ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতা নামের শত্রু শওকত ওসমানকে সারা জীবন ধাওয়া করেছে। শুধু জীবন ধারণের জন্য শৈশবে, কৈশোরে আর প্রথম জীবনে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছিল দুঃসহ পরিবেশের সঙ্গে। এরই মধ্যে পড়ার খরচ যোগাড় করতে হয়েছে নিজেকেই। বিক্রি করে পরীক্ষার ফিস জমা দেয়ার জন্য মা তাঁর একমাত্র গয়না ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই অস্বচ্ছলতার কথা কাউকে কখনও বুঝতে দেননি। সবসময় ধোপদুরস্ত কড়া ইস্ত্রি করা পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন, যা দেখে কেউ বুঝতেই পারতেন না যে তাঁর সম্বল ঐ একটি দুটি জামা কাপড়। সেগুলো তিনি রোজ নিজে ধুয়ে শুকাতেন। পরে তাঁর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের লন্ড্রিতে নিজেই ইস্ত্রি করে নিতেন। এত কষ্টের মধ্যে থেকেও কারও কাছে সাহায্য চাননি, মাথা নোয়াননি। পরিবেশ, মানুষ এবং জীবন কেউ শওকত ওসমানকে হারাতে পারেনি। তিনি চিরদিন মাথা উঁচু করেই থেকেছেন। সম্পূর্ণ নিজ প্রতিভায় তিনি এদেশের অন্যতম লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, মননশীল নিবন্ধ, রাজনৈতিক প্রবন্ধসহ সাহিত্যের সব শাখাতেই তিনি প্রতিভা ও সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছেন।
ভারতের পশ্চিবঙ্গের হুগলি জেলার খানাকুল থানার সবলসিংহপুর গ্রামে ১৯১৭ সালের ২রা জানুয়ারী শওকত ওসমান জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া। মা গুলজান বেগম। তাঁর আসল নাম শেখ আজিজুর রহমান। তবে তিনি শওকত ওসমান নামে লিখতেন। সবলসিংহপুর মক্তবে ১৯২২ সালে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯২৬ সালে ভর্তি হন সবলসিংহপুরের জুনিয়র মাদ্রাসায় এবং ১৯২৯ সাল পর্যন্ত ওখানেই পড়াশোনা করেন। এরপর কলকাতা মাদ্রাসা-এ আলিয়ায় ভর্তি হন। দুই বছর পড়ার পর এই মাদ্রাসার ইংরেজী বিভাগে স্থানান্তরিত হন এবং এখান থেকেই ১৯৩৩ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করেন। ১৯৩৪ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৩৯ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান পাশ করেন এবং ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন।
১৯৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার কাওসার আলীর মেয়ে সালেহা খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা। পুত্র বুলবন ওসমান, আশফাক ওসমান, ইয়াফেস ওসমান, তুরহান ওসমান (প্রয়াত) ও জাঁনেসার ওসমান। কন্যা আনফিসা আসগর।
স্নাতকোত্তর পাশ করার পর ১৯৪১ সালেই কলকাতা কর্পোরেশনে ৮০ টাকা বেতনে পাম্ফলেট রাইটারের চাকরী গ্রহণ করেন। একই বছর কমার্শিয়াল কলেজে ১২৫ টাকা বেতনে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন । ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজে চলে আসেন। ১৯৭০ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৭২ সালে ১লা এপ্রিল ঢাকা কলেজ থেকেই অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং এদেশের রাজাকার-আলবদররা যে হত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগের মতো নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে সে ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। একইভাবে জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে লাখ লাখ দেশপ্রেমিক যেভাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন সেই চিত্রও তিনি এঁকেছেন নিপুন শৈল্পিক দক্ষতায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর কলকাতায় প্রায় ৫ বছরের জন্যে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন তিনি। এটি তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।
উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, মননশীল প্রবন্ধ, ব্যঙ্গরচনা – সব ক্ষেত্রেই দক্ষতার পরিচয় দিলেও তাঁর লেখক জীবনের সূত্রপাত হয় কবিতার মাধ্যমে। তবে কবিতার সঙ্গে গভীর ভাব জমে ওঠার আগেই তিনি গদ্য লিখতে শুরু করেন। কবিতায় তিনি আর কখনও ফিরে আসেননি সেভাবে। তবে প্রথম জীবনে কবিতার প্রতি তাঁর যে ঝোঁক ছিল তা কখনও ত্যাগ করতে পারেননি তিনি। তারই জের টেনেছেন ‘শেখের সম্বরা’-এর দুই খণ্ডে। সেখানে তাঁর কবিতা ব্যঙ্গরসযুক্ত। তিনি রচনা করেছেন ‘জননী’-র মতো বিখ্যাত উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন প্রবাসী বাঙালী ওসমান জামাল। ‘জননী’ প্রকাশিত হয়েছে লন্ডনের একটি নামজাদা প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এই বিষয়ে শওকত ওসমান সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি শামসুর রাহমানকে তাঁর স্বভাবসুলভ চমৎকার ভঙ্গিতে বলতেন, ‘শোনো শামসুর রাহমান, আমি পাশ্চাত্যকে অন্তত একটি বাংলা শব্দ উপহার দিয়েছি – জননী।’ তাঁর রচিত ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’ গল্পগ্রন্থটির অনুবাদ ‘গডস অ্যাডভার্সারিজ’ প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন পাবলিশার্স। এই বইটিও অনুবাদ করেছেন ওসমান জামাল। বই দুটি বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ‘জননী’ বিষয়ে সপ্রশংস আলোচনা প্রকাশ করেছে। আইয়ুব শাহের সামরিক শাসনের সময়ে তিনি লিখেছেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’। সামরিকতন্ত্র ও স্বৈরাচার-বিরোধী এই উপন্যাস লিখে তিনি সেসময় যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেন। এই উপন্যাসটিও ইংরেজীতে অনূদিত হয়েছে।
তাঁকে বলা যায় একজন শ্রমজীবী সাহিত্যিক। শ্রমিকের যেমন প্রতিদিনের কাজের দায় থেকে অব্যাহতি নেই তেমনি তিনিও সাহিত্যকর্ম থেকে একমুহুর্তের জন্যও অব্যাহতি নেননি। স্বাস্থ্যহীনতা বা বয়স কোন অজুহাতেই তিনি নিজেকে ছুটি দেননি। প্রতিকূল পরিবেশ সাহিত্যচর্চার পথে যে কোন বাধাই হতে পারে না তা তিনি প্রমাণ করেছেন। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন লেখেন?’ স্বভাবসুলভ সম্বোধনে অতি সরল জবাবে বলেছিলেন, ‘কেন লিখব না ব্রাদার। না লিখে যে পারি না।’
প্রথম দিকে শওকত ওসমানের লেখা প্রকাশিত হয় ‘সওগাত’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ এবং ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায়। তবে তাঁর প্রতিভা বিকাশের বিশেষ ক্ষেত্র রচনা করে দিয়েছিল হবীবুল্লাহ্ বাহার ও শামসুন নাহার সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকা। ‘বুলবুল’ সেকালে উচ্চ মানের সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে সমাদৃত ছিল। হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রী ঘটাতে তার পাতায় এগিয়ে এসেছিলেন অনেকে। সমাজের অনেক অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে এই পত্রিকায় লেখা হত।
শওকত ওসমান ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেননি। কিন্তু ‘জননী’-তে ওয়হাবি আন্দোলনের যে কথা আছে, তা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত শতাধিক বছরে বাঙ্গালী মুসলমান সমাজ নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেভাবে অগ্রসর হয়েছে তার সুস্পষ্ট একটা চিত্র তাঁর রচনায় আমরা দেখতে পাই । এ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে সমাজের বাহ্য ও সমাজভুক্ত মানুষগুলোর অন্তর্গত পরিবর্তন। সর্বযুগের সর্বকালের বড় কথাসাহিত্যিকের মতো কালের সাক্ষ্য বহন করে তাঁর রচনা। গ্রাম ছেড়ে আসার পর তিনি আর গ্রামে ফিরে যাননি। কিন্তু গ্রামের স্মৃতি তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। দীর্ঘসময় তিনি তাঁর লেখায় গ্রামজীবনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তারপর তাঁর লেখায় প্রাধান্য পায় শহর ও নগর জীবন।
গৃহকোণে বসে থেকে তিনি শুধু সাহিত্য সাধনা করেননি। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে লেখনী ছাড়াও তিনি রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছেন। জীবনের শেষের দিকে শওকত ওসমান রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতেন। শ্রমিকদের বিজয়ী রাষ্ট্র হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে তিনি খুব কষ্ট পান। দরিদ্র শ্রমিকদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর ভালবাসা। তিনি বলতেন, বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন খাদেম মাত্র- অর্থাৎ শ্রমিক। আর সেকারণেই শওকত ওসমানকে সাংবাদিক-সাহিত্যিক শ্রী সন্তোষ গুপ্ত বাংলার ‘গোর্কি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ ম্যাক্সিম গোর্কি এবং শওকত ওসমান দু’জনের লেখাতে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জীবনের বর্ণনা প্রাধান্য পেয়েছে।
তাঁর গল্প-গ্রন্থ : পিঁজরাপোল (১৯৫০); জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২); সাবেক কাহিনী (১৯৫৩); প্রস্তর ফলক (১৯৬৪); উপলক্ষ (১৯৬৫); নেত্রপথ (১৯৬৮); শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলন (১৯৭৪); জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫); মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬), বিগত কালের গল্প (১৯৮৬); পুরাতন খঞ্জর (১৯৮৭); উভশৃঙ্গ (১৯৮৮); ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০) প্রভৃতি।
তাঁর উপন্যাস : বনি আদম (১৯৪৩); জননী (১৯৫৮); ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২); সমাগম (১৯৬৭); চৌরসন্ধি (১৯৬৮); রাজা উপাখ্যান (১৯৭০); জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১); নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩); পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩); রাজসাক্ষী (১৯৮৫); আর্তনাদ (১৯৮৫); জনাংগী (১৯৮৬); পিতৃপুরুষের পাপ (১৯৮৬); দুই সৈনিক (১৯৭৩); রাজপুরুষ (১৯৯২) প্রভৃতি।
তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ : সমুদ্র নদী সমর্পিত (১৯৭৩); ভাব-ভাষা-ভাবনা (১৯৭৪); ইতিহাসে বিস্তারিত (১৯৮৫); সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই (১৯৮৫); নিঃসঙ্গ নির্মাণ (১৯৮৬); মুসলমান মানসের রূপান্তর (১৯৮৬); পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০) প্রভৃতি।
তাঁর কাব্যগ্রন্থ: নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত (১৯৮২); শেখের সম্বরা, ১ম ও ২য় খণ্ড (১৯৯২)।
তাঁর নাটক : আমলার মামলা (১৯৪৯), কাঁকর মনি (১৯৫২); তস্কর ও লস্কর (১৯৫৩); জন্ম জন্মান্তর (১৯৬০); তিনটি ছোট্ট নাটক (১৯৮৯) প্রভৃতি।
তাঁর শিশু সাহিত্য : ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪); তারা দুইজন (১৯৪৪); মস্কুইটোফোন (১৯৫৭); ডিগবাজী (১৯৬৪); এতিমখানা (১৯৬৪); প্রাইজ ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৯) প্রভৃতি।
তাঁর অনুবাদ : নিশো (১৯৪৮); পাঁচটি কাহিনী [লিও টলস্টয়] (১৯৫৯); টাইম মেশিন (১৯৫৯); পাঁচটি নাটক [মলিয়ের] (১৯৬৫); স্পেনের ছোট গল্প (১৯৬৫); পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ; সন্তানের স্বীকারোক্তি [অমৃতা প্রীতম] (১৯৮৫)।
এছাড়া তিনি আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা লিখেছেন এবং বিভিন্ন বই সম্পাদনা করেছেন।
সাহিত্যকর্মে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শওকত ওসমান ১৯৬২ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে লাভ করেন প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরমেন্স পদক। ১৯৮৩ সালে তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক। তিনি ১৯৮৬ সালে নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক ও ১৯৮৮ সালে মুক্তধারা পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৮৯ সালে ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯১ সালে টেনাশিস পুরস্কার ও ১৯৯৬ সালে মাহবুবউল্লাহ ফাউণ্ডেশন গ্রহণ করেন। আর ১৯৯৭ সালে তিনি লাভ করেন স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার।
পাকিস্তান আমলে যখন তিতাস গ্যাসের জন্ম হয় তখনকার কথা। দেশে তখন গ্যাসের চুলার প্রচলন হয়নি। গৃহস্থালির কাজে গ্যাস ব্যবহারের জন্য তিতাস গ্যাস লাইন টানা শুরু করেছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ খুঁজছিল একজন আদর্শ, সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ, যাঁর বাড়িতে প্রথম গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হবে। শেষে তারা নিজেরাই শওকত ওসমানকে নির্বাচন করে। অর্থাৎ শওকত ওসমানই একজন আদর্শ, সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ যাঁর বাড়িতে তিতাস গ্যাস কোম্পানীর সৌজন্যে প্রথম গ্যাসের চুলা জ্বলেছিল। পাকিস্তান আমলে তিনি স্বাধিকারের এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা সত্বেও পাকিস্তান আমলেই তাঁকে সৎ আদর্শবান ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে গর্বিত হয়েছে তিতাস গ্যাস।
দেশ ও জাতির প্রয়োজনে লেখনী ছাড়াও তিনি রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৪৬ সালের পাকিস্তানের বিরোধিতা থেকে শুরু করে ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধিতা পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
একেবারে শেষের দিকে তিনি আত্মজীবনী ‘রাহনামা’ লেখা শুরু করেন। এটি শেষ করার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত জেগে লিখতেন। ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ সেরিব্রাল অ্যাটাকে পড়েন তিনি। ফলে ‘রাহানামা’ রচনা অসমাপ্ত থেকে যায়। সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর শওকত ওসমান একেবারেই হারিয়ে ফেললেন তাঁর লেখালেখির ক্ষমতা। আর এই অসুখের সঙ্গে লড়াই করে ১৯৯৮ সালের ১৪ মে সকালে তিনি এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: ১৯১৭ সালের ২রা জানুয়ারী ভারতের পশ্চিবঙ্গের হুগলি জেলার খানাকুল থানার সবলসিংহপুর গ্রামে শওকত ওসমান জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা-মা: বাবা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া। মা গুলজান বেগম। তাঁর আসল নাম শেখ আজিজুর রহমান, কিন্তু তিনি শওকত ওসমান নামে লিখতেন।
পড়াশুনা: ১৯২২ সালে তাঁর শিক্ষা শুরু হয় সবলসিংহপুরের মক্তবে। ১৯২৬ সালে সবলসিংহপুরের জুনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ১৯২৯ সাল পর্যন্ত ওখানেই পড়াশোনা করেন। এরপর কলকাতা মাদ্রাসা-এ আলিয়ায় ভর্তি হন। দু বছর পর ওখানেই ইংরেজী বিভাগে স্থানান্তরিত হন। ১৯৩৩ সালে ১৬ বছর বয়সে ইংরেজীতে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৪ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৩৬ সালে প্রথম বিভাগে আই.এ. পাশ করেন। এরপর বি.এ. (অর্থনীতি সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে বি.এ. পাশ করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ.-তে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৪১ সালে এম.এ. পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে।
কর্মজীবন: স্নাতকোত্তর পাশ করার পর ১৯৪১ সালেই কলকাতা কর্পোরেশনে ৮০ টাকা বেতনে পাম্ফলেট রাইটারের চাকরী গ্রহণ করেন। একই বছর কমার্শিয়াল কলেজে ১২৫ টাকা বেতনে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজে চলে আসেন। ১৯৭০ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৭২ সালে ১লা এপ্রিল এই কলেজ থেকেই অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
পুরস্কার : ১৯৬২ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার; ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার; ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরমেন্স পদক; ১৯৮৩ সালে একুশে পদক; ১৯৮৬ সালে নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক; ১৯৮৮ সালে মুক্তধারা পুরস্কার; ১৯৮৯ সালে ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার; ১৯৯১ সালে টেনাশিস পুরস্কার; ১৯৯৬ সালে মাহবুবউল্লাহ ফাউণ্ডেশন আর ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার।
সংসার জীবন: ১৯৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার কাওসার আলীর মেয়ে সালেহা খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ পূত্র ও এক কন্যা। পুত্র সালে বুলবন ওসমান, আশফাক ওসমান, ইয়াফেস ওসমান, তুরহান ওসমান ও জাঁনেসার ওসমান। কন্যা সালে আনফিসা আসগর আলী।
মৃত্যু: ১৪ই মে ১৯৯৮ সালের সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র: শওকত ওসমান স্মারকগ্রন্থ, সম্পাদক – সেলিনা বাহার জামান, প্রথম প্রকাশ ১৪ মে, ২০০৪।
লেখক: মৌরী তানিয়া