পুলিশ ইন্সপেক্টর সৈয়দ হাতেম আলী আই.এ. পাশ করেই চাকরিতে যোগ দেন। খুলনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলা ছিল তাঁর কাজের এলাকা। তবে আই.জি. পুলিশ অফিসে রিপোর্ট দাখিল করার জন্য তিনি মাঝে মাঝে কলকাতায় যেতেন। সৎ মানুষ হিসেবে সুনাম ছিল তাঁর। তিনি মজলিশি ছিলেন এবং ‘খান সাহেব’ উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর দুই স্ত্রী। প্রথম পক্ষের স্ত্রী ১৯২৪ সালে মারা যাবার পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
প্রথম স্ত্রীর ঘরে পর পর তিনটি মেয়ে জন্মের পর ফররুখ আহমদের জন্ম হয়। রমজানের সময় ফররুখের জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর দাদি তাঁকে আদর করে রমজান বলে ডাকতেন। ছয় বছর বয়সে মাতৃহারা হয়েছিলেন ফররুখ। দীর্ঘজীবী দাদিই তাঁকে লালন পালন করেন। শৈশবে দাদির কাছে ফররুখ শুনতেন পুঁথির কাহিনী, তাজকিরাতুল আউলিয়া এবং কাসাসুল আম্বিয়া। দাদীর অতি আদরের এই নাতিটি ছোটবেলায় ছিলেন খুব দুরন্ত। তবে সেই বয়সের দুরন্ত এই ছেলেটিকেই আবার ভাবুকতা ও উদাসীনতা পেয়ে বসত প্রায়ই । ধু ধু মাঠে কিংবা মধুমতী নদী তীরে একা একা ঘুরে বেড়াতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। জ্যোৎস্না রাতে বাঁশঝাড়ের পাশে গিয়ে ডাহুকের ডাক শুনতেন চুপ করে। আর এসবই হয়তো তাঁর মধ্যে কবিতা লেখার প্রেরণা জুগিয়েছিল। যার ফলে তিনি স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করেন এবং এদেশের বিশিষ্ট ও প্রধান সারির কবিদের তালিকায় তাঁর নাম উঠে আসে।
যশোর জেলার মাগুরা থানার মাঝআইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ জুন ফররুখ আহমদ জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর মার নাম রওশন আখতার। ফররুখ ছিলেন সচ্ছল পরিবারের সন্তান। তাঁদের পরিবার ছিল শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত। ১৯৪৩ সালে ফররুখের বাবা ইন্তেকাল করেন। তাঁর দাদিও ঐ বছর মারা যান।
মাঝআইল গ্রামের পাঠশালায় ফররুখ কিছুদিন পড়েছিলেন। ফারসি-জানা এক মহিলা বাড়িতে এসে তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তারপর কলকাতায় গিয়ে মডেল এম.ই.স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এরপর কিছুদিন পড়েন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। বালিগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় তিনি দিলকুশা স্ট্রিটে থাকতেন এবং রোজ সন্ধ্যার পর দিলকুশা পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে যেতেন। সমবয়সী, পরবর্তীকালের বিখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদও ঐ লাইব্রেরিতে প্রায় প্রতিদিন যেতেন। কখনো লাইব্রেরিতে বসে, কখনো পার্ক সার্কাস ময়দানের কোনো নিরালা কোনায়, কখনোবা হেঁটে গড়িয়াহাট লেক পর্যন্ত যেতে যেতে তাঁরা দু’জনে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। সেইসময় তিনি নিরালায় দরাজ গলায় আবৃত্তি করতেন শেলি, কীটস, নজরুলের কবিতা।
এর পর ফররুখ ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। এই স্কুলে তাঁর শিক্ষক ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল ও কবি আবুল হাশেম। এই স্কুলের ম্যাগাজিনে ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এই স্কুল থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। কলকাতায় এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে রিপন কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে আই.এ. পাশ করার পর ঐ বছরই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে বি.এ.-তে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। তাঁর অধ্যাপকমণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ। স্কুল-কলেজে তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিকার সত্যজিৎ রায়, অভিনেতা ফতেহ লোহানী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে যে-কোনো কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত বি.এ. পরীক্ষা দেননি তিনি।
কলকাতায় থাকাকালীন ফররুখ আহমদ অনেকগুলি চাকরি করেছেন। কিন্তু সবগুলিই ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে, ১৯৪৫ সালে মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি।
তবে এসব কোনো চাকরিই বেশি দিন করেননি তিনি। কারণ শুধুমাত্র ‘মোহাম্মদী’ ছাড়া অন্যগুলির কোনটিই তাঁর কবিমনের সঙ্গে খাপ খায়নি। ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে ফররুখ আহমদ ‘মোহাম্মদী’-তে চাকরি নেন । আর লেখক হিসেবে অনেক আগে থেকেই ‘মোহাম্মদী’-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁর একটি কবিতা সেই সময়কার ‘মোহাম্মদী’ ও ‘আজাদ’ সম্পাদক নিজের নামে ছাপানোর কারণে তিনি ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘মোহাম্মদী’-র চাকরি ছেড়ে দেন।
ঢাকা বেতারেই ফররুখ আহমদ দীর্ঘদিন চাকরি করেন। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট বা নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং আমৃত্যু ঢাকা বেতারে ষ্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বেতারে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ফররুখ আহমদ দীর্ঘকাল ‘কিশোর মজলিশ’ পরিচালনা করেছেন। বেতারের প্রয়োজনে অসংখ্য গান, কথিকা, নাটিকা, শিশুতোষ রচনা, গীতিনাট্য, গীতিবিচিত্রা ইত্যাদি লিখেছেন। নিজের ও অন্যদের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। পুঁথি পাঠও করেছেন মাঝে মাঝে। বিশেষ অনুষ্ঠানসমূহ প্রযোজনা করেছেন। বেতারে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন কবি শাহাদাৎ হোসেন, কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি আবুল হোসেন, কবি সিকান্দার আবু জাফর, কবি শামসুর রাহমান, কবি হেমায়েত হোসেন, গীতিকার নাজির আহমদ, কথাশিল্পী আশরাফ-উজ-জামান খান, কথাশিল্পী নাজমুল আলম প্রমুখ।
১৯৩৭ সালে ফররুখ আহমদ প্রথম সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। কারণ এবছরই ‘বুলবুল’ ও ‘মোহাম্মদী’-তে তাঁর প্রথম রচনাবলি প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মনে হয়, ‘বুলবুল’-এ প্রকাশিত ‘রাত্রি’ সনেটটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা (শ্রাবণ ১৩৪৪)। এরপর প্রায় এক হাজারেরও বেশী সনেট তিনি রচনা করেছেন।
প্রথম দিকে ফররুখ গল্পও লিখতেন। যেমন ‘মৃত বসুধা’ (‘সওগাত’, কার্তিক ১৩৪৪), ‘যে পুতুল ডলির মা’ (‘বুলবুল’, বৈশাখ ১৩৪৫), ‘প্রচ্ছন্ন নায়িকা’ (‘মোহাম্মদী’, কার্তিক ১৩৪৬) ইত্যাদি। এমনকি ‘সিকান্দার শা-র ঘোড়া’ নামে ‘মৃত্তিকা’ পত্রিকায় একটি উপন্যাসও শুরু করেছিলেন (শ্রাবণ ১৩৫৩)- কিন্তু তা শেষ করেননি। ফররুখের কথাসাহিত্য বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কিন্তু অঝোরে কবিতা লিখতে থাকেন তিনি এবং তা নিয়মিত প্রকাশিতও হতে থাকে। সেকালে কলকাতার প্রথম শ্রেণীর বহু পত্র-পত্রিকায় তিনি লিখেছেন। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায়, অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘দিগন্ত’ বার্ষিকীতে; মুসলমান সম্পাদিত ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বুলবুল’, ‘মৃত্তিকা’ প্রভৃতি পত্রিকায়; ‘বাম বলয়ের অরণি’, ‘পরিচয়’ প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি লিখেছেন।
১৯৪৪ সালে ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হলে ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’ প্রভৃতি পত্রিকায় তার দীর্ঘ আলোচনা ছাপা হয়। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ফররুখ আহমদ যেমন ‘লাশ’, ‘আউলাদ’ প্রভৃতি কবিতা লিখেছেন, ১৯৪৬ সালে তেমনি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় আর্ত কবি লিখেছিলেন ‘বন্ধু’ (স্বাধীনতা, ২৩শে নভেম্বর ১৯৪৬), ‘নিজের রক্ত’ (২৭শে অক্টোবর ১৯৪৬) প্রভৃতি কবিতা। ‘নিজের রক্ত’ কবিতাটি অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কলকাতা কেন্দ্র থেকে কবিকণ্ঠে প্রচারিত হয়। কলকাতা-জীবনে ফররুখ আহমদের দুটি মাত্র কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল- ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪) ও ‘আজাদ করো পাকিস্তান’ (১৯৪৬)। কিন্তু কলকাতা জীবনে রচিত কবিতার সংখ্যা অজস্র।
১৯৪৮ সালে ফররুখ ঢাকায় চলে আসার পর মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঢাকাই ছিল তাঁর সাহিত্যক্ষেত্র। ১৯৪৮-৭৪ এই প্রায় তিন দশক তিনি অবিরত সাহিত্য চর্চা করেছেন। এই বছরগুলোতে তাঁর চারটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, চারটি শিশুকিশোরতোষ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া অনেকগুলো পাণ্ডুলিপির পরিকল্পনাও প্রস্তুত করেছেন, যার কয়েকটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রাকশিত হয়েছে। শিশু-সাহিত্যেও তাঁর দান রয়েছে অসীম।
বিভাগ পরবর্তীকালে তিনি মূলত লিখেছেন ‘সওগাত’, ‘আজাদ’, ‘মোহাম্মদী’, ‘মাহে-নও’, ‘দিলরুবা’, ‘সৈনিক’, ‘আজ’, ‘মদিনা’, ‘তাহজীব’ ইত্যাদি পত্রিকায়, অসংখ্য ছোট পত্রিকায় ও সংকলনে। ফররুখ কয়েকটি গদ্য ও কাব্যনাট্য লিখেছিলেন। এর মধ্যে ‘দরিয়ায় শেষ রাত্রি’ (সাত সাগরের মাঝি গ্রন্থভুক্ত), ‘তৈমুর’ ও ‘নৌফেল ও হাতেম’ রেডিও-তে প্রচারিত হয়েছে। ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমীর উদযাপিত নাট্য-সপ্তাহে ‘নৌফেল ও হাতেম’ মঞ্চস্থ হয়েছে।
ফররুখ আহমদ আরেকটি একাঙ্ক কাব্যনাট্য লিখেছিলেন। ‘নয়া জিন্দেগী’ নামে এটি ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়, পুনর্লিখিত হয়ে ‘ইবলিস ও বনিআদম’ (কাফেলা গ্রন্থভুক্ত) নামে ‘পৃথিবী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ঢাকা বেতারে যুক্ত হওয়ায় ফররুখ লেখেন অনেক আধুনিক, দেশপ্রেমিক, ইসলামি ও উদ্দীপনামূলক গান, গজল, হামদ ও নাত। এর সূচনা হয়েছিল অবশ্য কলকাতাতেই। ফররুখ আহমদের প্রথম প্রকাশিত গান ‘আহমদ আবদুল্লাহ’ ছদ্মনামে ‘কথা’ শীর্ষে মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র আষাঢ় ১৩৫২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ফররুখের কোনো কোনো গান ও গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে, তবে এখানো তাঁর কোনো গীতিগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। ফররুখের গানে যাঁরা সুর দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন আবদুল হালিম চৌধুরী, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ, সমর দাস, মোশাররফ হোসেন ফরিদ।
১৯৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ফররুখ আহমদকে যথার্থই উদ্দীপ্ত করেছিল। ভাষা বিষয়ে তাঁর সচেতনতা অনেক আগেই দেখা গিয়েছিল। ‘উর্দু বনাম বাংলা’ নামক ব্যঙ্গকবিতায় (মোহাম্মদী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৫২) ১৯৪৫ সালেই তিনি তীব্র বিদ্রূপ হেনে লিখেছিলেন, ‘দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন/বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকেই করিয়াছি নিকা’। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশিত তাঁর ‘পকিস্তান’ : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্যে’ (‘সওগাত’, আশ্বিন ১৩৫৪) তিনি দ্বিধাহীন জানিয়েছিলেন :
‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছে। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তাই হয়, তাহলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’
ফররুখ আহমদের কবিতা লেখার সূচনা বিভাগপূর্ব কালেই, কলকাতা পর্যায়ে। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল, সমাজের সর্বত্র ও রাজনীতিতে যে চতুর ধূর্ত ব্যক্তিদের তিনি দেখেছিলেন, অজস্র ব্যঙ্গকবিতায় তিনি তাদের ছবি ধরে রেখেছেন। এ এক বিশাল আশ্চর্য চরিত্রচিত্রশালা। জীবদ্দশায় তাঁর কোনো ব্যঙ্গকবিতা-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু তাঁর অনেক ব্যঙ্গকবিতার পঙক্তি সাহিত্যমোদিদের মুখে আজো শোনা যায়, তসবিরনামা, নসিহতনামা, ঐতিহাসিক-অনৈতিহাসিক কাব্য-এর উল্লেখ অনেকেই করেছেন। ব্যঙ্গকবিতা লিখতে পত্রিকায় ফররুখ অনেকগুলো ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন-হায়াত দারাজ খান পাকিস্তানী, ইয়ারবাজ খান, মুনশী তেলেসমাত, কোরবান বয়াতী, গদাই পেটা হাজারী, আবদুল্লা বয়াতী, জাহেদ আলী ঘরামী, মানিক পীর, শাহ বেয়াড়া বাউল, ঘুঘুবাজ খান, সরফরাজ খান, মোহাম্মদ আবদুল জলিল, আহমদ আবদুল্লা, মাহবুব আবদুল্লা প্রভৃতি। ১৯৫৭ সালে তাঁর ব্যঙ্গকবিতা নিয়ে সরকারি উপর-মহলে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, এমনকি তাঁকে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছে কিছুদিন, এজন্যে তিনি কয়েকদিন নিজ বাসা ছেড়ে কমলাপুরে মামার বাসায় ছিলেন।
বাঙালি-মুসলমানের ঐতিহ্যের সন্ধানেই চল্লিশের দশকে পুঁথিসাহিত্যের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছিলেন একদল শিক্ষিত লেখক ও কবি। ফররুখ আহমদ পুঁথিসাহিত্যের পুননির্মাণে মনোনিবেশ করেন। একদিক থেকে তিনি একটি ব্যাপক প্রভাবও সৃষ্টি করেন।
১৯৭১ সালের শেষে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ফররুখ আহমদ একান্ত গৃহবাসী হয়ে পড়েন। কিন্তু তখনো নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করেছেন। কোরআন-শরিফের পূর্বকৃত তরজমা পরিমার্জনা করেছেন; হাম্দ্ ও নাত্ লিখেছেন ও প্রাক্তন লেখা পরিমার্জনা করেছেন; গাদ্দাফি প্রাসঙ্গিক একগুচ্ছ কবিতা লিখেছেন; ‘নজরে আকিদাত’ নামে একটি উর্দু দীর্ঘ কবিতার তরজমা করেছেন ইস্কাটন মসজিদের ইমামের সহযোগিতায়; হিটলারের সঙ্গে সংলাপ-এমন একটি বিষয় নিয়ে পেন্সিলে একটি গদ্যরচনা লিখেছেন; আর লিখেছেন মৃত্যুর দু’মাস আগে অসামান্য একটি সনেট।
১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখের বিবাহ হয়। তৈয়বা খাতুনের বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ নূরুল হুদা। বিবাহের উদ্যোক্তা ছিলেন ফররুখ ও তৈয়বা খাতুনের নানা মোহাম্মদ হুরমাতুল্লাহ। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।
ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন। তাঁরা হলেন- সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহল মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান [আহমদ আখতার], সৈয়দ মুহম্মদ ওয়হিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।
তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। জ্ঞান থাকা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে কখনও নামায কাযা করেননি তিনি। শরীর ভীষণ অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তিরিশ রোজাই রেখেছেন। তিনি ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু গোঁড়া ও সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে দুটো পায়জামা, দুটো পাঞ্জাবি, একটি গেঞ্জি, একটি শেরওয়ানি, এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল, একজোড়া জুতো, শীতের সময় একটি পুলোভার এবং একটি আলোয়ানই যথেষ্ট ছিল তাঁর। নবীজীর সুন্নতকে ভালবাসতেন বলে তিনি কাপড়ে তালি দিয়ে পরতেন।
ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন ইসলামী রেনেসাঁর প্রবক্তা। কাজী নজরুল ইসলামের পর মুসলিম কবি হিসাবে ফররুখ আহমদই শ্রেষ্ঠ প্রতিভার দাবীদার। তিনি ইসলামিক ভাবধারার অনুসারী হলেও তাঁর মতাদর্শ কখনই তাঁর কবিসত্তাকে সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করতে পারেনি।
ফররুখ আহমদ জীবিত অবস্থায় চারটি পুরস্কারে ভূষিত হন। সেগুলি হল- প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ (১৯৬০); বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬০); ‘হাতেম তায়ী’ গ্রন্থের জন্য আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬); ‘পাখীর বাসা’ গ্রন্থের জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬)।
১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার ফররুখ আহমদকে ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাবে ভূষিত করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মৃত্যুর পর ফররুখ আহমদকে তিনটি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০) ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৪)।
১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধেবেলা ঢাকায় ইস্কাটন গার্ডেনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: যশোর জেলার মাগুরা থানার মাঝআইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ জুন ফররুখ আহমদ জন্ম গ্রহণ করেন।
মা-বাবা: বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর সৈয়দ হাতেম আলী। তাঁর মার নাম রওশন আখতার। মার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি । তাঁরা তিন ভাই, দুই বোন।
পড়াশুনা: মাঝআইল গ্রামের পাঠশালায় ফররুখ কিছুদিন পড়েছিলেন। ফারসি-জানা এক মহিলা বাড়িতে এসে তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তারপর কলকাতায় গিয়ে মডেল এম.ই.স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এরপর কিছুদিন পড়েন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। এর পর ফররুখ ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। এই স্কুলে তাঁর শিক্ষক ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল ও কবি আবুল হাশেম। এই স্কুলের ম্যাগাজিনে ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এই স্কুল থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। কলকাতায় এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে রিপন কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে আই.এ. পাশ করার পর ঐ বছরই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে বি.এ.-তে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। তাঁর অধ্যাপকমণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ। স্কুল-কলেজে তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিকার সত্যজিৎ রায়, অভিনেতা ফতেহ লোহানী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে যে-কোনো কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত বি.এ. পরীক্ষা দেননি তিনি।
কর্মজীবন: কলকাতায় থাকাকালীন ফররুখ আহমদ অনেকগুলি চাকরি করেছেন। কিন্তু সবগুলিই ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে, ১৯৪৫ সালে মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি।
ঢাকা বেতারেই ফররুখ আহমদ দীর্ঘদিন চাকরি করেন। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট বা নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং আমৃত্যু ঢাকা বেতারে ষ্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বিয়ে ও ছেলে-মেয়ে: ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখের বিবাহ হয়। তৈয়বা খাতুনের বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ নূরুল হুদা। বিবাহের উদ্যোক্তা ছিলেন ফররুখ ও তৈয়বা খাতুনের নানা মোহাম্মদ হুরমাতুল্লাহ। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়। ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন।
মৃত্যু: ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধেবেলা ঢাকায় ইস্কাটন গার্ডেনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: ফররুখ আহমদ: জীবন ও সাহিত্য, লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ। প্রকাশক: সাঈদ বারী, প্রকাশনী: সূচীপত্র, প্রথম প্রকাশ: ২০০৯
লেখক : মৌরী তানিয়া