যুদ্ধ। সারা পৃথিবী জুড়ে বেজে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ব্রিটিশদের এক বিশাল উপনিবেশ ভারত উপমহাদেশের কলকাতাতেও পুরোদমে ছড়িয়ে পড়েছে সে যুদ্ধ। সাইরেন, বোমা, ধোঁয়া, শব্দ, এ আর পি, দ্রুতগতির মিলিটারি লরি, উদ্বান্তু মানুষ- সব মিলিয়ে এক অস্থির কলকাতা। সাইরেন বাজলেই পথ ঘাটের মানুষ দ্রুত ছুটে পালাতে শুরু করে। লুকিয়ে পড়ে রাস্তার ধারে ধারে ‘সেন্টার ওয়ালের’ আড়ালে নয়ত মাঠের ট্রেঞ্চে। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ হয়ে যায়। কাঁচের জিনিসপত্র নামিয়ে দেয়া হয় নিচে, মেঝেতে। কেউ কেউ কানে তুলো গুঁজে বসে পড়ে ঘরের দেয়াল ঘেঁসে, ঘরের কোণগুলোতে, উত্কর্ণ হয়ে শোনে জাপানি প্লেনের গুট গুট শব্দ। বোমা আর অ্যান্টি এয়ারক্রাফটের শব্দ শহর কাঁপায়। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সগুলো বাঁশি বাজিয়ে একটার পর একটা ফিরে আসে। হাসপাতালের ডাক্তাররা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাইরেন বাজলেই সেখানে ইমারজেন্সি ডিউটি শুরু হয় তাঁদের। কলকাতার পুলিশ হাসপাতালে এমনি এক ইমারজেন্সিতে ব্যস্ত সময় পার করেন ডাক্তার আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক।
ডাক্তার আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিকের এক মেয়ে জোনাকী। যেন আসলেই একটা জোনাকী৷ যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স চার, পাঁচ বছর। কেবল বোমারু বিমান উড়ে যাওয়ার সময়, ভয় ধরানো শব্দে, সাইরেন বাজলে একটু ভয় পেয়ে চুপ করে নিভে যায় জোনাকী আর এর পর পরই শুরু হয় একমনে জ্বলে উঠা- নিভে যাওয়ার খেলা। ‘অল ক্লিয়ারের’ সাইরেন বেজে উঠলেই ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে মাঠে যায়। খেলার সাথিদের সঙ্গে কালো কাঁকর বিছানো রাস্তায়, মাঠে, বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বোমার স্প্লিন্টার কুড়ায়। মাঠের মাঝে জিগজাগ করে কাটা ট্রেঞ্চে নেমে দুষ্টুমি করে, ফড়িং ধরে খেলে। আর খেলা শেষে স্প্লিন্টার নামের মরণাস্ত্রের বাতিল টুকরাগুলো সিঁড়িতে সাজায়, ফুল তৈরি করার চেষ্টা করে। এইভাবে সেই সময়ে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম কালে জোনাকী নামের ছোট্ট খুকিটি যুদ্ধের হাত ধরাধরি করেই বেড়ে উঠেছে।
বাবার পছন্দের জোনাকী নামের এই মেয়েটি ছিল একটু অন্য রকম এক শিশু। বারো মাস অসুখ বিসুখ লেগেই আছে, দুর্বল শরীর। খেলাধুলা, ছোটাছুটি করার সামর্থ্য কম। গলার শব্দ কমজোর- চেঁচামেচি, হৈ হুল্লোড় করার শক্তিও কম। আর এই দুর্বল শরীরের কারণে কখনও কখনও মাঠে যেয়ে খেলা করলেও বেশির ভাগ সময় ঘরের কোন কোনায় বসে একা একা কথা বলে, ঘরের বারান্দায় একা আপনমনে খেলা করে। কথা বলে কাক আর চড়ুইয়ের সাথে। এই আপন মনের খেলাই তাঁকে করে তুলেছিল ভাবুক আর কল্পনাপ্রিয়। অনায়াসে তৈরি করে দেয় কাক, চড়ুইয়ের বাক- ক্ষমতা, বাড়ির সামনের রাস্তাটির শেষপ্রান্তে ঝাপড়ানো বিশাল বট গাছটিকে ভেবে বসে দৈত্য, দেয়ালের ওপরে লাফিয়ে ওঠা সাদা বেড়ালটিকে ভেবে নেয় পঙ্খিরাজ ঘোড়া। এই কল্পনা বিলাস, এই ভাব-ক্ষমতা আর যুদ্ধের মতো চরম দুর্বিপাকেও শিল্প সৃষ্টির তাড়নাই একদিন ছোট্ট জোনাকীকে এক বড় শিল্পী, এক বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। এই ছোট্ট জোনাকীই আজকের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান।
রিজিয়া রহমানের আদি পৈত্রিক নিবাস দক্ষিণ কোলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। কিন্তু জন্মেছেন কলকাতার ভবানীপুরে। তাঁর পারিবারিক ইতিহাস ঐতিহ্য খুঁজলে দেখা যায় বংশ পরম্পরায় এই পরিবারটি একটার পর একটা অভিবাসন তৈরি করে চলেছে। মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান থেকে এসে হিন্দুস্তানে এই পরিবারের অভিবাসন ঘটিয়ে ছিলেন হায়াত মাহমুদ খান নামের তুর্কীভাষী এক ধার্মিক পুরুষ। মধ্যযুগের প্রাচুর্যের নগরী সমরখন্দে ছিল তাঁর আবাস। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুফি দরবেশদের সহযাত্রী হয়ে দুর্গম দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি এসেছিলেন বঙ্গদেশে। আবাস গেড়েছিলেন কোলকাতার চব্বিশ পরগনার নওবাদে। সেই উজবেক হায়াত মাহমুদ খানের অষ্টম পুরুষ মুন্সী আব্দুল খালেক রিজিয়া রহমানের দাদা। মুন্সী আব্দুল খালেক কোলকাতার লন্ডন মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। চাকরী করতেন কোলকাতায়। সেই সুবাদে এখানে আরেক অভিবাসনের গোড়া পত্তন ঘটে। মুন্সী আব্দুল খালেকের একমাত্র ছেলে আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ডাক্তারি পেশার সুবাদে আসেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। এখানে পরিচয় হয় রিজিয়া রহমানের খালুর সঙ্গে। তিনি তখন চট্টগ্রাম জেলখানার ডেপুটি জেলার। এবং তাঁর মধ্যস্থতাতেই মরিয়াম বেগম ও আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিকের পরিণয় ঘটে। ‘৪৭-র দেশ বিভাগের পর এই পরিবার বাংলাদেশে থিতু হয়। পরবর্তীতে এই পরিবারের অনেকেই অভিবাসন গড়ে তোলে আমেরিকায়। এই হচ্ছে লেখক রিজিয়া রহমান ও তাঁর পরিবারের অভিবাসনের ইতিহাস।
রিজিয়া রহমান একটি সাংস্কৃতিক পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠেছিলেন। দাদার ছিল পড়ালেখার অভ্যেস। দহলিজ ঘরে তাঁর নিজস্ব একটি পড়ার ঘর ছিল। সেই ঘরে তাক ভর্তি ছিল ইংরেজি আর ফার্সি বই। শেষ বয়সে তিনি সারাদিন পড়তেন আর লিখতেন। ধারণা করা হয় তিনি সম্ভবত ইংরেজিতে কোন বই লিখছিলেন। যদিও সে বই তিনি শেষ করে যেতে পারেননি আর সেটি প্রকাশও হয়নি। দেশ বিভাগের পর বাড়ি বদলের ঝামেলায় শেষ পর্যন্ত পাণ্ডুলিপিটিও হারিয়ে যায়। বাবার ছিল সংগীতের প্রতি অসাধারণ টান। এস্রাজ বাজানোর শখ ছিল তাঁর, বাঁশিও বাজাতেন। ভালোবাসতেন কবিতা ও সংগীত। গান শোনার শখ ছিল তাঁর মায়েরও। কানন বালা, সায়গল, জগন্ময় মিত্রের গান পছন্দ করতেন তাঁর মা। নিজে গিয়ে কিনে আনতেন হিন্দি আর বাংলা জনপ্রিয় গানের রেকর্ড। বাবা পছন্দ করতেন ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও ইংরেজি উচ্চাঙ্গ বাজনা। কমলা ঝরিয়ার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর ওয়ালজ, ফঙ্ট্রট বাজনা ছিল তাঁর প্রিয়। আর খুব ছোটবেলা থেকেই রিজিয়া রহমানের গানের প্রতি অনুরাগ ছিল। সেই ছোটবেলায় কিছু না বুঝেই গুনগুনিয়ে গাইতেন- “ছোটি সি মন মেরে/ ছোটি সি দুনিয়ারে,/ ছোটি ছোটি দিন হো/ আওর ছোটি ছোটি রাতে… ।”
পড়ালেখার প্রতি রিজিয়া রহমানের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। কলকাতার ভবানীপুরে তাঁদের পাশের বাড়িতে থাকতেন তাঁর বাবার সহকর্মী ডাক্তার মাহমুদ। তাঁর স্ত্রী বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ। কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা তিনি। প্রতিদিন সকালে সাদা ঘোড়ার ফিটন গাড়িতে চড়ে, অনেকগুলো বই হাতে নিয়ে তিনি পড়াতে যান। শামসুন্নাহারকে তাঁর ভীষণ ভাল লাগত। কারণ তাঁর ঘর ভর্তি বই ছিল। তাঁদের বাড়িতে মাঝে মাঝে খেলতে যেতেন রিজিয়া রহমান। অন্যরা যখন টানা বারান্দায় ছুটোছুটি করতো তিনি তখন বইয়ের তাকের সামনে উত্সুক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বইয়ের না জানা জগতটিকে স্পর্শ করতে চাইতেন মনে মনে। শামসুন্নাহার মাহমুদ এগুলো লক্ষ্য করতেন। মাঝে মাঝে এসে বই নামিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘যাও দেখো নিয়ে।’ ভারি বড়োসড়ো বই দুহাতে জাপ্টে ধরে চলে আসতেন বারান্দায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে লম্বা করে ছড়িয়ে দেয়া দুপায়ের ওপর বইটি রেখে পৃষ্টা উল্টে যেতেন, কিছু পড়তে পারতেন না। একটি সুন্দর রূপকথার বই পড়তে না পেরে একবার তিনি কেঁদে উঠেছিলেন। শামসুন্নাহার মাহমুদের বড় ছেলে মামুন তাঁর কান্নার কারণ শুনে হেসে বলেছিলেন, ‘চলো তোমাকে আমি পড়ে শুনাচ্ছি।’ পড়ার জগতে রিজিয়া রহমানের প্রবেশ ঘটে এভাবেই।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শুরু করেছিলেন বাবার কর্মস্থল ফরিদপুরে। তারপর বাবার চাকরি সূত্রে ছুটোছুটি। ফলে নিরবিচ্ছিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যায়ন তাঁর কোনকালেই ঘটেনি। নানার বাড়ি ঢাকা জেলার শাইনপুকুরে। ১৯৫২ সালে বাবার মৃত্যুর পর তাঁর নানার বাড়ি ঢাকা আর ফরিদপুর ছুটোছুটি করতে করতে কখন যেন সামনে এসে দাঁড়ায় মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়। মামার চাকরিস্থল চাঁদপুরের এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তড়িঘড়ি করে ভর্তি হন নবম শ্রেণীতে। সেখানেও ঘটে এক বিপত্তি। তখনকার রক্ষণশীল সমাজ। মেয়েদের বাইরে বেরুনোর হাজার রকম প্রতিবন্ধকতা। ফলে মামার পরিবার থেকে দাবী উঠল স্কুলে যেতে হলে বোরখা পরে যেতে হবে। আজন্ম উদার সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা রিজিয়া রহমান তো অবাক! তাঁর মা-ই কোনদিন বোরখা পড়েননি আর তিনি কিভাবে পড়বেন? তবু একবার বোরখা পড়ে বের হলেন স্কুলে যেতে। মাঝ রাস্তায় বোরখায় প্যাঁচ লাগিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লেন জনসম্মুখে। এরপর তিনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে এক বছর আগেই প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলেন। এরপর তাঁর বিয়ে হয়। স্বামী খনিজ ভূতত্ববিদ মো. মীজানুর রহমান। স্বামীর চাকরি পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে। সেই সুবাদে সেখানে কোয়েটা গভর্মেন্ট কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে দুই বছর পড়াশুনা করার পর পরীক্ষার সময় মাইগ্রেশান সার্টিফিকেট নিয়ে জটিলতা বাধলো, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিল না। ফলে আবার দেশে ফিরে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে ডিগ্রি পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাষ্টার্স পাশ করেন।
লেখালেখিতে রিজিয়া রহমানের আগমন খুব অল্প বয়সেই। তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন কবিতার মাধ্যমে। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় সেই কবিতা অথবা ছড়া ছাপা হয়েছিলো ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় ছোটদের বিভাগে। তাঁর প্রথম গল্পও ছাপা হয়েছিল এই পত্রিকাতেই। এটিও ছোটদের বিভাগে। পরবর্তীতে দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়। বড়দের জন্য তাঁর লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ইডেন কলেজ ম্যাগাজিনে। এরপর ‘ললনা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ঘর ভাঙা ঘর’ উপন্যাস, যেটি বাংলা কথাসাহিত্যে সংযোজিত করে এক নতুন অধ্যায়ের।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে সব নতুন ঔপন্যাসিকের আগমন ঘটেছে রিজিয়া রহমান তাঁদের অন্যতম। বিষয় বৈচিত্র এবং শৈল্পিক উত্কর্ষে তাঁর উপন্যাসসমূহ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অর্জন করেছে স্বতন্ত্র মাত্রা। তাঁর ‘ঘর ভাঙা ঘর’ বস্তিজীবনের ক্লেদাক্ত যন্ত্রণার শব্দরূপ; আর ‘রক্তের অক্ষর’ হচ্ছে নিষিদ্ধ পল্লীর যন্ত্রণাদগ্ধ প্রাত্যহিকতার ভাষাচিত্র। চট্টগ্রামের হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিনতা নিয়ে গড়ে উঠেছে রিজিয়া রহমানের ‘উত্তর পুরুষ’। বাংলাদেশে পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং প্রতিষ্ঠাচিত্রণ সূত্রে এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচারের কাহিনী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বের কথা, পর্তুগিজদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস। এ উপন্যাসের ব্যতিক্রমী চরিত্র বনি, যে পর্তুগিজ নাগরিক হয়েও, বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্বদেশ হিসেবে গ্রহণ করেছে, ভালোবেসেছে এদেশের শ্যামল প্রকৃতি আর শ্যামল মানুষকে এবং ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে পর্তুগিজ অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসে রিজিয়া রহমান বাঙালির ইতিহাস সন্ধানী এবং সমকালস্পর্শী। শ্রম অধ্যবসায় ইতিহাসজ্ঞান এবং শিল্প চেতনার অন্তরমিলনে ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসটি বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল শিল্পকর্ম। এখানে সঙ্গত কারণেই ইতিহাসকে তিনি স্বচ্ছন্দ প্রয়াসে পরিণত করেছেন শিল্পে এবং শিল্পের দাবীতে, ইতিহাসের ধূসরতায় মিশেছে কল্পনার সৌরভ। রিজিয়া রহমান এ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন শতাব্দী পরম্পরায় প্রবাহমান এই ব-দ্বীপের অবহেলিত উপেক্ষিত অধিকারহীন মানুষের যাপিত জীবন; আর সে সূত্রেই এ উপন্যাসে উঠে এসেছে বাঙালি জাতি গঠনের অতীত ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে লেখকের ভাষ্য : “বাংলাদেশের জাতিগঠন ও ভাষার বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের সৃষ্টি।… আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু করে উনিশশ একাত্তুরের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কাল পর্যন্ত দীর্ঘ পরিব্যাপ্তির মধ্যে এ-উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাস করা হয়েছে।…বাংলার সিংহাসন চিরকাল বিদেশী ক্ষমতালিপ্সু এবং সম্পদলোভীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। বাংলার সাধারণ মানুষ চিরকালই অবহেলিত উপেক্ষিত এবং উত্পীড়িত। জাতি হিসেবে সামাজিক অর্থনৈতিক গণতান্ত্রিক মর্যাদা তারা কোনদিন পায়নি। ‘বং থেকে বাংলা’ যেমন একদিকে ইতিহাসের সঙ্গে সেই কথাটিই প্রকাশ করেছে, তেমনি কি করে সুদীর্ঘ দিনে একটি জাতি স্বাধীনতার মর্যাদায় এসে দাঁড়িয়েছে তারই চিত্রণের চেষ্টা করেছে।” (সূত্র: রিজিয়া রহমান: বং থেকে বাংলা, ১৯৭৮, ঢাকা, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ২২)
ভারত উপমহাদেশের প্রান্তসীমায় অবস্থিত বেলুচিস্তানের স্বাধীনচেতা মানুষ, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী সামাজিক অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার, তাদের দেশ প্রেম আর স্বজাত্যবোধের গৌরব আর সাহসের অনুপম শিল্পরূপ রিজিয়া রহমানের উপন্যাস ‘শিলায় শিলায় আগুন’। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিলুচিস্তানের বিদ্রোহ ও কালাতের যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস। তবে লেখকের সচেতন শিল্পদৃষ্টির স্পর্শে, এক বেলুচিস্তানের কাহিনীর আধারে, এখানে অভিব্যাঞ্জিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী শোষিত মানুষের সংগ্রাম সাহস আর স্বপ্নের কথা।
উত্তর বাংলার সাঁওতাল জীবন নিয়ে লেখা রিজিয়া রহমানের ‘একাল চিরকাল’ এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। এ উপন্যাস ধারণ করেছে সাঁওতাল জনপদের সুদীর্ঘকাল, এবং এখানে আছে সাঁওতালদের আনন্দ, বেদনা, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, ধর্মবিশ্বাস, কুসংস্কার, শোষণ, বঞ্চনা এবং ঈর্ষা আর স্বার্থপরতার ছবি। এই আরণ্যক আদি মানুষের জীবন, সভ্যতার স্পর্শে এক সময় বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে: “প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারের নীলাভ কুয়াশা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে মানুষ হড়৷ হড়রাই সেই নীলাভ অন্ধকারের পবিত্রতা দু’হাতের মুঠোয় ভরে ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে। আর অনেক দূর থেকে শংখিনী সাপের আঁকা বাঁকা দেহভঙ্গীর কুটিলতা নিয়ে পথ খুঁজে খুঁজে এগিয়ে আসে সভ্যতা।”(একাল চিরকাল, ১৯৮৪ ঢাকা, পৃষ্ঠা-৯)
আদিম জনপদের এই বিপর্যয়েরই শিল্পরূপ ‘একাল চিরকাল’। ভাষার ক্ল্যাসিক সংহতি, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, ইতিহাসনিষ্ঠা, সমাজ সচেতনতা এবং শৈল্পিক সতর্কতা- সবকিছুর অন্তর্মিলনে রিজিয়া রহমানের এ উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যের এক বিশিষ্ট সম্পদ। (সূত্র: বাংলাদেশের সাহিত্য, বিশ্বজিত্ ঘোষ)
লেখালেখির স্বীকৃতি হিসাবে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন রিজিয়া রহমান। জীবনের প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭৫ সালে। অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম পুরস্কার। এরপর ১৯৭৮ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে লাভ করেন যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার। হুমায়ুন কাদির স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৮৪ সালে। আসফ-উদ-দৌলা রেজা স্মৃতি পুরস্কার গ্রহণ করেন ১৯৮৪ সালে। এরপর ১৯৮৫ সালে লাভ করেন বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পদক এবং ১৯৯০ সালে তাঁকে দেওয়া হয় কমর মুশতারি সাহিত্য পদক।
রিজিয়া রহমান কর্মজীবনে একাধিক কর্ম ও একাধিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের মাঝে সাহিত্য পত্রিকা ‘ত্রিভূজ’ এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের কার্য পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে। দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যক্ষ হিসাবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অবশেষে বিভিন্ন ও বিচিত্র পেশা থেকে সরে এসে লেখালেখিতেই একান্তভাবে মনোনিবেশ করেছেন রিজিয়া রহমান।
ষাটের দশকের এই নামী কথাসাহিত্যিক জন্মেছিলেন কলকাতার ভবানীপুরে। বাবা ডাক্তার আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক। মা গৃহিনী মরিয়াম বেগম। তাঁরা ছিলেন চার ভাই এবং সাত বোন। স্বামী মো. মীজানুর রহমান। তিনি খনিজ ভূ-তত্ববিদ। তাঁদের এক সন্তান আব্দুর রহমান।
লেখালেখির বাইরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন রিজিয়া রহমান। দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর স্বজন, পরিজন। সেই সুবাদে ঘুরে বেরিয়েছেন লন্ডন, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র। সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন সিঙ্গাপুর, ভারতের দিল্লি ও উত্তর আমেরিকা।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
জন্ম : ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৯, ভবানীপুর, কলকাতা।
বাবা : আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক
মা : মরিয়াম বেগম
ম্বামী: মোঃ মীজানুর রহমান
সন্তান : এক ছেলে – আব্দুর রহমান।
শিক্ষা: এস.এস.সি.; (প্রাইভেট), এইচ.এস.সি.; ইডেন কলেজ, ঢাকা,
স্নাতক;, ইডেন কলেজ, ঢাকা, স্নাতকোত্তর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
গল্প : অগ্নিস্বাক্ষরা (১৯৬৭), নির্বাচিত গল্প (১৯৭৮)
উপন্যাস : ঘর ভাঙা ঘর (১৯৭৪), উত্তর পুরুষ (১৯৭৭), রক্তের অক্ষর (১৯৭৮), বং থেকে বাংলা (১৯৭৮), অরণ্যের কাছে (১৯৭৯), শিলায় শিলায় আগুন (১৯৮০), অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০), ধবল জোত্স্না (১৯৮১), সূর্য সবুজ রক্ত (১৯৮১), একাল চিরকাল (১৯৮৪), হে মানব মানবী (১৯৮৯), হারুন ফেরেনি (১৯৯৪)।
অনুবাদ : সোনালী গরাদ (১৯৯৫)।
পুরস্কার : অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৮), যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), আসফ-উদ-দৌলা রেজা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪), বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পদক (১৯৮৫), কমর মুশতারি সাহিত্য পদক (১৯৯০)।
মৃত্যু- ১৬ আগস্ট, ২০১৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : এহসান হাবীব