“প্রিয় সুলেমান। নানা কারণে হঠাৎ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশ ছেড়ে কলকাতা যাচ্ছি। …তোমার ছোটভাই কবি, ছবি আঁকার কলেজে ভর্তি হয়েছে শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। কবির যে নিষ্ঠা ও সাহস আছে, তাতে আমি বলতে পারি কবি একজন ভাল শিল্পী হতে পারবে। সে ঠিক পথটিই বেছে নিয়েছে। আমাদের সমাজে অভিভাবকরা ছবি আঁকা, গান বা নাটকে তাদের ছেলেমেয়েদের এগিয়ে দেন না। তোমার বাবা ও পরিবারের সবাইকে সেজন্য আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
ইতি- তোমাদের শিক্ষক, শ্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী।”
চিঠিতে উল্লিখিত সুলেমান সাহেবের ছোট ভাইটি হলো আজকের প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খান, যিনি আজকের হাশেম খান হয়ে ওঠার পেছনে প্রধান প্রেরণা পেয়েছেন তাঁর প্রিয় এই শিক্ষক সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তীর কাছ থেকে। তাঁর শিক্ষক সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই ছাত্র একসময় দেশের খ্যাতিমান শিল্পী হবেন। তাঁর এই ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। হাশেম খান হয়েছেন এদেশের বিশিষ্ট ও অন্যতম চিত্রশিল্পী। তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় চিত্রশিল্পী, প্রচ্ছদ শিল্পী, বই নকশাকার, পোষ্টার ডিজাইনার, শিশু সংগঠক ও লেখক হিসেবে পরিচিত।
শিক্ষক হিসাবে সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী ছিলেন একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি পড়াতেন না। গল্প করতেন। ছাত্রদের ছিলেন খুব ভাল বন্ধু। তিনি নিজে ছাত্রদের ভালো ভালো বই দিতেন আর ছাত্রদের কাছ থেকে বই নিতেনও। হশেম খানের বই প্রীতি দেখে তিনি খুবই খুশী হলেন। অন্তরঙ্গতার এক পর্যায়ে হাশেম খানকে তিনি প্রথমে ‘হাশেম খাঁ’ ও পরে ‘কবি’ বলে সম্মোধন করতেন। কারণ হাশেম খান ইতিমধ্যেই নানা পত্রিকায় লেখা ও ছবি পাঠানো শুরু করে দিয়েছেন। ছোটদের কাগজে সেসব ছবি ও লেখা ছাপাও হয়েছে।
আর ডা. সুলেমান খান, শিল্পী হাশেম খানের এই বড় ভাইটি তাঁকে শৈশবে সমস্ত শাসন থেকে এনে দিয়েছিলেন প্রথম মুক্তির স্বাদ। প্রিয় ভাইকে ‘বড়দা’ বলে ডাকতেন তিনি। ‘বড়দা’ মানে বয়সে দুই বছরের বড়। কিন্তু বড় হলেও দু’ভাই ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুলেমান ছিলেন বইয়ের পোকা। বাড়িতে আসত ‘প্রবাসী’, ‘বসুমতী’, ‘মর্ডান রিভিউ’, ‘মৌচাক’-এর মতো নানা পত্রিকা। তিনি হাশেম খানকে সেগুলো পড়তে উৎসাহিত করতেন। যাত্রা পালার গল্প শুনাতেন। নৌকা করে ঘুরে বেড়াতেন। কালী পুজোয় নিয়ে যেতেন জেলে পল্লীতে। সুলেমান স্কুল জীবন থেকেই জড়িয়ে পড়েছিলেন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে। কলেজে উঠে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন আণ্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। ডাক্তারি পড়তে যখন ঢাকায় আসেন তখন পুরোদস্তুর বিপ্লবী। উদীচীর প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি ছিলেন অন্যতম। হাশেম খানের রাজনৈতিক মনস্কতার পাঠ তাঁর হাতেই।
১৯৭১ সালে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে দু’ভাই মিলে চাঁদপুরে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। সেখানেই ২৬ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর মুসলিম লীগ তাদের দলবলসহ অস্ত্র নিয়ে তাঁদের বাড়িতে হামলা চালায়। খুবই সুপরিকল্পিতভাবে। রাজনৈতিক কারণেই এদের সাথে পূর্ব শত্রুতা ছিল সুলেমান খানের। খুনীরা জানত হাশেম খানও বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীকার আন্দোলনের একজন সক্রিয় সংগঠক। আওয়ামী লীগের ৬ দফাসহ অন্যান্য আন্দোলনের পোষ্টার তাঁর হাতে করা। খুনীরা দরজা ভেঙ্গে প্রথমেই গুলি চালায় ডা. সুলেমান খানের বুকে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার পর একে একে গুলি চালায় হাশেম খান, তাঁর মা এবং ভাগ্নি মঞ্জুর উপর। হাশেম খান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরার মতো মাটিতে পড়ে রইলেন। মা ও মঞ্জুর গুলি লাগে কোমরে। একজন হাশেম খানকে আবার গুলি করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর রক্তাক্ত অবস্থা দেখে আরেকজন বাধা দিয়ে বলেন, ‘উয় খতম হো গিয়া। চলো জলদি চলো।’ হাশেম খান বেঁচে গেলেন।
ডা. সুলেমান খান তখনো জীবিত। তাঁকে নিয়ে গভীর রাতে পরিবার ও গ্রামের লোকজন রওনা হয়েছেন চাঁদপুর শহরের দিকে। যুদ্ধের দিন। কোথাও কোনো ডাক্তার নেই, যানবাহন নেই। লোকজন চাঙ্গারি করে তাঁদের প্রিয় মানুষ ডা. সুলেমান খানকে বাঁচাতে মিছিলের মতো দৌড়াচ্ছে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও সহযোদ্ধা শামসুননাহার স্বপন। হশেম খান পেছন থেকে খেয়াল রাখছেন তাঁর বড়দার পা দুটো মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে। মনে আশা, তাহলে তাঁর বড়দা বেঁচে উঠবেন। এভাবে ঘন্টা দুয়েক যাবার পর হঠাৎ তিনি দেখেন ডা. সুলেমান খানের পা দু’টো অবশ হয়ে পড়ে আছে। শেষ পর্যন্ত ‘ইছলি’ খেয়াঘাটের কাছে এসে হাশেম খান বললেন, “ভাবী, আর এগিয়ে কাজ নেই। এবার খাটিয়া নামাও। বড়দা আর নেই।” তারপরই প্রিয় ভাই হারানো এক ‘শিশুর’ চিৎকার যেন রাতের সমস্ত অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে বেরিয়ে গেল।
হাশেম খান। পুরো নাম মো. আবুল হাশেম খান। জন্ম ৩রা বৈশাখ ১৩৪৯ (যদিও অফিসিয়াল ১৯৪১ সালের ১লা জুলাই)। মেঘনা বিধৌত চাঁদপুরের সেকদি গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ ইউসুফ খান। তিনি তৎকালীন কুমিল্লা জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। মা নূরেন্নেসা খানম, গৃহিনী। পরিবারটি ছিল গ্রামের মধ্যে একটু অবস্থাসম্পন্ন এবং লেখাপড়ার দিক থেকে অগ্রসর।
হাশেম খানের শিক্ষা জীবনের শুরু গ্রামের মুন্সিবাড়ি প্রাথমিক স্কুলে। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর ১৯৪৯ সালে চলে যান চন্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুলে। সেটি বাড়ি থেকে দু’মাইল দূরের পথ। বর্ষাকালে নৌকায় করে স্কুলে যেতেন। নৌকায় যেতে যেতে নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। তখন স্কুলের ছেলেমেয়েদের মানচিত্র আঁকার জন্য রিবম কোম্পানির রঙ্গিণ কলম কিনে দেয়া হতো। সেই দিয়েই প্রথম ছবি আঁকা শুরু। স্কুল থেকে ফেরার পথে কামার, কুমারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের নানা জিনিস বানানো দেখতেন আর মুগ্ধ হতেন। কানিবক, মাছরাঙ্গা, প্রজাপতির রঙ শৈশবে হাশেম খানকে আপ্লুত করত। খেলাধুলায় ছিলেন বেশ পারদর্শী। গোয়েন্দা বই পড়ার নেশাটাও এই সময়ই পেয়ে বসে তাঁকে। প্রকৃতি ও নদীর নিবিড় সংস্পর্শে তিনি বড় হয়েছেন বলেই তাঁর চিত্রকর্মে তারা বারবার ফিরে এসেছে।
প্রাথমিক স্কুল পাশ করার পর বড়ভাই সুলেমান খান আর তিনি চলে আসেন চাঁদপুর শহরে। ভর্তি হন বিখ্যাত হাসান আলী হাই স্কুলে। বাবা তখন সেখানে একটা ছোট বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়িতে ‘টীকা বুড়ি’ (মানুষদের টীকা দিত বলে এমন নাম) তাদের দেখভাল করতেন। স্কুলের ছিল এক বিশাল লাইব্রেরি, তাতেই মজে যান হাশেম খান। ১৯৫২ সালে সেই স্কুলে পড়ার সময়ই ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এসে যোগ দেন রাজপথে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে। সেই যে রাজপথে নেমেছিলেন আর কোনোদিন ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর। ১৯৫৬ সালে সেই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাশ করেন। পরে নিজের আগ্রহে ভর্তি হন তৎকালীন গভর্ণমেন্ট আর্ট কলেজে। (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)
এই সময় পারিবারিকভাবে খুবই আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়ে যান হাশেম খান। অনেক দিন একবেলা খেয়ে কাটিয়েছেন। পয়সার অভাবে প্রায়ই দু’বেলা খেতেন। ছবি আঁকার জন্য রঙ কিনতে পারতেন না। কিন্তু বন্ধুদের অসীম ভালবাসায় সেই অভাব দূর হয়ে যেত। ঢাকায় এসেই যুক্ত হন শিশু-কিশোর সংগঠন কচিকাঁচার আসর গড়ায়। বলা যায়, এর প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি অন্যতম। তাঁর বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতেন, হাশেম হচ্ছে দাদাভাই-এর দক্ষিণ হস্ত। জীবনের প্রথম উপার্জন আসে এখানে কাজ করেই, দাদাভাইয়ের হাত ধরে। ছবি ও লেখার জন্য তিনি প্রথম বিল তুলেছিলেন বারো টাকা। আনন্দে এক সের মিষ্টি আর এক সের গরুর মাংস নিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন।
১৯৬১ সালে চিত্রকলায় প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১-৬৩ পর্যন্ত এশিয়া ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে মৃৎশিল্পে রিসার্চ স্কলার হিসেব কাজ করেন। এই সময় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন বেশ ভালোভাবেই। আওয়ামী লীগের পোষ্টার, মঞ্চ, ব্যানার সব কিছুর নকশা করতেন তিনি। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পাত্র। ১৯৭৯ সালে জাপানের টোকিওতে শিশু পুস্তক চিত্রণে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। গত চার দশকে বর্তমান ঢাকার গড়ে ওঠাটাকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি খুব কাছ থেকে। সঙ্গত কারণেই তাঁর ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সময়ের ঢাকা নগরী।
হাশেম খান ১৯৬৩ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এছাড়া ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান গ্রন্থ অলংকরণের প্রধান শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের শিল্পকলার প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছুটে গেছেন তিনি।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলার দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা, দিল্লী ও বোম্বাইয়ে প্রদর্শনী করেছেন। আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ ১৯৭৯ উপলক্ষে জাপানে শিশু পুস্তক শিল্পীদের সম্মেলনে, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৮৭ ও ১৯৮৯ সালে টোকিও, চেকোস্লোভাকিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য প্রশিক্ষণ কর্মশালায়।
হাশেম খান তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিতব্য স্বাধীনতা স্তম্ভ-এর জুরি বোর্ড ও বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০০) হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন জাতীয় চিত্রশালা, জাতীয় নাট্যশালা এবং জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্রের বাস্তবায়নের স্টিয়ারিং কমিটির তিন সদস্যের অন্যতম বিশেষজ্ঞ সদস্য। দেশ ও শিশু প্রেমী এই শিল্পী বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর আজীবন সদস্য। ঢাকা নগর জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ের অলংকরণ ছাড়াও তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে চারুকলা ও ললিতকলা বিষয়ক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিষয় ভিত্তিক ৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের একটি শিশু যখন পড়তে শেখে তখনই তার পরিচয় হয় হাশেম খানের আঁকা নিসর্গ, বালক-বালিকা, ফুল-পাখি তথা বাংলাদেশের সঙ্গে। তারপর পাঠ্যবই, ছড়ার বইয়ের মনোলোগ ইলাস্ট্রেশন, গল্পের বইয়ের সচিত্রকরণ- শিশুটিকে ভাবতে শেখায়, কল্পনা করতে শেখায়, তার সৃজনশীলতা উম্মোচন করে। একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারে ছবি, আল্পনা আঁকা, ছয় দফার পোস্টার ও লোগো, ১৯৬৯ পরবর্তী সমস্ত গণ-আন্দোলন, মিছিল-সবখানেই তাঁর দৃপ্ত পদচারণা। এসব কারণেই শিল্পী হাশেম খানের সৃষ্টিশীল কাজে দেশ পাওয়া যায়, মানুষ ও প্রকৃতি-সমৃদ্ধ উপলব্ধি থাকে। থাকে বিদ্রোহ, থাকে প্রগতির কথা এবং মানবতা প্রতিষ্ঠার উপলব্ধি। দর্শক ও শিল্পবোদ্ধারা তাঁর ক্যানভাসের সামনে খানিকটা সময় নিয়েই দাঁড়ান। অনেকেই নিজকে বা নিজের উপলব্ধিকে খুঁজে পান।
১৯৬২-১৯৯৫ মোট ১৫ বার বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র কর্তৃক বইয়ের ছবি আঁকার (প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন) শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে লাইপজিগ আন্তর্জাতিক বই মেলায় তাঁর আঁকা বই পুরস্কৃত হয়। ১৯৮৮ ও ১৯৯৩ সালে শিশু সাহিত্যে অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, ১৯৮৮ সালে চাঁদপুর ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক, ১৯৯১ সালে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার এবং ১৯৯২ সালে জাতীয় সম্মান একুশে পদক লাভ করেন।
শিল্প ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হাশেম খান বেশ কিছু বই লিখেছেন। এর মধ্যে – ‘চারুকলা পাঠ’, ‘গুলিবিদ্ধ একাত্তর’, ‘দু’জন শিক্ষক আমি ছাত্র’, মাধ্যমিক পর্যায়ে চারুকলা শিক্ষার ৪টি বই, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে চারুকলা শিক্ষার ২টি বই, ‘শিল্পী জয়নুল আবেদিন- মানুষ জয়নুল আবেদিন’, ‘ড্রইং কথা’, ‘স্কেচ কথা’, ‘নিরাবরন কন্যার গল্প-অল্প’, ‘স্বাধীনতা ও জরিনারা উল্লেখযোগ্য’।
১৯৬৩-২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ২৫টি যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। ১৯৮১ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সবগুলো দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ছাড়াও এ সময়ে বিদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও যৌথ জলরঙ প্রদর্শনী- ১৯৬৮, বিদেশে-৩য় আন্তর্জাতিক দ্বিবাষিক প্রদর্শনী, তেহরান-১৯৬৭, টোকিও-৭০, বাংলাদেশের সমকালীন চারুকলা প্রদর্শনী- কলকাতা, দিল্লী ও বোম্বাই-১৯৭৩, জি.ডি.আর-১৯৭৮, ১ম এশীয় দ্বিবার্ষিক গ্রাফিক ডিজাইন প্রদর্শনী, তেহরান-১৯৭৯, ত্রিবার্ষিক সমকালীন চারুকলা প্রদর্শনী, ভারত-১৯৭৫ ও ৭৮, এশিয়ান আর্ট শিল্পমেলা, ফুকুওকা-জাপান-১৯৮০, হংকং-১৯৮১ ইত্যাদি প্রদর্শনীতেও অংশ নিয়েছেন। এছাড়াও ১ম আন্তর্জাতিক শিশু-বই চিত্র প্রদর্শনী, জাপান-১৯৮৬, আন্তর্জাতিক দ্বিবার্ষিক ইলাস্ট্রেশন প্রদর্শনী, ব্রাতিসলাভা, চেকোস্লোভাকিয়া- ১৯৮৩, ১৯৮৫, ১৯৮৭, ১৯৮৯, বাংলাদেশের শিল্পকলা প্রদর্শনী, ভারত-১৯৯৫, রাশিয়া-১৯৯৫, জার্মানি-১৯৯৯-তেও তিনি অংশ নিয়েছেন। ১৯৯২, ২০০০, ২০০২ ও ২০০৫ সালে ঢাকায় তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
স্ত্রী পারভীন হাশেম, কন্যা কনক খান রিয়াজ, পুত্র শান্তনু খান ও জামাতা রিয়াজ আহমেদকে নিয়ে হাশেম খানের ছোট্ট, সুখী পরিবার।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: হাশেম খান। পুরো নাম মো. আবুল হাশেম খান। জন্ম ৩রা বৈশাখ ১৩৪৯ (যদিও অফিসিয়াল ১৯৪১ সালের ১লা জুলাই)। মেঘনা বিধৌত চাঁদপুরের সেকদি গ্রামে।
বাবা-মা: বাবা মোহাম্মদ ইউসুফ খান। তিনি তৎকালীন কুমিল্লা জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। মা নূরেন্নেসা খানম, গৃহিনী। পরিবারটি ছিল গ্রামের মধ্যে একটু অবস্থাসম্পন্ন এবং লেখাপড়ার দিক থেকে অগ্রসর।
শিক্ষাজীবন: হাশেম খানের শিক্ষা জীবনের শুরু গ্রামের মুন্সিবাড়ি প্রাথমিক স্কুলে। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর ১৯৪৯ সালে চলে যান চন্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুলে।
প্রাথমিক স্কুল পাশ করার পর বড়ভাই সুলেমান খান আর তিনি চলে আসেন চাঁদপুর শহরে। ভর্তি হন বিখ্যাত হাসান আলী হাই স্কুলে। ১৯৫৬ সালে সেই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাশ করেন। পরে নিজের আগ্রহে ভর্তি হন তৎকালীন গভর্ণমেন্ট আর্ট কলেজে। (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)
১৯৬১ সালে চিত্রকলায় প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১-৬৩ পর্যন্ত এশিয়া ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে মৃৎশিল্পে রিসার্চ স্কলার হিসেব কাজ করেন। এই সময় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন বেশ ভালাভাবেই। আওয়ামী লীগের পোষ্টার, মঞ্চ, ব্যানার সব কিছুর নকশা করতেন তিনি। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পাত্র। ১৯৭৯ সালে জাপানের টোকিওতে শিশু পুস্তক চিত্রণে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
কর্মজীবন: হাশেম খান ১৯৬৩ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এছাড়া ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান গ্রন্থ অলংকরণের প্রধান শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের শিল্পকলার প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছুটে গেছেন তিনি।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলার দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা, দিল্লী ও বোম্বাইয়ে প্রদর্শনী করেছেন। আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ ১৯৭৯ উপলক্ষে জাপানে শিশু পুস্তক শিল্পীদের সম্মেলনে, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৮৭ ও ১৯৮৯ সালে টোকিও, চেকোস্লোভাকিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য প্রশিক্ষণ কর্মশালায়।
হাশেম খান তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিতব্য ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’-এর জুরি বোর্ড ও বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০০) হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন জাতীয় চিত্রশালা, জাতীয় নাট্যশালা এবং জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্রের বাস্তবায়নের স্টিয়ারিং কমিটির (৩ সদস্যের) অন্যতম বিশেষজ্ঞ সদস্য। দেশ ও শিশু প্রেমী এই শিল্পী বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর আজীবন সদস্য। ঢাকা নগর জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ের অলংকরণ ছাড়াও তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে চারুকলা ও ললিতকলা বিষয়ক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিষয় ভিত্তিক ৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি।
সংসার জীবন: স্ত্রী পারভীন হাশেম, কন্যা কনক খান রিয়াজ, পুত্র শান্তনু খান ও জামাতা রিয়াজ আহমেদকে নিয়ে হাশেম খানের ছোট্ট, সুখী পরিবার।
সূত্র:
১.হাশেম খানের সাক্ষাৎকার। নভেম্বর, ২০০৯
২.গুলিবিদ্ধ একাত্তর – হাশেম খান, প্রকাশক – ফরিদআহমেদ, সময় প্রকাশন, ২০০০।
৩.দু’জন শিক্ষক আমি ছাত্র – হাশেম খান, প্রকাশক – ফরিদআহমেদ, সময় প্রকাশন, ২০০০।
পুনর্লিখন : গুণীজন দল