কতই বা বয়স তখন তাঁর? ছয় বছর! বাবার কন্ঠে রবি ঠাকুরের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার আবৃত্তি শুনে, কেঁদে বুক ভাসাতেন রাখালের জন্য। শুভ্র চুল দাড়ির এই শুভ্র বৃদ্ধকে বড় নিষ্ঠুর মনে হতো তাঁর। সমুদ্র দর্শনের আনন্দ নিয়ে রাখালকে মাসীর বুকে ফিরিয়ে দিলে কী ক্ষতি হতো? কেন এত দুঃখের ভেতর দিয়ে মানুষকে আনন্দ দেয়া? এই কি কবির কাজ? বাবা বলতেন, এগুলো কল্পনা, সত্য নয়৷ “Life is Mathematical, not poetry”.
বাবার মুখে ‘দুই বিঘে জমির’ আবৃত্তি শুনে উপেনের জন্য কষ্ট হতো খুব। বেচারার নিজের গাছের দু’টো আম পাবারও অধিকার নেই? ও কেন বোকার মত সাধু সাজতে গেল? কবিতা শুনতে গিয়ে কবিতার চরিত্রদের সাথে, এভাবেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন কবিতাকেও। মা ছিলেন অষ্টগ্রামের দত্ত বংশীয়া। মনসামঙ্গলের আদি কবি কারাহরি দত্ত ছিলেন দত্তদের পূর্ব পুরুষ। সেখানেই কি প্রথিত ছিল বীজ? বাবা ছিলেন চিত্রশিল্পী। কিন্তু কলকাতা আর্ট স্কুলের ছবি আঁকার পাঠ শেষ করতে না পারায় মনের অজান্তেই তিনি হয়ত চেয়েছিলেন- তাঁর ছেলে-মেয়েদের কেউ একজন শিল্পী হোক। তাই হয়ত সচেতনভাবেই এক সন্তানের নামও রেখেছিলেন মহাকবি কালিদাসের নামে, যে মাত্র ৩ বছর বয়সেই মারা গিয়েছিল। আর ছোট ছেলের মাঝে কবিতাগুণের প্রকাশ দেখে, শিল্পী হতে সহায়তা করতে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার বিশাল আকাশ। যে আকাশকে ক্যানভাস করে তাঁর ছেলে আঁকবে কাব্যচিত্র। তাঁর সেই স্বাধীনতার আকাশ পাওয়া ছেলেটির নাম নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী। যে তাঁর ক্যানভাসকে রাঙিয়েছে নানা বর্ণের কাব্যচিত্রে।
ঠাকুরদা রাম সুন্দর গুণ। এনট্রান্স পাশ করে জজ কোর্টে চাকুরী করতেন ময়মনসিংহ শহরে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও চাকরি সূত্রে ভাগ্য পরিবর্তন হয়। এক পর্যায়ে গৌরীপুরের জমিদারের কাছে থেকে ডেমুরা, চাপারকোণা, সাধুহাটি ও কাশতলা-চারটি গ্রামের তালুকদারী ক্রয় করলে, নামের শেষে যুক্ত হয় চৌধুরী৷ ৫ পুত্র ১ কন্যার ছোট ছেলে সুখেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী। সুখেন্দুর ৩ কন্যা ও ২ পুত্রের ছোট পুত্র নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী।
যে বয়সে মায়ের চেয়ে খেলাকেই বেশী ভালোবাসতে শুরু করে শিশুরা সেই বয়সেই মা বীনাপনিকে হারান নির্মলেন্দু গুণ। মাত্র ৪ বছর বয়সে। জন্ম তারিখ ২১ জুন ১৯৪৫, ৭ আষাঢ় ১৩৫২। দিনটি বৃহস্পতিবার। ময়মনসিংহের বারহাট্টার কাশবন গ্রামে। মা মারা যাবার পর তাঁর বাবা আবার বিয়ে করেন। লেখা পড়ার হাতেখড়ি নতুন মা চারুবালার হাতেই। ৩য় শ্রেণীতে, প্রথম স্কুলে ভর্তি হন। বারহাট্টা স্কুলে। পুরো নাম করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউট। ক্লাসে বসেই একদিন লিখে ফেলেন একটি ছড়া, স্কুলকে নিয়ে। শুরুটা এভাবেই। ক্লাস এইটে পড়ার সময় স্কুলে বাংলার নতুন শিক্ষক মুখলেসুর রহমান স্যার আসেন। তিনি খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতেন। তাঁর মাধ্যমেই এসময় মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের পর কবি জীবনানন্দের কবিতার সাথে প্রথম পরিচিত হন তিনি। এসময় বারহাট্টার বিখ্যাত রামমঙ্গল গায়েন ছিলেন নরেন্দ্র গায়েন। বিভিন্ন পার্বণে নরেন্দ্র গায়েনের গান অবাক হয়ে গভীর আগ্রহে শুনতেন তিনি। গেরুয়া রং এর ধুতি, পাঞ্জাবী ও উত্তরীয় পরা নরেন্দ্র গায়েন যখন হারমোনিয়াম, খোল, করতাল বাদ্যসহকারে আবেগপূর্ণভাবে রামমঙ্গল পরিবেশন করতেন, তখন সেই কাব্য ও ছন্দের মাধুর্য তাঁকে নতুন জগতের সন্ধান দিত। কাব্য আর ছন্দের প্রেরণা সেখান থেকেও তিনি পেয়েছিলেন।
দুই বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পান ১৯৬২ সালে। মাত্র ৩ জন প্রথম বিভাগ পেয়েছিল স্কুল থেকে। বাবা তাঁর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন- “কৃষ্ণ কৃপাহি কেবলম।”
মেট্রিক পরীক্ষার আগেই নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’। এসময় এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্রবীণ সাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী। কবিতাটি ছিল নেত্রকোণার নবাগত এস.ডি.ও. জনাব নূরুল ইসলাম খানকে উদ্দেশ্য করে লেখা। মেট্রিকের পর আই.এস.সি. পড়তে চলে আসেন আনন্দমোহন কলেজে, ময়মনসিংহ। থাকেন হিন্দু হোষ্টেলে। নতুন জীবনের স্বাদ এবার এখানে। স্বাধীনতা। যা খুঁজেছেন এতদিন। দেরীতে হোষ্টেলে ফেরা শুরু হয় নিত্যদিন। ২য় বর্ষে উঠেই হোষ্টেলের ম্যানেজার নির্বাচিত হন এবং বাজারের টাকা মারা ও জুয়া খেলার অপরাধে হোষ্টেল ত্যাগের নির্দেশ পান। সকলের বক্র দৃষ্টি তাঁকে কন্টকাকীর্ণ করে তোলে। আনন্দমোহনে আর আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়না। বিদ্রুপ এসে নাও ভিড়িয়েছে সেখানে। বাবার প্রস্তাবে টিসি নিয়ে চলে যান নেত্রকোণা কলেজে।
মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের সুবাদে পাওয়া রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশিপসহ পড়তে থাকেন এখানে। নেত্রকোণায় ফিরে এসে নির্মলেন্দু গুণ আবার ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকা ও তাঁর কবি বন্ধুদের কাছে আসার সুযোগ পান। নেত্রকোণার সুন্দর সাহিত্যিক পরিমন্ডলে তাঁর দিন ভালোই কাটতে থাকে। একসময় এসে যায় আই.এস.সি. পরীক্ষা। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আই.এস.সি. পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগ অর্জনকারীর মাঝে তিনিই একমাত্র নেত্রকোণা কলেজের।
সকলে খুশি। বাবা খুশি। এবার ছেলের সামনে উচ্চশিক্ষার সুগম পথ। ভালো ফলাফল তাঁর যাত্রাকে বেগবান করবে এমনটাই আশা। বাবা চাইতেন ডাক্তারী পড়া। কিন্তু না তিনি সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে। ভর্তির প্রস্তুতি নেন নির্মলেন্দু গুণ। হঠাত্ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় ঢাকায়। দাঙ্গার কারণে তিনি ফিরে আসেন গ্রামে। ঢাকার অবস্থার উন্নতি হলে ফিরে গিয়ে দেখেন তাঁর নাম ভর্তি লিষ্ট থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়া। আর ভর্তি হওয়া হলো না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিরে আসেন গ্রামে। আই.এস.সি.-তে ভালো রেজাল্ট করায় তিনি ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। মাসে ৪৫ টাকা, বছর শেষে আরও ২৫০ টাকা। তখনকার দিনে অনেক টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারায় একবার ভেবেছিলেন পড়াশুনার ইতি টানবেন। কিন্তু ভালো রেজাল্টের সুবাদে পাওয়া ফার্ষ্ট গ্রেড স্কলারশিপ মিস্ না করতে আবার ফিরতে হয় সেই আনন্দমোহন কলেজে। যে কলেজটি আই.এস.সি. দ্বিতীয় বর্ষে তাঁকে ঘৃণাভারে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এখানে তিনি ভর্তি হন পাস কোর্সে বি.এস.সি.তে। যদিও এ পরীক্ষায় আর উত্তীর্ণ হওয়া হয়নি তাঁর। কিন্তু ১৯৬৯ সালে প্রাইভেটে বি.এ. পাশ করেন তিনি (যদিও বি.এ. সার্টিফিকেটটি তিনি তোলেননি)।
১৯৬৫ সালে আবার বুয়েটে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ডাক পড়ে ভাইভা বোর্ডে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো। আর বেশ কিছু হিন্দু ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার চাকরি ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিল বলে ভর্তিচ্ছুদের পারিবারিক অবস্থা জেনে নেবার চেষ্টা করতেন প্রশ্নকর্তারা। নির্মলেন্দু গুণ পরিষ্কার করেন যে, তাঁর এক ভাই ভারতে থাকলেও ইঞ্জিনিয়ার হলে তিনি দেশেই থাকবেন। কিন্তু ভাইভা বোর্ডে পাঠ্যসূচী থেকে কোন প্রশ্ন না করেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ততদিনে সাম্প্রদায়িকতার কালো শেকড় অনেক জায়গাতেই প্রথিত হয়েছে। একবুক কষ্ট নিয়ে ফিরে আসেন আনন্দমোহনে। তখন থেকেই হতাশাগ্রস্ত নির্মলেন্দু গুণ অফুরন্ত আনন্দের উত্সে অবগাহনে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। আই.এস.সি.তে পাওয়া বৃত্তির টাকা আর হাতশা তাঁকে নতুন যাত্রার পথে ঠেলে দেয়। তাঁর মাঝে ঘুমিয়ে থাকা আত্মপ্রকাশে উন্মুখ নেশাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। নব আনন্দে ডালপালা মেলে দেয় তারা। অফুরন্ত আনন্দের তৃষ্ণা তাঁকে অস্থির করে তোলে। নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে, আনন্দের চেয়ে বড় আরাধ্য, বড় প্রত্যাশা জীবনে আর কী হতে পারে? আনন্দ সমুদ্রে অবগাহনের চেয়ে মহত্ অর্থ আর কী আছে? মৃত্যু নামক নিশ্চয়তা যেখানে থাবা পেতে দাঁড়িয়ে, যেখানে একদিন নিঃশেষ হতে হবেই, তবে কেন বিমূর্ত এক জীবন আনন্দের আশায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দকে অস্বীকার করে কষ্ট পাওয়া। চারপাশে যেখানে বিরাজমান অফুরন্ত আনন্দের অজস্র উপাদান। ধরণীর আনন্দ আবাহনে সাড়া দেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ শেষে জেগে ওঠেন নবীন উল্লাসে। মদ্য-পদ্য-সিদ্ধি-গণিকা-জুয়া এই পঞ্চভূতের পাদপথে উত্সর্গ করেন নিজেকে। আর সেই সাথে চলে সর্বদা কাব্য চর্চার সঞ্জীবনী খুঁজে ফেরা। প্রকাশিত হয় কবিতা। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে ঢাকার ‘সাপ্তাহিক জনতা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ‘কোন এক সংগ্রামীর দৃষ্টিতে’। নিজের সম্পাদনায় বের করেন ‘সূর্য ফসল’ সংকলন। কবি সিকান্দার আবু জাফর সংকলনের জন্য আশীর্বাণী লিখে দেন। ঐ সংকলনের কবিতার মাধ্যমে শোষক শ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষকে ডাক দেওয়া হয়। সংকলনের বিভিন্ন কবিতায় ফুটে ওঠে বিদ্রোহ যা শাসক শ্রেণীর পছন্দ হয় না। ফলস্বরূপ মামলা হয়। জারি হয় নির্মলেন্দু গুণের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা।
পরে অবশ্য প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা খুরশেদ চৌধুরী ও মৌলনা ফজলুর রহমান সাহেবের মধ্যস্থতায় মামলা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এর পরই আসে অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাত। ডাকাতির মামলা হয় তাঁকে আসামী করে, আবার গ্রেফতারী পরোয়ানা। হুলিয়া। পলাতক জীবন। কখনও গৌরীপুর, শ্যামপুর, কখনও জারিয়া-ঝাঞ্ছাইল। একসময় চলে আসেন ঢাকা। থাকতে শুরু করেন নাট্যকার বন্ধু মামুনুর রশীদের সাথে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট-এর হোষ্টেলে। কাজ শুরু করেন আব্দুল্লাহ্ আবু সায়ীদের ‘কন্ঠস্বর’ পত্রিকায়। এসময় কবি বন্ধু আবুল হাসান তাঁর সর্বক্ষণ সঙ্গী হয়ে ওঠেন। মাথার ওপর তখনও ঝুলছে হুলিয়া। যে কবিতার জন্য হুলিয়া মাথায় নিয়েছেন সে কবিতাকে আর সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। নির্মলেন্দু গুণ ঠিক করেন সাহিত্যের সাথেই সংযুক্ত থাকবেন। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। যদিও শিক্ষা খাতে অর্থ আর সময় ব্যয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন এতদিনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব অর্জনের জন্য। এক সময় তুলে নেওয়া হয় মামলা। সর্বক্ষণ তাঁর ধ্যান জ্ঞানে কবিতা তখন ডালপালা মেলছে।
দেশ তখন অস্থির। ৬ দফা আন্দোলন তখন দানা বাঁধছে। তখন ‘সংবাদে’ ছাপা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে উত্সর্গ করা কবিতা ‘প্রচ্ছদের জন্য’। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সহপাঠী হিসেবে পান মুজিব কন্যা শেখ হাসিনাকে।
১৯৬৭ সালে কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, কবি সিকান্দার আবু জাফর প্রমুখ বাংলা কবিতার প্রধান কবিদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে রুশ কবি মিখাইল লূকোনিন ঢাকায় আসেন। লেখক সংঘের এক অনুষ্ঠানে লুকোনিন আবৃত্তি করেন নিজ কবিতা “Sleep ‘O Sleep”এবং “The Charcoal Frontier” কবিতার অংশবিশেষ। তিনি মুগ্ধ হন এবং লুকোনিনের সাহিত্য ও দর্শনে আকৃষ্ট হন। সমাজ বাস্তবতাবাদী মার্কসীয় সাহিত্য দর্শনের প্রতি আস্থা সৃষ্টিতে এ রুশ কবির দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন।
ঢাকা শহরে নির্মলেন্দু গুণের নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা ছিল না। কবিতা লিখতেন, ঘুরে বেড়াতেন, আড্ডা দিতেন, প্রকাশকদের বইয়ের প্রুফ দেখতেন। আর টাকা পেলে নিয়মিত যেতেন ঠাঠারিবাজারের হাক্কার জুয়ার আড্ডায়। ১৯৬৮ সালের ২৯ জুলাই হোটেল পূর্বাণীতে তরুণ কবিদের কবিতা পাঠের আসরে সুযোগ পান। পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার পায় এ কবিতা পাঠের আসর। এ সুযোগ তাঁকে পাঠক ও কবি মহলে পরিচিতি দেয়।
এ বছরের প্রথম দিকে ছোট বোন সোনালী মাইগ্রেশন করে ভারতে চলে যায়। বোনকে সীমান্তে পৌঁছিয়ে দিতে গিয়ে দেশে হিন্দু-মুসলমানের বৈষম্য ও ফলশ্রুতিতে দেশত্যাগের ঘটনা তাঁর অন্তরাত্মাকে নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন করে। দেশত্যাগের সময় হিন্দুদের নাড়ি ছেঁড়ার বেদনায় দ্রবীভূত হয় তাঁর মন। এসময় তিনি অন্য অনেক সচেতন ছাত্র জনতার মত আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মেতে ওঠেন।
‘৬৯-এর প্রথম দিকে রেডিওতে কবিতা পাঠের আসরে ডাক পান নির্মলেন্দু গুণ। ঢাকায় তাঁর প্রচুর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি লিখতেন ‘সংবাদ’, ‘আজাদ’, ‘পাক জমহুরিয়াত’, ‘জোনাকী’ প্রভৃতিতে। প্রকাশিত হয় তাঁর কলাম ‘ফসল বিনাসী হাওয়া’। ২১ জুলাই ১৯৭০। তরুণ কবিদের কবিতা পাঠের আসরে পাঠ করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘হুলিয়া’। ‘হুলিয়া’ তাঁকে কবি খ্যাতি এনে দেয়। বড় বড় লেখকরা তাঁর কবিতার প্রশংসা করেন। সমালোচনা লেখেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী ‘তৃতীয় মত’ কলামে। খান ব্রাদার্স বের করে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’। পশ্চিম বঙ্গের শক্তিমান লেখক শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ট কবিতা’ গ্রন্থে ছাপেন ‘হুলিয়া’ কবিতাটি। এর পর আর থেমে থাকার সময় কোথায়? প্রেম ও গণমানুষকে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুতে পরিণত করে একে একে লিখে চলেন কবিতা- ‘অমীমাংসিত রমণী’, ‘চৈত্রের ভালোবাসা’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’সহ আরও অনেক কবিতার বই।
স্বাধীনতার পূর্বপর্যন্ত চাকরি করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কন্ঠস্বর’, আহমদ রফিক সম্পাদিত ‘নাগরিক’, ‘পরিক্রম’ ও ‘জোনাকী’ পত্রিকায়। এর পর আবিদুর রহমান সম্পাদিত ইংরেজী পত্রিকা ‘পিপল্’ এ কাজ নেন সাব এডিটর হিসেবে। স্বাধীনতার পর কাজ করেছেন আল মাহমুদ সম্পাদিত ‘গণকন্ঠ’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। এরপর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন ‘সংবাদ’ ও ‘দৈনিক বাংলার বাণী’-তে। এখান থেকে চাকরি নেন ‘বাংলাবাজার’ পত্রিকায় সাহিত্য ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে। এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন ‘দৈনিক আজকের আওয়াজ’ নামে একটি পত্রিকায় যেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি আর কোথাও চাকরি করেননি। এখন তিনি তাঁর লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছেন।
মহান ১৯৭১। যুদ্ধকালীন কলিকাতাস্থ আকাশবাণী ভবনে ‘বেতার জগত’ পত্রিকার সম্পাদক ডা. গাঙ্গুলীর সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নির্মলেন্দু গুণ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কবিতাকে অস্ত্রে পরিণত করেন। তাঁর নিজের ভাষায় “কবিতা আমার নেশা, পেশা, প্রতিশোধ গ্রহণের হিরন্ময় হাতিয়ার।” তাঁর কবিতার মাঝে ছিল দেশপ্রেম, সংগ্রাম, রাজনীতি। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সমাজ জীবনের উজ্জীবন ও সাধারণ জীবনযাত্রাকে ধরতে সক্ষম ছিল তাঁর কবিতার ফ্রেম।
মূলত গদ্যকবিতা রচনা করলেও ছন্দ নিয়ে খেলা করেছেন নির্মলেন্দু গুণ। কোন কোন সমালোচক তাঁর ছন্দ কবিতায় ছন্দ-শৈথিল্যের কারণে ছন্দ লিখতে প্রায়ই হোঁচট খাবার অভিযোগ করেন। তবে তিনি বিশুদ্ধ ছন্দ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রেও সমালোচকের মন্তব্য, “ঝড়ে দুয়েকটি বক মরেছে।”
মার্কিন বীট বংশীয় কবিসম্রাট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তাঁর। অ্যালেন গিন্সবার্গ ছিলেন বাংলাদেশের একজন পরম সুহৃদ। যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা লিখে তাতে সুরারোপ করে গেয়ে বেড়িয়েছেন মিছিলে মিছিলে। প্রচারণা চালিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।
নির্মলেন্দু গুণ এক কন্যাসন্তানের জনক। তাঁর মেয়ের নাম মৃত্তিকা গুণ।
নির্মলেন্দু গুণ সাহিত্য সাধনার জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, একুশে পদক, আলাওল সাহিত্য পুরষ্কার, কবি আহসান হাবীব সাহিত্য পুরষ্কার। তিনি নিজ গ্রাম কাশতলায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘কাশবন বিদ্যা নিকেতন’ নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
এক সময় ভাবতেন বড় হয়ে সন্ন্যাসী হবেন। তাঁর জ্যাঠা মশাই সন্ন্যাস ব্রত নিয়েছিলেন। জ্যাঠা মশাই কেন সন্ন্যাসী হয়েছিলেন খুব জানার ইচ্ছে ছিল তাঁর। তবে তিনি তা জানতে পারেননি। কিন্তু কাব্যকে আশ্রয় করে তিনিও তো সন্ন্যাসী হয়েছেন। কবিতার প্রেরণায় ছুটেছেন পথ থেকে পথে। কবিতার ভাষায় হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাধর। আর পরম ক্ষমতার প্রতি তাঁর নিজ সঙ্গায়িত ভক্তি রেখে ছুটেছেন বাক্যের পথে প্রান্তরে। লিখতে পেরেছেন “ধাবমান হরিণের দুত্যি” বা “অগ্নি সঙ্গমের” মত চিন্তার খোরাক জোগানো কাব্য। প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের কাব্য দর্শন। শ্বেত শুভ্র চুল দাড়ির এ কাব্য অন্বেষক, কাব্য দার্শনিকও তো বটে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম:নির্মলেন্দু গুণ
জন্ম: জন্ম তারিখ ২১ জুন ১৯৪৫, ৭ আষাঢ় ১৩৫২৷ ময়মনসিংহের বারহাট্টার কাশবন গ্রামে।
মা ও বাবা: বীনাপনি ও সুখেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী।
পড়াশুনা: লেখা পড়ার হাতেখড়ি মার হাতেই৷ ৩য় শ্রেণীতে, প্রথম স্কুলে ভর্তি হন। বারহাট্টা স্কুলে। পুরো নাম করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউট। দুই বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পান ১৯৬২ সালে। মাত্র ৩ জন প্রথম বিভাগ পেয়েছিল স্কুল থেকে। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আই.এস.সি. পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগ অর্জনকারীর মাঝে তিনিই একমাত্র নেত্রকোণা কলেজের। ১৯৬৯ সালে প্রাইভেটে বি.এ. পাশ করেন তিনি ( যদিও বি.এ. সার্টিফিকেটটি তিনি তোলেননি)।
কর্মজীবন: স্বাধীনতার পূর্বপর্যন্ত চাকরি করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কন্ঠস্বর’, আহমদ রফিক সম্পাদিত ‘নাগরিক’, ‘পরিক্রম’ ও ‘জোনাকী’ পত্রিকায়। এর পর আবিদুর রহমান সম্পাদিত ইংরেজী পত্রিকা ‘পিপল্’ এ কাজ নেন সাব-এডিটর হিসেবে। স্বাধীনতার পর কাজ করেছেন আল-মাহমুদ সম্পাদিত ‘গণকন্ঠ’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। এরপর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন ‘সংবাদ’ ও ‘দৈনিক বাংলার বাণী’-তে। এখান থেকে চাকরি নেন ‘বাংলাবাজার’ পত্রিকায় সাহিত্য ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে। এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন ‘দৈনিক আজকের আওয়াজ’ নামে একটি পত্রিকায় যেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি আর কোথাও চাকরি করেননি। এখন তিনি তাঁর লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছেন।
তথ্য সূত্র :
আমার ছেলেবেলা-নির্মলেন্দু গুণ
আমার কন্ঠস্বর-নির্মলেন্দু গুণ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : লেখক
লেখক : রাজিত আলম পুলক