বাবা বলতেন জন্মের পর ছ’মাস বয়স থেকেই এ ছেলের লেখা বা অক্ষরের প্রতি আকর্ষণ ছিল, কোন লেখা বা কোন অক্ষর দেখলে টেনে নিয়ে ককক বা ললল বলে উঠতো। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হোসাইন ভোর ৪টায় উঠে শোবার ঘরের টেবিলে লিখতে বসতেন। টিনের চালে শিশির পড়ার টুপটাপ আওয়াজ হত, তিনি আধো-ঘুম আধো- জাগরণে দেখতেন শান্ত-স্নিগ্ধ আর নিরিবিলি পরিবেশে বাবা তন্ময় হয়ে লিখছেন। তখন থেকেই তিনি ভাবতেন, ‘লেখালেখি করাটা আসলে একটা খুব বড় কাজ আর আমিও এভাবে লেখলেখি করতে চাই।’ ১৫ বছর বয়সে কবিকে গর্ভে নিয়ে তাঁর মা জীবনে প্রথম অক্ষরজ্ঞান গ্রহণ করেন। জন্মের পর একটু বড় হয়ে তাঁরা মায়ে-ছেলেতে মিলে একটি কেরোসিনের বাতি জ্বেলে তার নিচে বসে পড়াশুনা করতেন। কুড়িগ্রাম জেলায় ১৯৩৫ সালের এক শীতের রাতে সাত মাস না পেরোতেই তাঁর জন্ম হয়। খুব ক্ষীণ ছিলেন, ফলে মুখে খাবার দেয়া হত তুলোয় ভিজিয়ে। সে ক্ষীণ শিশুটিই বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ছোটবেলায় তাঁর বাবার লেখালেখি আর মায়ের সাথে কেরসিনের বাতির নীচে বসে লেখাপড়া এই দুটো স্মৃতি মানসপটে গেঁথে রয়েছে খুব পরিষ্কারভাবে, কবি মনে করেন এদুটো ঘটনাই তাঁর মধ্যে লেখা-পড়ার দিকে ঝোঁক তৈরী করেছিল, তাঁকে পড়ুয়া স্বভাবের করে দিয়েছিল, যার ফলে তিনি হয়তো আজ লেখক হতে পেরেছেন। জন্মের পর হাইস্কুল পর্যন্ত কুড়িগ্রামেই কেটেছে। তাই তাঁর প্রায় সব গল্প-উপন্যাসের প্রধান পটভূমি হল কুড়িগ্রাম জেলার জলেশ্বরী নামের এলাকা। মানসপটের কল্পনা আর বাস্তবকে মিলিয়ে এ স্থানটি তৈরী করেছেন। বাবার হাতে লেখাপড়ার প্রথম হাতেখড়ি হলেও কুড়িগ্রাম মাইনর ইংলিশ স্কুলে ক্লাস থ্রী থেকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সূচনা ঘটে। এরপর অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে কুড়িগ্রামের পাট চুকিয়ে দেন, সময়টা ছিল ১৯৪৮ দেশভাগের পরের বছর, বাবা বললেন বড় হতে হলে বড় জায়গায় যেতে হবে। পূর্ববঙ্গের নতুন রাজধানী ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ১২ বছর বয়সে শামসুল হককে তাঁর বাবা অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন এবং সেখান থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করেন।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় থেকেই তাঁর বই পড়ার ভীষণ ঝোঁক ছিল। ১৬ বছর বয়স থেকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তিনি গল্প, কবিতা পাশাপাশি লিখে গেছেন। ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে এমন আশা করলেও ছেলের কিন্তু বরাবর সাহিত্য পড়ার শখ, সে ইচ্ছা বাবার কাছে ব্যক্তও করা হল। প্রত্যুত্তরে বাবা বললেন, ‘আইএসসিতে বিজ্ঞানের কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, বায়োলজি ইত্যাদি বিষয়গুলো পড়তে ভয় পাচ্ছো বলেই তুমি ডাক্তারি পড়তে চাইছো না।’ এ কথায় কিশোর শামসুল হকের আঁতে ঘা লাগলো। বাবার এই কথাটা ভুল প্রমাণ করার জন্য, এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ফলে তিনি আইএসসিতে টেস্ট পরীক্ষা পর্যন্ত পড়লেন এবং তখন জগন্নাথ কলেজের ১১’শ ছাত্রের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন। টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল দেখিয়ে তিনি বাবাকে বলেছিলেন, ‘আমি যে বিজ্ঞান ভয় পাই না এবং আমি বিজ্ঞান পারি এটা প্রমাণ করার জন্য আমি এতদিন বিজ্ঞানে পড়েছি। তবে আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করতে চাই না। এখন আমি আর্টস পড়তে চাই।’ পরের বছর তিনি জগন্নাথ কলেজ থেকে মানবিক শাখায় আইএ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স পড়া শুরু করেন। তবে অনার্স শেষ করার আর সুযোগ হয়নি। তার আগেই বাবার মৃত্যু হয়, ফলে পড়ালেখা ছেড়ে জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। সময়টা ১৯৫৪, আট ভাই- বোনের সংসারের সকল দায়িত্ব বর্তেছিল সদ্য ১৮’য় পা দেয়া বড় ছেলে সৈয়দ শামসুল হকের ওপর। একই বছর তাঁর প্রথম গল্পের বইটি ছাপা হয়। প্রথম কবিতার বই ছাপা হয় ১৯৬১ সালে।
লেখক সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, স্কুল ও কলেজ জীবনে কিছু অসাধারণ শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন। যাঁরা কিনা তাঁর মধ্যে ইংরেজী ও বাংলা দু’টো ভাষার খুব শক্ত ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। যা পরবর্তিতে লেখালেখি ও পেশাগত জীবনে খুব সহায়ক হয়েছিল। ফলে কবি তাঁর শিক্ষক হিসেবে দৌলতুজ্জামান স্যার, ফরিদ মাস্টার, অনীবাবু, নৃপেনবাবু, থিতিনবাবু, রাজেশবাবু, সুকুমারবাবু, অজিতকুমার গুহ, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক তত্তাবধায়ক সরকার প্রধান হাবিবুর রহমান শেলী’র মত কিছু নাম আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চান।
তিনি আরও মনে করেন তাঁর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বুদ্ধির বিকাশ এবং চিন্তা করার শক্তি বিকশিত হয়েছিল পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে। যে এলাকায় তিনি বড় হয়েছেন সেখানে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে বসবাস করতো। মুসলিম ঘরের সন্তান হিসেবে তাঁর মনে গেঁথে দেয়া হয়েছে মুসলিম কৃষ্টি, আচার-বিধান, সাহিত্য-কলা ও কোরানের বানী। অন্যদিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষক, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সংস্পর্শে বেদ-মহাভারত, পূজা-অর্চনা ও বিভিন্ন পার্বণ-উৎসবের সাথে পরিচিতি হতে পেরেছেন। একই সাথে তাঁর বাবার ইচ্ছাতে ছোটবেলায় প্রতি রবিবারে পাড়ায় গীর্জায় বাইবেল পাঠের আসরে যেতেন। আর সে সময়ে বৃটিশ শাসনাধীন বাংলাদেশে সব জায়গায় একটা পাশ্চাত্যের ভাবধারা নিহিত ছিল, স্কুলে ইংরেজী সাহিত্য পড়ানো হত বাধ্যতামূলকভাবে। ফলে এরকম পরিবেশের কারণে তাঁর মধ্যে সনাতনী ধারার মধ্য থেকে মুক্ত চিন্তা ও সঠিক যুক্তিক্রম দিয়ে ভাবার শক্তি তৈরী হয়েছিল যা তাকে লেখক হতে সহায়তা করেছে।
কবি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও কথাগুলোকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন, চারিদিকের বাস্তবতাকে অনবরত পর্যবেক্ষণ করেন যার প্রেক্ষিতে মনের মধ্যে অনেক কথা তৈরী হয় এবং সেই কথাগুলোকে তিনি কখনও গল্প কখনও কবিতা বা প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। তিনি লেখেন নিজের আনন্দে, মূলত নিজের মনের অস্থিরতাকে দূর করার জন্য। এরপর তা আরও দশজনের মধ্যে ভাগভাগি করে নেয়ার জন্য সে লেখাগুলোকে কাগজে প্রকাশ করেন। তবে এ পর্যন্ত তিনি আসলে কত লিখেছেন তার সঠিক হিসেব করে দেখেননি।
সংক্ষিপ্ত পরিচয়
জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর। ছোটগল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ সাহিত্যের সব শাখায় সমানভাবে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলাদেশের একমাত্র সব্যসাচী লেখক। লেখালেখি শুরু করেন ১২ বার বছর বয়স থেকে। সাংবাদিক হিসেবে পেশা জীবন শুরু করলেও পরবর্তিতে লেখালেখিকেই মূল উপজীব্য হিসেবে নিয়েছিলেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, একুশে পদক পেয়েছিলেন ১৯৮৪ সালে। তাঁর বিখ্যাত সাহিত্য কর্মগুলো হল; উপন্যাস: নিষিদ্ধ লোবান, খেলা রাম খেলে যা, সীমানা ছাড়িয়ে, নীল দংশন, মৃগয়ার কালক্ষেপ। নাটক: পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুলদীনের সারা জীবন গণনায়ক। কবিতা সংকলন: পরানের গহীন ভিতর, বেজান শহরের জন্য কোরাস, এক আশ্চর্য সংগ্রামের স্মৃতি, প্রেমের কবিতা। শিশু সাহিত্য: সীমান্তের সিংহাসন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দু’সন্তানের জনক আর জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন বাংলাদেশের আরেক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিককে, ড আনোয়ারা সৈয়দ হক।
মৃত্যু: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৬।
লেখক : শামসুন নাহার রূপা