জিয়া হায়দার যখন কলেজে পড়তেন তখন তাঁর বাবা হাকিমউদ্দিন শেখ বেঁকে বসলেন ছেলেকে আর পড়াবেন না। তিনি তাঁকে বললেন ‘বাড়ি ফিরে আস। জমি-জিরাত দেখাশোনা কর, ব্যবসা-বাণিজ্য কর। আর লেখাপড়া করতে হবে না।’ জিয়া হায়দারের মনটা ভেঙ্গে গেল। কারণ তিনি এই হায়দার বংশের প্রথম মেট্রিকুলেট। কত স্বপ্ন তাঁর। তিনি নিজে পড়াশুনা করবেন। ভাই-বোনদের পড়াশোনা করাবেন। কিন্তু বাবার এই সিদ্ধান্তে আকাশ ভেঙ্গে পড়ল তাঁর মাথায়। আর ঠিক এই সময়ই এগিয়ে এলেন তাঁর মা রহিমা খাতুন।
স্বামীর অজান্তে নিজের গলার দামি একখানা হার বিক্রি করে ছেলেকে দিলেন পড়াশুনা করার জন্য। এ নিয়ে পরে স্বামীর অনেক গালমন্দও শুনতে হয়েছে তাঁকে। মায়ের দেয়া হার বিক্রির টাকায় নতুন উদ্যোমে পড়াশুনা শুরু করলেন তিনি। মায়ের দেয়া হার বিক্রির সেই টাকা বৃথা যেতে দেননি জিয়া হায়দার কারণ তিনি এদেশের খ্যাতনামা নাট্য ব্যক্তিত্ব, কবি এবং শিক্ষক জিয়া হায়দার নামে পরিচিতি লাভ করেন।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জিয়া হায়দার বাংলাদেশের নাট্যকলাকে সৃজনশীলতা, প্রজ্ঞা ও সাধনায় সমৃদ্ধ করতে আমৃত্যু প্রয়াসী ছিলেন। পাঁচ খণ্ডে লিখেছেন থিয়েটারের কথা। নাটককে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে রেখেছেন বিশেষ অবদান।
জিয়া হায়দারের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ নভেম্বর পাবনা জেলার দোহারপাড়া গ্রামে। পারিবারিকভাবে জিয়া হায়দারদের পরিবার ছিল বিশাল ভূ-সম্পদের অধিকারী। তাঁর বাবা সেই জমি-জমা দেখতেন। আর ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। মূলত পরিবারটি ছিল সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার। তাঁর মা ছিলেন গৃহিণী। মাত্র ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই বিদ্যা নিয়েই তিনি শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, এমনকি ‘গোরা’র মতো কঠিন উপন্যাসও বানান করে করে পড়ে ফেলেছিলেন। হায়দার পরিবারের ছেলেদের কপালে ‘সাহিত্যিক’ অভিধা জোটার পেছনে এই মাতৃদেবীর ভূমিকা ছিল অনেকখানি। হাকিমউদ্দিন শেখ আর রহিমা খাতুনের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। জিয়া হায়দার সর্ব জ্যেষ্ঠ। ডাক নাম রউফ। বাড়ির ছোটরা তাঁকে আদর করে ‘সোনাভাই’ বলে ডাকতেন।
সেকালে অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে সন্তান হলে তাঁর কুষ্টি লিখে রাখা হত। কুষ্টি মানে যাতে সন্তানের ভূত-ভবিষ্যত লেখা থাকে। জন্মের ক্ষণের সাথে মিলিয়ে পণ্ডিত বা আলেমরা এই কুষ্টি লিখে দিতেন। কুষ্টির কথা কতটুকু ফলত তা নিয়ে মনে হয় লোকে খুব একটা মাথা ঘামাত না। একটা গোল করে গোঁটানো লম্বা কাগজে বাঁকা-বাঁকা প্রাচীন ধাঁচের হাতের লেখায় কী সব হাবিজাবি লেখা হত এবং সেটি বাড়ির দেয়ালের গায়ে লাগানো কাঠের তাকে যত্ন করে তুলে রাখা হত, আর এটিই হল সেই কুষ্টি। নাট্যজন জিয়া হায়দারের এরকম একটা কুষ্টি ছিল। তাতে কী লেখা ছিল তা জানা যায়নি।
জিয়া হায়দারের লেখাপড়ার শুরু তাঁর বাবারই প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাথমিক স্কুলে। নাম আরিফপুর প্রাথমিক স্কুল। এখানে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। পরে চলে যান পাবনা জেলা স্কুলে। সেখানে গিয়ে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি হন। এরপর গোপালচন্দ্র ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন জিয়া হায়দার।
একই বছর ভর্তি হন পাবনা এডওর্য়াড কলেজে। কলেজে ভর্তি হয়েই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনের সাথে। আগে থেকেই চেনাজানা ছিল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের লোকজনদের সাথে। নিজে যেহেতু গল্প-কবিতা লিখতেন, শহরে শিক্ষিত সমাজে তাঁর একটা পরিচিতি ছিল। ফলে পাকিস্তানি শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে একেবারে যুক্ত হয়ে গেলেন তিনি। এমনভাবেই মিশলেন যে কলেজ জীবনের তিনটি বছর মাটি করে দিলেন। অবশ্য এক বছর শারীরিক অসুস্থতায়ও ভুগেছেন। তবে এর জন্য রাজনীতিই একমাত্র কারণ না। সাহিত্যও বোধ হয় আরেকটা কারণ। জিয়া হায়দার তো তখন কবিতার খেচর।
পাবনা তখন শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির সমঝদার শহর। এ ছোট জেলা শহরটি তখন সাহিত্যের প্রতি খুবই আগ্রহী। উৎসাহী কিছু তরুণ কবিতাকর্মী ছিল এর নেপথ্যে। জিয়া হায়দার ভিড়ে গেলেন সেই দলে। তাঁর লেখা তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় হরহামেশাই ছাপা হচ্ছে। বাড়িতে গেলে নিজের ভাইদের এসব কবিতা পড়ে পড়ে শোনান। ছাপা অক্ষরে সোনাভাইয়ের নাম। ভাইদের বিস্ময় জাগে মনে। গর্ব হয় সোনাভাইয়ের জন্য।
এভাবে তিন বছর নষ্ট হওয়ায় বাবা হাকিমউদ্দিন শেখ বেঁকে বসলেন ছেলেকে আর পড়াবেন না। অবশেষে মা রহিমা খাতুনের হস্তক্ষেপে তিনি পড়াশুনা চালিয়ে যান এবং ১৯৫৬ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর জিয়া হায়দার ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৮ সালে তিনি সেখান থেকে বাংলায় অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। রাজশাহী অবস্থানকালে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে বেশ ভালভাবেই জড়িয়ে যান। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল-অস্থির রাজনীতি। দেশ হাঁটছে স্বাধীনতার পথে, ধীরে ধীরে। জিয়া হায়দার মাঝে মাঝেই যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তখন সত্যিকার অর্থেই সাহিত্যের তীর্থভূমি। কবি ও সাহিত্যিক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা নুরউল ইসলাম, কবি মযহারুল ইসলাম, অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক বদরুদ্দীন উমর, অধ্যাপক মশাররফ হোসেন, হাসান আজিজুল হক, আবদুল হাফিজ, আলী আনোয়ার সবাই মিলে যেন এক শিল্প-সাহিত্যের রাজত্ব তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকেই তখন ছোট কাগজ সম্পাদনা করেন। গল্প-কবিতা লেখার কারণে সকলেরই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন জিয়া হায়দার। এমন পরিবেশে নিজেকে নিয়োজিত করে রাখেন কবিতা লেখায়। ঢাকার অনেক পত্রিকাতেই তখন নিয়মিত কবিতা ছাপা হচ্ছে তাঁর। সারাদিন ঘোরাঘুরি, রাতভর আড্ডা, তর্ক-বিতর্ক, শেষ রাতে আস্তানায় ফেরা। সব কিছুতেই নিজেকে লীন করে দেন। আবার গোপনে বুনে তোলেন সাহিত্যের নিজস্ব এক ঠিকানাও।
এরপর মাস্টার্স ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬১ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তারপর কিছুদিন কাজ করেন তখনকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘চিত্রালি’-তে। মাস্টার্সের ফল বেরুবার আগেই অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যান তোলারাম কলেজে। যাবার সময় নিজের চাকরিটা দিয়ে যান ছোট ভাই রশীদ হায়দারকে। নিজের লেখালেখির জগত, চাকরি আর পরিবারের ছোট ভাই-বোনদের মানুষ করার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। এর মাঝে কিছুদিন কাজ করেন বাংলা একাডেমিতে। তারপরে পাকিস্তান টেলিভিশনে। টেলিভিশন ভবন তখন ছিল ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক ভবন)। ১৯৬৮ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। পরে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সার্টিফিকেট ইন শেক্সপিয়ার থিয়েটার’ ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে জিয়া হায়দার যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। সেখান থেকেই অবসর নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় এবং পরে এশিয়া ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা পৃথিবী চষে বেরিয়েছেন নাটকের প্রয়োজনে। বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বের নামি-দামি নাট্যজনদের সাথে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আজিজুর রহমান মল্লিকের পরামর্শে তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের এক জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ছিল ‘কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’ নামে এক কেন্দ্র। সেখানের ল্যাবরেটরিতে হাত বোমা, গ্রেনেড তৈরির প্রস্তুতি নেয়া হয়। ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ জনতার প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জিয়া হায়দারও সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই সভাতেই সভাপতি জনতার ইচ্ছায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সভা থেকে এক বিরাট মিছিল চট্টলার রাজপথ অতিক্রম করে। সেই সভা চলাকালেই চট্টগ্রাম বন্দরে ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর সময় বাঙালি জনতা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়ার খবর আসে।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করে। সেসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা সবাই একযোগে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্যাম্পাস ছেড়ে দেয়। চট্টগ্রাম শহরের তখন পতন হয়ে গেছে। জিয়া হায়দার ফিরে আসেন ঢাকায়। ঢাকা তখন অবরুদ্ধ। অবরুদ্ধ ঢাকাতেই হায়দার পরিবারের ছেলেরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। রশীদ হায়দার তখন খিলগাঁওয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু কাজ হত। যদিও ছোট ভাই জাহিদ হায়দার সরাসরি যুদ্ধ করার জন্য ভারত গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি পরে আবার ফিরে আসেন।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে তিনি মা আর ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে আসেন । কারণ হায়দার পরিবারে যতটা বিত্ত ছিল, ততটা বিদ্যা ছিল না। তাই তাঁর ইচ্ছে সবাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। আজ যারা হায়দার পরিবারকে জানেন, চিনেন তাঁরা একথা মানবেন যে এর মূল কাণ্ডারি ছিলেন জিয়া হায়দার। মানুষটি একের পর এক নিজের পরিবার, নাটক, বিশ্ববিদ্যালয়, দেশ নিয়ে গুছিয়ে কাজ করে গেছেন। সেসব ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। কিন্তু জিয়া হায়দারের নিজের জীবনটা ততোটা গোছানো ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি মেয়েকে ভালবাসতেন। সবাই জানত তাঁদের বিয়ে হবে কিন্তু হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গেলেন, সেখানে এক সহপাঠীর সাথে জড়িয়ে পড়েন আবেগময় সম্পর্কে। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই ‘মেম’-এর সাথে যোগাযোগ ও গভীর টান থাকলেও এক ছাদের নীচে বাস করা হয়নি তাঁদের। মা, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সবার অনুরোধে-উপরোধে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন এক অধ্যাপিকাকে, ১৯৭৫ সালের ২৩ জুন। অধ্যাপিকা ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। কিন্তু সে বিয়েও টেকেনি। কারণ অধ্যাপিকা ছিলেন সিজনাল মানসিক রোগী। সেটা বিয়ের পর ধরা পরে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না জিয়া হায়দারের। চিকিৎসার সব রকম চেষ্টাই করেন তিনি। অবশেষে সেই সংসারও ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে বিয়ের সেই তারিখ আর নিজের বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়ে রসিকতা করে বলতেন, ‘১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল।’
এই বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়েই সারাটা জীবন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি আর সেখানকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে কাটিয়ে দিলেন জিয়া হায়দার। খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া ঢাকায় আসতেনও না। দূর থেকে আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতা করার যথাসম্ভব চেষ্টা করতেন। চট্টগ্রামের ব্যস্ততম এলাকার লালখানবাজার মোড়ের ইস্পাহানি বিল্ডিংয়ে শুধু রাশি রাশি বই আর তার ব্যক্তিগত অজস্র অসংখ্য স্মৃতিভার অবলম্বন করেই বেঁচে ছিলেন জিয়া হায়দার। এটা সন্ন্যাস নয়। নয় বুদ্ধের মতো গৃহত্যাগও। কিন্তু নিঃসঙ্গ। বিপুল এক শূন্যতা নিয়েই সমস্ত জীবন কেটেছে তাঁর।
এই অবস্থাতেই শেষ জীবনে এসে আক্রান্ত হলেন মরণব্যাধি ক্যান্সারে। অনেক কাজে হাত দিয়েছিলেন। আর কিছুটা সময়ও প্রয়োজন ছিল জিয়া হায়দারের। অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য, খুব বাঁচার আকুতি ছিল তাঁর। ভাইদের বলতেন সেকথা। কিন্তু ডাক্তার তো সব জানেন, তারা খুব অল্প সময়ই বেঁধে দিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যদের। ২০০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নাট্যজন জিয়া হায়দার। তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় জন্মস্থান পাবনার দোহারপাড়ার আরিফপুর গোরস্থানে।
জিয়া হায়দারের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-একতারাতে কান্না (১৯৬৩), কৌটার ইচ্ছেগুলো (১৯৬৪), দূর থেকে দেখা (১৯৭৭), আমার পলাতক ছায়া (১৯৮২), লোকটি ও তার পেছনের মানুষেরা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভালবাসা ভালবাসা। নাটকঃ শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ (১৯৭০), এলেবেলে, সাদা গোলাপে আগুন ও পংকজ বিভাস (১৯৮২)। রূপান্তরিত নাটকঃ প্রজাপতি নির্বন্ধ, তাইরে নাইরে না, উন্মাদ সাক্ষাৎকার, মুক্তি মুক্তি। অনুদিত নাটকঃ দ্বার রুদ্ধ, ডক্টর ফস্টাস, এ্যান্টিগানে। প্রবন্ধঃ নাট্য বিষয়ক নিবন্ধ, থিয়েটারের কথা (১ম-৫ম খন্ড), বাংলাদেশের থিয়েটার ও অন্যান্য রচনা, স্ট্যানিসলাভস্কি ও তার অভিনয় তত্ত্ব, নাট্যকলার বিভিন্ন ইজম ও এপিক থিয়েটার, বিশ্বনাটক।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: জিয়া হায়দারের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ নভেম্বর পাবনা জেলার দোহারপাড়া গ্রামে।
বাবা-মা: বাবা হাকিমউদ্দিন শেখ। মা রহিমা খাতুন।
পড়াশুনা: জিয়া হায়দারের লেখাপড়ার শুরু তাঁর বাবারই প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাথমিক স্কুলে। নাম আরিফপুর প্রাথমিক স্কুল। এখানে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। পরে চলে যান পাবনা জেলা স্কুলে। সেখানে গিয়ে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি হন। এরপর গোপালচন্দ্র ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন জিয়া হায়দার। ১৯৫৬ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর জিয়া হায়দার ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৮ সালে তিনি সেখান থেকে বাংলায় অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। পরে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সার্টিফিকেট ইন শেক্সপিয়ার থিয়েটার’ ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন: ১৯৬১ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর কিছুদিন কাজ করেন তখনকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘চিত্রালি’-তে। মাস্টার্সের ফল বেরুবার আগেই অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যান তোলারাম কলেজে। যাবার সময় নিজের চাকরিটা দিয়ে যান ছোট ভাই রশীদ হায়দারকে। নিজের লেখালেখির জগত, চাকরি আর পরিবারের ছোট ভাই-বোনদের মানুষ করার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। এর মাঝে কিছুদিন কাজ করেন বাংলা একাডেমিতে। তারপরে পাকিস্তান টেলিভিশনে। টেলিভিশন ভবন তখন ছিল ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক ভবন)। ১৯৬৮ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। পরে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সার্টিফিকেট ইন শেক্সপিয়ার থিয়েটার’ ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে জিয়া হায়দার যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। সেখান থেকেই অবসর নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় এবং পরে এশিয়া ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা পৃথিবী চষে বেরিয়েছেন নাটকের প্রয়োজনে। বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বের নামি-দামি নাট্যজনদের সাথে।
বিয়ে: ১৯৭৫ সালের ২৩ জুন এক অধ্যাপিকাকে বিয়ে করেন। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। কারণ অধ্যাপিকা ছিলেন সিজনাল মানসিক রোগী। সেটা বিয়ের পর ধরা পরে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না জিয়া হায়দারের। চিকিৎসার সব রকম চেষ্টাই করেন তিনি। অবশেষে সেই সংসার ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে বিয়ের সেই তারিখ আর নিজের বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়ে রসিকতা করে বলতেন, ‘১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল।’
মৃত্যু: শেষ জীবনে এসে আক্রান্ত হন মরণব্যাধি ক্যান্সারে। ২০০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নাট্যজন জিয়া হায়দার। তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় জন্মস্থান পাবনার দোহারপাড়ার আরিফপুর গোরস্থানে।
তথ্যসূত্র: এই লেখাটি তৈরির জন্য ফেব্রুয়ারী, ২০১০-এ জিয়া হায়দারের ছোট ভাই সাহিত্যিক রশীদ হায়দারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এছাড়াও বাংলা একাডেমির চরিতাভিধান ও রশীদ হায়দার রচিত ‘জিয়া হায়দার: আমাদের সোনাভাই’ থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়