১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাস। শুরু হল শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ। শহীদ মিনারের কাজে একেবারে ডুবে গেলেন তিনি। নিজ বাড়ি-ঘর ছেড়ে নির্মাণাধীন মিনারের পাশেই একটি খুপরি ঘরে বাসস্থান গড়লেন। এই খুপরি ঘরেই তিনি ঘুমান আর বাকি সময় নিবিষ্টমনে কাজ করেন। ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের প্রতীক হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে যে শহীদ মিনার তা তাঁরই সৃষ্টি। শহীদ মিনারের মূল স্তম্ভটি জননী-জন্মভূমির প্রতীক। পরম স্নেহে জননী তাঁর সন্তানের দিকে ঝুঁকে আছেন। দুই পাশে দাঁড়ানো রয়েছে তাঁর চারটি শহীদ সন্তান, যাঁরা মাতৃভাষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য, মায়ের জন্য জীবন দিয়েছেন। এই শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে- তিনি হলেন শিল্পী হামিদুর রহমান।
মীর্জা এফ মোহাম্মদ ও জামিলা খাতুন ছিলেন সংস্কৃতি আমোদে মানুষ। পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে আশিক লেনের একটি পুরনো দোতলা বাড়িতে থাকেন তাঁরা। এফ মোহাম্মদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল বিশ্ববিখ্যাত সঙ্গীত-সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মতো মানুষদের। জামিলা খাতুনের সঙ্গে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত-শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের সুফিবাদের গভীর তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা বেশ জমে উঠত। এফ মোহাম্মদ ও তাঁর ভাই মীর্জা ফকির মোহাম্মদ ওই সময়ে ঢাকায় থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই পরিবারের সঙ্গে ঢাকার সংস্কৃতিবান পরিবারগুলোর বেশ সখ্যতা ছিল।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার লোকজনের অবাধ যাতায়াত ছিল এই বাড়িতে। বাবা-মা ও পরিবারের বন্ধুদের গুণ ছড়িয়ে পড়ছিল ছেলেমেয়েদের মধ্যেও। এফ মোহাম্মদ ও জামিলা খাতুন দম্পতির ছেলে নাসির আহমদ, নাজির আহমদ, হামিদ আহমদ (হামিদুর রাহমান) ও সাঈদ আহমদ। এই দম্পতির তিন মেয়ে। মেহেরুননিসা বেগম, শামসুন্নাহার বেগম ও লুত্ফুন্নাহার বেগম।
হামিদুর রাহমান চিত্রশিল্পী হলেও শৈশবে তাঁর মূল আগ্রহের জায়গা ছিল গান ও কবিতা। স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোতে গান গাওয়ার জন্য ডাক পড়ত হামিদুর রাহমানের। কবি ও সাহিত্যিক বন্ধুদের মতো তিনিও চাইতেন সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হতে। আবার একই সাথে চলত ছবি আঁকাও। হামিদুর রাহমানের শৈশবের শিক্ষা শুরু হয় পুরনো ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। ওই স্কুলে পড়ার সময় একদিন ভূগোলের ক্লাসে বসে মানচিত্র আঁকছিলেন। বাঁ হাতে কালির দোয়াত আর ডান হাতে আঁকছেন মানচিত্র। হঠাত্ শার্টের বাঁ হাতায় কিছু একটা ঢুকে পড়ে। ডান হাতে মানচিত্র আঁকতে আঁকতেই শ্রেণিশিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাঁ হাতটা তুলে ধরেন। বাঁ হাতের মুঠোতে ধরা দোয়াত থেকে কালি পড়ে তাঁর মুখ, গায়ের শার্ট- সব মাখামাখি হয়ে যায়। শ্রেণিকক্ষের মেঝেতেও কালি পড়ে। খুব অপমানিত বোধ করেন হামিদ। বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বলেন, ওই স্কুলে তিনি আর যাবেন না। বাবা ছেলের মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে তাঁকে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করেন। সেই স্কুলের বেঞ্চিতে কালির দোয়াত বসানো থাকত। হাত দিয়ে দোয়াত ধরে রাখার কোনো ঝামেলা ছিল না। তাঁদের পুরনো ঢাকার সেই বাড়ির আশপাশেই ছিল নানা ধরনের কারিগর। তাঁতের শাড়ি, সোনার গয়না ও শঙ্খের কাজ করত তারা। কারিগররা তাদের গড়া জিনিসের ওপর নানা ধরনের নিপুণ নকশা ফুটিয়ে তুলত। স্কুলে পড়ার বয়সেই এসব ঘুরে ঘুরে দেখতেন হামিদ। ওই বয়সে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি এঁকে বন্ধুদের বাহবা কুড়াতেন তিনি। পুরনো ঢাকার কারিগরদের নকশা আঁকার নৈপুণ্য, রঙের ব্যবহার ও হাতি, ঘোড়া, বাঘ, পুতুল গড়ার কাজ তাঁকে মুগ্ধ করত। পদার্থ বিদ্যা ও রসায়নের আর্যা, সূত্র, সংকেত তাঁর মোটেও ভালো লাগত না। তাঁর ভালো লাগত গাছের পাতার গঠন ও রং। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে সেসব মন ভরে দেখতেন তিনি। উদ্ভিদবিদ্যার ক্লাসে খুব মজা পেতেন হামিদুর রাহমান। রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা নিরস লাগার কারণেই মাঝপথে কলেজ ছেড়ে দেন তিনি। চুটিয়ে আড্ডা দেন বন্ধুদের সঙ্গে। বন্ধু কবি আলাউদ্দিন আল-আজাদ, হাসান হাফিজুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও শামসুর রাহমানের সঙ্গে সদরঘাটের বাকল্যাণ্ড বাঁধের পাশে স্বরচিত কবিতা, গল্প ইত্যাদি আবৃত্তি করেন। একদিন কবি শামসুর রাহমানই তাঁকে বলেন, ‘তুই রং ও রেখায় মনের ভাব ভালো প্রকাশ করতে পারবি।’ আর হামিদুর রাহমান উত্তরে বলেন, ‘তুই ছোটগল্প লেখা ছেড়ে দিয়ে কবিতা লেখ।’ কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এত গভীর ছিল যে দুজনেই নাম মিলিয়ে রেখেছিলেন। ‘হামিদ আহমদ’ বদলে নাম নিয়েছিলেন হামিদুর রাহমান।
রং ও রেখায় মনের ভাব প্রকাশের জন্যও তো শিক্ষা দরকার। হামিদুর রাহমান তা শিখবেন কোথায়? ১৯৪৮ সালে সারা বাংলাদেশে আর্ট স্কুল বলতে গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউট। ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের দুই-তিনটি কক্ষ নিয়ে সে স্কুল। শিক্ষকদের মধ্যে আছেন জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক ও কামরুল হাসানের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। ১৯৪৮ সালে এখানেই হামিদের চিত্রকলার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউটে দুই বছরের শিক্ষা শেষ করার আগেই উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান ইউরোপে। বড়ভাই নাজির আহমদ তখন বিবিসিতে লন্ডনে কর্মরত। প্রথমে গিয়ে উঠেন তাঁর কাছেই। লন্ডনে কয়েক মাস থাকার পর হামিদ ঠিক করেন, প্যারিস যেহেতু শিল্পের রাজধানী, সেখানেই লেখাপড়া করবেন তিনি। প্যারিসে থাকতেন তাঁর ভাই নাজিরের বন্ধু শিল্পী পরিতোষ সেন। প্যারিসে গিয়ে তাঁর সহযোগিতা নিয়ে ভর্তি হলেন ইকোল দ্য ব্যোজ আর্টসে। প্যারিসে একা থাকার সমস্যা, নিঃসঙ্গতা এবং ভাষা সমস্যার কারণে মত পাল্টাতে বাধ্য হলেন হামিদ। ইকোল দ্য ব্যোজ আর্টসে সংক্ষিপ্ত শিক্ষা শেষে ফিরে এলেন লন্ডনে। ভর্তি হলেন লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইনে। ততদিনে হামিদের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে নভেরা আহমেদের সঙ্গে। নভেরা তখন পড়ছেন লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টসে। ইউরোপে ভাস্কর্য শিখতে গিয়েছিলেন নভেরাও। ঢাকার গভর্নমেন্টে আর্ট কলেজে হামিদের সহপাঠী শিল্পী আমিনুল ইসলাম তখন ইতালিতে। সেখান থেকে বন্ধু হামিদকে লিখে জানালেন, তিনি ইতালি সরকারের বৃত্তি নিয়ে ফ্লোরেন্সের অ্যাকাডেমিয়া ডি বেলে আর্টিতে ভর্তি হয়েছেন। বান্ধবী নভেরাকে নিয়ে হামিদ চলে গেলেন ইতালিতে। মুরাল পেইন্টিং শেখার জন্য তিনিও ভর্তি হলেন অ্যাকাডেমিয়া ডি বেলে আর্টিতে। নভেরা ইতালীয় ভাস্কর ভেন্তোরিনো ভেন্তরির কাছে ভাস্কর্য শিক্ষা শুরু করলেন। তিনজনে মিলে ভাড়া করলেন একটা স্টুডিও। একসাথে থাকা, শিল্পচর্চা ও ইতালির বিভিন্ন শিল্পকলা কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা। সেটা ছিল ১৯৫৩ সাল। ছয় মাস পর ইতালি থেকে হামিদ ও নভেরা ফিরে এলেন লন্ডনে। যোগ দিলেন নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯৫৪ সালে শিল্পী হামিদুর রাহমানের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসে। প্রথম প্রদর্শনীর মাধ্যমেই চিত্রকলার সমঝদার ও সমালোচকদের নজর কাড়েন। ১৯৫৬ সালে হামিদুর রাহমান লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছর তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকলা ও শিল্পের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন।
চিত্রকলার বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ১৯৫৬ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন শিল্পী হামিদুর রাহমান। তাঁর সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন ভাস্কর নভেরা আহমেদও। ওই বছরই ঢাকায় পাকিস্তান আমেরিকান সোসাইটির উদ্যোগে ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস (ইউএসআইএস) মিলনায়তনে তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। ঢাকায় সেটাই ছিল প্রথম বিমূর্ত চিত্রকলার প্রদর্শনী। হামিদুর রাহমানের সেসব বিমূর্ত চিত্র তখন রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। প্রচুর বিতর্ক ও আলোচনা, সমালোচনাও হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কারফিউ উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে পাকিস্তান সরকার নির্বিচার গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আবদুল জব্বার, আবুল বরকত ও রফিকউদ্দিন আহমদ। ২২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। দিকে দিকে স্লোগান উঠতে থাকে ?রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই?, ?শহীদ স্মৃতি অমর হোক?। পরবর্তী সময়ে শহীদ হন সালাম ও শফিউর রহমান।
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে কারফিউের মধ্যেই রাতারাতি গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনার। শহীদ মিনার যেখানে গড়ে ওঠে সে স্থানটিতেই একুশে ফেব্রুয়ারীর পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী সেই শহীদ মিনার পাকিস্তান সরকার নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এরপর নিশ্চিহ্ন মিনারের কাপড় ঘেরা স্থানটিই হয়ে ওঠে বাঙালীর শহীদ মিনার। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শহীদ মিনার নির্মাণ ও শহীদ দিবস ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ক্ষমতায় আসার মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় ভেঙে যায় যুক্তফ্রন্ট। ক্ষমতায় আসে আবুল হোসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক পার্টি। আবুল হোসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে ১৯৫৬ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে হামিদুর রাহমান ছিলেন ইউরোপে। দূর থেকে তাঁর বুকেও তখন রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রাহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সরকারের আমলে সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শহীদ মিনারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার এম. এ. জব্বার ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ওপর। শিল্পী হামিদুর রাহমান তখন ঢাকায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন হামিদুর রাহমানকে শহীদ মিনারের একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের অনুরোধ জানান। হামিদ শহীদ মিনারের একটি মডেল, ৫২ টি নকশা ও পরিকল্পনার অন্যান্য কাগজপত্র পেশ করেন। বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়নে তাঁকে সহযোগিতা করেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। অন্যান্য শিল্পী ও স্থপতিরাও প্রতিযোগিতামূলক নকশা দিয়েছিলেন। বিখ্যাত গ্রিক স্থপতি ডক্সিয়াডেস, প্রকৌশলী এম এ জব্বার ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি হামিদের নকশাটি অনুমোদন করে। শিল্পী হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৫৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত হামিদুর রাহমানের তত্ত্বাবধানে শহীদ মিনারের কাজ চলেছিল। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ।
বিশাল কাজের প্রায় অনেকটাই গুছিয়ে এনেছিলেন হামিদুর রহমান। কিন্তু ওই বছরের অক্টোবরে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের প্রথম দিনেই হামিদুর রাহমানকে শহীদ মিনার এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এমনকি শিল্পকর্মের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে আসারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। সামরিক সরকার ওই সময় তাঁকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। তিনি তা জানতে পেরে করাচিতে চলে যান। সেখানে একদিন থাকার পর চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন পাকিস্তানে অবস্থানরত তাঁর এক মার্কিন বন্ধু।
১৯৬৩ সালে হামিদুর রাহমানের মূল পরিকল্পনায় অনেক কাটছাট করে শহীদ মিনারের কাজ শেষ করা হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী শহীদ মিনারের ওপরও বর্বর আক্রমণ চালায় এবং সেটি আবার ধুলিসাত্ করে ফেলে। সবশেষ ১৯৮৪ সালে হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে শহীদ মিনারের কাজ সম্পন্ন হয়। বর্তমান শহীদ মিনারে হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনার কাঠামোগত দিকটি ঠিক রাখা হলেও নান্দনিক অনেককিছু বাদ পড়ে গেছে।
১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া রাজ্যের একাডেমী অব ফাইন আর্টসে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে কাজ করেন শিল্পী হামিদুর রাহমান। ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আবার দেশে ফিরে আসেন। পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলে খণ্ডকালীন প্রশিক্ষকের কাজ করার সুবাদে ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার পর তিনি পাকিস্তানের তত্কালীন রাজধানী করাচিতে থেকেছেন। এরপর আর্ট কাউন্সিলের ঢাকা শাখায়ও তিনি কাজ করেছেন। করাচিতে থাকার সময় হামিদুর রাহমানের ১১ নম্বর বোনাস রোডের স্টুডিওটি ছিল শিল্পী ও চিত্র সমালোচকদের মিলনকেন্দ্র। তখনকার সময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অনেক চিত্রশিল্পী, কবি, সাহিত্যিকই সেখানে যাতায়াত করতেন।
১৯৬০ সালে ঢাকায় ফিরে এসে বিয়ে করেন হামিদুর রাহমান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হামিদুর রাহমান ভেবেছিলেন, এবার হয়ত তাঁর করা মূল পরিকল্পনা অনুসারে শহীদ মিনার নির্মিত হবে। কিন্তু ১৯৭২ সালে ঘটে যায় উল্টো ঘটনা। শহীদ মিনারের নিচের দেয়ালে তিনি এক হাজার বর্গফুটের যে ম্যুরাল অঙ্কন করেছিলেন তা যেন কোনো অদৃশ্য হাতের ইশারায় ধ্বংস করে ফেলা হয়। সুদীর্ঘ এই ম্যুরালের ওপর কারা চুনকাম করেছে তা কেউ বলতে পারে না। এমনকি এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সরকারের গণপূর্ত বিভাগও সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না। ক্ষোভে, দুঃখে ও লজ্জায় ওই বছরই ইউরোপের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন তিনি। দেশ ত্যাগ করলেও দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তাঁর যে অসীম মমতা তা ত্যাগ করতে পারলেন না। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশকে তিনিই প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরলেন তাঁর চিত্রকলার মাধ্যমে। ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহ রূপ ও সেই জলোচ্ছ্বাসে যে প্রাণহানি হয় তা তিনি তাঁর চিত্রে তুলে ধরেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সাহস ও সংগ্রাম ও মানবিক বিপর্যয়ের চিত্রমালাও তিনি রচনা করেছেন। এসব ছবি নিয়ে লন্ডনে প্রদর্শনী করেছেন ১৯৭৩ সালে। ইউরোপের দর্শকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ প্রত্যক্ষ করে তাঁর চিত্রের মাধ্যমে। শিল্পী হামিদুর রাহমানের ছবিতে আবহমান বাংলার চালচিত্র ফুটে উঠেছে বারবার বিভিন্নভাবে। হামিদুর রাহমানের শিল্পীসত্ত্বায় সমন্বয় ঘটেছে দেশপ্রেম, সমকালীনতা, মানবতাবোধ ও আন্তর্জাতিকতার। তাঁর ছবিতে এসেছে কৃষক, জেলে, মজুরদের জীবন ও তাদের জীবনের অনুষঙ্গ- নৌকা, মাছ, বৃক্ষ, বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি। চিত্রে বাংলাদেশ ও বিশ্বের সমকালীন ঘটনাবলি ও জীবন উপস্থাপনে তিনি প্রকাশবাদ, বিমূর্ততা, কিউবিক পদ্ধতির মতো তাঁর সময়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিভিন্ন শিল্পরীতি ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত বাস্তবতা, গণকবর, বন্দিশিবিরে নারী, আদিবাসী জীবন- এসব বিষয় শিল্পী হামিদুর রাহমানের মানবতাবোধকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
১৯৭৩ সালে তিনি লন্ডন থেকে চলে যান কানাডায়। ১৯৭৫ সালে তিনি কানাডায় শিক্ষকতা শুরু করেন। শুরু হয় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস। কানাডায় বসবাস করা সত্ত্বেও বারবার দেশে ফিরে আসতে চেয়েছেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসেছেন। বন্ধুবান্ধবদের কাছে বলেছেনও বাংলাদেশে থিতু হওয়ার কথা। ঢাকায় এসে বারবার চেষ্টা করেছেন শহীদ মিনারকে তাঁর স্বপ্নের রূপে গড়ে তুলতে। কিন্তু বারবারই তাঁকে ব্যর্থ হতে হয়েছে। ১৯৮৪ সালে ঢাকায় এলে সরকারের গণপূর্ত বিভাগ তাঁকে নিয়ে শহীদ মিনার পরিদর্শন করে এবং অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে উদ্যোগও পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়ন ছাড়াও ঢাকার অনেক বিশিষ্ট ভবনের দেয়ালে শিল্পী হামিদুর রাহমান অনেক মুরাল করেছিলেন। ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের দেয়াল, এয়ারপোর্ট রোডে এম আর খানের বাসার ভেতরের দেয়াল, শাহবাগে সাকুরা রেঁস্তোরার ভেতরের দেয়াল, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ভবনের ভেতরের দেয়াল, পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক ভবন, ব্যাংক অব আমেরিকার করাচি শাখার ভবন, আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ভবন, জনতা ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকের লন্ডন শাখার দেয়াল, ব্রাসেলসের জনতা ব্যাংক শাখার দেয়ালে হামিদুর রাহমানের করা মুরাল রয়েছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিভিন্ন ভবন ও দেয়ালে যেসব মুরাল তিনি করেছেন সব মিলিয়ে সেসবের আয়তন ১১ হাজার বর্গফুট। তাঁর করা উল্লেখ্যযোগ্য মরালের মধ্যে আছে ‘বোরাক দুলদুল’, ‘ফিশার ম্যান্স্ ভিলেজ’ ও ‘বোট কম্পোজিশন’। ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরির দেয়ালে এগুলো ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে করা হয়। ইংল্যান্ডের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউট গ্যালারিতে স্থায়ী প্রদর্শনী হিসেবে ৩২ ফুট / ১৩ ফুট আকারের ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ নামে একটি মুরাল রয়েছে। কানাডার ইন্টারন্যাশনাল ডাউসন কলেজ ভবনেও তিনি একটি মুরাল করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেয়ালে তাঁর মুরালের মোট আয়তন ২০ হাজার বর্গফুটেরও বেশি।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে তাঁর চিত্রকলার প্রদর্শনী হয়েছে। ১৯৫১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর যেসব চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে সে তালিকাও বিশাল। ১৯৭৩ সালে লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউট গ্যালারি তাঁর একটি একক চিত্র প্রদর্শনী স্পন্সর করে। ১৯৫৬ সালে লন্ডনে আয়োজিত কমনওয়েলথ চিত্র প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকলা অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬০ সালে ইতালির মিলানে গ্রুপ শোতে এবং ১৯৫৭ সালে ওয়াশিংটনের কালেক্টরস কর্নার গ্যালারিতে তাঁর চিত্রমালা প্রদর্শিত হয়। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে কানাডা ও ভারতের প্রধান প্রধান গ্যালারিতে তাঁর চিত্রের বেশকিছু প্রদর্শনী হয়। ১৯৮২ সালে কানাডার অটোয়ায় তাঁর কাজের একটি প্রদর্শনী হয়। ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালেও তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে।
শিল্পচর্চার জন্য হামিদুর রাহমান দেশে ও বিদেশে পুরস্কৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭২ সালে ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব বাংলাদেশী পেইন্টার্স-এ শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পান ‘মাদার অ্যান্ড স্মোক’ চিত্রের জন্য। ইরানের ফিফথ তেহরান বাইএনালে প্রথম পুরস্কার অর্জন করে তাঁর ‘ফ্লাওয়ার ইন মাই বডি’ চিত্রটি। কমনওয়েলথ পেইন্টার্স এক্সিবিশনে শ্রেষ্ঠ চিত্রের সম্মান অর্জন করে ‘বোট’। পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিংস অ্যান্ড স্কালপচার্সে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে তাঁর ‘সানফ্লাওয়ার’ চিত্রটি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড অব প্রাইড অব পারফরমেন্স ফর পেইন্টিং পদক প্রদান করে, কিন্ত তিনি এ পদক প্রত্যাখ্যান করেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক প্রদান করে।
১৯৮৮ সালের ১৯ নভেম্বর শিল্পী হামিদুর রাহমান প্রতিদিনের মতোই নাস্তার টেবিলে বসেছিলেন। ওই দিন সন্ধ্যায় ছিল তাঁর ছেলের বিয়ে। নাস্তার টেবিল ছেড়ে আর উঠতে পারেননি তিনি। হঠাত্ থেমে যায় তাঁর হৃদস্পন্দন। সুদূর কানাডার মন্ট্রিয়লে মৃত্যুকে বরণ করে নেন অমর এই শিল্পী। তবে তাঁর অন্তিম ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের মাটিতে চিরশয্যা নেওয়ার। ২৫ নভেম্বর শিল্পী হামিদুর রাহমানের মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এর পরের দিন আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবরের পাশে শিল্পী হামিদুর রাহমানকে কবর দেওয়া হয়।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
জন্ম ও শৈশব-কৈশোর
চিত্রকর হামিদুর রহমানের জন্ম ১৯২৮ সালে পুরনো ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা মীর্জা এফ মোহাম্মদ ও মা জমিলা খাতুনের চার ছেলের মধ্যে হামিদ ছিলেন তৃতীয়। হামিদের বড় ভাই নাসির আহমদ ছিলেন সংস্কৃতিমনা ও ব্যবসায়ী। পরে নাজির আহমদ ছিলেন বিশিষ্ট বেতার ব্যক্তিত্ব। হামিদুর রাহমানের ছোট সাঈদ আহমদ বাংলাদেশের পথিকৃত নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম। পারিবারিক নাম হামিদ আহমদ হলেও পরে তিনি তা পরিবর্তন করে হামিদুর রাহমান করেন।
শিক্ষা
বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার পর তিনি প্যারিসের ইকোল দ্য বোজ্ আর্টস থেকে সংক্ষিপ্ত শিক্ষা লাভ করেন। পরে লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন থেকে ১৯৫৬ সালে ডিগ্রি অর্জন করেন। এর মধ্যে ১৯৫৩ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স একাডেমী দ্য বেল আর্ট থেকে মুরাল পেইন্টিংয়ের ওপরে গ্রীষ্মকালীন কোর্স সম্পন্ন করেন।
পেশা
হামিদুর রাহমান পেশাগত জীবনে কোথাও স্থির হননি। চিত্রশিল্পের নেশায় ঘুরে বেরিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। পেশায় চিত্রকলার শিক্ষক ছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় একাডেমী অব ফাইন আর্টসে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সর্বশেষ অধ্যাপনা করেছেন কানাডার ম্যাকডোনাল্ড কার্টিয়ার পলিটেকনিক মন্ট্রিয়লে।
পরিবার
১৯৬০ সালে বিয়ে করেন হামিদুর রাহমান। হামিদুর রাহমান ও আশরাফ রাহমান দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে নাদিম রাহমান, ছোট ছেলে ফাহিম রাহমান, মেয়ে নওশাবা রাহমান।
উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়ন করেন হামিদুর রাহমান। পাকিস্তানের বিশিষ্ট অনেক ভবনের দেয়ালে তাঁর করা অনেক মুরাল রয়েছে। ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরির দেয়ালে মুরাল করেছেন তিনি। এছাড়া মুরাল করেছেন লন্ডন, করাচি, ব্রাসেলস ও কানাডার বিভিন্ন ভবনে। বিশ্বের বিভিন্ন দেয়ালে তাঁর মুরালের মোট আয়তন ২০ হাজার বর্গফুটেরও বেশি।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে তাঁর চিত্রকলার প্রদর্শনী হয়েছে। ১৯৭৩ সালে লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউট গ্যালারি তাঁর একটি একক চিত্র প্রদর্শনী স্পন্সর করে। ১৯৫৬ সালে লন্ডনে আয়োজিত কমনওয়েলথ চিত্র প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকলা অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬০ সালে ইতালির মিলানে গ্রুপ শোতে এবং ১৯৫৭ সালে ওয়াশিংটনের কালেক্টরস কর্নার গ্যালারিতে তাঁর চিত্রমালা প্রদর্শিত হয়। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে কানাডা ও ভারতের প্রধান প্রধান গ্যালারিতে তাঁর চিত্রের বেশ কিছু প্রদর্শনী হয়। ১৯৮২ সালে কানাডার অটোয়ায় তাঁর কাজের একটি প্রদর্শনী হয়। ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালেও তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
শিল্পচর্চার জন্য হামিদুর রাহমান দেশে ও বিদেশে পুরস্কৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭২ সালে ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব বাংলাদেশি পেইন্টার্স-এ শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পান ‘মাদার অ্যান্ড স্মোক’ চিত্রের জন্য। ইরানের ফিফথ তেহরান বাইএনালে প্রথম পুরস্কার অর্জন করে তাঁর ‘ফ্লাওয়ার ইন মাই বডি’ চিত্রটি। কমনওয়েলথ পেইন্টার্স এক্সিবিশনে শ্রেষ্ঠ চিত্রের সম্মান অর্জন করে ‘বোট’। পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিংস অ্যান্ড স্কালপচার্সে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে তাঁর ‘সানফ্লাওয়ার’ চিত্রটি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড অব প্রাইড অব পারফরমেন্স ফর পেইন্টিং পদক প্রদান করে, কিন্ত তিনি এ পদক প্রত্যাখ্যান করেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক প্রদান করে।
মৃত্যু
শিল্পী হামিদুর রাহমান ১৯৮৮ সালের ১৯ নভেম্বর কানাডার মন্ট্রিয়লে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে ভাষা শহীদদের কবরের কাছাকাছি স্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটির জন্য ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন নাট্যকার সাঈদ আহমদ। তাঁর সম্পাদনায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘হামিদুর রাহমান’ গ্রন্থটিও এক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছে।
লেখক : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ