হাসান হাফিজুর রহমানের বাবার গ্রন্থাগারে ছিল বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের বই, অন্যদিকে মায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকতো মুসলমান লেখকদের উল্লেখযোগ্য বই। ফলে পছন্দ-মতো বই পড়ার সুযোগ পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। তাঁর বাবার একটা অদ্ভুত মানসিকতা ছিল, তিনি সরাসরি কোনোদিন বই পড়তে বলতেন না, কিন্তু এনে দিতেন। বই পড়ার ব্যাপারে তাঁর এই পরোক্ষ প্রেরণা তাঁর জন্য ছিলো গৌরবের।
সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় দেশের বাড়িতে হাসান হাফিজুর রহমান একটি লাইব্রেরী গড়ে তুলেছিলেন। রাজপুত বীরদের কাহিনীভিত্তিক অনেক বই তখন পাওয়া যেত, সেগুলো ক্রয় করতেন তিনি। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগে লরেন্সের (ডি.এইচ) ‘লেডি চ্যাটার্লিস লাভার’ নামের মূল বইটি তিনি পান। স্যার ডব্লিউ স্কটের ‘আইভ্যানহো’ বইটিও পড়ে ফেলেন সাথে সাথে। বিদেশী সাহিত্যের প্রচুর অনুবাদ তিনি এ সময় পড়েছেন। বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে যে সব গ্রন্থ প্রকাশিত হতো, তা সংগ্রহ করে পড়েছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বইও পড়ছেন তিনি। বিশেষ করে তাঁর ‘গণদেবতা’ ও ‘পঞ্চগ্রাম’ হাসানের প্রিয় বই। সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের বাসা ছিলো তাঁদের বাসার পাশে। তাঁর ছোটো ভাই সৈয়দ আলী রেজাও তাঁকে বই সরবরাহ করতেন। ‘বঙ্কিম-রচনাবলী’, ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’, ‘শরৎ-রচনাবলী’ সহ প্রায় লেখকের বিখ্যাত বইগুলো পড়ে ফেলেন তিনি।
বাল্যকাল থেকে সাহিত্যের প্রতি এই দুর্বার আকর্ষণই তাঁকে লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা যোগায় এবং পরবর্তীতে তিনি এদেশের অন্যতম কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। বাংলা কবিতায় রুচিবোধের পরিবর্তনে হাসান হাফিজুর রহমানের অবদান অসামান্য। তিনি একাধারে একজন বিশিষ্ট কবি, প্রগতিশীল আন্দোলনের একজন মহান কর্মী, মননশীল প্রবন্ধকার, খ্যাতিমান অধ্যাপক, বিশিষ্ট সাংবাদিক, কথাশিল্পী, সমালোচক এবং অসাধারণ সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠক।
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৩২ সালে ১৪ জুন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর শহরে তাঁর নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক বাড়ি ছিলো বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার ইসলামপুর থানার কুলকান্দি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুর রহমান এবং মার নাম হাফিজা খাতুন। আবদুর রহমান ১৯১৪ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তারি পড়া অসমাপ্ত রেখেই তিনি শিক্ষা বিভাগে চাকরি নেন। চাকরি জীবনের পুরো সময় তিনি ঢাকা শহরেই অতিবাহিত করেন। তবে ১৯৩৯-১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি বরিশালে কর্মরত ছিলেন। চাকরি ছাড়াও তাঁর আয়ের উৎস ছিল গ্রামের ভূ-সম্পত্তি। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম সন্তান। প্রথম স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাওয়ার পর আবদুর রহমান দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন এবং তাঁর প্রথম সন্তান হাসান হাফিজুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন সাত ভাই ও তিন বোন। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয় অপরিণত বয়সে। স্কুলে ভর্তি হবার পূর্বে মাকে তিনি মুখে মুখে একটি ছড়া শুনাতেন-‘খেয়ে মোদের অন্নজল/হবে মোদের হাতির বল’।
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৩৮ সালে ঢাকার নবকুমার স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে তাঁর বাবা বরিশালে বদলি হয়ে গেলে তিন বছর জামালপুরের সিংজানী হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন তিনি। ১৯৪২ সালে তাঁর বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে এলে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়াশুনা করেন।
১৯৪৬ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। এবং এ বছরই ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বি.এ. অনার্স শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ না করে ১৯৫১ সালে তিনি পাস কোর্স-এ বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন।
অনার্স পরীক্ষা না দেয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন : ‘সাহিত্য-খেলার মাতামাতিই আমাকে অনার্স না দেয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রাখে। পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষা না দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে আসি। বাবা বাসায় ছিলেন। তাঁর মুখোভঙ্গিটা আমার এখনো মনে আছে। আমি যখন উচ্চারণ করলাম, ‘বাবা পরীক্ষা দিলাম না।’ তখন তিনি নির্বাক মূর্তির মতো বসে ছিলেন। বাবা আমাকে নিয়ে বড়ো কোনো প্রত্যাশা করেননি কখনো। একাডেমিক পড়া-লেখার চেয়ে বাইরের পড়া-লেখাকে তখন অধিক গুরুত্ব দিতাম।’
অনার্স শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় আকস্মিকভাবে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এবং ফজলুল হক হলের মুসলিম লীগের ছাত্রফ্রন্ট থেকে নির্বাচনে এ.জি.এস. পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় লাভ করেন। হল সংসদের ভি.পি. নির্বাচিত হয়েছিলেন মুসলেহ্উদ্দিন। হাসান হাফিজুর রহমানের হল সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ সচেতন রাজনীতিসম্পৃক্তি না হলেও এই ঘটনার মধ্য দিয়েই তাঁর রাজনীতি সচেতনতার সূত্রপাত হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংযুক্তির কারণে বি.এ. পড়ার সময় হলসমূহের নির্বাচনী ইস্তেহার লেখা এবং পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো তাঁর কার্যক্রম। সংগঠনের বেশী Serious ওয়ার্কারদের চিনতেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের সাথে পরিচয় তেমন ঘনিষ্ঠ ছিলো না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের এই চরিত্র হাসান হাফিজুর রহমানের সাহিত্য সাধনার জন্য হয়েছিলো অনুকূল। কমিউনিস্ট পার্টির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ তিনি উপস্থিত ছিলেন- যেখানে জ্ঞান চক্রবর্তীর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও উপস্থিত থাকতেন। সমসাময়িককালেই তিনি আকৃষ্ট হন প্রগতি লেখক সংঘের কর্মধারার প্রতি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯-এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের কার্যক্রম বিকাশ লাভ করে। সপ্তাহের প্রতি রবিবার সকাল ১১টায় মধুর রেস্তোরায় সংঘের সাহিত্যসভা অনুষ্ঠিত হতো। এ ক্ষেত্রে সক্রিয় সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী, শামসুর রহমান খান, সুলতানুজ্জামান খান, অরবিন্দ সেন, মদনমোহন বসাক, আমিনুল ইসলাম, হাসান হাফিজুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ।
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস কোর্স-এ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম পর্ব এম.এ. শ্রেণীতে ভর্তি হন।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে তিনি এবং অলি আহমদ মধুর কেন্টিনে বসে ছিলেন। অলি আহমদ হাসানকে বললেন, মেডিকেল কলেজের ওখানে ছেলেরা ইট-পাটকেল ছুড়ছে তুমি গিয়ে তাদের নিষেধ করো, নতুবা গুলি চলতে পারে। হাসান গিয়ে তাদের নিষেধ করলেন, কিন্তু কেউ তাঁর কথা শুনলো না। কতক্ষণ পর দেখলেন, তিনি নিজেও ইট মারতে শুরু করেছেন। তারপর একটা টিয়ার গ্যাসের শেল তাঁর কাছে পড়লো, কিন্তু সেটা ফাটেনি। হাসান সেটা ঘুরিয়ে উল্টাদিকে মারলেন, তিন চার হাত দূরে সেটা পড়লো।
এর তিন/চার মিনিট পরে গুলি চললো। কারা করছে বুঝতে পারলেন না হাসান। বরকত ব্যারাকের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর থাই ভেদ করে গুলি চলে গেলো। লম্বা মানুষ। বসে থাকলেও গুলি তাঁর মাথায় লাগতো। হাসান এবং বরকত এক সাথেই অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন, Political Science-এ। বরকত বেশ লম্বা, ছয় ফিট তিন ইঞ্চি, খুব চুপচাপ থাকতেন। হাসান তখন গেটে-যখন বরকত গুলিবিদ্ধ হলেন। হাসান এবং মুর্তজা বশীর অন্য একজন আহতকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ‘অমর একুশে’ কবিতাটি তিনি ১৯৫২-এর মার্চ/এপ্রিলের দিকে লেখেন। জুন মাসে কুমিল্লা সাহিত্য সম্মেলনে প্রথম জনসম্মুখে পাঠ করেন কবিতাটি। তাঁর সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনেই সেটা প্রথম ছাপা হয়। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলন প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়।
বিচিত্র কর্মধারার সাথে জড়িত থাকা সত্ত্বেও জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়, অর্থ ও শ্রম তিনি ব্যয় করেছেন মানুষ ও শিল্পের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্যে। ১৯৫৪, ‘৫৫ ও ‘৫৬ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’-এর সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। এম.এ. পরীক্ষার পূর্বেই সাহিত্য-সাংবাদিকতায় প্রতি আগ্রহের কারণে তিনি ১৯৫২ সালে ‘বেগম’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তারপর সওগাত পত্রিকার দায়িত্বপূর্ণ সহকারী সম্পাদক হন। কেবল চাকরির জন্য নয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার জন্যই তিনি পত্রিকায় চাকরি নিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে কুমিল্লা শহরে অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন’-এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব তিনি দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। ১৯৫৪ সালে ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবং এই দায়িত্ব পালনকালে (১৯৫৪-১৯৫৫) তিনি ‘Spectra‘ নামক ইংরেজি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর বাবা ঢাকায় চাকরি করা অবস্থায় তিনি বাবার সাথে বাসায় বসবাস করতেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালে তাঁর বাবা আবদুর রহমান চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে গ্রামের বাড়ি চলে যান। ফলে, শিক্ষাজীবনের শেষ বছর ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অবস্থান করেন। এরপর তিনি আরও ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ‘সংস্কৃতি সংসদ’, ‘ড্রামা সার্কের’ প্রভৃতি সংগঠনের দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৫৫ সালে এম.এ. দুই পর্ব এক সাথে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন হাসান হাফিজুর রহমান। এবং এ বছরই তিনি ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন।
তাঁর ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকার চাকুরি স্থায়ী হয় ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৭ সালেই তিনি জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ড্রামা সার্কেল (১৯৫৭-৫৮) গঠিত হলে তিনি তার সভাপতি হন। ‘সওগাত’-এর পর ১৯৫৭ সালে সিকান্দার আবু জাফর ও হাসান হাফিজুর রহমানের যৌথ উদ্যোগে ‘সমকাল’ নামে একখানা উন্নত শ্রেণীর মাসিকপত্র বের হয়।
হাসান হাফিজুর রহমানের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায়, ১৯৪৯ সালে। ১৯৫০ সালে ‘পূর্বাশা’-য় তাঁর কবিতা ‘যে কোন সর্বহারার প্রার্থনা’ এতো গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় যে, একজন তরুণ কবি রাতারাতি আলোচিত হয়ে ওঠেন সাহিত্যাঙ্গনে। এরপর বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’-য় ‘কোন একজনের মৃত্যুর মুহূর্তে’ খুব সম্মান সহকারে ছাপা হয়। ১৯৫০ সালে আশরাফ সিদ্দিকী এবং আবদুর রশীদ খান সম্পাদিত বিভাগোত্তর কালের প্রথম আধুনিক কবিতা সংকলন ‘নতুন কবিতা’য় ‘কোন একজনের মৃত্যুর মুহূর্তে’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর দাঙ্গাবিরোধী অনবদ্য গল্প ‘আরো দুটি মৃত্যু’ ১৯৫০ সালে প্রথমে ‘অগত্যা’য় এবং পরে ‘দিলরুবা’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও আলাউদ্দিন আল আজাদ সম্পাদিত ‘দাঙ্গার পাঁচটি গল্প’ গ্রন্থের প্রকাশক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। এই গ্রন্থের জন্যে কৃষাণ চন্দরের একটি গল্পেরও অনুবাদ করেন তিনি। মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৮) প্রকাশিত হয় তাঁর ‘অস্বস্তি’ নামক ছোটগল্প। ‘জরিমানা’ গল্প মুদ্রিত হয় ‘সওগাত’-এর পৌষ ১৩৫৯ সংখ্যায়।
১৯৬৩ সালে ‘বিমুখ প্রান্তর’, ১৯৬৮ সালে ‘আর্ত শব্দাবলী’ ও ‘অন্তিম শরের মত’, ১৯৭২ সালে ‘যখন উদ্যত সঙ্গীন’, ১৯৭৬ সালে ‘বজ্রচেরা আঁধার আমার’, ১৯৮২ সালে ‘শোকার্ত তরবারি’, ১৯৮৩ সালে ‘আমার ভেতরে বাঘ’ ও ‘ভবিতব্যের বাণিজ্য তরী’ নামক তাঁর কবিতার বইগুলি প্রকাশিত হয়।
এছাড়া ১৯৬৫ সালে সমালোচনা গ্রন্থ-‘আধুনিক কবি ও কবিতা’, ১৯৭০ সালে ‘সাহিত্য প্রসঙ্গ’ ও ‘মূল্যবোধের জন্য’, ১৯৭৭ সালে ‘আলোকিত গহ্বর’ ও ১৯৭৫ সালে ‘দক্ষিণের জানালা’ নামক প্রবন্ধ-নিবন্ধের বই, ১৯৫০ সালে ‘দাঙ্গার পাঁচটি গল্প’, ১৯৫৩ সালে ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি’ নামক তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য ছোট গল্পের বই হচ্ছে ‘আরও দুটি মৃত্যু’। তাঁর বহু রচনা ইংরেজী, উর্দু, ও রুশসহ অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টির অধিক।
১৯৫৮ সালের ১৭ই এপ্রিল হাসান হাফিজুর রহমান সাঈদা হাসানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হাসান হাফিজুর রহমান ও সাঈদা হাসানের প্রথম সন্তানের নাম হাসান সাঈদ দিশা। দ্বিতীয় সন্তানের নাম এশা হাসান মুন্নী।
বিবাহিত জীবনে হাসান হাফিজুর রহমানকে চাকরিহীন-বেতনহীন জীবনযাপন করতে হয়েছে একাধিকবার। তিনি যখন জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করছিলেন তখন সেখানকার অধ্যক্ষ শিক্ষকদের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। সেই প্রিন্সিপালের কার্যকলাপের বিরোধিতা করার ফলে হাসান হাফিজুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে জগন্নাথ কলেজের নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ পুনরায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন হাসান হাফিজুর রহমানকে।
কিন্তু চাকরিতে পুনরায় যোগদান করলেও তাঁর সংবেদনশীল মন গভীরভাবে আলোড়িত এবং রক্তাক্ত হয়েছিলো তাঁকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহে। তিনি কলেজ ছাড়ার জন্য অধীর হয়ে উঠলেন এবং ১৯৬৫ সালের ১লা জানুয়ারিতে তিনি তৎকালীন ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত উক্ত পদেই কর্মরত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর কনিষ্ঠ দুই ভাই ফারুক হাসিবুর রহমান ও কায়সার আমিনুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি যোগ দেন তাঁর পুরনো কর্মক্ষেত্র ‘দৈনিক বাংলা’য় (‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার পরিবর্তিত নাম)।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে হাসান হাফিজুর রহমানের পরবর্তী কর্মজীবন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর প্রকাশিত ‘বিচিত্রা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারি ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদমুখর শোভাযাত্রা বের করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। মিছিলটি ঢাকাস্থ মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে কিশোর ছাত্র মতিউল কাদের নিহত হয়। এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে ‘দৈনিক বাংলা’ বিশেষ টেলিগ্রাম বের করে। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে এ সময় হাসান হাফিজুর রহমান যে নির্ভীকতা ও দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন, সাংবাদিকতার ইতিহাসে সেরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। তবে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ব্যাহত হলো তাঁর জীবনের স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ গতিবেগ। তিনি ‘দৈনিক বাংলা’ থেকে চাকুরিচ্যুত হলেন। তারপর তাঁকে মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর নিযুক্ত করা হয়- যার সাথে হাসান হাফিজুর রহমানের সারা জীবনের কাজের কোনো সঙ্গতি ছিলো না। রুটিনবদ্ধ এবং কর্মহীন জীবনে মস্কোতে পোষাতো না তাঁর। ফলে উনিশ মাস মস্কোয় কাটানোর পর ১৯৭৪ সালের ১১ ডিসেম্বর হাসান হাফিজুর রহমান দেশে ফিরে এলেন।
মস্কো থেকে প্রত্যাবর্তনের পর হাসান হাফিজুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন শাখার (Establishment Division) ও.এস.ডি. হিসেবে থাকেন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভাবনীয় রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর আড়াই বছর প্রায় চাকরিহীন-বেতনহীন জীবনযাপন করেন তিনি। যিনি জীবনে কখনো Crisis দেখেননি, তাঁর জন্যে সত্যিকার অর্থেই এ সময়কাল ছিলো সংকটময়, যন্ত্রণাদায়ক।
১৯৭৮ সালে হাসান হাফিজুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প’-এর প্রধান নিযুক্ত হন। তাঁর সম্পাদনায় ষোল খণ্ডে পরিকল্পিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সংকলনের কাজ সম্পন্ন হয়। প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৮৩ সালের ১৭ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে প্রেরণ করা হয়।
মস্কোর সেন্ট্রাল ক্লিনিক হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর প্রথম দিকে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেও পরে আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল হাসান হাফিজুর রহমানের কর্মবহুল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের অবসান ঘটে। ৫ এপ্রিল মঙ্গলবার মস্কোর শান্তি সরণীর মসজিদে জানাজার পর তাঁর মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে দ্বিতীয়বার জানাজার পর বনানী কবরস্থানে হাসান হাফিজুর রহমানকে শায়িত করা হয় চিরনিদ্রায়।
সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য হাসান হাফিজুর রহমানকে ১৯৬৭ সালে লেখক সংঘ পুরস্কার, ১৯৬৮ সালে আদমজী পুরস্কার, ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে সূফী মোতাহার হোসেন স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৮২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮২ সালে নাসিরউদ্দিন স্বর্ণ পদকে ভূষিত করা হয়।
তথ্যসূত্র: ‘হাসান হাফিজুর রহমান’, সম্পাদক- খালেদ খালেদুর রহমান, প্রকাশকাল- জুন ১৯৮৩ ‘হাসান হাফিজুর রহমান : জীবন ও সাহিত্য’ লেখক- রফিকউল্লাহ খান, প্রকাশনী- বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ- জুন, ১৯৯৩।
লেখক : মৌরী তানিয়া