‘রাবুর হাতের লেখা পত্রিকা অফিসের পরপুরুষেরা দেখে, এজন্য আমাকে গঞ্জনা সহিতে হয়’ এরকম একটি চিঠি একদিন এসে হাজির রাবু অর্থাৎ রাবেয়া খাতুনের বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি থেকে। সময়টা ১৯৪৮-৪৯ সাল। রাবেয়া খাতুনের দু’চারটে গল্প ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কাগজে ছাপা হয়েছে। কিশোরী রাবেয়ার চোখে তখন স্বপ্ন লেখক হবার। স্বপ্নটা যখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে, তখন হুট করে এমনি একটা চিঠি এসে তাঁকে কি দমিয়ে দিতে পেরেছিলো? না পারেনি। মা-বাবার হাজারো আপত্তির দেয়াল টপকে সেদিনের রাবু আজ রাবেয়া খাতুন হতে পেরেছেন। সেদিনের সেই কিশোরী মেয়েটি আজ আমাদের দেশের খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন।
রাবেয়া খাতুনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে মামার বাড়ি পাউসার গ্রামে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে। বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ, মা হামিদা খাতুন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে আর দাদা ছিলেন শখের কবিরাজ। রাবেয়া খাতুনের জন্ম নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে – তাঁর জন্মের সংবাদটা শুনে তাঁর বাবা একসঙ্গে খুশি হয়েছিলেন আবার দু:খও পেয়েছিলেন। রাবেয়া যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁর বাবা ছিলেন রাবেয়ার নানা বাড়িতে। সেকালে জামাইরা পিঠে খাবার দাওয়াত পেতেন শ্বশুরবাড়ি থেকে। ঘটা-করা ব্যাপার ছিল সেটা। তাঁর বাবা আমন্ত্রিত হয়ে অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে খুশি মনে দাওয়াত খেতে গেলেন। বাবা গেলেন বৃহস্পতিবার আর রাবেয়া খাতুন জন্ম নিলেন শুক্রবার সকালে। তাই তাঁর বাবার আর থাকা হলো না। শ্বশুড়বাড়ির নানারকম পিঠে-পুলি এবং আরও মজার মজার খাবার ছেড়ে চলে এলেন তিনি। রাবেয়া খাতুনের জন্মের খবর শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন ঠিকই তবে শ্বশুড় বাড়ির খাবার-দাবার ছেড়ে চলে আসতে হবে ভেবে মনও খারাপ হয়েছিল তাঁর। সেই সময় কন্যাসন্তান জন্মালে পরিবারের লোকজন খুশি হতো না। কিন্তু রাবেয়া খাতুনের বেলায় হয়েছে উল্টো। তাঁর জন্মের খবর শুনে তাঁর পরিবারের লোকজন খুব খুশি হয়েছিলেন।
পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজারের অলি-গলিতে ও অন্যান্য শহরে কেটেছে তাঁর শৈশবকাল। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি গিয়েও বেড়াতেন পরম আনন্দে। তাঁর কবিরাজ দাদা তাঁদেরকে প্রতীমা দেখার জন্য নৌকা করে নিয়ে যেতেন। ষোলঘর থেকে শ্রীনগর যাতায়াত ছিল বড় কষ্টের। এমন কিছু দূরে নয়। কিন্তু পুরো তল্লাটের পানি দখল করে থাকতো কচুরি পানায়। এই পানা ঠেলে প্রতিমা দেখতে যাওয়া ছিল খুব কষ্টের। তাঁর কাকারা বলতেন আধখানা প্রাণ নাকি বেরিয়ে যেতো। বিশেষ করে তাঁর মাস্টার কাকা হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক) খুব গাঁইগুঁই করতেন বৈঠা টানতে। কিন্তু তিনি তাঁর বাবাকে কিছু বলতে পারতেন না। তবে কাকাদের কষ্ট হলেও রাবেয়ারা খুব মজা পেতেন। হ্যাজাক বাতিতে রাতকে মনে হতো দিন। গান বাজনা হত। খাওয়া হতো মিষ্টি, মুড়কি ভাজা আরও অনেক কিছু। রাবেয়ার দাদা ধুতির (তখনকার মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের বাইরের পোশাক) প্রান্ত কিংবা আদ্দির পাঞ্জাবির পকেট থেকে দু পয়সা এক পয়সা করে তাঁদের হাতে দিতেন ইচ্ছেমত খরচ করার জন্য। একদিকে নতুন ফ্রক স্যান্ডেল পেয়ে তাঁরা খুব খুশি হতেন। তার ওপর ঝকঝকে তামার পয়সা পেয়ে তাঁদের চোখ চিক চিক করে উঠত। রাবেয়া খেলনা কিনতেন। বেশি চঞ্চল ছিলেন বলে নৌকা চলার সময় ধানগাছ ধরে ফেলতেন। পাতার ধারে হাত কেটে রক্ত ঝরতো। তাঁর মা বকুনি দিতেন। ওই পানি থেকেই কোন এক লতা দাঁতে চিবিয়ে প্রলেপ লাগাতেন কাটা জায়গায়।
পুতুল খেলার প্রতি রাবেয়ার খুব ঝোঁক ছিল। সাধারণত মেয়েরা আট দশ বছরেই পুতুল খেলা ছেড়ে দেয়। কিন্তু তিনি খেলেছেন বারো বছর বয়স পর্যন্ত। শুধু পুতুল বিয়েই দিতেন না। তিনি তাঁর পুতুলদের দিয়ে নার্স, ডাক্তার, হাসপাতাল সবই বানাতেন। তাঁর পুতুল খেলা তাই একটু ভিন্ন রকম ছিল। আরেকটা খেলা খেলতেন তিনি সেটা হল সিনেমার বইয়ের ছবি কেটে কেটে গল্প বানাতেন। তাঁর খাতার ভেতরই এসব করতেন তিনি। এজন্য তাঁকে অনেক পরিশ্রম করতে হতো।
তাঁর বাবা ছিলেন মাছ ধরার ওস্তাদ। তাঁর এই মৎস্য শিকারের সঙ্গে থাকতেন রাবেয়া। নৌকা নিয়ে তাঁরা মাছ ধরতে যেতেন। কিন্তু চুপচাপ নৌকার খোলে পুতুলের মতো বসে থাকতে পারতেন না রাবেয়া। প্রায়ই নৌকা নাড়াচাড়া দিয়ে বিস্তর বকুনি খেতেন বাবার হাতে। বাবা বকা দিতেন ঠিকই কিন্তু মাছ ধরার সময় আবার তাঁকেই সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কারণ তিনি থাকলে নাকি মাছ ঘন ঘন টোপ ফেলে।
তাঁর বয়স যখন পাঁচ- ছয় বছর তখন তাঁরা থাকতেন পুরানো ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন সর্দার লেনে। শোবার ঘরের ছিল একটা জানালা। জানালার বাইরে খানিকটা আকাশ দেখা যেত। আর সেই জানালার পাশে ছিল একটি বিশাল সজনে গাছ। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলেই তিনি দেখতেন, তাঁর বাবা জানালার ধারে নামাজের ভঙ্গিতে বসে ভায়রো রাগে গান গাইছেন। শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন কিন্তু এই ছবিটি সারাজীবন তাঁর স্মৃতির ভেতর প্রাণবন্ত হয়ে আছে। ছোটবেলায় গান শিখতেন রাবেয়া কিন্তু নিয়মিত রেওয়াজ করতে পারতেন না। কারণ সেইসময় গানকে ভালো চোখে দেখা হতো না। তাঁদের বাসাটি ছিল মসজিদ লাগোয়া। তাই হারমোনিয়াম বাজানো ছিল নিষিদ্ধ। প্রায় দিনই খালি গলায় গাইতেন তিনি। যেদিন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামতো সেদিন শুধু হারমোনিয়ামের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে পারতেন কারণ বৃষ্টির শব্দের ফলে হারমোনিয়ামের আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যেত না। বৃষ্টির দিনে তাঁর বাবা বাজাতেন, তিনি আর তাঁর ছোট বোন সুফিয়া গাইতেন। গানকে খুব ভালবাসেন তিনি।
পুরনো ঢাকায় তিনি থেকেছেন প্রায় ১০ বছর। এর মধ্যে তাঁর বাবা এ শহর সে শহর বদলি হয়েছেন। বেশিরভাগ সময় কেটেছে ঢাকার বিভিন্ন ভাড়াটে বাসায়। তাঁদের আশপাশের অধিকাংশ লোকজনই ছিল আদিবাসী অর্থ্যাৎ মূল ‘ঢাকাইয়া’। প্রতিবেশীদের বাসায় যাওয়া তাঁদের জন্য নিষেধ ছিল। কিন্তু তিনি এসব নিষেধাজ্ঞার ভেতর দিয়েও সব বাসায় যেতেন। এ জন্য অনেক বকুনি শুনতে হতো তাঁকে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় স্কুলের গন্ডির পর তাঁকে কলেজে যেতে দেয়া হয়নি। স্কুলে মুসলমান ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কারণ সমাজের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে মেয়েরা তখন স্কুলে আসতে পারতো না।
রাবেয়া খাতুন ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। রাবেয়া খাতুনের লেখার হাতেখড়ি হয় উপন্যাস দিয়ে। তাঁদের বাড়ির নিয়ম ছিল সপ্তাহে দু’টো বায়োস্কোপ বা টকি সিনেমা দেখা। তাঁর উপন্যাসের কাহিনী তৈরি হতো সম্ভবত সেই বায়োস্কোপ বা টকি সিনেমার কাহিনীকে কেন্দ্র করে। ভেতরে তাঁরই আঁকা ছবির ক্যাপশন থাকত। প্রথম উপন্যাসের নাম ছিল নিরাশ্রয়া, পরে বিদায়, অশোক-রেবা এই ধরনের নাম। কিন্তু এই উপন্যাসগুলি কখনও গ্রন্থ আকারে বের হয়নি। ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকের তলায় গল্পের বই লুকিয়ে রাখতেন তিনি। আর এটি দেখে তাঁর মা ভীষণ রেগে যেতেন। এছাড়া তিনি যখন গল্প লিখতে বসতেন তখনও তাঁর মা রেগে যেতেন খুব। কারণ সব মায়ের মতো তাঁরও স্বপ্ন ছিল মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হবে। সেসময় তাঁদের পড়াশুনা করানো হতো মূলত একটি ভালো বিয়ে দেওয়ার জন্যই। কিন্তু তাঁর মা যেমনটি চাইতেন রাবেয়া ছিলেন ঠিক তাঁর উল্টো কারণ পড়াশুনায় তিনি মোটেই ভাল ছিলেন না। কোন রকমে টেনেটুনে পরীক্ষায় পাশ করতেন তিনি। তাঁর মা এজন্য দায়ী করতেন বাইরের বই পড়া ও গল্প লেখার নেশাকে।
জাহানারা ইমামের পাক্ষিক পত্রিকা ‘খাওয়াতীন’-এ কাজ করার সময় জাহানারা ইমামের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে দূর থেকে দেখেছেন সম্পাদক ও চিত্র পরিচালক এটিএম ফজলুল হককে। বাসার পরিস্থিতি তখন খুব খারাপ। বিয়ের কারণে তাঁর ওপর পরিবার রীতিমতো বিরক্ত। কারণ কোনো পাত্রই পছন্দ হয় না তাঁর। আত্মীয় পরিজনরা হাসাহাসি করে, বলাবলি করে “ও হবে এদেশের বড় লেখিকা। আর ওর জন্য আকাশ থেকে আসবে রাজপুত্র।” সত্যিই একদিন রাজপুত্র এলো তাঁর জন্য তবে আকাশ থেকে নয়, জমিন থেকে। ফজলুল হক আর কাইয়ুম চৌধুরী তখন জুটি হিসেবে সাইকেলে ঘোরাফেরা করেন। প্রথমজন চালক আর দ্বিতীয়জন রডে বসা আরোহী। প্রতিবেশী কাইয়ুম তাঁর বাড়ি চেনেন। এক বিকেলে দু’জন এসে রাবেয়ার বাবার সঙ্গে আলাপ করে গেলেন। বাসা থেকে রাবেয়ার ওপর এলো প্রবল চাপ। এরা কেনো এলো? তিনি কিন্তু কিছুই জানেন না। চিন্তাও করেননি এমন দুঃসাহস হবে তাঁদের।
এই ঘটনার পর একদিন জাহানারা ইমামের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছেন তিনি। এক ফাঁকে ফজলুল হক তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এলেন। প্রস্তাব রাখলেন তিনি যদি রাজি থাকেন তবে তাঁর বাবার কাছে বিয়ের বিষয় প্রস্তাব নিয়ে আসবেন তার আত্মীয়স্বজনরা। লম্বা, স্মার্ট, সুদর্শন এবং সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত রাজপুত্রের মতো যুবকটিকে সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন আপত্তি নেই। দু’সপ্তার মধ্যে কাবিন হয়ে গেল তাঁদের। রাবেয়ার বাবা-চাচার মত ছিল না। কারণ হিসেবে বললেন, চেনা জানা নেই, দূর দেশ, বগুড়ার ছেলে এইসব। কিন্তু ভীষণ খুশী হলেন তাঁর মা। তাঁর স্বামী ফজলুল হকের বাবা আর ভাইবোনেরাও সবাই খুব খুশি হলেন। তবে শুধু বেজার হলেন তাঁর মা। কারণ তিনি স্থানীয় এক ধনী কন্যাকে ঠিক করে রেখেছিলেন ছেলের বউ করবেন বলে।
১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই তাঁদের বিয়ে হয়। ঢাকার টিক্কাটুলীতে বাসা নিলেন তাঁরা। রাবেয়ার বয়স তখন উনিশ বছর। রান্নার র’ও জানতেন না। অবশেষে বাবুর্চি এলো। দশটায় খেয়ে- দেয়ে দুজনেই অফিসে চলে যেতেন। ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের একটা বিশাল বাড়ির দোতালায় সিনেমা পত্রিকার অফিস। পত্রিকা চালাতেন মূলত চার জন। ফজলুল হক, তাঁর ছোট ভাই ফজলুল করীম (বিশ্বখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ), জহীর রায়হান ও কাইয়ুম চৌধুরী। তাঁদের সাথে যুক্ত হলেন রাবেয়া খাতুন। আর এরপর থেকে পরিচিত হতে লাগলেন উদীয়মান সাহিত্য প্রতিভাদের সঙ্গে।
চার সন্তানের জননী রাবেয়া খাতুন। ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল, ফারহানা কাকলী।
সেই পঞ্চাশের দশক থেকে এখন পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় রাবেয়া খাতুনের কলম থেকে অবলীলায় ঝরে পড়ছে শব্দ আর কথামালা ৷ রাবেয়া খাতুনের উপন্যাসগুলি হলো- মধুমতী, সাহেব বাজার, অনন্ত অন্বেষা, রাজারবাগ শালিমারবাগ, মন এক শ্বেত কপোতী, ফেরারী সূর্য, অনেকজনের একজন, জীবনের আর এক নাম, দিবস রজনী, সেই এক বসন্তে, মোহর আলী, নীল নিশীথ, বায়ান্ন গলির একগলি, পাখি সব করে রব, নয়না লেকে রূপবান দুপুর, মিড সামারে, ই ভরা বাদর মাহ ভাদর, সে এবং যাবতীয়, হানিফের ঘোড়া, হিরণ দাহ, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র, এই বিরল কাল, হোটেল গ্রীন বাটন, চাঁদের ফোটা, নির্বাচিত প্রেমের উপন্যাস, বাগানের নাম মালনিছড়া, প্রিয় গুলসানা, বসন্ত ভিলা, ছায়া রমণী, সৌন্দর্যসংবাদ, হৃদয়ের কাছের বিষয়, ঘাতক রাত্রি, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, মালিনীর দুপুর, রঙিন কাঁচের জানালা, মেঘের পর মেঘ, যা কিছু অপ্রত্যাশিত, দূরে বৃষ্টি, সাকিন ও মায়াতরু, রমনা পার্কের পাঁচবন্ধু, শুধু তোমার জন্য, ঠিকানা বি এইচ টাওয়ার, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, প্রথম বধ্যভূমি, কমলিকা, দশটি উপন্যাস, শঙ্খ সকাল প্রকৃতি, যা হয়না, আকাশে এখনো অনেক রাত, উপন্যাস সমগ্র, স্বনিবার্চিত উপন্যাস, জাগতিক, স্বপ্নে সংক্রামিত, ও কে ছিল, মহা প্রলয়ের পর, নির্বাচিত উপন্যাস, শহরের শেষ বাড়ি, নষ্ট জ্যোস্নার আলো, মাইগো, সমুদ্রবণ ও প্রণয় পুরুষ, এই দাহ, রাইমা।
এছাড়া তিনি লিখেছেন জীবন ও সাহিত্য, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, স্মৃতির জ্যোর্তিময় আলোকে যাদের দেখেছি নামক গবেষণামূলক গ্রন্থ, একাত্তরের নয় মাস, স্বপ্নের শহর ঢাকা, চোখের জলে পড়ল মনে স্মৃতিকথা মূলক গ্রন্থ এবং হে বিদেশী ভোর, মোহময়ী ব্যাংকক, টেমস থেকে নায়েগ্রা, কুমারী মাটির দেশে, হিমালয় থেকে আরব সাগরে, কিছুদিনের কানাডা, চেরি ফোঁটার দিনে জাপানে, কুমারী মাটির দেশে অষ্ট্রেলিয়ায়, আবার আমেরিকা, মমি উপত্যকা এবং অন্যান্য আলোকিত নগর, ভূস্বর্গ সুইজারল্যান্ড, হংকং, মালদ্বীপ, পূবের ভূস্বর্গ সোয়াত, তাসমানিয়া নামক ভ্রমণকাহিনী। ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন দুঃসাহসিক অভিযান, সুমন ও মিঠুন গল্প, তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা, একাত্তরের নিশান, দূর পাহাড়ের রহস্য, লাল সবুজ পাথরের মানুষ, সোনাহলুদ পিরামিডের খোঁজে, চলো বেড়িয়ে আসি, রক্তমুখী শিলা পাহাড়, কিশোর উপন্যাস সমগ্র, সুখী রাজার গল্প, হিলারী যখন ঢাকায় আমরা তখন কাঠমুন্ডুতে, রোবটের চোখ নীল, ইশা খাঁ, ছোটদের উপহার নামক উপন্যাস ৷ তাঁর অনেক লেখা ইংরেজী, উর্দু, হিন্দী ও ইরানী ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
লেখালেখির পাশাপাশি রাবেয়া খাতুন শিক্ষকতা করেছেন। সাংবাদিকতাও করেছেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল মেম্বার। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরীবোর্ডের বিচারক, শিশু একাডেমীর কাউন্সিল মেম্বার ও টেলিভিশনের ‘নতুন কুড়ি’র বিচারক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জাতীয় বিতর্কের জুরীবোর্ডের বিচারক ও সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্ত আছেন বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, বিজনেস ও প্রফেশনাল উইমেন্স ক্লাব, বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কথা শিল্পী সংসদ ও মহিলা সমিতির সঙ্গে।
রাবেয়া খাতুনের লেখা কাহিনী নিয়ে চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম চলচ্চিত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম কিশোর চলচ্চিত্র। ১৯৬৪ সালে এটি নির্মিত হয়। বহু বছর তিনি আর চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হননি। এর কারণ সেই সময় যারা চলচ্চিত্র করতে চাইতেন তারা বলতেন শুধু চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনী নির্মাণ করতে কিন্তু তিনি তাতে রাজী ছিলেন না। তাঁর লেখা পুর্ণাঙ্গ হতো গল্প বা উপন্যাসে। কোন কিছুকে লক্ষ্য রেখে তিনি লিখতে পারতেন না, আর এই কারণেই বহু বছর চলচ্চিত্র থেকে দূরে থেকেছেন। চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় ২০০৪ সালে চলচ্চিত্রে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘মেঘের পর মেঘ’। ছবিটি একাধিক পুরস্কার পায়। মৌসুমী পরিচালিত ‘কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি’ মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। এটি একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট নির্ভর চলচ্চিত্র। এর পর ২০০৫-এ মুক্তি পায় ‘ধ্রুবতারা’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন চাষী নজরুল ইসলাম। এটি ‘মহাপ্রলয়ের পর’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছে।
ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, জাপান, নেপাল, ভারত, সিকিম, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিশর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, উজবেকিস্তান, মরিশাস, মালদ্বীপ, সুইজারল্যান্ড, হংকং। এছাড়াও টরেন্টো ইউনিভার্সিটি বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে ঘুরে এসেছেন কানাডায়।
১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার ,১৯৯৩ সালে একুশে পদক, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, ১৯৯৬ সালে জসিমউদ্দিন পুরস্কার, শেরে বাংলা স্বর্ণপদক ও শাপলা দোয়েল পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে টেনাশিনাস পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে ঋষিজ সাহিত্য পদকসহ রাবেয়া খাতুন আরও বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: রাবেয়া খাতুনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে মামার বাড়ি পাউসার গ্রামে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে।
বাবা-মা: মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ ও মা হামিদা খাতুন।
পড়াশুনা: রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় স্কুলের গন্ডির পর তাঁকে কলেজে যেতে দেয়া হয়নি। স্কুলে মুসলমান ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কারণ সমাজের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে মেয়েরা তখন স্কুলে আসতে পারতো না।
পরিবার: ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই সম্পাদক ও চিত্র পরিচালক এটিএম ফজলুল হকের সাথে রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয়। চার সন্তানের জননী রাবেয়া খাতুন। ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী।
কর্মজীবন: লেখালেখির পাশাপাশি রাবেয়া খাতুন শিক্ষকতা করেছেন। সাংবাদিকতাও করেছেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল মেম্বার। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরীবোর্ডের বিচারক, শিশু একাডেমীর কাউন্সিল মেম্বার ও টেলিভিশনের ‘নতুন কুড়ি’র বিচারক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জাতীয় বিতর্কের জুরীবোর্ডের বিচারক ও সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্ত আছেন বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, বিজনেস ও প্রফেশনাল উইমেন্স ক্লাব, বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কথা শিল্পী সংসদ ও মহিলা সমিতির সঙ্গে।
মুত্যু: জানুয়ারি ৩, ২০২১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মূল লেখক : কামরুন ঝুমুর
পুনর্লিখন : গুণীজন দল