করাচিতে দুই কামরার বাসায় থাকেন সাঈদ আহমদ। সরকারি চাকরিতে একজন বাঙালি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি তখন কোণঠাসা অবস্থায়। ওই সময় করাচিতে গেলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে হাজির হলেন শিল্পী হামিদুর রাহমান ও মুর্তজা বশীর। এদের সাথে এসে যোগ দিলেন করাচির বিখ্যাত চিত্রকর সাদেকাইন। দুই কামরার বাসার পক্ষে যথেষ্ট ভীড়। সারা দিন পেইন্টিং, আড্ডা, হট্টগোল লেগেই আছে। বিরক্ত হয়ে পড়লেন সাঈদ আহমদ। অফিস থেকে বাসায় ফিরে নিজের কাজ কিছুই করা হচ্ছিল না তাঁর। একদিন তিনি রেগে গিয়ে অন্যান্যদেরকে বললেন, ‘আমি দরজা বন্ধ করে কাজ করব। আপনারা হৈচৈ করবেন না।’
দরজা বন্ধ করে লিখতে বসে গেলেন তিনি। একটানা রাত আটটা পর্যন্ত লিখলেন। লিখলেন ইংরেজিতে। প্রায় সাতদিনে এ লেখাটি একটি অ্যাবসার্ডধর্মী পূর্ণাঙ্গ নাটক হয়ে উঠল। নাটকের নাম রাখলেন ‘দ্য থিং’ । নাটকটি তিনি পড়ে শুনালেন জয়নুল আবেদিন ও হামিদুর রাহমানকে। জয়নুল আবেদীন শুনে মন্তব্য করলেন, ‘এই নাটক খুব মুশকিলের। আমি তেমন বুঝতে পারি নাই। তবে আমি এটির প্রচ্ছদ করব।’ শিল্পাচার্য এ নাটকের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু প্রচ্ছদটি আঁকা হয়নি তাঁর। সাঈদ আহমদের ‘দ্য থিং’ নাটকটি যখন লেখা হয় তখনও বাংলায় তো নয়ই উপমহাদেশেও অ্যাবসার্ডধর্মী কোনও নাটক রচিত হয়নি। সাঈদ আহমদের সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের নাট্যকার বাদল সরকার অ্যাবসার্ডধর্মী নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ রচনা করেন আরও এক বছর পর ১৯৬২ সালে ।
১৯৬১ সালে আমেরিকা থেকে করাচিতে আসে মেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেইন মাসকুইয়ার্স’ দল। তখন নাট্যকার হিসেবে এই দলের দলনেতা ড. হারশালের সাথে পরিচয় হয় সাঈদ আহমদের। করাচিতে এ দলের পরিবেশনায় ‘দ্য থিং’ মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি বাংলায় ‘কালবেলা’ নামে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা নেয় ড্রামা সার্কল। গ্রুপ থিয়েটারের পথিকৃৎ নাট্যসংগঠনগুলোর অন্যতম ড্রামা সার্কল অ্যাবসার্ডধর্মী প্রথম নাটকটিকে মঞ্চে জীবন্ত করে তোলে। এক্ষেত্রে নাট্যনির্দেশক বজলুর রহমান ও নাট্যকার নিজে নাটকটির বাংলা অনুবাদ করেন। পরে নাট্যকার নিজে আরও পরিমার্জন ও সংশোধন শেষে এটিকে মুদ্রণ মাধ্যমের উপযোগী করে তোলেন এবং ‘পরিক্রমা’ নামের একটি সাহিত্যপত্রে সেটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে ড্রামা সার্কল ঢাকার তোপখানা রোডে তৎকালীন ইউসিস মিলনায়তনে এটি মঞ্চস্থ করে। ‘কালবেলা’ নাটকটি বেশকিছু ভাষায় অনূদিত এবং বিদেশে মঞ্চস্থও হয়েছে।
বাংলা নাটক ও নাট্যচর্চার ইতিহাসে সাঈদ আহমদ বিশেষ ও বিশিষ্ট ব্যতিক্রম। দেশের নাটককে বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে নিয়ে গেছেন তিনি। বাংলাদেশের আধুনিক নাট্যচর্চার গোড়াপত্তনকারীদের অন্যতম সাঈদ আহমদ উপমহাদেশের অ্যাবসার্ড নাটকের পথিকৃৎ। নাট্যকার সাঈদ আহমদ সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্র-সমালোচক, সংস্কৃতিবেত্তা, নির্মাতা এবং অভিনেতাও। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর নাটক অনূদিত হয়েছে। বিশ্বের নামিদামি অনেক একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
সাঈদ আহমদের জন্ম ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি পুরনো ঢাকার ইসলামপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। নর্মাল স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন তিনি। এরপর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অন্য অনেকের মতো তাঁর শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতায় এক বছরের জন্য ছেদ পড়ে। ফলে ১৯৪৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ব্রিটেনে চলে যান। ১৯৫৬ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
শিক্ষাজীবন শেষ করার পরপরই ১৯৫৬ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান তিনি। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে নিষ্ঠার সাথে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দীর্ঘ চাকরি জীবনের প্রথমদিকে পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি।
সাঈদ আহমদের পরিবার শুধু বংশপরিচয়ের দিক থেকে নয়, শিল্প-সংস্কৃতির দিক থেকেও সম্ভ্রান্ত। তাঁর বাবা মীর্জা এফ মোহাম্মদ ও মা জামিলা খাতুন দুজনেই সংস্কৃতি আমোদে মানুষ। বাবা ও চাচার সাথে প্রখ্যাত সঙ্গীতসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বন্ধুত্ব ছিল। সুফিবাদের গভীর তত্ত্ব নিয়ে তাঁর মা জামিলা খাতুন এবং শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের মধ্যে আলোচনা বেশ জমে যেত। সাঈদ আহমদের পরিবারের সাথে ঢাকার সংস্কৃতিবান পরিবারগুলোর সখ্য ছিল। শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটত তাঁদের বাড়িতে।
সাঈদ আহমদের ভাইবোনদের মধ্যে বেতার ব্যক্তিত্ব নাজির আহমদ ও চিত্রশিল্পী হামিদুর রাহমান শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। অন্য ভাইবোনদের মধ্যে আছেন নাসির আহমদ, মেহেরুননিসা বেগম এবং শামসুন্নাহার বেগম, লুৎফুন্নাহার বেগম। ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ ছিলেন সাঈদ আহমদ।
আজকের সাঈদ আহমদ নাটকের জন্য সমধিক পরিচিত হলেও শৈশব ও কৈশোরে এমনকি প্রথম যৌবনেও সঙ্গীত তাঁকে যতটা মগ্ন করে রেখেছিল নাটক ততটা মগ্ন করতে পারেনি। একেবারে ছেলেবেলা থেকেই অসম্ভব টান ছিল সঙ্গীতের প্রতি। আবৃত্তি আর গান মিলে ছিল তাঁর ছেলেবেলা। দশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পলাতকা’ আবৃত্তি করে প্রথম পুরস্কার বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি। স্কুলের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্যও তাঁর ডাক পড়ত।
বড়মাপের সঙ্গীতসাধক হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের পরিবারের সাথে তাঁদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান ছিলেন তাঁর সমবয়সী এবং বন্ধু। ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান তাঁর ওস্তাদ। আয়েত আলী খাঁর কাছ থেকেও তিনি পরোক্ষ শিক্ষা পেয়েছেন। সাঈদ আহমদ বাংলাদেশের ২১ জন সঙ্গীতজ্ঞের জীবন ও কর্মের পরিচিতি তুলে ধরে ‘বাংলাদেশের সুরস্রষ্টারা’ নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
সাঈদ আহমদ ১৯৫১ সালে পাশ্চাত্যের ধাঁচে একটি সঙ্গীতের দল গড়ে তোলেন। তাঁর সে দলের নাম ছিল ‘সাঈদ আহমদ অ্যান্ড পার্টি’। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে প্রথম তিনি ইলেক্ট্রিক গিটার নিয়ে আসেন। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানে সেতার ও অর্কেস্ট্রা বাদন পরিবেশন করেন । রেডিওর সেসব অনুষ্ঠানের জন্য স্ক্রিপ্ট করতেন কবি শামসুর রাহমান এবং সুর করতেন তিনি। তাঁদের পরিবেশনা ‘সোনার কাঠি-রুপার কাঠি’ , ‘সৃষ্টি’ এবং ‘এরা নির্ভীক যাত্রী’ সে সময় জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘এরা নির্ভীক যাত্রী’-তে ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকায় কর্তৃপক্ষ আপত্তি তোলে। পরে ওই স্ক্রিপ্টে মরুভূমির প্রেক্ষাপট জুড়ে দেওয়া হয়, আর সবই ঠিক থাকে। এতে করে শ্রোতারা যা বোঝার ঠিকই বুঝেছিল।
লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সে পড়ার সময় সাঈদ আহমদের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক মেনিং। সে সময়ে পড়ার পাশাপাশি লন্ডনের মর্লি কলেজ অব মিউজিক-এ সঙ্গীত শেখার অনুমতি চাইলেন। মেনিংয়ের ছেলে ছিলেন সাঈদ আহমদের বন্ধু।
বন্ধুর বাবা হওয়া সত্ত্বেও মেনিং তাঁর এই ছাত্রকে গানের কলেজে ঢোকার অনুমতি দিতে চাইলেন না। কিন্তু ছাত্র বড় একরোখা। গানের কলেজে তিনি যাবেনই। প্রয়োজনে ছেড়ে দেবেন কলেজ অব ইকনোমিক্স। বাধ্য হয়ে অনুমতি দিলেন মেনিং। সপ্তাহে তিন দিন মর্লি কলেজে মিউজিক শিখতেন সাঈদ আহমদ।
রেডিও পাকিস্তানে অর্কেস্ট্রা ও সেতার বাদন ছাড়াও বিবিসিতে সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিবিসির সাথে। লন্ডনের বিভিন্ন থিয়েটার ও কনসার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি। ১৯৫৫ সালে প্যারিসের ‘মুজি গিমেট’-এ আমন্ত্রিত হয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সাঈদ আহমদ। ফ্রান্স টেলিভিশনে সে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ভারতীয় নৃত্যদলের সাথে সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব হিসেবে সাঈদ আহমদ পশ্চিম জার্মানি, স্পেন ও ইতালি সফর করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় মোকসুদ আলীর ‘ইউরেকা’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। পরে তিনি শেক্সপিয়রের নাটক ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’সহ অভিনয় করেন ‘অবাক জলপান’, ‘শেষরক্ষা’ ইত্যাদি নাটকে। উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনে ইউরোপে থাকার সময় নাটক দেখা ও অভিনয় দুটোই করেছেন তিনি। এর পরে লন্ডনে থাকার সময় অভিনয় করেন ‘আ কিং ইজ বর্ন’ নাটকে। শ্বেতাঙ্গদের ভিড়ে এই নাটকে তিনিই একমাত্র অসবর্ণ অভিনেতা।
সাঈদ আহমদের লেখা দ্বিতীয় নাটক ‘মাইলপোস্ট’ । ‘মাইলপোস্ট’ লেখা শুরু করেন পাকিস্তানের লাহোরে থাকার সময়। ‘মাইলপোস্ট’ নাটকটিও প্রথমে ইংরেজিতে লেখেন। এটির প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান। ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাংলা একাডেমী আয়োজিত নাট্য মৌসুমে ‘সাতরং নাট্যগোষ্ঠী’ বাংলা একাডেমী মিলনায়তনে এটি প্রথম মঞ্চস্থ করে। তাঁর লেখা তৃতীয় নাটক ‘তৃষ্ণায়’। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এ নাটকটি রচনা করেন তিনি। প্রথমত এ নাটকটি বাংলায় লেখা হয় এবং পাশাপাশি নাট্যকার নিজে এটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমী ‘তৃষ্ণায়’ নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোককাহিনী শিয়াল ও কুমীর ছানার গল্পকে উপজীব্য করে এ নাটকটি রচিত। অস্তিত্বের সংগ্রামে সুচতুর শেয়ালের কাছে মার খাওয়া কুমীরের গল্প এ নাটকে বিনির্মিত হয়ে আরও ব্যাপকতর মাত্রা পায় এবং সামগ্রিক জীবনবোধ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। বাংলাদেশে লোককাহিনী নিয়ে শিশুতোষ নাটকের বাইরে কোনও নাটক তিনিই প্রথম রচনা করেন। ‘ব্যতিক্রম’ নাট্যগোষ্ঠী নাটকটি বাংলাদেশে প্রথম মঞ্চস্থ করে।
১৯৬৭ সালে ‘তৃষ্ণায়’ এর পাঞ্জাবি অনুবাদ ‘জঙ্গল গা রাখা’ মঞ্চস্থ হয় লাহোরে। সরকারি চাকরিসূত্রে সাঈদ আহমদ তখন লাহোরে। লাহোর, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও পেশোয়ারে এর আগেও তাঁর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটকটি দেখার জন্য প্রতিদিন দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। এক সপ্তাহ চলার পর লাহোরের কমিশনার সাঈদ আহমদকে ডেকে পাঠালেন। কমিশনারের সাথে তাঁর বেশ বন্ধুত্ব ছিল, কিন্তু ওইদিন তিনি বন্ধুত্ব দেখালেন না। কী করলেন? তা সাঈদ আহমদের কাছ থেকেই শোনা যাক: ‘কমিশনার গম্ভীর হয়ে বললেন, নাটকে আপনি ইয়াহিয়া খানকে কটাক্ষ করেছেন। এর সাজা আপনাকে নিতে হবে। আমি বললাম, আমি তো জেনে করিনি। তাছাড়া এ তো জানোয়ারকা কাহানি হ্যায় জানোয়ার বলতা হ্যায়। একটা নাটকের আর কী এমন দাম। কিন্তু এসব কথায় তিনি দমবার পাত্র নন। বহুত লোক দেখছে, অ্যান্টি প্রপাগান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এ নাটক মঞ্চায়নের আগে আপনি অনুমতি নেননি। কেন অনুমতি না নিয়ে মঞ্চায়ন করলেন? বললাম, অনুমোদনের ব্যাপারটি আমার জানা ছিল না। সেবার এসব বলে টলে পার পেয়েছিলাম এবং চাকরিটাও রক্ষা হয়েছিল। কিন্তু নাটকটির শো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ঠিকই।’
সাঈদ আহমদের চতুর্থ নাটক ‘প্রতিদিন একদিন’ । মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় এ নাটক রচনা করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে এ নাটক রচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনে নেমে আসা চরম অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেন তিনি এ নাটকে। তাঁর লেখা পঞ্চম নাটক ‘শেষ নবাব’ । ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দশ বছর এ নাটক রচনায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
সাঈদ আহমদ বাংলাদেশের চিত্রকলা নিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছেন। চিত্রকলার সমালোচনা শুরুই করেন তিনি। করাচিতে থাকাকালে তিনি চিত্রকলা নিয়ে লেখালেখির শুরু করেন । লন্ডনে থাকার সময় আর্টের ওপর একটা কোর্স করেন তিনি। চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, হামিদুর রাহমান, মুর্তজা বশীর, সাকের আলী, সাদেকাইন প্রমুখদের সংস্পর্শ ও আড্ডা তাঁকে আর্ট নিয়ে লেখার শক্তি দেয়। তখন পাকিস্তানের ‘ডন’ ও ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় চিত্রসমালোচনা লিখতেন তিনি।
১৯৬৪ সালে লাহোরে এক এক্সিবিশনের আয়োজন করে গ্রে ফাউন্ডেশন। আর্টের ওপর বক্তব্য রাখার জন্য সেখানে তাঁকে ডাকেন মিসেস গ্রে। তিনি বললেন শিল্পের জন্য শিল্পের পক্ষে আর তারই বন্ধু সফদার মীর বললেন মানুষের জন্য শিল্পের পক্ষে। দুজনের মধ্যে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলল। পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার ক্রিটিক ছিলেন সফদার মীর। বিতর্ক চলল দীর্ঘ ছয়মাস ধরে। বিভিন্ন পত্রিকায় পক্ষে বিপক্ষে লিখে চললেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত জিত হল শিল্পের জন্য শিল্পের।
সাঈদ আহমদ পাকিস্তানের ১৫ বছরের এবং পরে বাংলাদেশের ১৪ বছরের চিত্রকলার সুলোক সন্ধান নিয়ে সংকলন ও সংগ্রহ সম্পাদনা করেছেন। বাংলাদেশের চিত্রকলার উপর লেখা নিয়ে সাঈদ আহমদের বেশকিছু গ্রন্থ ও মনোগ্রাফ প্রকাশিত হয়েছে। চিত্রশিল্পী হামিদুর রাহমানকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ (বাংলা ও ইংরেজিতে) রচনা করেছেন তিনি। চিত্রকলার বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ ও বিবরণে সমৃদ্ধ এসব সমালোচনা কর্মে তিনি তাঁর শক্তিমত্তার প্রকাশ দেখিয়েছেন। রচনাগুলো প্রকাশিত হয় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায়।
দৃশ্যনির্ভর মাধ্যমের জন্য করা সাঈদ আহমদের অন্যতম কর্ম বিশ্বনাটক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য ১৯৮২ সাল থেকে টানা দশ বছর ধরে দর্শকনন্দিত এ অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। বিশেষ একটি দেশের নাটকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূত্রপাত করতেন তিনি। তারপর দর্শকদের একটি ভূমিকা দিয়ে ওই দেশের উল্লেখযোগ্য একটি নাটক দেখাতেন। অনুষ্ঠানটি ছিল ৫০ মিনিটের। বছরে ১২ টি করে বিশ্বের মোট ৭১ টি নাটক এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি উপস্থাপন করেন। এ অনুষ্ঠান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ আছে সাঈদ আহমদের।
সাঈদ আহমদের স্ত্রী পারভীন আহমদ। বাংলাদেশের নারীদের সম্ভাবনা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, গ্রামীণ নারী শিক্ষা, নারী ও গ্রামীণ অর্থনীতি এবং হস্তশিল্প বিষয়ে পারভীন আহমদের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণা রয়েছে। পারভীন আহমদের লেখা সবই ইংরেজিতে। বাংলাদেশের নকশি কাঁথা নিয়ে তাঁর একটি উন্নতমানের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।
কখনও ভারতীয় সঙ্গীত ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি হয়ে, কখনও নাট্যকার হিসেবে, কখনও আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসবের জুরি হিসেবে, কখনও টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে, কখনও বিশ্বের প্রখ্যাত কোনও একাডেমি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রিত শিক্ষক হিসেবে সাঈদ আহমদকে যেতে হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও নাট্যকলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। শিল্পকলা বিষয়ে পড়িয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে।
শিল্প-সংস্কৃতির পথে জীবনব্যাপী যাত্রা সাঈদ আহমদের। অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশ ও বিদেশের বহু পুরস্কার, পদক, সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। বাংলা নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালে পেয়েছেন ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’। নাট্যকার সাঈদ আহমদের সম্মানে ১৯৭৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসির প্রখ্যাত নাট্যশালা এরিনা স্টেজের দর্শকাশনের একটি সারিতে নামাঙ্কন করা হয়। ১৯৭৮ সালে পেয়েছেন সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার। ১৯৮৩ সালে জার্মানির বার্লিন টিভি ড্রামা উৎসবে তাঁকে প্রিক্স ফিউচুরা পদক প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো থেকে মার্কুইজ হুজ হু পাবলিকেশন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ‘হুজ হু ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ (সপ্তম সংস্করণ ১৯৮৪,১৯৮৫) গ্রন্থে নাট্যকার হিসেবে তাঁর পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। ফরাসি সরকার ১৯৯৩ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার লিজন দ্য অনার সম্মানে ভূষিত করে। দেশের অন্যতম নাট্যচর্চা সংগঠন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ এশিয়া পদক প্রদান করে। ১৯৯৭ সালে তিনি মুনীর চৌধুরী পদক লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রকফেলার ফাউন্ডেশন সাঈদ আহমদকে রেসিডেন্ট প্লেরাইট নিয়োগ করে। ২০০৮ সালে ঢাকা আর্টস সার্কেল তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। ২০১০ সালে তাঁকে নাট্যকলায় (মরনোত্তর) একুশে পদক দেওয়া হয়।
সাঈদ আহমদ ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারী ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: সাঈদ আহমদের জন্ম ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি পুরনো ঢাকার ইসলামপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে।
বাবা-মা: তাঁর বাবা মীর্জা এফ মোহাম্মদ ও মা জামিলা খাতুন।
পড়াশুনা: তিনি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অন্য অনেকের মতো তাঁর শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতায় এক বছরের জন্য ছেদ পড়ে। ফলে ১৯৪৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ব্রিটেনে চলে যান। ১৯৫৬ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
কর্মজীবন: শিক্ষাজীবন শেষ করার পরপরই ১৯৫৬ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান তিনি। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে নিষ্ঠার সাথে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দীর্ঘ চাকুরি জীবনের প্রথমদিকে পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
পারিবারিক জীবন : সাঈদ আহমদের স্ত্রী পারভীন আহমদ। বাংলাদেশের নারীদের সম্ভবনা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, গ্রামীণ নারী শিক্ষা, নারী ও গ্রামীণ অর্থনীতি এবং হস্তশিল্প বিষয়ে পারভীন আহমদের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণা রয়েছে। পারভীন আহমদের লেখাজোখা সবই ইংরেজিতে। বাংলাদেশের নকশি কাঁথা নিয়ে তাঁর একটি উন্নতমানের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।
মৃত্যু: সাঈদ আহমদ ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারী ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
তথ্যসূত্র:
১.সাঈদ আহমদ এবং পারভীন আহমদের সাথে সরাসরি কথাবার্তা; সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৬
২.আলাপনে নাট্যকার সাঈদ আহমদ- সাক্ষাৎকার: শফি আহমদ ও হাসান শাহরিয়ার: নাট্যপত্রিকা থিয়েটারওয়ালা- ২০০৫
৩.নাট্যকার সাঈদ আহমদ: একটি মূল্যায়ন- মুস্তাফিজুর রহমান সৈয়দ: শিল্পকলা একাডেমি পত্রিকা
৪.বাংলাদেশের নাটকে রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতা – সৈয়দা খালেদা জাহান: বাংলা একাডেমি
৫.কালের ধুলোয় লেখা- শামসুর রাহমান
৬.বাংলাদেশের সুরস্রষ্টারা- সাঈদ আহমদ- সাহিত্য প্রকাশ
৭. শেষ নবাব – সাঈদ আহমদের নাটকের শামসুর রাহমান লিখিত ভূমিকা, পূর্বলেখ – শিল্পকলা একাডেমি
লেখক : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ