স্কুলের নাম রাজা গিরিশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। সিলেটের এই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র দিলওয়ার খান। তাঁর শিক্ষক মুসলিম মিয়া সাহেব ছাত্রছাত্রীদেরকে একদিন বাংলার কৃষক নিয়ে একটি লেখা জমা দিতে বললেন। সবাই টেবিলে লেখা জমা দিলো। শিক্ষক একে একে লেখাগুলো দেখলেন। সব শেষে একটা খাতা হাতে নিয়ে নিবিষ্ট মনে লেখাটি পড়লেন। কৃষকের ফসল তোলার সোনালি হাসি, উগার (ধান সংরক্ষণের বস্তু) ভরা ধান, বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার করুন কান্না, নবান্ন উৎসব, কৃষকের স্বপ্ন, ক্ষেতের আল, লাঙ্গল-কাঁচি, গোয়াল ঘর, লাল দামা, দুধের গাভী আর বাছুরের ইড়িং-বিড়িং নাচ, এক ভোরে কৃষক উঠে দেখে লাল দামাটি গোয়াল ঘরে চার পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। দামাটির নিথর দেহ দেখে কৃষকের ছেলের কান্না আর থামে না -সব মিলিয়ে গ্রাম-বাংলার কৃষকের আসল রূপ উঠে এসেছে বাংলার কৃষক বিষয়ক লেখাটিতে। প্রবন্ধটি পড়া শেষে শিক্ষক দেখলেন নীচে লেখা মৃণাল কান্তি চক্রবর্তী।
শব্দের নিখুঁত গাথুনি আর আবেগ-বাস্তবতায় শিক্ষকের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। সুযোগ থাকলে লেখাটি জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে অন্তর্ভূক্ত করে দিতেন জিসি হাই স্কুলের শিক্ষক মুসলিম মিয়া। তিনি ইশারা করে মৃণালকে দাঁড়াতে বললেন। মৃণাল দাঁড়িয়ে বললো স্যার লেখাটি আমার নয়, এটা দিলু লিখেছে। দিলু অর্থাৎ দিলওয়ার খানকে কাছে টেনে নিলেন স্যার এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করলেন। স্যার মুসলিম মিয়া সেদিন হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন দিলওয়ার বড় হয়ে অনেক খ্যাতিমান লেখক হবে।
এরপরের ঘটনা। দিলওয়ার খান তখন ৫১-৫২ শিক্ষাবর্ষের এস.এস.সি. পরীক্ষার্থী। তখন মারফি রেডিও খুব কম সংখ্যক মানুষের ঘরে থাকলেও দিলওয়ারের ঘরে মারফি রেডিও ছিলো। তখন বিবিসি’র অনুষ্ঠানগুলো ছিলো খুব জনপ্রিয়। একদিন বিবিসি থেকে রচনা প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হল। বিষয়-‘পাকিস্তানের কমনওয়েলথে থাকা উচিত কিনা?’ তাঁরই প্রিয় শিক্ষক দীপেন্দ্র চক্রবর্তী তাঁকে ডেকে এতে অংশগ্রহণের পরামর্শ দিলেন। দিলওয়ার একটা লেখা দাঁড় করে শিক্ষকের কাছে দিলেন। এরপর শিক্ষক নিজ হাতে লেখাটি পাঠিয়ে দিলেন বিবিসি বরাবরে। বিবিসি একদিন তাদের বিষয়ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করল। সব প্রতিযোগীকে ছাড়িয়ে দিলওয়ার খান প্রথম পুরষ্কার হিসেবে একটি মারফি রেডিও জিতে নিলেন। ওই দিন ছাত্রের বিজয়ে দীপেন্দ্র চক্রবর্তী স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি শুধু মারফি রেডিও জিতেননি। কিশোর বয়সেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আর পত্রিকায় কবিতা ছেপে অসংখ্যবার প্রাইজবন্ড জিতেছেন দিলওয়ার খান।
মুসলিম মিয়া এবং দীপেন্দ্র চক্রবর্তী শিক্ষকের অতি প্রিয় ছাত্র দিলওয়ার খান পরবর্তীতে বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। তবে গণমানুষের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ এই কবি জনমনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া খান উপাধি বাদ দেন এবং গণমানুষের কবি দিলওয়ার নামে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন।
সিলেট জেলার সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে ভার্থখলা গ্রামে একটি রক্ষণশীল পরিবারে ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারী কবি দিলওয়ার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মৌলভী মোহাম্মদ হাসান খান আর মা রহিমুন্নেছা। দিলওয়ার চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে সপ্তম। তাঁর প্রিয় নদী সুরমার সাথে খেলা করে আর জন্মস্থানের অবাধ প্রকৃতির দৃশ্য অবলোকন করে তাঁর শৈশবের দিনগুলি কেটেছে।
দিলওয়ারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় সিলেটের দক্ষিণসুরমাস্থ ঝালপাড়া পাঠশালায় ৷ সিলেটের উত্তরসুরমাস্থ রাজা জি.সি. হাইস্কুল থেকে ১৯৫২ সালে তিনি প্রবেশিকা পাশ করেন ৷ সিলেট এম. সি. কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে তিনি পাশ করেন ইন্টারমিডিয়েট। এরপর শারীরিক অসুস্থতা বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর শিক্ষা জীবনে। এখানেই ইতি ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। এরপর অবতীর্ণ হন জীবনযুদ্ধের মাঠে। শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। তবে ভেতরের কবিসুলভ উতলা মন স্থির হয়নি সেখানে। দুই মাস ছিলো তাঁর শিক্ষকতা জীবনের বয়স। এরপর পাড়ি জমান ঢাকায়। শব্দের কারিগর শব্দ নিয়ে খেলা করার লোভে জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৭ সালে তিনি দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন।
সেখানে দু’বছর কাজ করার পর ফিরে আসেন সিলেটে। দেশ তখন উন্মাতাল, বাঙালীরা জাগতে শুরু করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সিলেটে এর পথ দেখানোর দায় তুলে নেন কবি নিজের কাঁধে। গড়ে তোলেন ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’। উনসত্তরের উন্মাতাল হাওয়ায় এই সংগঠন সিলেটে চেতনার রসদ যুগিয়েছিলো। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে এই সংগঠন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে দৈনিক ‘গণকন্ঠ’-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ৷ ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকাস্থ রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘উদয়ন’ পত্রিকার সিনিয়র অনুবাদক হিসেবে প্রায় দুই মাসের মতো কাজ করেন ৷ এরপর তিনি স্বেচ্ছায় সেই চাকুরীটি ছেড়ে দেন। কারণ ঢাকায় তাঁর মন টেকেনি। আবার ফিরে আসেন সুরমার তীরে। এসময় তিনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন। গতি পায় তাঁর লেখালেখির। ঢাকা-সিলেটের পত্র-পত্রিকায় সমান তালে তাঁর লেখা প্রকাশ হতে থাকে।
তাঁর কলমটা জোর গতিতে চলতে থাকলেও দেহটাতে কবি সেভাবে গতি পাননি কখনো। জীবনের সোনালী সময় থেকে নানা জটিল রোগ তাঁর সহচর। সেই সহচরই তাঁকে জীবন সহচারীর সন্ধান এনে দেয়। চিকিৎসার সূত্রে পরিচয় হয় উর্দুভাষী সিনিয়ন স্টাফ নার্স আনিসা খাতুনের সাথে। পরিচয় থেকে হয় প্রেম। কিন্তু প্রেমের শুরু থেকেই তাঁদের সামনে এসেছে অনেক বাধা। কারণ দিলওয়ারের পরিবারে আনিসা গ্রহণযোগ্য ছিলেন না, প্রথমত আনিসার পেশাগত কারণ এবং দ্বিতীয়ত আনিসা বহিরাগত বলে ৷ কিন্তু তাঁরা সব বাধা অতিক্রম করে ১৯৬০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ৷ বিয়ের পর আনিসা খাতুন হয়ে গেলেন আনিসা দিলওয়ার ৷
মানবতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ এক মহিয়সী মহিলা ছিলেন আনিসা দিলওয়ার ৷ আর্ত মানুষের সেবা করা শুধু যে তাঁর পেশা ছিল, তা নয় ৷ এটা তাঁর নেশাও ছিল ৷ তাঁর স্নেহ কোমল পরশে মুমূর্ষু রোগীও নতুন প্রাণ ফিরে পেত ৷ হাসপাতালের সেবিকা সংসার জীবনেও সেবিকার ব্রত নিয়েছিলেন ৷ তাঁর সেবা শুশ্রূষার গুণে দিলওয়ারের কাব্য প্রতিভা বিকাশ লাভ করে ৷ তাছাড়া তিনি ছিলেন দিলওয়ারের সৃষ্টি কর্মের অফুরন্ত প্রেরণার উত্স-তাঁর কবি জীবনের পরিপূরক সত্তা ৷ আনিসা অবাঙ্গালী ছিলেন ৷ কিন্তু বলে না দিলে তা বুঝার উপায় ছিলনা ৷ চলনে বলনে এবং মনে প্রাণে তিনি ছিলেন নিখুঁত বাঙ্গালিনী ৷ বাংলা লেখার চমত্কার হাত ছিল তাঁর ৷
আনিসা ও কবি দিলওয়ারের ঘরে জন্ম নেয় ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা ৷ ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড় ছেলে শাহীন ইবনে দিলওয়ার। এরপর জন্ম নেন কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। তারপর নাহিদ বিনতে দিলওয়ার, রোজিনা বিনতে দিলওয়ার, সাজিয়া বিনতে দিলওয়ার। সবার ছোট কামরান ইবনে দিলওয়ার ।
১৯৭৫ সালে দূরারোগ্য ব্যাধি টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে আনিসা দিলওয়ার ইহলোক ত্যাগ করেন ৷ আনিসার মৃত্যুর পর তাঁর সংসারের হাল ধরার জন্যে আসেন আনিসারই সহোদরা ওয়ারিসা খাতুন ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দূতে অনার্সের ছাত্রী ওয়ারিসা খাতুন ১৯৭৫ সালেই কবির সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে তাঁর মরহুমা বোনের সন্তানদের দেখার দায়িত্ব নেন ৷ ওয়ারিসা ও কবি দিলওয়ারের ঘরে জন্ম নেয় এক মেয়ে ও দুই ছেলে ৷ মেয়ে নওশাবা বিনতে দিলওয়ার শৈশবেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৷ দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ওয়ারিসা খাতুনও কবিকে ছেড়ে ইহলোক ত্যাগ করেন ২০০৩ সালে ৷
১৯৪৯-৫০ সালের দিকে কবি দিলওয়ারের প্রথম কবিতা তৎকালীন সাপ্তাহিক যুগভেরীতে প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম- ‘সাইফুল্লাহ হে নজরুল’। কবিতাটি হারিয়ে গেছে। এরপর লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, গান, ছড়া। কিন্তু সবগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। এপর্যন্ত যে বইগুলি প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি হলো- জিজ্ঞাসা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৫৩), ঐক্যতান (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৬৪), পুবাল হাওয়া (গানের বই, ১৯৬৫), উদ্ভিন্ন উলস্নাস (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৬৯), বাংলা তোমার আমার (গানের বই, ১৯৭২), ফেসিং দি মিউজিক (ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৫), স্বনিষ্ঠ সনেট (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৭), রক্তে আমর অনাদি অস্থি (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮১), বাংলাদেশ জন্ম না নিলে (প্রবন্ধগ্রন্থ, ১৯৮৫), নির্বাচিত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮৭), দিলওয়ারের শত ছড়া (ছড়ার বই, ১৯৮৯), দিলওয়ারের একুশের কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), ছাড়ায় অ আ ক খ (ছড়ার বই, ১৯৯৪), দিলওয়ারের রচনাসমগ্র ১ম খ- (১৯৯৯), দিলওয়ার-এর রচনা সমগ্র ২য় খ- (২০০০), ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ডাকে (ভ্রমণ, ২০০১) ৷
শুধু বাংলাদেশেই নয় কলকাতার পত্রিকাগুলোতেও কবি দিলওয়ারের লিখা নিয়মিত ছাপা হয়েছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘শিশুমেলা’-য় অনেক বছর আগে তাঁর ছড়া ছাপা হয়। সত্যজিত রায় সম্পাদিত পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এ তিনি শিশুদের জন্য ছোট্ট একটি মেয়েকে নিয়ে লিখেছেন মজার ছড়া। দেবসাহিত্য কুঠির থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সুখতারা’-য় তাঁর ছড়া ছাপা হয়। ‘সুখতারা’-য় লেখা ছাপানো অনেকটা কঠিন ছিলো। কারণ তারা শংকর বন্দোপাধ্যায়, বনফুলের মতো ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত জুরি বোর্ড থেকে ছাড় পাওয়ার পরে লেখা প্রকাশিত হতো। এসব মানদন্ড অতিক্রম করে ‘সাদেক-সুধীন যাচ্ছিলো পথ দিয়ে’ দিলওয়ারের রচিত এ রকম অনেক ছড়া ও কবিতা নিয়মিত ছাপা হয়েছে ‘সুখতারা’-য়। দিলওয়ার কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি একজন শক্তিশালী ছড়াকার। ছড়ার সম্রাটও বলা যায়। তিনি শিশুদের উপযোগী করে লিখেছেন শত ছড়া। স্বরে-অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত প্রতিটি বাংলা বর্ণমালা দিয়ে ছড়া লিখেছেন তিনি।
১৯৬০ সালে তাঁর লেখা একটি গান দিয়ে সিলেট রেডিও স্টেশনের উদ্বোধন করা হয় ৷ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোং লি. কবির ৪টি গান দিয়ে একটি ডিস্ক বাজারে ছাড়ে ৷ গানগুলো হলো- মুর্শিদ আমি খুঁজবো না গো, তুমি রহমতের নদীয়া, মন আমার কেমন করে, ও নদীর ঘাটে জল আনিতে গিয়া ৷ তাঁর একাধিক গণসঙ্গীত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছিল। সেগুলি হলো- ‘মা আমার গলা ধরে বলেছে’, ‘বলো বুলবুলি কি কাকের খাঁচায়’, ‘আয়রে চাষী মজুর কুলি’, ‘চলছে মিছিল চলবে মিছিল’ প্রভৃতি ৷ ৬৩-৬৪ সালের দিকে সিলেটের জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ সমিতির জন্য সঙ্গীত লিখে দেন কবি দিলওয়ার।
দিলওয়ারের কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন দেশের অনেক খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক। দেশের অতি পরিচিত প্রতিভাবান কবি নুরুল হুদা বলেন, তিনি যখন চট্টগ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন তখন দিলওয়ারের কবিতা পড়ে নিজেকে একজন কবি হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হন। আরেক শক্তিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ। নিজেই বলেছেন, দিলু ভাই যদি আমাকে লেখা পরিবর্তনের কথা না বলতেন, তাহলে হয়তো আমার কাছ থেকে ‘হুলিয়া’ কবিতা বেরিয়ে আসতোনা। সাবেক সচিব ও কবি মোফাজ্জল করিম বলেছেন, কবি দিলওয়ারের সাথে যদি দেখা না হতো, তাহলে হয়তো আমি কবি হয়ে উঠতাম না, আমার কলম থেকে কবিতা বেরিয়ে আসতো না।
কবি দিলওয়ার ধার্মিক হলেও ধর্মীয় গোড়ামি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। সেজন্যই হয়তো তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ কর্তৃক তাঁকে দেওয়া ‘কেমুসাস’ পদক অতি বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেন। তিনি একটি সূত্রে বিশ্বাসী সেটা হলো ‘জন্মগতভাবে মানুষের সন্তান, ধর্মগতভাবে মুসলিম এবং জাতিসত্ত্বায় বাঙ্গালি’।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮০ সালে কবি দিলওয়ারকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং পরে ১৯৮১ সালে ফেলোশিপ প্রদান করা হয় ৷ ১৯৮২ সালে কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয় কবিকে সংবর্ধনা দেয় ৷ ১৯৮৭ সালের ৯ আগস্ট যুক্তরাজ্যে লন্ডনস্থ সিলেট সেন্টারে তাঁকে যুক্তরাজ্য প্রবাসী কর্তৃক সংবর্ধনা দেয়া হয় ৷ স্বর্ণ শাপলা এবং তাম্রফলকে লিখিত শ্রদ্ধাঞ্জলিসহ দিলওয়ার-কে ১৯৭৮ সালের ৭ মার্চ সিলেটের সর্বস্তরের নাগরিক কর্তৃক সংবর্ধনা দেওয়া হয় ৷
ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ কর্তৃক তিনি ১৯৮৬ সালে আবুল মনসুর সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ৷ ১৯৯১ সালে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক ও সম্মাননা লাভ করেন দিলওয়ার ৷ এছাড়া রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার, সুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার এবং অন্যান্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি ৷ ২০০১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘ সংবর্ধনা প্রদান করে তাঁকে ৷ বাংলাদেশের পক্ষে কবি দিলওয়ার এবং ভারতের পক্ষে বরেণ্য আলোকচিত্রী রবিন সেনগুপ্তকে সংবর্ধনা দেয়া হয় ৷ মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, শিক্ষামন্ত্রী অনিল সরকার, অর্থমন্ত্রী বাদল চৌধুরী ও উভয় দেশের আরও বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ৷
২০০৮ সালে তাঁকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। ২০০৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যামাইকাস্থ তাজমহল হোটেলে সংবর্ধনা প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীবৃন্দ ৷ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. কবীর চৌধুরীর ভাষায়- ‘কবি দিলওয়ারের সাহিত্য কর্মের জাতীয়ভাবে যথার্থ মূল্যায়ন করা হলে তিনি দেশবাসীকে নোবেল প্রাইজ উপহার দিতে পারতেন ৷’ এছাড়া ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘কবি দিলওয়ার পরিষদ’ কবির সাহিত্য কর্ম প্রকাশনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে বেসরকারী উদ্যোগে ৷
সুরমার তীরে হেঁটে আর সুরমার বুকে সাঁতার কেটে বেড়ে উঠেছেন কবি দিলওয়ার। সুরমা তাঁর শৈশবের নদী। সুরমা তাঁর খেলার সাথী। খেলার সাথী সুরমার সাথে তিনি পেয়েছেন জন্মস্থান ভার্থখলা গ্রামের অবাধ প্রকৃতি। এই প্রকৃতিকে তিনি খুব ভালবাসেন। আর এই প্রকৃতিও যেনো তাঁর সাথে খেলা করে প্রাণ পায়। আর তাইতো শৈশবের সেই খেলার সাথী প্রিয় সুরমা আর জন্মস্থান ভার্থখলার অবাধ প্রকৃতিকে ছেড়ে রাজধানী ঢাকাতে থিতু হতে পারেননি তিনি। যদিও তাঁর সামনে সে সুযোগ অবারিতই ছিল। সুরমার টানে, শিকড়ের টানে তিনি স্থায়ী হন সুরমা পারে। তবে সুরমা আর ভার্থখলার প্রকৃতির কাছে থেকেই তিনি সারা দেশের কবি হয়ে উঠেছেন। পরিচিত লাভ করেছেন গণমানুষের কবি দিলওয়ার নামে।
দিলওয়ার খান ২০১৩ সালের ১০ই অক্টোবর মারা যান।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: সিলেট জেলার সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে ভার্থখলা গ্রামে একটি রক্ষণশীল পরিবারে ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারী কবি দিলওয়ার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মৌলভী মোহাম্মদ হাসান খান আর মা রহিমুন্নেছা। দিলওয়ার চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে সপ্তম।
পড়াশুনা: দিলওয়ারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় সিলেটের দক্ষিণসুরমাস্থ ঝালপাড়া পাঠশালায় ৷ সিলেটের উত্তরসুরমাস্থ রাজা জি.সি. হাইস্কুল থেকে ১৯৫২ সালে তিনি প্রবেশিকা পাশ করেন ৷ ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত’ সিলেট এম. সি. কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে তিনি পাশ করেন ইন্টারমিডিয়েট। এরপর শারীরিক অসুস্থতা বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর শিক্ষা জীবনে। এখানেই ইতি ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার।
কর্মজীবন: শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। তবে ভেতরের কবিসুলভ উতলা মন স্থির হয়নি সেখানে। দুই মাস ছিলো তাঁর শিক্ষকতা জীবনের বয়স। এরপর পাড়ি জমান ঢাকায়। শব্দের কারিগর শব্দ নিয়ে খেলা করার লোভে জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৭ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন।
সেখানে দু’বছর কাজ করার পর ফিরে আসেন সিলেটে। দেশ তখন উন্মাতাল, বাঙালীরা জাগতে শুরু করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সিলেটে এর পথ দেখানোর দায় তুলে নেন কবি নিজের কাঁধে। গড়ে তোলেন ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’। উনসত্তরের উন্মাতাল হাওয়ায় এই সংগঠন সিলেটে চেতনার রসদ যুগিয়েছিলো। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে এই সংগঠন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে দৈনিক গণকন্ঠের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ৷ ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকাস্থ রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক উদয়ন পত্রিকার সিনিয়র অনুবাদক হিসেবে প্রায় দুই মাসের মতো কাজ করেন ৷ এরপর তিনি স্বেচ্ছায় সেই চাকুরীটি ছেড়ে দেন। কারণ ঢাকায় তাঁর মন টেকেনি। আবার ফিরে আসেন সুরমার তীরে। এসময় তিনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন। গতি পায় তাঁর লেখালেখির। ঢাকা-সিলেটের পত্র-পত্রিকায় সমান তালে তাঁর লেখা প্রকাশ হতে থাকে।
সংসার জীবন: ১৯৬০ সালে আনিসা খাতুনের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ৷ বিয়ের পর আনিসা খাতুন হয়ে গেলেন আনিসা দিলওয়ার ৷ আনিসা ও কবি দিলওয়ারের ঘরে জন্ম নেয় ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা ৷ ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড় ছেলে শাহীন ইবনে দিলওয়ার। এরপর জন্ম নেন কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। এরপর নাহিদ বিনতে দিলওয়ার। তারপর জন্ম নেন রোজিনা বিনতে দিলওয়ার। এরপর সাজিয়া বিনতে দিলওয়ার। সবার ছোট কামরান ইবনে দিলওয়ার ৷
১৯৭৫ সালে দূরারোগ্য ব্যাধি টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে আনিসা দিলওয়ার ইহলোক ত্যাগ করেন ৷ আনিসার মৃত্যুর পর তাঁর সংসারের হাল ধরার জন্যে আসেন আনিসারই সহোদরা ওয়ারিসা খাতুন ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দূতে অনার্সের ছাত্রী ওয়ারিসা খাতুন ১৯৭৫ সালেই কবির সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে তাঁর মরহুমা বোনের সন্তানদের দেখার দায়িত্ব নেন ৷ ওয়ারিসা ও কবি দিলওয়ারের ঘরে জন্ম নেয় এক মেয়ে ও দুই ছেলে ৷ ২০০৩ সালে ওয়ারিসা খাতুনও দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন ৷
মৃত্যু : ২০১৩ সালের ১০ই অক্টোবর।
তথ্যসূত্র: ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারীতে কবির ৭৩ তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘কবি দিলওয়ার পরিষদ’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘দিলওয়ার’ নামের ৫ম সংকলনটি থেকে নেওয়া হয়েছে।
লেখক: মৌরী তানিয়া