২০০৪ সাল। শিল্পী শাকুর শাহ’র একক চিত্র প্রদর্শনী চলছে প্যারিসের একটা দ্বীপে। চিত্রপ্রিয় মানুষরা সেই প্রদর্শনীতে এসে ছবি দেখছেন। একজন দর্শক অনেকক্ষণ ধরে ছবি দেখছেন। তারপর হঠাৎ করেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন। অন্যান্য দর্শকরা অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকান। শাকুর শাহ তখন গ্যালারির বাইরে কফি খাচ্ছিলেন। তিনি এসে দর্শকটির চিৎকার করার কারণ জানার চেষ্টা করেন এবং জানতে পারেন দর্শকটি ছবি দেখে এতোটাই আপ্লুত হয়েছেন যে, আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছে, অনেকদিন পর তিনি কোনো ভাল ছবি দেখছেন। আর এটাই তাঁর চিৎকার করার কারণ।
শাকুর শাহ, আমাদের দেশের অন্যতম এই শিল্পীর জন্ম বগুড়া জেলায় ১৯৪৬ সালে। পুরো নাম আব্দুস শাকুর শাহ। শিল্পী শাকুর শাহ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। বাবা ওসমান আলী শাহ। তিনি ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। বগুড়াতেই চাকরি করতেন। মা হালিমা খাতুন। শাকুর শাহ’র নয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। প্রাথমিক লেখাপড়া বগুড়াতেই। সেখান থেকেই এসএসসি পাশ করেন। পরিবারের ভাইবোনেরা অন্য পেশায় জড়িত। একমাত্র শাকুর শাহ’ই শিল্পী হয়েছেন।
ছেলেবেলা থেকেই প্রকৃতি তাঁকে খুব কাছে টানত। সেই ছেলেবেলা থেকেই তিনি প্রকৃতির অপার রহস্য আর রূপ মুগ্ধ হয়ে দেখতেন। তখন প্রতি বছর তাঁদের গ্রামে মেলা বসত। সেই মেলাতে দূর দূরান্ত থেকে কুমার সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ে আসত নানা রঙের মাটির বাহারি জিনিস। এসব খুব আগ্রহ সহকারে দেখতেন শাকুর শাহ। মূলত সেই রঙের মোহে পড়েই শিল্পী হবার বাসনা জাগে তাঁর মনে। তখন তিনি নিজে কাগজে নানা রঙ দিয়ে এঁকে নানা জিনিস বানাতেন। সেগুলো আবার মেলায় বিক্রিও করতেন। এভাবেই নিজের আগ্রহটি গাঢ় হতে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ঢাকায় আর্ট শেখার জন্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে সেখানে ভর্তি হতে গেলে এস.এস.সি. পাশ করতে হয়। ১৯৬৫ সালে এস.এস.সি. পাশ করে চলে আসেন ঢাকায়, ভর্তি হন আর্ট কলেজে।
শাকুর শাহ যখন ঢাকায় আসেন তখন স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গণ খুবই উত্তপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্মম শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালি জোট বেধে সংগ্রামের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। যুক্তফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্বে দেশ চলছে। যদিও সেই সরকারকে খুব বেশিদিন কাজ করতে দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এদেশে জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে যে গণসংগ্রাম রচিত হয় তার সাথে জড়িয়ে পড়েন লেখক-শিল্পী সম্প্রদায়।
আর্ট কলেজের ছাত্র হিসেবে শিল্পী শাকুর শাহও অন্য সবার মত হাঁটেন রাজপথে। হাত লাগান এদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষকরা একসাথে মিলেই বিভিন্ন দাবিতে পোষ্টার, ব্যানার তৈরি করে সেসময় বড় বড় মিছিল, সমাবেশে অংশগ্রহণ করতেন। অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি কাজ করতে হত। সেসব কাজেও শাকুর শাহ’র উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মত।
ঊনসত্তর সাল থেকেই বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন আরো বেগ পেতে থাকে। বাঙালি বুঝে ফেলে স্বাধীনতা ছাড়া তাদের মুক্তি নেই। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীও বাঙালিদের দামাবার জন্য সামরিক বাহিনী দিয়ে সংগ্রামীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। কিন্তু বাঙালিরা এগিয়ে যায় স্বাধীনতার পথে ধীর পায়ে।
ষাটের দশকে বাংলাদেশের চিত্রকলা নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাঁদের মতে, সেই দশকে ‘মূলত নকশাধর্মী এবং বিমূর্ত অথবা বাস্তবধর্মী হলেও জীবনের প্রতিফলন সেখানে খুবই সীমিত। এখানে অধিকাংশ শিল্পী জীবন বলতে প্রতিকৃতি এঁকেছেন। অথবা জাতীয় জীবনের রূপককে ব্যবহার করেছেন।’ তবে এটা ঠিক এর মধ্যে সমালোচকরা জয়নুলকে একেবারেই ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের ভাষায়, ‘নিসর্গকে তিনি যেমন ফ্রেমে বেঁধেছেন ঠিক তেমনি তাঁর ছবিতে চেনা যায় বাংলা ও বাংলার মানুষকে। বাংলার আপামর কর্মী মানুষকে এবং গ্রামীণ মানুষকে আধুনিক শিল্প কৌশলের মাধ্যমে পারদর্শিতা দিয়ে তিনি একের পর এক তুলে ধরেছেন।’
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ বাঙালি জনগণ আওয়ামী লীগের ধর্ম নিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচীর পেছনে রয়েছে। এই নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক শক্তি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসনের প্রতি আনুগত্যশীল রাজনৈতিক নেতারা প্রমাদ গুণল। তারা নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে। নানা প্রকার ছল-ছাতুরির আশ্রয় নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আলোচনার নামে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলার সব প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সামরিক শাসকদের এই কূটচাল ধরতে ব্যর্থ হল।
১৯৭০ সালেই শাকুর শাহ ইন্সস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস থেকে বি.এফ.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। সে বছরের ডিসেম্বরেই সিলেট রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে যান। সেখানে গিয়েও রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ রাখেন। চাকুরিকালীন সময়ে থাকতেন কলেজ কোয়ার্টারেই।
১৯৭১ সালের গণহত্যা। রাজধানীর পর জেলা শহরগুলোতেও ঢুকে পড়ে হানাদার বাহিনী। প্রাথমিকভাবে বাঙালিরা কিছু প্রতিরোধ গড়ে তুলার চেষ্টা করলেও তা খুব বেশি একটা কার্যকর হয়নি। সিলেটেও একই অবস্থা। শাকুর শাহ যে কলেজে কাজ করতেন সেটা শহর থেকে একটু দূরে। কিন্তু সেখানেও দু’একদিনের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চলে যায়।
একদিন দুপুর বেলা ফাঁকা কলেজ ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে কী করা যায় তা নিয়ে কলেজ অধ্যক্ষ, শাকুর শাহ সহ কয়েকজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। ঠিক সেসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটা লরি এসে থামে কলেজের সামনে। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই সৈন্যরা গুলি ছোঁড়া শুরু করে। হতভম্ব হয়ে সকলেই জীবন বাঁচাতে এদিক-সেদিক ছুটে যান। সৈন্যরা কলেজে ঢুকে সমস্ত ক্যাম্পাস সার্চ করে কাউকে না পেয়ে চলে যায়। সেদিন নেহাত ভাগ্যগুণেই বেঁচে যান শাকুর শাহ সহ অন্যরা।
এদিকে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় পরিবার থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন শাকুর শাহ। পরিবারের অন্য সদস্যরা কোথায় কীভাবে আছে তা জানা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। গোটা মুক্তিযুদ্ধকালেই তিনি পরিবারের কোনো খবর পাননি।
কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে চলে আসেন সিলেট শহরে। সেখানেও তখন একেবারে ভূতুরে অবস্থা। কোথায় যাবেন, কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। এই অবস্থায় সুরমা নদী পার হয়ে পরিচিত এক শিক্ষকের কাছে আশ্রয় পান। কিন্তু সুরমা নদীর ওপারে তখন বাঙালি পুলিশ-ইপিআর-এর সদস্যরা প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তুলেছে। যেদিন রাতে শাকুর শাহ সেখানে যান ঠিক সেদিন ভোর রাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে বাঙালি প্রতিরোধকারীদের এক সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানরিা সেই স্থান দখল করে নেয়। ফলে আবার অনিশ্চয়তায় পড়তে হয় শাকুর শাহকে। তিনি এই এলাকার কিছুই চিনেন না, জানেন না, কোথায় যাবেন ভেবে না পেয়ে গ্রামের পথ ধরে হাঁটা দেন।
হাঁটতে হাঁটতে নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে এক গ্রামে গিয়ে আশ্রয় পান। সেখান থেকে একবার ভারত যাবার জন্য অগ্রসর হয়েও মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস তিনি এদেশেই অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকেন।
দেশ স্বাধীন হলে আবার চাকুরিতে যোগ দেন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সিলেটেই কাজ করেন। ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য চলে যান। স্বাধীন দেশে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব কিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। সামাজিক চরিত্রও বদলেছে ভাল অথবা মন্দের দিকে। কী সাহিত্য-সংস্কৃতি, কী শিল্পকলায়।
তারপর ১৯৭৮ সালে আসে জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। তখন তিনি একটি বৃত্তি পেয়ে পোষ্ট ডিপ্লোমা কোর্স করার জন্য চলে যান ভারতের বারোদা এম.এস বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই পান শিল্পী-শিক্ষক কে.জি সুব্রামানিয়ানকে। যার প্রভাব শিল্পী শাকুর শাহ’র জীবনে প্রভূত।
এ প্রসঙ্গে ‘বেঙ্গল গ্যালারি’র প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লিখিত শিল্পী শাকুর শাহ’র নিজের বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। “যাদের কাজ আমাকে বিভিন্ন সময়ে অনুপ্রাণিত করেছে তাদের মধ্যে যামিনী রায়, কে. জি. সুব্রমানিয়ান, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী প্রমুখ। উনিশশো ছিয়ানব্বই। মৈমনসিংহ গীতিকার মধ্য দিয়ে মূলত লোকজ ফর্মের আশ্রয়ে গড়ে উঠতে থাকে ছবিরা। নতুন আনন্দে সখ্য জমে ওঠে………..এ ধারায় আঁকতে গিয়ে ব্রতচারী আন্দোলনের জন্য খ্যাত গুরুসদয় দত্তের একটি কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আগে বাঙালি হও তারপর বিদেশি হয়ো।'” উনাশি সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে চলে আসেন তিনি।
শাকুর শাহ’র চিত্রকর্মের মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রখ্যাত চিত্র সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ বলেছেন, “মৈমনসিংহ গীতিকা বাংলাদেশের-বাঙালির প্রধান সাহিত্যিক দলিল। এই কবিতায় হাওর-বাওর সমৃদ্ধ জল-সচল ভূপ্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা নর-নারীর সম্পর্ক বিশেষ করে প্রেম প্রধান উপজীব্য। মানুষের মনোবেগ জলের মত বিচিত্রভাবে প্রবাহমান, নিসর্গের মতই পল্লবিত ও প্রফুল্ল। শাকুর এই প্রফুল্ল প্রকৃতির শিল্পী। তাঁর পূর্বজ শিল্পীদের মত লোকশিল্পকে তিনি অনুসরণ করেননি। দ্বিমাত্রিক জমিনের ওপর দ্বিমাত্রিক ইমেজেই শিল্পী পাশাপাশি চাপিয়েছেন। বর্ণের উজ্জ্বলতা, অলংকারধর্মিতা আর রেখার বাঁকানো ও নমিত আচরণে শাকুর মানব-মানবী, নদী-খাল, ঝাড়-জঙ্গল, পশু-পাখি এঁকেছেন। বেতে বোনা পাটি আর নকশি কাঁথার ব্যাকরণ মেনে তিনি স্পেস ভাগ করেছেন যেন। তাছাড়া তার কাজে যে আখ্যানধর্মিতা আছে তাতে পটের মাহাত্মও যুক্ত হয়েছে। জড়ানো পট নয়, বিশেষ এক ধরনের চৌকা পটই যেন আধুনিক চিত্রবিদ্যায় এক শিল্পী এঁকে চলেছেন। আখ্যানের বিস্তারের জন্য তার চৌকা পট সব সময় বর্গাকার নয়, প্রচুর আয়তকার স্পেসও তার প্রয়োজন হয়েছে। শাকুর রঙিন ও নকশাদার উদ্ভিদ ও প্রাণিজ ইমেজের সঙ্গে অক্ষর সাজিয়ে সেই গাঁথা কবিতার পংক্তিমালা জুড়ে দিয়েছেন। একদিকে প্রকৃতি অনুষঙ্গ, অন্য দিকে টাইপোগ্রাফিক অনুষঙ্গ। এই দুই-এ মিলে কী হল? এ প্রশ্নে দর্শকচোখ ভাবিত হয়। ইমেজ ও অক্ষরের সমন্বিত প্রয়োগ এ দেশের শিল্পে নেই। গাঁথা কবিতার চরণগুলো অন্য অবয়বের পাশাপাশি উপস্থাপিত হওয়ায় একটি সত্যই অনুভূত হয় যে ওই ভূপ্রকৃতি ও মানুষের হৃদয়েই বাস করে এই কাব্যানুভূতি। শাকুর মহুয়া, মলুয়া, কাজলরেখার কবিদের চিত্রকর সহোদর।”
শাকুরের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয় রাজশাহীতে ১৯৭৫ সালে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি দেশ-বিদেশে প্রায় সতেরটি একক চিত্র প্রদর্শনী করেন। আর যৌথভাবে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ শুরু করেন ছাত্র থাকাবস্থাতেই। ১৯৬৯ সালে পটুয়া গ্রুপের সদস্য হিসেবে খুলনা ও ঢাকাতে প্রদর্শনীর মাধ্যমে যাত্রা শুরু। এরপর দেশ-বিদেশে অংশগ্রহণ করেন প্রায় দেড় শতাধিক যৌথ প্রদর্শনীতে। দেশ-বিদেশের নানা সংগ্রহশালায় ছড়িয়ে আছে তাঁর চিত্রকর্ম। শিল্পী আব্দুর শাকুরের সংগ্রহেও রয়েছে আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ভারত ইটালি, জাপান, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পাকিস্তান, পোলান্ড, স্পেন, আমেরিকা, ব্রিটেন, দোহা, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের চিত্রকর্ম। বাংলাদেশের প্রতিথযশা শিল্পীদের কাজ তো রয়েছেই। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে সুদৃশ্য বইও।
শিল্পী শাকুর শাহ ১৯৭৭ সালে ভারতের গুজরাটের ললিতকলা একাডেমীতে চিত্র প্রদর্শনীর জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় বাটা আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার, জাপানে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এক্সেলেন্স পুরস্কার, ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে জাপানের টকিওতে এসিসিইউ-তে রানার আপ পুরস্কার, ২০০২ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক, ২০০৮ সালে শিল্পী এস এম সুলতান পদক সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। ছবির মোহে ঘুরে বেরিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা সব সংগ্রহশালা।
বগুড়া শিল্পসাহিত্যে অবদান রেখে আসছে যুগ যুগ ধরেই। পূর্ব ভারতীয় শিল্পঐতিহ্যের রত্নভান্ডার এটি। এখানে ভারতীয় নানা অনুষঙ্গের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে এদেশের মাটির ঘ্রাণ, দেশিয় বৈশিষ্ট্যের উপাদান। বগুড়ার লোক ঐতিহ্যে নানাভাবে সমৃদ্ধ এদেশের শিল্প-সাহিত্য। এখানে রয়েছে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের উচ্চমানসম্পন্ন টেরাকোটার মূর্তিকলা এবং বাঁশ-বেতের শিল্প ও কাঁথা শিল্পের নান্দনিকতা। এসবের মাঝেই বেড়ে ওঠা শাকুরের শৈশব। যদিও একটা সময় গিয়ে শিল্পীকে আর স্থানিক থাকলে চলে না, তাঁকে অতিক্রম করে যেতে হয় সব মোহ ও মায়া। না হলে সৃষ্টিশীলতার নতুন আঙ্গিক আসবে কোত্থেকে? তবু স্থানিকের যে সৌন্দর্য আর নান্দনিকতা তাই শিল্পীকে টেনে নিয়ে আসে শেকড়ের কাছে। এটাই শিল্প ও শিল্পীর বোঝাপড়া। সম্ভাবনার দিকে বাঁক নেবার প্রস্তুতি, আকুতিও বটে।
তথ্যসূত্র: লেখাটি তৈরির জন্য ফেব্রুয়ারী, ২০১০-এ শিল্পী শাকুর শাহ’র সাক্ষাৎকার ও ‘ব্যালাডস এন্ড পেইন্টিং: শাকুর’ নামক গ্রন্থ -এর সহযোগিতা নেয়া হয়েছে।
লেখক : চন্দন সাহা রায়