ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ক্লাসরুম। ক্লাস শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। ছাত্রছাত্রীরা দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে। কারণ ক্লাস নেবেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। ক্লাস শুরু হল। একেবারে পিনপতন নীরবতা। শুরুতে কয়েকজনকে ছোট ছোট কয়েকটা প্রশ্ন করলেন তিনি, বেশির ভাগই তাঁর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারল না। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা তো কোন লেখাপড়া করনি, কোনকিছু জান না।’ কথাটা একটি তরুণের মনে খুব লেগেছিল, নিজেকে সামলাতে পারলেন না তিনি। শেষে বলেই ফেললেন, ‘আমি স্কুল-কলেজে থাকতে যা পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা পড়েছেন কিনা সন্দেহ।”
তরুণটির কথাটার পিছনে জোর ছিল। প্রমাণও ছিল। লিখেছিলেন ‘আমেরিকান নিগ্রো সাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধ, অনুবাদ করেছিলেন বিভিন্ন ভাষার গল্প। তিনি আহমদ শরীফকে সেদিনই জানালেন, তিনি নাটক লেখেন, পরদিন রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর লেখা একটি নাটক প্রচারিত হবে। তাঁর বিশ্বাস, এরকম নাটক এর আগে খুব একটা হয়নি। কথাটি বলেই তাঁর মনে হল, সর্বনাশ! কার সামনে কী বললেন তিনি। এখন পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচেন।
পরের দিন বন্ধুরা তাঁকে বললেন, ‘শরীফ স্যার তোকে খুঁজছেন। এখনই দেখা করে আয়।’ শুনে আমর্ম কেঁপে উঠেছিলেন তরুণটি। কাঁপা কাঁপা বুকে অধ্যাপক আহমদ শরীফের কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন তিনি। ভেতরে কাজ করছিলেন অধ্যাপক শরীফ, সালাম শুনে মাথাটা একটু তুলে বললেন, ‘তোমার নাটক দেখলাম। তোমার অহংকার স্বার্থক।’ বলে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। তরুণটি এক মূহূর্ত দেরি না করে ছুটতে শুরু করলেন। আর ছুটতে ছুটতে একটা বড় বাজিতে জিতে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে বন্ধুদের এসে বললেন, ‘শরীফ স্যার নাটক দেখেছেন, স্যার বলেছেন, আমার অহংকার স্বার্থক।’ সেদিনের সেই তরুণটি হলেন বাংলাদেশের অন্যতম নাট্যকার সেলিম আল দীন, যাঁকে নিয়ে এদেশের মানুষ অহংকার করে।
একেবারে অল্প বয়স থেকেই তাঁর দুরন্তপনা ছিল চোখে পড়ার মত। সবাইকে চমকে দিতে পছন্দ করতেন তিনি। দিন-রাতের কোন বালাই ছিল না। ভয় দেখাতে কোনো দ্বিধা করতেন না তিনি। প্রচন্ড দুরন্তপনার পাশাপাশি চলত তাঁর পড়ালেখাও। ছেলেবেলার বন্ধুরা এখনও তাঁর চঞ্চলতার সেসব কথা বলে যেসবের মধ্যে একই সঙ্গে একজন সৃষ্টিশীল মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ছিল।
কলাগাছের খোল কেটে, খেজুর গাছের কাঁটা সাজিয়ে বিচিত্র সব ভয় দেখানো জিনিসপত্র তৈরি করতেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন আর গ্রামে থাকা হয় না তাঁর। সেনেরখিল গ্রামের পাঠ চুকিয়ে বাবার সঙ্গে কখনও যেতে হয় চট্টগ্রামে, কখনও সিলেট, কখনও আখাউড়া, কখনও রংপুরে। তারপর ছেলেটি আবার ফিরে যান নিজ গ্রামে। সেখানে মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭ম থেকে ৯ম শ্রেণীতে থাকার সময়ই পড়া হয়ে যায় বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের গুরুত্বপূর্ণ অনেক রচনা। কৈশোরেই বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা পড়ে বিস্মিত, রবীন্দ্রনাথের গোরা পড়ে আলোড়িত হন ছেলেটি। একই সঙ্গে পড়া হয়ে যায় বাংলা কবিতার কেন্দ্রে, প্রান্তে থাকা বিভিন্ন কবিদের রচনা। এভাবে একটু একটু করে তৈরি হতে থাকে একজন শিল্পীর সৃজনশীল মন। কলেজে ওঠার সময়টায় তিনি বুঝতে পারেন কবিতা তাঁকে ডাকছে। ফেনী কলেজের দিনগুলোতে কবিতা তাঁকে আরও আকৃষ্ট করে। ছোটবেলা থেকে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে বিমুগ্ধ তরুণটি কবিতার মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করতে চাইলেন প্রথমে। কিন্তু কিছুতেই কবিতার ভাষাটি আয়ত্তে আসছিল না তাঁর। এই বেদনা তাঁকে তাড়িয়ে ফেরে।
সেই দিকটি চিনিয়ে দিয়ে একদিন আহসান হাবীব ওই তরুণকে বললেন, ‘তুমি নাটক লেখো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তির পর একদিন ক্লাসে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কারা কবিতা লেখ?’ কয়েকজন মহা-উত্সাহে দাঁড়ালে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাঁদের বললেন, ‘তোমরা বেরিয়ে যাও।’
সবাই অবাক। কিন্তু মুনীর স্যারের কথা, টু শব্দ না করে সবাই মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে না বাড়াতেই তিনি তাঁদের বললেন, ‘বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের মতো কবি এসেছেন, আরও কত কবি আছে বিশ্বসাহিত্যে, কবির কোনো শেষ নেই, শেষ নেই কবিতারও। তোমাদের মধ্যে কে জোর দিয়ে বলতে পারবে যে সে জীবনানন্দ দাশের চেয়ে ভাল কবিতা লিখতে পারবে? যদি না পার তাহলে কেন কবিতা লেখা?” কিন্তু সেদিন মুনীর স্যারের কথার উত্তর না দিয়ে সবাই চুপ করে রইল। তখন তিনি বললেন, ‘তবে যারা নাটক লিখতে চাও তারা থাকতে পার।’ এটা ছিল কবি হতে চাওয়া একটি তরুণের জীবনের দ্বিতীয় ধাক্কা। তাহলে কি নাটকই তাঁর জীবনের নিয়তি? আহসান হাবীব বললেন, মুনীর চৌধুরী তাগাদা দিলেন আর বিষয়টা চূড়ান্ত করলেন আহমদ শরীফ। শুরু হল নিয়মিত নাটক লেখা। সেই যে শুরু আর তার শেষ হল ২০০৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী। যেদিন ঢাকায় ল্যাব এইড হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মারা গেলেন তিনি। সারা দেশের নাট্যপ্রিয় মানুষকে, অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী আর প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিলেন বাংলা নাটকের অবিসংবাদিত পুরুষ সেলিম আল দীন।
জন্মেছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৮ই আগস্ট ফেনীর সোনারগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে। মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান তিনি। লেখাপড়ার শুরু হয়েছিল আখাউড়ায় গৃহশিক্ষকের কাছে। এর কিছুদিন পর সেনেরখিল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। তারপর মৌলভীবাজার বড়লেখার সিংহগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রামের উলিপুরে মহারাণী স্বর্ণময়ী প্রাইমারী স্কুল এবং রংপুর ও লালমনিরহাটের স্কুলে পড়েন। পরে নিজ গ্রাম সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৬৪ সালে। ফেনী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। টাঙ্গাইলের সাদত কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। আহসান হাবীব, মুনীর চৌধুরী, আহমদ শরীফ তাঁর শিল্পের পথকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন এবং করোটিয়ায় পেয়েছিলেন কবি রফিক আজাদের সাহচর্য, যা তাঁর শিল্পযাত্রাকে আরো বেগবান করেছিল। এ যাত্রার মাধ্যম ছিল নাটক। ঝুঁকেছিলেন পাশ্চাত্য নাটকের তত্কালীন বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান নাট্যকারের দিকে। তাঁদের মধ্যে এডওয়ার্ড এলবি যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আয়োনস্কোসহ আরো কিছু নাট্যকার।
অ্যাবসার্ড নাটকের ধারাকেই সেলিম আল দীনের চূড়ান্ত ধারা মনে হয়েছিল কিছুদিন। কিন্তু নানা খটকাও ছিল। যে জীবন তিনি দেখেন, যে জীবন তিনি অনুভব করেন ও কল্পনা করেন, অ্যাবসার্ড নাটকের ধারায় তা খুব খাপছাড়া লাগে তাঁর কাছে। অসংলগ্ন বোধ হয়। এই চিন্তার পাশাপাশি চলছিল রেডিও-টিভিতে নাটক লেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে পেয়ে গেলেন ম. হামিদ, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মতো সতীর্থদের। তাঁর লেখা ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ নাটকটির নির্দেশনা দিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। সেই থেকে শুরু হল সেলিম আল দীন ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নাট্যাভিযান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশ, মানুষ ও মাটি নিয়ে সেলিম আল দীনের পূর্বেকার ভাবনাগুলোতে ভাঙচুর ঘটে। গণহত্যা আর পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নতুন এক আত্মপ্রত্যয় আবিষ্কার করেন। লেখার ভিতর দিয়ে এদেশের মাটির দাবিকে বুঝতে পারেন তিনি। বুঝতে পারেন, মানুষের দাবিকে তুলে আনতে পাশ্চাত্যের নাট্যাঙ্গিক নয়, নিজস্ব আঙ্গিক ও মাত্রা প্রয়োজন। ততদিনে লেখা হয়ে গেছে ‘সর্প বিষয়ক গল্প’, ‘আতর আলির নীলাভ পাট’, ‘সংবাদ কার্টুন’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসির’র মতো নাটকগুলো। এদিকে জীবিকার কথাও ভাবতে হচ্ছে। তাই কপি রাইটার পদে বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘বিটপী’তে কাজ শুরু করলেন। একদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন চোখে পড়ল ছেঁড়া একটা কাগজে। হাতে বেশি সময় ছিল না। বিষয়টি নিয়ে তিনি আলাপ করলেন পারুলের সঙ্গে। কারণ পারুলকে তিনি জীবনসঙ্গিনী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পারুলকে বেছে নেওয়ার কারণ, তিনি হবেন লেখক। দরকার ধীর-স্থির ও কষ্টসহিষ্ণু একটি মেয়ে। যাঁর চাহিদা থাকবে কম; প্রেরণা থাকবে বেশি। পারুলের ভেতর সেই মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। পারুলকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে কেমন হবে?’ পারুল সানন্দে সায় দেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগদানের কিছুদিন পরেই বিয়ে হয় দুজনের। পারুলের সামনে একটাই স্বপ্ন, বিরাট বড় লেখক হবেন সেলিম আল দীন। তাঁর ভিতরের সৃষ্টিশীলতা আর বিরাট কিছু করার প্রত্যয় আর স্বপ্নকে চিনতে পেরেছিলেন তিনি।
স্ত্রী পারুলের কাছ থেকে প্রেরণা পাওয়ার পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সেলিম আল দীনের শিল্প সাধনাকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অপূর্ব নৈসর্গিক প্রকৃতি তাঁকে আকৃষ্ট করত ভীষণভাবে। তিনি বলতেন, ‘এই ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ।’
প্রথাগত শিক্ষকের মতো শুধুমাত্র শ্রেণীকক্ষেই পাঠদান, পরীক্ষা, খাতা দেখা, ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন না তিনি। ক্লাসের বাইরেও তাঁর সৃজনশীল কাজের অংশীদার করে তুলতেন শিক্ষার্থীদের। তাদেরকে মানবসভ্যতার নানান বিন্দুকে চিনিয়ে দিতেন তিনি। তাদের হাতে তুলে দিতেন যার যার নিজস্ব শিল্পগৃহ খোলার চাবিকাঠি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর তিনি ১৯৮৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। একদিকে শিক্ষকতার দায়িত্ব অন্যদিকে লেখালেখি। একরকম টানাটানির ভেতর দিয়ে পার করতে হয়েছে অনেকটা সময়। টিভিতে নাটক লিখে খুব একটা আয়-রোজগার হত না প্রথম দিকে। আর শিক্ষকতার মাইনে তো খুবই সামান্য। এই আয়ের একটা অংশ দেশের বাড়িতে পাঠাতেন তিনি। আর ভাইবোনদের মানুষ করার মতো দায় দায়িত্বগুলো নিতে হয়েছিল তাঁকে। এ কাজের অনেকটাই বহন করেছিলেন পারুল নিজেও। পারুল তখন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলে। আস্তে আস্তে ভাইবোন প্রত্যেককে দাঁড় করিয়ে দিতে যেটুকু সহযোগিতা প্রয়োজন, স্ত্রী পারুল তা করেছেন যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে।
১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর নাটক লেখার ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি কীভাবে নিজের স্বর প্রতিষ্ঠা, মাটি ও মানুষের নান্দনিক দাবিকে পূরণ করা যায়-অবিরাম সে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সেলিম আল দীন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিতরে শিক্ষক ও গবেষক হিসাবে সেই সত্তাটিকে লালন করেছেন যার সঙ্গে তাঁর সৃজনশীল সত্তার কোনো বিরোধ ছিল না। গবেষক হিসেবেই খুঁজে বের করলেন বাংলা নাটকের হাজার বছরের পুরনো শিল্পরীতিকে। যে নাট্যরীতি আমাদের একেবারেই নিজস্ব, ছোটগল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধের মতো পাশ্চাত্যের প্রেরণা তাড়িত বিষয় নয়। লঙ্গিনাসের ‘অন সাবলাইম’ আর পিটার ব্রুকের ‘দ্য এম্পটি স্পেস’এর মতো রচনাগুলোর সঙ্গে তিনি সমন্বয় করতে চাইলেন প্রাচ্যের নান্দনিকতার। ভারত নাট্যশাস্ত্রের নির্যাস ও বাংলা ভাষার মধ্যযুগের সাহিত্যরীতি থেকে পাওয়া শিল্প উদ্দীপনাগুলো, এমনকি শব্দপ্রতিমাকে নতুন করে জাগিয়ে তুললেন নিজের সৃষ্টিকর্মে।
সেলিম আল দীনকে নতুন একটি শিল্পভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিল এই নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তা। তিনি লিখলেন ‘শকুন্তলা’। কিন্তু তাঁর মনে হল আরও বিরাট কোন জায়গায় নাটককে নিয়ে যাওয়া যায়। করে তোলা যায় মহাকাব্যের সমান। একদিকে হোমার, ওভিদ, ভার্জিল, দান্তে, অন্যদিকে বেদব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাসসহ ভারতীয় নন্দন শাস্ত্রকারদের রচনার মধ্য থেকে বের করতে চাইলেন মহাকাব্যিক বাস্তবতার মাত্রা। লেখা হল ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘কিত্তনখোলা’ ও ‘হাত হদাই’।
তিনি সারা জীবন চেষ্টা করেছেন কোনো পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় এবং সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন শেষাবধি। ‘মধ্য যুগের বাংলা নাট্য’ নামের গবেষণাটি সম্পন্ন্ করার সময় তিনি কথানাট্য, পাঁচালি রীতির মতো শিল্প আঙ্গিকের চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি গবেষণাটি সম্পন্ন করার আগেই লিখে ফেললেন ‘চাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’ ও ‘হরগজ’। এছাড়া দ্বৈতাদ্বৈতবাদ সেলিম আল দীনকে নতুন নাট্যধারার পথ দেখিয়ে দিয়েছিল। তিনি মনে করতেন, একজন লেখককে বাঁচায় তাঁর নিজস্ব সৌন্দর্যদর্শন, তাঁর নিজের এসথেটিক্স। যার সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হয় দেশীয় ঐতিহ্যের শিল্পধারণা ও প্রেরণা।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে কিছু বিষয় তাঁকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। অস্থির ও কেন্দ্রচ্যুত করে তুলেছিল- এর চূড়ান্তে ছিল শ্যালিকার মেয়ে অন্বিতার লিউকোমিয়া ধরা পড়ার বিষয়টি। একমাত্র সন্তান মঈনুল হাসানের অকাল মৃত্যুর পর থেকে সেলিম আল দীন ছিলেন নিঃসন্তান। শিশু অন্বিতাকে ভীষণ ভালবাসতেন তিনি। আর নিজের সেজভাই বোরহান উদ্দীনের মেয়ে কাজরীকে সন্তানের মমতায় বড় করেছেন। অন্বিতার ক্যান্সার হওয়াটাকে সহজ ভাবে নিতে পারেননি তিনি। ডাক্তারের কাছে রোগটির কথা শুনে চিত্কার করে শিশুর মতো কেঁদে একটি কথাই বারবার বলেছিলেন, ‘অন্বিতার মৃত্যু আমি কিছুতেই দেখতে পারব না। তার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়।’ তাঁর সেই ইচ্ছাই পূরণ হয়েছিল। অন্বিতার মৃত্যুর প্রায় দেড়মাস আগেই মারা গেছেন সেলিম আল দীন।
সেলিম আল দীনের মৃত্যু তো আসলে মৃত্যু নয়, এটা আরেক উজ্জীবনের নাম। তাঁর চলে যাওয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর অস্তিত্বকেই বরং আমরা বারবার টের পাব তাঁর রচনাবলির মধ্য দিয়ে। নিজের গ্রন্থ প্রকাশ নিয়ে তিনি কোনো দিন ব্যস্ত ছিলেন না। তাঁর কিছু ভক্ত আর কিছু শুভানুধ্যায়ী বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিভিন্ন বই প্রকাশ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এছাড়া বাংলা একাডেমী তাঁর কয়েকটি বই প্রকাশ করে।
বছরের পর বছর নিমগ্ন থাকতেন কোন একটা চিন্তার পেছনে। কিন্তু সেটা শেষাবধি আর হয়ে উঠত না। আবার এক ঝলকে পেয়ে যেতেন কোনো কাহিনীর রূপরেখা। বিশেষ করে টিভি নাটকের অসংখ্য কাহিনী তাঁর মনে বিদ্যুতের ঝলকের মতো রেখাপাত করত।
তারুণ্যের শেষ দিক থেকেই উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। রাতে উচ্চ রক্তচাপ রোধ করার ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যেতেন, কিন্তু অনেক সময়ই ঘুম হত না। বিশেষ করে লেখায় পেয়ে বসলে অসুখ-বিসুখ, নিয়ম-কানুন সব ভুলে যেতেন তিনি।
বিভিন্ন উত্সব আয়োজন যা কিছু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হত তা তাঁকে বাদ দিয়ে ভাবা যেত না। বিভিন্ন উত্সবের মূল বাণী ঠিক করে দেওয়া, অনুষ্ঠানের মেজাজ অনুযায়ী গান তৈরি করে দেওয়া সবই করতেন তিনি। গান লিখতেন আশির দশকের মাঝমাঝি সময় থেকে। নাটকের গান তো ছিলই। পাশাপাশি আরও অনেক গান লিখেছিলেন। তিনি গানকে বলতেন, কথাসুর। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ছোট্ট একটা গানের দল। নাম দিয়েছিলেন, ‘কহনকথা’।
বেশ কিছু গান তিনি ও তাঁর গানের দল ‘কহনকথা’র শিল্পীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেছিলেন। ‘কহনকথা’র শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সাবেরা তাবাসসুম, সাকিরা পারভীন সুমা, সঙ্গীতা চৌধুরী, কাজী শুসমিন আফসানা, আবদুল্লাহ আল মামুন ও শশী।
সেলিম আল দীন প্রেরণা পেয়েছেন হোমার, ফেরদৌসী, গ্যেটে আর রবীন্দ্রনাথের মতো কবিদের কাছ থেকে। তাঁদের কাছ থেকে বারবার ফিরে গেছেন একান্ত বাধ্যগত শিষ্যের মতো। আবার তাঁদেরকে গুরু মেনে তাঁদেরকে পেরিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা দিনরাত মনের ভেতরে লালন করতেন তিনি। কিন্তু তিনি এটাও জানতেন তাঁর সেই আশা কোন দিন পূরণ হওয়ার নয়। শেষদিকে লেখা তাঁর দিনপঞ্জির অসংখ্য পাতায় এর প্রমাণ আছে। সেলিম আল দীন যেসব কাজ করেছেন সেগুলির মূলে আছে পাশ্চাত্য শিল্পধারাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজস্ব শিল্প সৃষ্টি করে তা অনুশীলন করা। পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের লেখক, কবি, শিল্পী ও নাট্যকর্মীদের এই বোধে উজ্জীবিত করা যে আমাদের শিল্প ঐতিহ্য নিয়েই আমরা তৈরি করতে পারি আমাদের নিজস্ব শিল্পজগত। পরের অনুকরণ করে কখনও নিজস্বতা অর্জন করা যায় না। খুব জোরের সঙ্গে বারবার বলেছেন, ‘অন্যের বসন কখনও নিজের হয় না। হয় না সেটা নিজের ভূষণ।’
শিল্প বিষয়ে জ্ঞান অর্জন, নিজের শিল্পবিশ্বাস নির্মাণ করে তা অনুশীলন ও পরবর্তী প্রজন্মকে সেই শিল্প ধারণায় অবগাহনের প্রেরণা আমৃত্যু সঞ্চার করেন যিনি তিনিই তো একজন আচার্য হয়ে ওঠেন। সেই অর্থে সেলিম আল দীনের অবস্থান আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে একজন আচার্যের মতোই। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে দায়িত্ব তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অর্পন করে গেছেন, তা তাদেরকে অবিরাম প্রেরণা দিয়ে যাবে।
সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
জন্ম ও শৈশব
নাট্যকার সেলিম আল দীন জন্মেছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৮ই আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে। মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান তিনি। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে। বাবার চাকুরির সূত্রে এসব জায়গার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা করেছেন তিনি।
শিক্ষা
সেলিম আল দীন ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পাস করেন। ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. পাস করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন৷ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করোটিয়ায় সাদত কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন সেলিম আল দীন।
পেশা
বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে কপি রাইটার হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু করলেও পরে সারাজীবন শিক্ষকতাই করেছেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন তিনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
রচিত গ্রন্থ
প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক’ (১৯৭৩)। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক-গ্রন্থ: ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ (১৯৭৫), ‘বাসন’ (১৯৮৫) ‘মুনতাসির’, ‘শকুনত্মলা’, ‘কিত্তনখোলা’ (১৯৮৬), ‘কেরামতমঙ্গল’ (১৯৮৮), ‘যৈবতী কন্যার মন’ (১৯৯৩), ‘চাকা’ (১৯৯১), ‘হরগজ’ (১৯৯২), ‘প্রাচ্য’ (২০০০), ‘হাতহদাই’ (১৯৯৭), ‘নিমজ্জন’ (২০০২), ‘ধাবমান’, ‘স্বর্ণবোয়াল’ (২০০৭), ‘পুত্র’, ‘স্বপ্ন রজনীগণ’ ও ‘ঊষা উত্সব’৷ রেডিও টেলিভিশনে প্রযোজিত নাটক: ‘বিপরীত তমসায়’ (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯), ‘ঘুম নেই’ (পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭০), ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি), ‘অশ্রুত গান্ধার’ (বিটিভি, ১৯৭৫), ‘শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য’ (বিটিভি ১৯৭৭), ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ (আয়না সিরিজ, বিটিভি ১৯৮২-৮৩), ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ (বিটিভি ১৯৯০-৯১), ‘ছায়া শিকারী’ (বিটিভি ১৯৯৪-৯৫), ‘রঙের মানুষ’ (এনটিভি ২০০০-২০০৩), ‘নকশীপাড়ের মানুষেরা’ (এনটিভি, ২০০০), ‘কীত্তনখোলা’ (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫)৷
গবেষণাধর্মী নির্দেশনা: ‘মহুয়া’ (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯০), ‘দেওয়ানা মদিনা’ (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯২), ‘একটি মারমা রূপকথা’ (১৯৯৩), ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘মেঘনাদ বধ’ (অভিষেক নামপর্ব)৷ অন্যান্য: ‘চাকা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪, ‘কীত্তনখোলা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে৷ ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪; ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা, ১৯৮৫; কথক সাহিত্য পুরস্কার, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ; একুশে পদক, ২০০৭; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৯৩; অন্য থিয়েটার (কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা); নান্দিকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা) ১৯৯৪; শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার, ১৯৯৪; খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪; মুনীর চৌধুরী সম্মাননা, ২০০৫।
মৃত্যু: তিনি ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসুত্র: থিয়েটারওয়ালা, থিয়েটার, থিয়েটার স্টাডিস, ভোরের কাগজ, যুগান্তর, লেখকের স্ত্রী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা সেলিম ও তাঁর ছাত্র।
লেখক : শামীমা দোলা