তখন বশীর আল্হেলালের বয়স তিন কি চার বছর। হাতেখড়ি হবে এই ছোট্ট ছেলেটির। তাঁর মা তাঁকে পড়ালেন নতুন জামা, আর চন্দন বেটে কপাল জুড়ে প্রলেপ দিয়ে সাজালেন। মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে বৈঠকখানায় বসে আছেন বাবা। এই ঘরেই তাঁর ভাই-বোনসহ অনেক আত্মীয়স্বজন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। নতুন জামা আর কপাল জুড়ে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে সাজিয়ে ছোট্ট ছেলেটিকে মা নিয়ে এসে বাবার কোলে বসিয়ে দিলেন। বাবা তাঁর নিজ হাতে তৈরী একটি কলম ছেলেটির ছোট্ট কোমল হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেই ছোট্ট হাতটি বাবা তাঁর নিজ হাতে শক্ত করে ধরে কলমটি চন্দনের মধ্যে চুবিয়ে কাঠের তক্তিতে লিখলেন, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’। শুরু হল বশীর আল্হেলালের লেখাপড়া। তখন কি তাঁর মা-বাবা জানতেন এই ছেলেটি একদিন হবেন বাংলাদেশের শক্তিমান কথা সাহিত্যিক। আর তাঁর হাতেই একদিন রচিত হবে অনেক গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ গবেষণার বইসহ আরও অনেক বই।
বশীর আল্হেলাল, বাংলাদেশের এই শক্তিমান কথা সাহিত্যিকের জন্ম ১৯৩৬ সালে ৬ জানুয়ারী। মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামের মীর পাড়ায়। তালিবপুর মুর্শিদাবাদের একটি বৃহৎ ও বিখ্যাত গ্রাম। তালিবপুর গ্রামটি কান্দি মহকুমার ভবপুর থানার অন্তর্গত ও সালার রেলষ্টেশনের নিকটে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ গ্রাম। বশীর আল্হেলালের জন্মগ্রাম তালিবপুরে জন্মেছিলেন প্রখ্যাত পল্লীগীতি শিল্পী আব্দুল আলীম ও ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ আবুল বরকতসহ শত কবি-সাহিত্যিক, সংগ্রামী ও বিপ্লবী।
বশীর আল্হেলালের পূর্ব-পুরুষরা ১২ প্রজন্ম পূর্বে ইরাকের বাগদাদ থেকে ভারতে এসেছিলেন। ভারত উপমহাদেশ তখন থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিল। মূলত ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁর পূর্ব-পুরুষগণ এখানে এসেছিলেন। এখানে এসে তাঁরা মুর্শিদাবাদ এলাকায় বসবাস শুরু করেন।
তাঁর বাবার নাম সৈয়দ মুহাম্মদ আলী আসমার। তিনি উত্তর ভারতের দেওবন্দ, বেনারস, রামপুর ইত্যাদি স্থানে শিক্ষা লাভ করেন এবং ওই সমস্ত অঞ্চলে শিক্ষকতা করেন। তিনি আরবী-ফার্সী-উর্দু ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। আরবী-ফার্সী-উর্দু ভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্য সমগ্র ভারতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া তিনি মৌলবী ও ইউনানী পশু চিকিৎসক ছিলেন।
তাঁর বাবা ফার্সী ও আরবী ভাষায় লেখালেখি করতেন। তিনি মূলত ফার্সী ভাষার একজন শক্তিমান সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি উর্দু ভাষায়ও লিখতেন। তবে তিনি বাংলা সাহিত্য কম জানতেন। বাংলায় ভাল কথা বলতে পারলেও লিখতে পারতেন না। বশীর আল্হেলালের মায়ের নাম আ-মাতার রোকেয়া (রোকেয়া খাতুন)। তিনি বাংলা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি। তিনি কেবল প্রথাগত ভাষা জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
বশীর আল্হেলালের পিতামহ ছিলেন আবুল মুজফফর। তিনি দীর্ঘদিন দার্জিলিঙের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তিনিও ছিলেন বিশিষ্ট ফার্সী কবি। তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিলো।
সৈয়দ মুহাম্মদ আলী আসমার ও আ-মাতার রোকেয়া পরিবারে ১২টি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু অধিকাংশই কৈশোর অতিক্রম করার পূর্বেই মারা যান। মেয়ে সন্তানের মধ্যে কেবল ওয়াকেফাতুল আহাদ বিয়ে হওয়ার পর মারা যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের পরিবারে বেঁচেছিলেন ৩টি ছেলে সন্তান। নেয়ামাল ওয়াকিল (জন্ম ১৯২৬), নেয়ামাল বাসির (জন্ম ১৯৩২) ও নেয়ামাল বশীর (জন্ম ১৯৩৬)। নেয়ামাল ওয়াকিল ছিলেন কথাশিল্পী ও নাট্যকার। তিনি ১৯৬৫ সালে কলকাতায় স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। নেয়ামাল বাসির পাকিস্তান সরকারের পার্লামেন্টের সেক্রেটারী ছিলেন। স্বাধীনতার পরে তিনি বাংলাদেশ পার্লামেন্টের সেক্রেটারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট অনুবাদক, ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক। নেয়ামাল বাসির ও নেয়ামাল বশীর দু’ভাইয়ের নাম প্রায় একই রকম এবং তাঁরা দুজনই লেখালেখি করতেন, ফলে তাঁদের লেখা যখন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতো তখন পাঠকরা দ্বিধায় পড়ে যেতেন আসলে লেখাটি কার। আর এ সমস্যা সমাধানের জন্য নেয়ামাল বশীর পরবর্তীতে তাঁর নাম পরিবর্তন করে বশীর আল্হেলাল রাখেন।
বাবার কাছে পড়াশুনায় হাতেখড়ি হওয়ার পর বশীর আল্হেলাল ভর্তি হন তালিবপুর পাঠশালায়। তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে ২ টাকা বৃত্তি পান। এরপর ভর্তি হন তালিবপুর গ্রামের এইচ.ই. হাইস্কুলের প্রাইমারী সেকশনে। সেখানে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।
১৯৪৭ সালে বশীর আল্হেলালের দু’ভাই পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। কিছু দিন পর তিনিও পূর্ব বাংলার রাজশাহীতে মেজ ভাইয়ের কাছে চলে আসেন। ৭ম শ্রেণীতে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। রাজশাহীতে এক বছর পড়াশুনা করার পর সেতাবগঞ্জ হাই স্কুলে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই মেট্রিক পাশ করেন।
মেট্রিক পাশ করার পর ১৯৫২ সালে তিনি আবার জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যান। ওই সময় পাকিস্তানে যাওয়া আসার জন্য ভিসা লাগতো না। তখন তাঁর মামাদের ব্যবসা ছিল কলকাতায়। তিনি কলকাতার সরকারি কলেজে ভর্তি হলেন এবং মামাদের বাসায় থাকা শুরু করলেন। ১৯৫৪ সালে এই কলেজ থেকে ২য় বিভাগে আই.এ. পাশ করেন। এরপর তিনি জলপাইগুড়ির এ.সি. কলেজে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে ২য় বিভাগে অনার্স পাশ করার পর তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ওই সময় তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং বামপন্থী রাজনীতি শুরু করেন।
বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে তিনি অনেকদিন যুক্ত ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি কলকাতা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং লাল কার্ড পান। তখনকার দিনে লালকার্ড পাওয়া খুব সহজ ছিলো না। ১৯৫৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২য় বিভাগে বাংলায় এম.এ. পাশ করেন। ততদিনে তিনি লেখক হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছেন। ছাত্র রাজনীতি ও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির পাশাপাশি তিনি প্রচুর পড়তেন এবং লেখালেখি করতেন। ওই সময় কলকাতা থেকে তাঁর প্রথম গল্পের বই বের হয়।
এম.এ. পাশ করার পর বশীর আল্হেলাল কলকাতায় হজ কমিটিতে চাকুরী নেন। তখন মাওলানা আযাদের ছেলে আকরাম খান কলকাতা থেকে একটি পত্রিকা বের করতেন। পত্রিকাটি সপ্তাহে ৩ দিন বের হতো। এটা মুসলমানদের পত্রিকা ছিল। হজ কমিটিতে চাকুরীর পাশাপাশি তিনি এই পত্রিকায়ও চাকুরী করতেন। তিনি সাংবাদিকতা ও চাকুরীর পাশাপাশি লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। তাঁর বাবা ফার্সী, উর্দু ও আরবী ভাষায় লেখালেখি করলেও বশীর আল্হেলাল ছোট বেলা থেকে মাতৃভাষা বাংলায় লিখতেন।
১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে তিনি তাঁর মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তখন পরিস্থিতি ভাল ছিল না বলে ভারত থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মেঝ ভাই তখন ঢাকায় পাকিস্তান সরকারের চাকরি করতেন। ঢাকায় আসার পর তাঁর চোখের সামনে একে একে ঘটে গেল ১৯৬৯-এর গণঅভূত্থান, ১৯৭০’র নির্বাচন ও ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধ। আর এসব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনিও সামিল হয়েছিলেন।
১৯৬৯ সালে তিনি ফিরোজা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিরোজা বেগম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁদের পরিবারও দেশবিভাগের পর ভারত থেকে পূর্ববাংলায় চলে আসেন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। পড়াশুনা শেষ করে তাঁরা এখন চাকরী করছেন।
মাকে নিয়ে ঢাকায় আসার পর বশীর আল্হেলাল বিভিন্ন বইয়ের সমালোচনা লেখা শুরু করেন। যা ওই সময় খুব কম লেখা হতো। আর শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মহল ছাড়া এসব বিষয় তেমন কেউ পড়তেন না। বছর খানেকের মধ্যে তিনি শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে বাংলা একাডেমীতে চাকরীর জন্য আবেদন করেন। ১৯৬৯ সালে সহ-অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হলেন বাংলা একাডেমীতে। সর্বশেষে তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর তিনি বাংলা একাডেমীতে চাকরী করেছেন।
বশীর আল্হেলাল মূলত কথাসাহিত্যিক হিসেবে সুনাম অর্জন করলেও গল্প, উপন্যাস, কবিতা, অনুবাদ ও প্রবন্ধ-গবেষণায়ও তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তাঁর বড় ভাইয়ের কাছ থেকেই মূলত লেখালেখির ব্যাপারে উৎসাহ পেয়েছিলেন। ছেলেবেলায় তিনি গল্পের বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। সেইসময় গল্পের বই পড়ার পাশাপাশি নিজেও গল্প লিখতেন এবং তা বড় ভাইকে দেখাতেন। তাঁর ভাই বলতেন, খুব ভাল হয়েছে। ছেলেবেলায় যে গল্পগুলো লিখতেন সেগুলোর বেশীর ভাগই ছিল ইসলামী। নিজে নিজে গল্প বানিয়ে তিনি সহপাঠীদের শোনাতেন। সহপাঠীরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
৭ম শ্রেণি থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি লেখালেখির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। এ সময় ছোট কাগজে-পত্রিকায় লেখা দেয়া শুরু করেন। ওই সময় খুবই ধার্মিক ছিলেন তিনি। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনী তাঁর প্রায় মুখস্ত ছিল।
তিনি যখন ১০ম শ্রেণীতে পড়তেন তখন রচনা প্রতিযোগিতায় একবার হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর উপর প্রবন্ধ লিখে পুরস্কার হিসেবে একটা ঘড়ি পেয়েছিলেন। ওই সময় থেকে তাঁর লেখা ‘আজাদ’ আর ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। তিনি যখন আই.এ. পড়তেন তখন ‘দৈনিক পাকিস্তান’সহ পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি পত্রিকায় লিখতেন।
তিনি অসংখ্য গল্প লিখেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর ৬টি গল্পের বই বেরিয়েছে। সেগুলো হলো-‘স্বপ্নের কুশীলব’, ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, ‘আনারসের হাসি’, ‘বিপরীত মানুষ’, ‘ক্ষুধার দেশের রাজা’, ‘গল্প সমগ্র’-প্রথম খণ্ড।
গ্রামীণ ও শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনকে আরো অর্থবহ করতে তিনি জীবনধর্মী ও সমাজসচেতনতামূলক ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। বশীর আল্হেলালের সকল সৃষ্টি-কাজে প্রধানত গ্রামীণ ও শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ধারণের চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি বেশ ক’টি উপন্যাস লিখেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর ৬টি উপন্যাস বেরিয়েছে। সেগুলো হলো- ‘কালো ইলিশ’, ‘ঘৃতকুমারী’, ‘শেষ পানপাত্র’, ‘নূরজাহানদের মধুমাস’, ‘শিশিরের দেশে অভিযান’ ও ‘যে পথে বুলবুলিরা যায়’।
বশীর আল্হেলাল একজন সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে সমালোচনা লিখেছেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকাতে আসার পর সাহিত্য সমালোচনা লিখতে শুরু করেন। ওই সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকায় অসংখ্য কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাসের উপরে সমালোচনা লিখেছেন, যা সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে যে ক’জন প্রবন্ধ-গবেষক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বশীর আল্হেলাল। বাংলা একাডেমীতে চাকরি করার সময় তিনি প্রবন্ধ-গবেষণার কাজ শুরু করেন। ভাষা-সাহিত্য বিষয়ে গবেষণা করে তিনি বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর বই লেখেন। বানান, ঊচ্চারণ ও পরিভাষা প্রয়োগের বিষয়ে প্রশিক্ষণের উপরেও তিনি কাজ করেছেন।
তাঁর প্রবন্ধ-গবেষণার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো: ‘আমাদের কবিতা’, ‘বাংলা গদ্য’, ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’, ‘বাংলা একাডেমীর ইতিহাস’, ‘আদর্শ বাংলা বানান’, ‘বাংলা ভাষার নানান বিবেচনা’, ‘বাংলা ঊচ্চারণ’, ‘কিশোর বাংলা ঊচ্চারণ মঞ্জুরী’, ‘ভাষা আন্দোলনের সেই মোহনায়’ ও ‘আমাদের বিদ্বৎসমাজ’।
প্রশাসনে বাংলা ভাষা প্রচলন ও ভাষা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও তাঁর যথেষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার পরে সরকারী অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য বিশেষ করে বাংলা একাডেমীর প্রতিনিধিরূপে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি অফিসের কাজের যাবতীয় কাগজ-পত্র বাংলায় অনুবাদ করে দেন। বাংলা একাডেমীর ছোটদের অভিধান সম্পাদনা পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমীর প্রশাসনিক পরিভাষা’র সংকলন সম্পাদনার কাজ করেন।
তিনি একজন অনুবাদক। শুধু ইংরেজী নয়, ইংরেজী ছাড়াও তিনি একসময় উর্দু-ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করেছেন। তাঁর যে অনুবাদ বইগুলো বের হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো – ‘এশিয়ার লোককাহিনী’ প্রথম খণ্ড, ‘যুগোস্লাভিয়ার ছোটগল্প’, ‘দেশে আসা’ ও ‘হামিদুর রহমান রিপোর্ট’।
বাংলা একাডেমী থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করেন। শুধু ‘দৈনিক বাংলা’-য় তাঁর ১৬৫টি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। এছাড়া অন্যান্য পত্রিকায়ও তাঁর বেশ কটি নিবন্ধ ছাপা হয়। এগুলো ছিল রাজনৈতিক নিবন্ধ।
বশীর আল্হেলাল কবিরূপে তেমন পরিচিত নন। কিন্তু তিনি কবিতা লেখেন। কবিতার ক্ষেত্রে তিনি নমনীয়। তিনি মনে করেন, কবিতার চিরায়তকে কম-বেশী হোক সবসময় প্রবাহিত রাখা চাই। মজার কথা তিনি কবিতা লেখার জন্য নিজস্ব একটা ফর্ম তৈরী করে নিয়েছেন। এর নাম ভণিতা কবিতা। অর্থাৎ ১০ লাইনের এই কবিতাগুলোর শেষের দুই লাইনের মধ্যে কবির নাম থাকে। কবিতার প্রতিটি লাইনের শেষ শব্দের ছন্দের সাথে পরের লাইনের শেষ শব্দের ছন্দের মিল থাকে।
বশীর আল হেলাল-এর ভণিতা কবিতার একটি নমুনা:
চিঠির বাক্সে চিঠি আছে, পায়ে আমার বাত
ও মেয়ে, ওটা এনে দিবি? নামছে আঁধার রাত
আঁধার রাতে অন্ধ আমি, সকাল হওযার পরে
দেহ খাঁচায় তখনো পাখি থাকবে ধৈর্য ধরে
আশা আছে এতটুকু দে রে এনে দে চিঠিখানা
এই শেষবার সে লেখে নি আ’ ভুল ঠিকানা
চিঠিটা যদি বড় হয় ধর বড় হয় পাতা দুই
ইতিতে প্রথমে দেখে নেবে সেই নীল রঙে সাদা জুঁই
বশীর আল্হেলাল বলে এই বুড়ো কেন এত তোর আশা
আয়ুর অধিক হয় নাকি রে লম্বা ভালোবাসা
বশীর আল্হেলাল তার সাহিত্যকর্মের জন্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হল: আলাওল সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯১, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯৩, লেখিকা সংঘ পুরস্কার, গৌরী ঘোষাল স্মৃতি সম্মান পুরস্কার-২০০২ কলকাতা ও অধ্যাপক আবুল কাসেম পুরস্কার-২০০৪।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: বশীর আল্হেলালের জন্ম ১৯৩৬ সালে ৬ জানুয়ারী। মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামের মীর পাড়ায়।
বাবা: তাঁর বাবার নাম সৈয়দ মুহাম্মদ আলী আসমার। মা: তাঁর মা’য়ের নাম আ-মাতার রোকেয়া (রোকেয়া খাতুন)।
পড়াশুনা: বাবার কাছে পড়াশুনায় হাতেখড়ি হওয়ার পর বশীর আল্হেলাল ভর্তি হন তালিবপুর পাঠশালায়। তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে ২ টাকা বৃত্তি পান। সে সময় ২ টাকার মূল্য ছিলো অনেক। এরপর ভর্তি হন তালিবপুর গ্রামের এইচ.ই. হাইস্কুলের প্রাইমারী সেকশনে। সেখানে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ৭ম শ্রেণীতে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। রাজশাহীতে এক বছর পড়াশুনা করার পর সেতাবগঞ্জ হাই স্কুলে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই মেট্রিক পাশ করেন।
১৯৫৪ সালে কলকাতার সরকারি কলেজ থেকে ২য় বিভাগে আই.এ. পাশ করেন। এরপর তিনি জলপাইগুড়ির এ.সি. কলেজে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে ২য় বিভাগে অনার্স পাশ করার পর তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২য় বিভাগে বাংলায় এম.এ. পাশ করেন।
কর্মজীবন: এম.এ. পাশ করার পর বশীর আল্হেলাল কলকাতায় হজ কমিটিতে চাকুরী নেন। তখন মাওলানা আযাদের ছেলে আকরাম খান কলকাতা থেকে একটি পত্রিকা বের করতেন। পত্রিকাটি সপ্তাহে ৩ দিন বের হতো। এটা মুসলমানদের পত্রিকা ছিল। হজ কমিটিতে চাকুরীর পাশাপাশি তিনি এই পত্রিকায়ও চাকুরী করতেন।
১৯৬৯ সালে সহ-অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হলেন বাংলা একাডেমীতে। সর্বশেষে তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর তিনি বাংলা একাডেমীতে চাকরী করেছেন।
সংসার জীবন: ১৯৬৯ সালে তিনি ফিরোজা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিরোজা বেগম সরকারী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁদের পরিবারও দেশবিভাগের পর ভারত থেকে পূর্ববাংলায় চলে আসেন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। পড়াশুনা শেষ করে তাঁরা এখন চাকরী করছেন।
তথ্যসূত্র: জুন, ২০০৯ তারিখে বশীর আল্হেলালের সরাসরি সাক্ষাৎকার নিয়ে জীবনীটি লেখা হয়েছে।
লেখক : মৌরী তানিয়া এবং শেখ রফিক