খোরশেদ আলী সরকারের বয়স যখন ২০ কি ২১ বছর তখন তিনি হঠাৎ সাধুপুরুষ হয়ে গেরুয়াধারী বেশ ধারণ করলেন এবং কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। বাবা-মা ছেলেকে খুঁজে হয়রান। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাঁকে। শেষে একটা নদীর ব্রীজের উপর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাওয়া গেল। নদীটি এলাহাবাদের কাছে একটা শহরে অবস্থিত ছিল। সেখানকার লোকজন অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাঁর কাগজ-পত্র ঘেঁটে তাঁরা তাঁদের পারিবারিক ডাক্তার জগদীশ সেনের ঠিকানা ছাড়া তাঁর বাড়ির ঠিকানা বা অন্য কারও ঠিকানা পাননি এবং সেই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন তাঁরা। বাড়িতে ফিরে তিনি সাধুগিরি ছাড়লেন।
এবার বাবা-মা চেপে ধরলেন বিয়ে করার জন্য। তিনি রাজী হলেন তবে শর্ত একটা, মেয়ে শিক্ষিত হতে হবে। বেশ মুশকিলে পড়লেন বাবা-মা। কারণ তখন মুসলমান পরিবারে শিক্ষিত মেয়ে ছিল না। তবুও তাঁরা হাল না ছেড়ে শিক্ষিত মেয়ের খোঁজ শুরু করলেন। তাঁর বাবা-মা তাঁদের পরিবারের সেই ডাক্তার জগদীশ বাবুর শরণাপন্ন হলেন। তিনি এ.এম.এফ. পাস। সাইকেলে চড়ে চার-পাঁচ মাইল দূরে দূরে রুগী দেখতে যান। এক রুগীর বাড়িতে তাঁর যাতায়াত ছিল। সেই বাড়িতে একটি মেয়ে পেলেন তিনি। মেয়েটির নাম মোসাম্মত সালেমা খাতুন। তখনকার দিনে দশ-বার বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু সালেমা খাতুনের বয়স ১০-১২ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়নি। সালেমার মা তাঁকে ছোটবেলায় রেখে মারা যান এবং তাঁর বাবা আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। সালেমার বড়ভাই ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের হেড পন্ডিত। তিনি নিজে পড়তেন এবং বোনকে পড়াতেন। সালেমা পাঠশালায় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন। কিন্তু তারপর আর তাঁকে পাঠশালায় যেতে দেওয়া হয়নি। তবে পাঠশালায় না গেলেও বাসায় তাঁর বড়ভাই তাঁকে নিয়মিত পড়াতেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর।
সালেমা খাতুনকে দেখে ডাক্তার বাবু খোরশেদ আলীর বাবা-মাকে বললেন, একটা মেয়ে পাওয়া গিয়েছে, মেয়েটি শিক্ষিত। সবাই দেখার পর সালেমাকে পছন্দ হয় এবং তাঁর সঙ্গেই বিয়ে হয় খোরশেদ আলী সরকারের। বিয়ের দিন তাঁর বন্ধুরা এবং তাঁদের আত্মীয় স্বজনরা নতুন বউ দেখতে এলেন। তাঁর বন্ধুদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু এবং তাঁরা ছিলেন শিক্ষিত। তাঁর এক বন্ধুর বোন নতুন বউ এর পায়ে আংটি পড়া দেখে বললেন, ছি! ছি! এগুলি পড়েছ কেন? এগুলি তো ছোট লোকেরা পড়ে। একথা শুনে নতুন বউ এর মেজাজ গেল বিগড়ে। এরপর সেই মহিলাটি নতুন বউকে জিজ্ঞেস করলেন, এই মেয়ে তুমি লেখাপড়া জান? নতুন বউ কোন কথা না বলে মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিলেন যে তিনি লেখাপড়া জানেন না। এই কথা শুনে সেই মহিলা হৈ হৈ করে বলে উঠলেন, ওমা এ কেমন কথা! তুমি না বলেছিলে তুমি লেখাপড়া জান, এখন বলছ তুমি লেখাপড়া জান না? এ কেমন মেয়ে বিয়ে করেছে? এরপর সব আত্মীয়রা চলে যাওয়ার পর খোরশেদ আলী সরকার নতুন বউকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি লেখাপড়া জান না? তিনি উত্তরে বললেন, না আমি লেখাপড়া জানিনা।। একথা শুনে তিনি তো রেগে আগুন।
‘তুমি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছ, তুমি মিথ্যুক এসব বলে তিনি রেগে মেগে নতুন বউয়ের সুটকেসসহ বিয়েতে যেসব জিনিসপত্র উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন সব উঠানের মধ্যে ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। দু-এক দিন পরে মেয়ের বাড়ি থেকে মেয়ে জামাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নকশা করা গরুর গাড়ি নিয়ে আসেন মেয়ের দূর সম্পর্কের এক দাদী। তিনি এসে দেখেন জামাই নেই। জামাইয়ের জন্য অপেক্ষা করেন এক রাত । কিন্তু জামাইয়ের দেখা নেই। শেষে জামাই ছাড়া মেয়েকে একা নিয়ে চলে গেলেন তিনি। খোরশেদ আলী সরকার কয়েকদিন পর ফিরে এলেন এবং দেখলেন জিনিসপত্রগুলি উঠানের মধ্যেই পড়ে আছে। কেউ তোলেনি। জিনিসপত্রগুলি উঠানের মধ্যে পড়ে থাকায় তিনি রাগারাগি শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর মা বললেন, কেন তোলা হবে? তুই ফেলেছিস তুই তুলবি। তারপর তিনি নিজেই সেগুলি উঠান থেকে তোলা শুরু করলেন। যখন সুটকেসটি তুলতে গেলেন তখন দেখলেন সুটকেসটি খুব ভারী। তিনি সুটকেসটি খুলে দেখলেন সেটির মধ্যে কিছু কাপড় আর বাকি বঙ্কিম চন্দ্র আর শরৎ চন্দ্রর বইয়ে ভর্তি। বইগুলিতে স্পষ্টভাবে লেখা আছে এই বইয়ের মালিক মোসাম্মত সালেমা খাতুন। এটি দেখে খোরশেদ আলী সরকার সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য তৈরী হলেন। তাঁর সাইকেলটা নষ্ট হওয়ায় তিনি ঘোড়ায় চড়ে শ্বশুরবাড়িতে গেলেন এবং নতুন বউয়ের সঙ্গে তাঁর খাতির হয়ে গেল। কয়েকদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকার পর নকশা করা গরুর গাড়িতে করে নতুন বউকে নিয়ে এবং নিজে শ্বশুরের দেওয়া নতুন সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।
সেই যুগে মুসলমান মেয়েদেরকে ১০-১১ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত, মুসলমান ছেলেরা তখন শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করার কথা কল্পনাও করত না। কিন্তু সেই সময় শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করার কথা ভেবেছেন খোরশেদ আলী সরকার। কারণ তিনি নিজে পড়াশুনা ভালবাসতেন, প্রচুর বই পড়তেন এবং লেখালেখি করতেন। আর ১০-১১ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে না বসে মোসাম্মত সালেমা খাতুন গিয়েছেন স্কুলে, পড়েছেন বঙ্কিম চন্দ্র আর শরৎ চন্দ্রের প্রচুর বই । বই পাগল খোরশেদ আলী সরকার এবং মোসাম্মত সালেমা খাতুনের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দু-একজনের কবি-সাহিত্যিক হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। আর তাইতো তাঁদের তৃতীয় সন্তান শওকত আলী হয়েছেন এদেশের সুনামধন্য সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৬৮ সালে তাঁকে দেওয়া হয় বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে তাঁকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
জন্মসাল নিয়ে অস্পষ্টতা আছে শওকত আলীর। সার্টিফিকেটে তাঁর জন্মসাল দেওয়া আছে ১৯৩৬। তবে তাঁর বাবার ডায়রির খাতায় তাঁর জন্মসাল লেখা আছে ১৯৩৫। তিনি নিশ্চিত নয় কোন সালটি সঠিক। তবে দুই জায়গাতে জন্মতারিখ লেখা আছে ১২ ফেব্রুয়ারি। তিনি পশ্চিমবঙ্গের থানা শহর রায়গঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় শওকত আলী সরকার। তাঁদের পারিবারিক পদবী ছিল প্রথমে প্রধান, তারপর হয় সরকার। তিনি যখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়তেন তখন যোগেশ চন্দ্র ঘোষ নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি খুব ভাল শিক্ষক ছিলেন। তিনি ক্লাসে এসে প্রথমে একজন ছাত্রকে ডেকে একটা বাংলা বাক্য লিখতে বলতেন। তারপর আর একজনকে ডেকে বলতেন এই বাক্যটির ইংরেজী কর। তারপর বলতেন, শওকত আলী সরকার কান মলা দরকার। বন্ধুরা তাঁকে ক্ষেপাতেন, কীরে কানমলা দরকার তা তুই এখানে কেন? সেজন্য তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেশনের সময় সরকারটা বাদ দিয়ে দেন।
শওকত আলীর জন্মের পর তাঁর একটি বোনের জন্ম হয়। এই বোন জন্মের দু বছর পর তাঁর মা আবার অন্তঃসত্ত্বা হন। গর্ভের সন্তান জন্মের পর পরই তাঁর সেই বোনটি মারা যায়। তাঁর বোনটি মারা যাওয়ার পর তাঁর বাবার মাথায় পাগলামি ওঠে। তাঁর বাবার মনে হয় তাঁর আদরের মেয়ের মৃত্যুর জন্য এই নবজাতক পুত্রটিই দায়ী। সে জন্য তিনি নবজাতকটিকে ইঁদারার পাশে কচুবনে রেখে আসেন। তাঁর দাদী সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে নবজাতকটিকে কোলে তুলে মার বুকের কাছে রাখেন। আর ঘরের দরজায় পাহাড়ায় থাকেন যাতে তাঁর ছেলে আর এরকম পাগলামি করতে না পারে। তাঁরা নয় ভাই-বোন। তাঁর মা মারা যাওয়ার পর তাঁর বাবা এক বিধবা মহিলাকে বিয়ে করেন। এই পক্ষের কয়েকজন ভাইবোন আছে। তাঁর বাবা কংগ্রেসি আন্দোলন করতেন। তাঁর মা মুসলিম লীগের পক্ষে ছিলেন কিন্তু তাঁর বাবা মুসলিম লীগের বিপক্ষে এবং কংগ্রেসের পক্ষে ছিলেন। ছোটবেলায় শওকত আলীকে পাঠশালায় ভর্তি করানো হয়েছিল কিন্তু তাঁর পাঠশালায় যেতে ভাল লাগত না বলে তিনি পাঠশালায় যাননি।
শওকত আলীসহ তিন সন্তান জন্মের পর তাঁর মা তাঁর বাবার সাথে বায়না ধরলেন তিনি ইংরেজি শিখবেন। কিন্তু খ্রীষ্টান মহিলার কাছে মুসলমান মহিলা কেন ইংরেজী শিখবে? এ নিয়ে রায়গঞ্জের অন্যান্য মহিলারা এসে তাঁর দাদীকে কথা শুনাতেন। কিন্তু এসব বাধা সত্ত্বেও মিশন স্কুলের একজন খ্রীষ্টান শিক্ষক রাখা হলো তাঁর মাকে ইংরেজি শেখানার জন্য। তিনি সেই শিক্ষকের কাছে ইংরেজি সহ অন্যান্য সব বিষয় পড়েন। এর কিছুদিন পর তাঁর মা শ্রীরামপুরের টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। তাঁর মা এখানে ভর্তি হওয়ার কয়েকমাস পর তাঁরা সপরিবারে শ্রীরামপুরে চলে আসেন এবং শ্রীরামপুর মিশনারী স্কুলে শওকত আলীর বাল্য শিক্ষা শুরু হয়। তিনি এখানে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তাঁর মা এই ইন্সটিটিউট থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এ তিন বছরের ডিপ্লোমা করেন। এরপর সেখান থেকে বি.এ. করার কথা ছিল। কিন্তু সালটা ১৯৪১ হওয়ায় তিনি তা করতে পারেননি কারণ তখন কোলকাতাতে বোমা পড়া শুরু হয়েছিল। তারপর আবার সেই রায়গঞ্জে ফিরে এলেন তাঁরা সপরিবারে। রায়গঞ্জে ফিরে এসে তাঁর মা সেখানকার গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলেন এবং বাবা ডাক্তারী পেশা শুরু করেন। রায়গঞ্জ করনেশন ইংলিশ হাইস্কুলে শওকত আলীকে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
১৯৫১ সালে তিনি করনেশন স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন । তখনকার দিনে মুসলমানরা পড়াশুনায় খুব অনগ্রসর ছিল । একারণে তিনি ম্যাট্রিক প্রথম বিভাগে পাস করার পর তাঁদের প্রতিবেশীরা অবজ্ঞাভরে বলত প্রথম বিভাগে পাস করেছে ‘মুসলার ছেলে’। সেইসময় সব স্কুলগুলি কোলকাতা ভার্সিটির অধীনে ছিল। তাঁর স্কুলের শিক্ষকরা প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। তাঁরা কোলকাতা ভার্সিটিতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আর সেই চিঠিতে তাঁরা লিখেছিলেন, আপনাদের রেজাল্ট দেখতে ভুল হয়েছে আপনারা আবার রেজাল্ট সিট ভালভাবে দেখুন, কারণ শওকত আলী প্রথম বিভাগে পাস করেনি। কারণ তাঁর শিক্ষকরা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, মুসলমানের ছেলে হয়ে তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেছেন। তখন কোলকাতা ভার্সিটি থেকে তাঁর স্কুলে রেজাল্ট সিট পাঠিয়ে দেওয়া হয় যেটা দেখে শিক্ষকরা নিশ্চিত হলেন যে তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেছেন। এরপর ১৯৫১ সালে তিনি দিনাজপুরের সুরন্দ্রনাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হন।
এরপর আসে ১৯৫২ সাল। যে সালের কথা মনে হলে এখনও শওকত আলীর বুকটা বেদনায় ভরে ওঠে। কারণ এই ১৯৫২ সালেই জন্মভূমিকে ত্যাগ করে তাঁরা চলে আসেন পূর্ববাংলার দিনাজপুরে। আর এটি ছিল তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা। তাঁরা ভাইবোনরা সবাই চলে এলেন কিন্তু তাঁর বাবা জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করতে পারলেন না। তিনি থেকে গেলেন কলকাতাতে। দিনাজপুরে আসার আগেই তাঁর মা মারা যান। দিনাজপুর জেলা শহরে এসে তাঁরা বাড়ি কিনলেন। বাবা না আসার কারণে তাঁদেরকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ফলে ১৯৫৩ সালে তাঁর বাবা চলে এলেন দিনাজপুরে।
রাজনীতির পাশাপাশি তাঁর বাবা লেখালেখিও করতেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধ কোলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর আর একটি নেশা ছিল হাত দেখা। তিনি হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলে দিতেন। পাকিস্তান সমর্থন করেননি বলে দেশভাগের সময় তিনি প্রথমে তাঁর ছেলেমেয়েদেরকে দিনাজপুরে পাঠিয়ে দেন কিন্তু তিনি আসেননি। পরে তাঁর বন্ধুরা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে যখন তাঁকে দিনাজপুরে পাঠিয়ে দিলেন তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ দেশ ছেড়ে আর কখনও যাবেন না। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই যখন ভারতে চলে গেলেন তখন তিনি সেখানে যাননি, দিনাজপুরেই তাঁর বাড়িতে রয়ে গেলেন একা। একদিন তাঁর বাড়ির দরজায় টোকা পড়ল। তিনি দরজা খুলে দেখলেন কেউ নেই। দরজায় কে টোকা দিল তা দেখার জন্য তিনি বাড়ির বাগান পার হয়ে বাইরের দরজার কাছে চলে এলেন এবং দেখলেন পাকিস্তানি আর্মি বাড়ির বাইরে টহল দিচ্ছে। তাঁকে দেখে তারা উর্দুতে বলল ‘ও ডাক্তার, ওকে মেরে ফেল।’ সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হল। মেরে ফেলার পর দুই মাস তাঁর মৃতদেহ তাঁর বাড়ির উঠানেই পড়ে ছিল। তারপর জনৈক এক ব্যক্তি তিনিও পাকিস্তান বিরোধী রাজনীতি করতেন, তিনি সেই মৃতদেহের হাড়-গোড় নিয়ে যেয়ে তাঁর বাড়ির সামনে কবর দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবর থেকে তাঁর হাড়-গোড় তুলে তাঁর নিজের বাড়ির উঠানে কবর দেওয়া হয় এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় খোরশেদ আলী সরকারের নাম ওঠে। শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান হওয়ায় শওকত আলী খুব গর্ববোধ করেন।
১৯৫১ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আই.এ. ভর্তি হওয়ার পর ১৯৫৩ সালে শওকত আলী দ্বিতীয় বিভাগে আই.এ. পাস করেন। তখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. জিসি দেব। তিনি তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। শওকত আলীর শখ ছিল ডাক্তার হওয়ার। সেকারণে তিনি আই.এস.সি. ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেরীতে ভর্তি হতে আসার কারণে তিনি আই.এস.সি.-তে ভর্তি হতে পারলেন না। ড. জিসি দেব তাঁকে আই.এ.-তে ভর্তি হতে বললেন। আই.এ. পাস করার পর এই কলেজেই বি.এ.-তে ভর্তি হলেন তিনি। কলেজ জীবন থেকেই কমিউনিষ্ট পার্টি করতেন এবং বিভন্ন মিছিল, আন্দোলনে তিনি থাকতেন। ফলে ১৯৫৪ সালে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলে তিনি এই বছর এপ্রিলে ধরা পড়েন এবং জেলে যান। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে তিনি ছাড়া পান। বন্দী অবস্থায় জেলখানাতেই বইপত্র নিয়ে তিনি পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করেছেন। তাঁর সাথে কয়েকজন শিক্ষকও ধরা পড়েছিলেন, তাঁরা জেলখানাতে তাঁকে পড়াশুনার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।
জেল থেকে বের হওয়ার বিশ দিন পর টেষ্ট পরীক্ষা দেন। ১৯৫৫ সালে বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে তৃতীয় বিভাগে পাস করেন । এরপর টিউশানী করা শুরু করেন। কিন্তু শওকত আলীর খুব শখ এম.এ. পড়বেন। তিনি নিজে কিছু টাকা জমালেন আর স্কুল টিচার বোন ও বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ. তে ভর্তি হলেন। তখন বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। দৈনিক ‘মিল্লাত’-এ একটা চাকুরীর জন্য তিনি সম্পাদকের সাথে দেখা করেন। সম্পাদক সাহেব বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া তাঁর লেখা পড়েছেন এবং পছন্দ হয়েছে। ফলে ১৯৫৫ সালে তিনি দৈনিক ‘মিল্লাত’-এ চাকুরী পেলেন নিউজ ডেস্কে। এরপর আবার ব্যাপকভাবে ধরপাকড় শুরু হলে তিনি পালিয়ে ঠাকুরগাঁও চলে যান। সেখানকার একটি স্কুলের হেড টিচারকে তিনি বলেন, শুধু থাকা খাওয়ার বিনিময়ে এই স্কুলে একটি চাকুরি দেন, বেতন প্রয়োজন নেই। তবে ৮০ টাকা বেতনে তাঁর সেই স্কুলেই চাকুরী হয়ে যায়। এই স্কুলে ৬-৭ মাস থাকার পর তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন এবং এম.এ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর তিনি প্রাইভেট টিউশনী শুরু করেন আর পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদপত্রে চাকুরী করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি বাংলায় এম.এ. পাস করেন।
এম.এ. পাস করে তিনি দিনাজপুরে ফিরে যান এবং সেখানকার একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ঠাকুরগাঁও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে এই কলেজে যোগ দেন বাংলার শিক্ষক হিসেবে। এই কলেজে থাকা অবস্থায় ১৯৬১ সালে তিনি বিয়ে করেন। মেয়ে ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হল স্বামী -স্ত্রীর নাম এক । তাঁর স্ত্রীর নাম শওকত আরা। ঠাকুরগাঁও-এ তাঁদের সংসার জীবন শুরু হয়। এর কিছুদিন পরেই তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৬২ সালে জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে চাকুরী করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে জেলা গেজেটিয়ারের ঢাকার হেড অফিসে এ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। অফিসটি এখন উঠে গেছে। ব্রিটিশ আমলে এই অফিসটি তৈরী হয়েছিল। এখানে অনেক বিখ্যাত লোক কাজ করেছেন। প্রত্যেকটি জেলার অতীত ও বর্তমানের সব দলিলপত্র এই অফিসে জমা থাকত। পরে এখানে তিনি ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৮৯ সালে তাঁকে সরকারী মিউজিক কলেজের প্রিন্সিপাল করা হয়। এরপর ১৯৯৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর তিন ছেলে। তাঁর স্ত্রী মারা যান ১৯৯৬ সালে।
ক্লাস নাইন টেনে-পড়তেই শওকত আলী লেখালেখি শুরু করেন। তবে দেশভাগের পর দিনাজপুরে এসে তাঁর প্রথম লেখা একটি গল্প প্রকাশিত হয় কলকাতার বামপন্থীদের ‘নতুন সাহিত্য’ নামে একটি পত্রিকায়। এরপর দৈনিক ‘মিল্লাত’, মাসিক ‘সমকাল’, ‘ইত্তেফাক’-এ তাঁর অনেক গল্প, কবিতা এবং বাচ্চাদের জন্য লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’ প্রকাশিত হয়। এটি একটি ছোট উপন্যাস। এরপর প্রকাশিত হয়েছে ‘ওয়ারিশ’, ‘প্রাদোশে প্রাকৃতজন’, ‘উত্তরের খেপ’সহ আরও অনেক বই। তিনি শিশু কিশোরদের জন্যও লিখেছেন। ‘ওয়ারিশ’ উপন্যাসে চারটি প্রজন্মের চিন্তাভাবনা ও জীবন যাপনের ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে একটি আত্ম আবিস্কারের কাহিনী গভীর বিশ্বস্ততার সাথে নির্মিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে ‘ওয়ারিশ’ অবশ্যই বিশিষ্ট সংযোজন ।
সেনরাজের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে দেশ। তুর্কী আক্রমণ অত্যাসন্ন। তবু সামন্ত-মহাসামন্তদের অত্যাচারের শেষ নেই। সেই অত্যাচার রুখে দাঁড়ায় কখনও অন্ত্যজেরা, কখনো বৌদ্ধেরা। শাসকদের বিশেষ রোষ তাই তাদের উপর। তাদেরই একজন প্রশ্ন করে দেখ, এই কী মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলই প্রাণ নিয়ে পলায়ণ করতে হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? এ জীবন কী যাপন করা যায়। বলো কতদিন এভাবে চলবে? ইতিহাসের সেই প্রাদোষকালের জটিল আবর্তে ঘুণ্যমান কয়েকজন প্রাকৃত নরনারীর কাহিনী বিবৃত হয়েছে ‘প্রাদোশে প্রাকৃতজন’ নামক উপন্যাসে। ইতিহাসে তাদের নাম নেই। হয়তো অন্য নামে তারা বাস করেছে সেই কালে। হয়তো অন্য কালেও। বড় যত্নের সঙ্গে শওকত আলী লিখেছেন তাদের কথা, সেই সময়ের কথা। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই বইতে দরদ, তথ্যের সঙ্গে মিলেছে অন্তর্দৃষ্টি, মনোহর ভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুপম ভাষা। এই উপন্যাস আমাদের উপন্যাসের ধারায় একটি স্মরণীয় সংযোজন। সবমিলিয়ে তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ২০-২২ টি হবে। এছাড়া ভিতর গড়ের তিন মূর্তিসহ আরও অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন বাচ্চাদের জন্য। তাঁর প্রবন্ধের বই বের হয়েছে একটা।
বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও একুশে পদক ছাড়াও তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির কর্তৃক হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৮৩ সালে তাঁকে অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: জন্মসাল নিয়ে অস্পটতা আছে শওকত আলীর। সার্টিফিকেটে তাঁর জন্মসাল দেওয়া আছে ১৯৩৬। তবে তাঁর বাবার ডায়রির খাতায় তাঁর জন্মসাল লেখা আছে ১৯৩৫। তিনি নিশ্চিত নয় কোন সালটি সঠিক। তবে দুই জায়গাতে জন্মতারিখ লেখা আছে ১২ ফেব্রুয়ারি। তিনি পশ্চিমবঙ্গের থানা শহর রায়গঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।
পড়াশুনা: শ্রীরামপুর মিশনারী স্কুলে শওকত আলীর বাল্য শিক্ষা শুরু হয়। তিনি এখানে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে কোলকাতাতে বোমা পড়া শুরু হলে আবার সেই রায়গঞ্জে ফিরে এলেন তাঁরা সপরিবারে। রায়গঞ্জে ফিরে এসে তাঁর মা সেখানকার গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলেন এবং বাবা ডাক্তারী পেশা শুরু করেন। রায়গঞ্জ করনেশন ইংলিশ হাইস্কুলে শওকত আলীকে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
১৯৫১ সালে তিনি করনেশন স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন । ১৯৫১ সালে সুরন্দ্রনাথ কলেজে আই.এ. ভর্তি হওয়ার পর ১৯৫৩ সালে শওকত আলী দ্বিতীয় বিভাগে আই.এ. পাস করেন। ১৯৫৫ সালে বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে তৃতীয় বিভাগে পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ. তে ভর্তি হলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি বাংলায় এম.এ. পাস করেন।
চাকুরি জীবন: ১৯৫৫ সালে তিনি দৈনিক ‘মিল্লাত’-এ চাকুরী পেলেন নিউজ ডেস্কে। এরপর আবার ব্যাপকভাবে ধরপাকড় শুরু হলে তিনি পালিয়ে ঠাকুরগাঁও চলে যান। সেখানকার একটি স্কুলের হেড টিচারকে তিনি বলেন, শুধু থাকা খাওয়ার বিনিময়ে এই স্কুলে একটি চাকরি দেন, বেতন প্রয়োজন নেই। তবে ৮০ টাকা বেতনে তাঁর সেই স্কুলেই চাকুরী হয়ে যায়। এই স্কুলে ৬-৭ মাস থাকার পর তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন এবং এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর তিনি প্রাইভেট টিউশনী শুরু করেন আর পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদপত্রে চাকুরী করেন।
এম.এ. পাস করে তিনি দিনাজপুরে ফিরে যান এবং সেখানকার একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ঠাকুরগাঁও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে এই কলেজে যোগ দেন বাংলার শিক্ষক হিসেবে। এই কলেজে থাকা অবস্থায় এর কিছুদিন পরেই তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৬২ সালে জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে চাকুরী করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে জেলা গেজেটিয়ারের ঢাকার হেড অফিসে এ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। অফিসটি এখন উঠে গেছে। ব্রিটিশ আমলে এই অফিসটি তৈরী হয়েছিল। এখানে অনেক বিখ্যাত লোক কাজ করেছে। প্রত্যেকটি জেলার অতীত ও বর্তমানের সব দলিলপত্র এই অফিসে জমা থাকত। পরে এখানে তিনি ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৮৯ সালে তাঁকে সরকারী মিউজিক কলেজের প্রিন্সিপাল করা হয়। এরপর ১৯৯৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
সংসার জীবন: ১৯৬১ সালে তিনি বিয়ে করেন। মেয়ে ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম শওকত আরা। ঠাকুরগাঁও এ তাঁদের সংসার জীবন শুরু হয়। তাঁর তিন ছেলে। তাঁর স্ত্রী মারা যান ১৯৯৬ সালে।
মৃত্যু- ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮ সালে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: আগষ্ট, ২০০৯ সালে শওকত আলীর সরাসরি সাক্ষাৎকার নিয়ে লেখাটি তৈরী করা হয়েছে।
লেখক : মৌরী তানিয়া