম সরকারী মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে দুই মাস চাকরি করেন। এরপর চাট্টগ্রাম কাজেম আলী বেসরকারী হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন।
১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম শহরের কাজী বাড়ির মেয়ে নূরজাহান বেগমের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে আবুল ফজলের বিয়ে হয়। কিন্তু নূরজাহান বেগম যখন সাত-আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। এরপর আবুল ফজল দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন এবং এই স্ত্রীও এক ছেলে রেখে মারা যান। এরপর তিনি তৃতীয়বার বিয়ে করেন এবং এই ঘরে দুই ছেলে ও এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই ঘরের এক ছেলে দেড় বছর বয়সে মারা যায়।
১৯৩৩ সালে আবুল ফজল খুলনা জেলা স্কুলে দ্বিতীয় পন্ডিতের পদে স্থায়ীভাবে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালে খুলনা ছেড়ে এসে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে সহকারী ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করেন। ১৯৪১ সালে কৃষ্ণনগর কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজে। এই কলেজের কলেজ গভর্নিং বডির নির্বাচনে তিনি দাঁড়ান এবং জয়ী হন। ১৯৪৩ সালের শেষের দিকে তাঁর মা মারা যান। দীর্ঘ সময় এই কলেজে চাকরি করার পর ১৯৫৯ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে এবং বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। আবুল ফজলের উল্লেখযোগ্য গল্পগুলো হলো- ‘রহস্যময়ী প্রকৃতি’, ‘প্রেম ও মৃত্যু’, ‘বিবর্তন’, ‘চোর’, ‘বিংশ শতাব্দী’ প্রভৃতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো- ‘রাঙ্গাপ্রভাত’, ‘চৌচির’, ‘জীবন পথের যাত্রী’, ‘মাটির পৃথিবী’, ‘বিচিত্র কথা’, ‘সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন’ প্রভৃতি।
তাঁর রচিত ‘চৌচির’, ‘মাটির পৃথিবী’ আর ‘বিচিত্র কথা’ নামের তিনটি বই ১৯৪০ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে, শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হওয়া সত্বেও তখন নিজের হাতে এক দীর্ঘপত্র তাঁকে লিখেছিলেন।
১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘রাঙ্গা প্রভাত’ বইটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পাঠ্য হয়। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত বিভিন্ন কলেজে যাঁরা বইটি পড়াতেন সেসব অধ্যাপকদের মধ্যে কেউ কেউ বইটির প্রশংসা করে তাঁকে চিঠি লিখেছেন।
১৯৬৩ সালের ৭ ডিসেম্বরের ‘আজাদ’-এ জনৈক লেখক ‘জাতীয় আদর্শের বিরোধিতা : রাঙ্গাপ্রভাত’-এ নামে এক প্রবন্ধ লিখে আবুল ফজলকে পাকিস্তান বিরোধী ও ইসলাম বিরোধী বলে উল্লেখ করেন।
বইটি ছয় বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ক্লাসে পড়ানো হয়। বইটিতে জাতীয় আদর্শ বা ধর্ম বিরোধী কোন কথা থাকলে তা ছাত্র ও অধ্যাপকদের চোখে পড়ত। ‘আজাদ’-এ প্রকাশিত লেখাটির উদ্দেশ্য ছিল গ্রন্থের লেখকের কিছু ক্ষতিসাধন করে কিঞ্চিৎ আত্মতৃপ্তি লাভ। ‘আজাদ’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধটির কর্তৃকা (কাটিংস) কে বা কারা প্রদেশের স্বরাষ্ট্র বিভাগ থেকে রাউয়ালপিন্ডি প্রেসিডেন্ট দফতর পর্যন্ত সর্বত্র পাঠিয়েছিলেন। ফলে পরের বছর থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকা থেকে বইটি বাদ পড়ে।
১৯৪৮-৪৯ সালে তিনি সংকলন করেছিলেন ‘সাহিত্য চয়নিকা’ নামে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর উপযোগী দুটি সাহিত্য বই। পাঠ্যবই হিসেবে ঐ দুটি বইও টেক্সট্ বুক কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল। তাঁর এ দু’টা সংকলন পাঠ্য বই হিসেবে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
১৯৪৯ সালে তিনি কোরান শরীফ ভালো করে বুঝে ইংরেজী অনুবাদের মাধ্যমে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ‘কোরানের বাণী’ নামক একটি বই প্রকাশ করেন। ডক্টর আবদুল্লা সোহরওয়ার্দীর ‘Sayings of Muhammed’ নামের বইটির সংকলিত ৫০০ হাদিস এবং অন্যান্য বই থেকে আরও ৫০০ হাদিস সংগ্রহ করে মোট ১০০০ হাদিস দিয়ে ‘হাদিসের বাণী’ নামে কোরানের বাণীর পরিপূরক হিসেবে আর একটি বই সংকলন করেন তিনি। ব্যাকরণের একটি বইও লিখেছেন তিনি।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলো। সামরিক শাসন জারির অনেক আগে ‘সমকাল’ নামক একটি মাসিক পত্রিকায় তিনি ‘সাহিত্যের সংকট’ নামে এক প্রবন্ধ লিখে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু লেখাটি প্রকাশিত হলো সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর। কিছুদিন পর দেখা গেলো সরকার সমকালের ঐ সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করেছে। কেন এবং কোন লেখার জন্য এই সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করা হলো ঘোষণায় তার কোন উল্লেখ নেই। তবে সবাই বুঝলো আবুল ফজলের লেখাটির কারণে এই সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। স্বয়ং সম্পাদকও তাঁকে তাই বলেছেন।
এভাবেই লেখালেখির মাধ্যমে তিনি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন এবং করেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ । ফলে তাঁকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু পিছপা হননি তিনি, বরং সদর্পে চালিয়ে গেছেন তাঁর লেখালেখি।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয়েছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কার, সমকাল পুরস্কার এবং সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি।
১৯৮৩ সালের মে মাসে আবুল ফজল মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: রেখাচিত্র, লেখক-আবুল ফজল, প্রকাশক-সিকদার আবুল বাশার, প্রকাশনী- গতিধারা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬
লেখক: মৌরী তানিয়া