স্কুলে পড়ার সময়ই ছবি আঁকায় হাতেখড়ি হয়েছিল কিবরিয়ার। তাঁর জন্মস্থান বীরভূমে প্রতিবছর কৃষি মেলা হতো, যেখানে আঁকিয়েরা ছবি নিয়ে যেতেন। বীরভূম জেলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই মেলার ছবি প্রদর্শনীতে ছোট ছোট কাজ নিয়ে হাজির হতো। মোহাম্মদ কিবরিয়াও কয়েকবার অংশগ্রহণ করেছেন মেলায়। মৃত্যুর মাস ছয়েক আগে রবীন্দ্রনাথ একবার এসেছিলেন এই মেলায়, তিনি আসায় ওই কৃষিমেলাটি অনেক বেশী গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। কিবরিয়া তখন ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণীতে পড়তেন। রবীন্দ্রনাথের সৌম্য শান্ত মূর্তি তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। বীরভূম জেলা স্কুল থেকে হাতে লেখা ম্যাগাজিন বেরুত। সেই ম্যাগাজিনে আঁকতেন কিবরিয়া। তাঁর ছবি আঁকার আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিলেন স্কুলের শিক্ষকরা। বীরভূম জেলা স্কুল শেষ করে যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেন, তাঁর পেছনে অনুপ্রেরণা এসেছিল সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কথা বলেছিলেন কিবরিয়ার পরিবারের সঙ্গে। ফলে তিনি ১৯৪৫ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন।
এই আর্ট স্কুল থেকে পাস করার পর থেকে তিনি সমকালীন চিত্রকলার একটি নিজস্ব ভাষা ও শৈলী গড়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের শিল্পকলার বর্তমান অবস্থানে পৌঁছানোর পেছনে অবদান রেখেছেন এবং পশ্চিমা আধুনিকতার নানান ধারার সঙ্গে দেশজ চেতনা ও ঐতিহ্যের একটি সম্মেলন ঘটিয়েছেন। বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্রকলার চর্চায় এবং ছাপচিত্রে কিবরিয়া যে মৌলিকত্ব, সৃজনপ্রতিভা এবং উত্কর্ষ দেখিয়েছেন, তার তুলনা বিরল।
মোহাম্মদ কিবরিয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জেলার বীরভূমে ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ রফিক এবং মাতা সায়েরা বেগম। বড় ভাই মোহাম্মদ আরিফ। তিনি বাবাকে হারিয়েছেন খুব অল্প বয়সে। একটি ছোট প্রেস ছিল কিবরিয়ার বাবার। তাঁর মৃত্যুর পর কিবরিয়ার বড় ভাই সেটি চালাতেন। মা বা বড় ভাই কেউই কিবরিয়ার শিল্পী হওয়ার ইচ্ছায় কোন বাধা দেননি। পরিবারের পরিবেশটি ছিল খোলামেলা, আন্তরিক। মোহাম্মদ কিবরিয়ার স্ত্রীর নাম আনজুম কিবরিয়া। তিনি দুই ছেলের জনক।
মোহাম্মদ কিবরিয়া বীরভূম জেলা স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেন। স্কুল শেষ করে ১৯৪৫ সালে ষোল বছর বয়সে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে কলকাতার স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস থেকে পেইন্টিংয়ে গ্রাজুয়েট হন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অফ ফাইন আর্টস অ্যান্ড মিউজিক থেকে পেইন্টিং ও গ্রাফিকসে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯৫০ সালে কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে বেরুলেন কিবরিয়া এবং ১৯৫১ সালের শেষের দিকে চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে তিনি নওয়াবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ড্রয়িং-শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ততদিনে জয়নুল আবেদিন তাঁর কয়েকজন সতীর্থের সহায়তায় ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট খুলেছেন, এবং এর অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন। জয়নুল কিছু সময়ের জন্য লন্ডন গেলে কিবিরিয়া আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার সুযোগ পান, জয়নুল ফিরে এলে তিনিও ফিরে যান নওয়াবপুর স্কুলে। তবে ১৯৫৪ সালে পাকাপাকিভাবে আর্ট ইনস্টিটিউটে (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
কলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। জয়নুল আবেদিন ছিলেন সেখানকার শিক্ষক, খুবই জনপ্রিয়। আরও ছিলেন আনোয়ারুল হক, মণিভূষণ দাশগুপ্ত। আরও একজন শিক্ষক ছিলেন, বসন্ত গাঙ্গুলি। তিনি কিবরিয়াকে প্রভাবিত করেছেন শিল্পের প্রকরণ ব্যবহারে সৃজনশীল হওয়ার ক্ষেত্রে। বসন্ত গাঙ্গুলি নিজে এসব প্রকরণ-রঙ, প্যাস্টেল, কাঠকয়লা-খুবই দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারতেন। আবার ছবির ভেতরেও যে একটি কাঠামো থাকে, যার সঙ্গে উপরিতলের থাকে একটি দ্বান্দিক সম্পর্ক, সেটি তিনি চমত্কারভাবে চিহ্নিত করতে পারতেন। ছবির কম্পোজিশনে কোথায় কোন দৃষ্টিক্ষেত্রকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে, বসন্ত গাঙ্গুলি তা-ও ভালো জানতেন। কিবরিয়ার মধ্যে তিনি এসব গুণের উন্মেষ ঘটাতে পেরেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে কিবরিয়া জেনেছিলেন, প্রতিটি ছবির একটি কেন্দ্রবিন্দু থাকে এবং ছবির কাঠামোকে সেই বিন্দুর চারদিকে সাজাতে হয়। এই সাজানোটি যে সবসময় একটি পূর্ব পরিকল্পনা থেকে করতে হয়, তা নয়, বরং ছবি আঁকার সময় (অথবা ছাপাই ছবিতে রেখার সূক্ষ ও জটিল প্রয়োগের সময়) একটি স্বতঃস্ফুর্ততা থেকে, একটি অনিবার্যতা থেকে সেই ছবির ফর্মগুলো যেন একটি কেন্দ্রাভিমুখ বিন্যাসে গ্রন্থিত হয়ে যায়। এই কেন্দ্রটি নান্দনিক অনুভূতির, আবেগের, সৃজন কল্পনার অথবা বিচারবুদ্ধির। কিবরিয়ার ছবিতে (আধা-বিমূর্ত, আধা-অবয়বধর্মী অথবা বিমূর্ত) এই কেন্দ্রিকতার বিষয়টি একটা গতিশীলতা সৃষ্টি করে। এমনকি, যে ছবিতে অবয়বটি শনাক্তযোগ্য, সেখানেও।
১৯৫৯ সালে আঁকা তাঁর ‘ফুল হাতে বালক’ ছবিটির উদাহরণ দেয়া যাক। এ ছবিতে দর্শকের প্রধান অনুভূতিটি কি বালক সম্পর্কিত, নাকি ফুল সম্পর্কিত? একটুক্ষণ তাকালে দেখা যাবে বালক ও ফুল- এ দু’য়ের পেছনে আছে এক ধরনের বিষণ্নতা। বালকের চোখে যেমন নেই উচ্ছ্বাস, তেমনি ফুলও ঠিক ফুল হয়ে ধরা দেয় না। এই ছবিতে ফুল সম্পর্কিত প্রথাগত রোমান্টিকতা নেই, আছে বিষণ্নতা, অথবা অনিষ্পাপতা (বালকের ফিগারকে তুলে ধরে যে রঙ তা ওই অনিষ্পাপতার ইঙ্গিতবহ)। এই ছবির কেন্দ্র কোথায়? কেন্দ্র আছে ওই বিষণ্নতা/অনিষ্পাপতার অনুভূতিতে, যেখানে এই ছবির অভিজ্ঞতা আমাদের নিয়ে যায়। অথবা ছাপাই ছবিতে (যেমন, ১৯৬০-তে করা ‘দুটি ফুল’, লিথোগ্রাফ) ফর্মগুলো পরস্পর সম্পর্কিত হয়, নিষিক্ত হয়, বিকর্ষিত হয়, কিন্তু ছবিতে একটা ভারসাম্য সবসময় বজায় থাকে। ‘দুটি ফুল’-এ ফুলের দুই প্রতিরূপ, বিমূর্ত দুটি ফর্ম, একটি পরিব্যাপ্ত পরিসরে স্থাপিত। তাদের ভিতরে মিল আছে, অমিল আছে। কিন্তু একসময় বোঝা যাবে, এই দুটি ফর্ম আসলে সম্পর্কের অনিবার্যতার একটা চিন্তাকেই জাগিয়ে দেয়। এ ছবির কেন্দ্র কোথায়? কেন্দ্রটি উপস্থিত একটি বোধে, একটি অনুভূতিতে, একটি বিচারে, যাতে পৌঁছানোর জন্য দুটি ফর্মের আন্তঃসম্পর্ককে বুঝতে হবে। কলকাতা আর্ট স্কুলে যখন পড়তেন কিবরিয়া, পশ্চিমা ধাঁচের অ্যাকাডেমিক চর্চাটাই তখন প্রবল ছিল। তাতে একটি পর্যায়ের দক্ষতা সবাই অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু শুধু এই চর্চায় মননশীলতার বিকাশটি ছিল কঠিন। কিবরিয়া অবশ্য অ্যাকাডেমিক চর্চার মাধ্যমে ভিত্তিটি তৈরি করেছেন। কাজের যে একটি শৃঙ্খলা, একটি নিষ্ঠা থাকা প্রয়োজন, সেটুকুও উপলব্ধি করতে পেরেছেন তিনি এই অ্যাকাডেমিক চর্চার মাধ্যমে।
কিবরিয়ার অ্যাকাডেমিক চর্চায় জলরঙ ও তেলরঙের ব্যবহার ছিল। ভারতীয় ঐতিহ্যে ঘন ও অনচ্ছ জলরঙ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু তার তুলনায় তেলরঙে চিত্রতলে অনেক বেশি গভীরতা আনা সম্ভব এবং টেক্সচারের উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যানভাসকে গতিশীল করা যায়, এরকম একটি সিদ্ধান্ত থেকে অ্যাকাডেমিক চর্চা রঙ ও অন্যান্য প্রকরণ ব্যবহারে যেমন পশ্চিমকে অনুসরণ করেছে, তেমনি বিষয়বন্তুতেও বৈচিত্র্য আনতে তা সচেষ্ট ছিল। কিবরিয়া অ্যাকাডেমিক কাজ করেছেন, কিন্তু ইমপ্রেশনিজমের দ্বারস্থ হয়েছেন ক্যানভাসকে নির্ভার ও স্পন্দমান করতে। আলোর প্রতি এবং খোলা জায়গার প্রতি ইমপ্রেশনিস্টদের পক্ষপাতিত্ব আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রকৃতিমুখী করতে প্রণোদনা যুগিয়েছে। ইমপ্রেশনিস্টদের মতো কিবরিয়া একদিকে ছবিতে নিজেকে প্রকাশের একটি সুযোগ এবং পৃথিবীর প্রতি তাঁর দৃষ্টি ভঙ্গি তুলে ধরার উপায় হিসেবে দেখেছেন, অন্যদিকে প্রকৃতির ভিতরের জীবনকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন।
আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে বেরুনোর পর কিবরিয়া যামিনী রায়ের ছবির, বিশেষ করে তাঁর রঙ ব্যবহারের গুণগ্রাহী হয়ে পড়েন। কিবরিয়া নিবিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন যামিনী রায়ের কাজ। পটুয়াদের বিষম বর্ণলেপনের পরিবর্তে সুষম বর্ণলেপনের প্রতি যামিনীর পক্ষপাতিত্ব, ছবিতে গড়নের পরিবর্তে দ্বিমাত্রিকতার উদ্ভাস, রেখা ও রঙের সাযুজ্য ও সংহতি- এ-সবই কিবরিয়াকে আকর্ষণ করল। তাছাড়া ইউরোপের পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট ধারায় আঁকা যামিনী রায়ের কিছু নিসর্গচিত্রও তাঁকে এরকম ছবিতে আলোর খেলার বাইরে ছবির নিজস্ব বাস্তবতাকে আলাদা করে দেখতে অনুপ্রাণিত করেছে। নিসর্গ কিবরিয়ার ছবিতেও মূর্ত হয় নানান আবহে, নিসর্গের সঙ্গে ছড়িয়ে থাকে নানা বোধ এবং অনুভূতি, আনন্দ এবং বেদনা, বাস্তবতার অভিঘাত ও নস্টালজিয়ায়। এসময় স্পেসের ব্যবহারে তিনি উদার হয়েছেন, যাতে ক্যানভাসের ভেতরে পরিসরের একটি পরত খুলে যায়; বস্তুর পেছনে গিয়ে ভিন্ন একটি মাত্রায় স্থিত হয় চিত্রতল। নিসর্গের পাশাপাশি ব্যক্তির ওপর তিনি দৃষ্টি দিয়েছেন, বুঝতে চেয়েছেন ব্যক্তির ভেতরের জগত ও তার নানা বিন্যাসকে। তিরিশের দশকের বাংলা কবিতা পশ্চিমা আধুনিকতা, এবং পশ্চিমা আধুনিকতার শৈলীগত লক্ষণগুলো আত্মস্থ করে যেরকম ব্যক্তির বিষণ্নতা, বিকার, পারক্যবোধ এবং তার সংক্ষুব্ধ চিত্তের নানা আখ্যান রচনা করেছিল, যার প্রভাবে বাংলা কবিতায় ঘটে যায় এক কালান্তর, তেমনি পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাংলাদেশের চিত্রকলায় ব্যক্তির ওপর সন্ধানী আলো পড়ে। কিবরিয়ার ছবিতে এই ব্যক্তি উদ্ভাসিত হয়েছে অবশ্য কিছুটা আত্ম-অবলোকনের আলোতে। বালকবেলা থেকেই পারিবারিক আবহ কিবরিয়ার জন্য সৃষ্টি করেছে নিঃসঙ্গতা এবং একাকীত্ববোধ। হয়ত অনিশ্চয়তার অস্বস্তিও। এই অনিশ্চয়তার উত্পত্তি তাঁর পরিপার্শ্বকে নিজস্ব করে নিতে না পারার, অথবা জীবনের রীতিবদ্ধ প্রবাহে নিশ্চিত পা রাখতে না পারার অসফলতা থেকে। কিবরিয়া কখনও উচ্চকিত হতে পারেননি তাঁর চিন্তা নিয়ে, দ্বন্দ্ব নিয়ে, ক্রোধ নিয়ে; আত্মমগ্নই থেকে গেছেন বরাবর। তাঁর চিত্রস্বভাবও তাই অন্তর্গামী। সেজন্য দ্বন্দ্বকে তিনি সাজান রঙ ও ফর্মের একটি অন্তর্কাঠামোয়। বস্তুর বহিরাঙ্গ তাঁকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু শীঘ্রই তিনি দৃষ্টি ফেলেন এর ভেতরের বিন্যাসে, এর অন্তর্কাঠামোয়।
একটি ছবি শুরু করতে গিয়ে কিবরিয়া অনুভব করেন, তাঁর ছবি শুধু একটি চিন্তা অথবা অনুভূতিকেই প্রকাশ করবে না, বরং তা ব্যক্তির নিগূঢ় মানসিক অবস্থারও প্রতিফলন ঘটাবে। ছবির পেছনে চেতন-অবচেতনের একটি যুগ ক্রিয়া থাকে, অচেতনের নানা ইঙ্গিত থাকে। সেগুলোর একটি ব্যাখ্যা না হলেও অন্তত প্রকাশটা থাকা দরকার। এই অবচেতন বিষয়টি কিবরিয়ার ছবির জন্য জরুরি। এক্সপ্রেশনিজম বা প্রকাশবাদী ছবি- ফিগারধর্মী অথবা বিমূর্ত, যে- কোনও শ্রেণীরই হোক- ব্যক্তির মনোজগতের যেসব টানাপোড়েন, তার সংক্ষুব্ধতা, হতাশা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটায়, তার নৈর্বস্তুক উপস্থাপনা একটি দুরুহ ব্যাপার। কিবরিয়া সে কাজটি সফলভাবে করেছেন। তবে একটি বিশেষ রীতিতে চিত্রচর্চার সংকল নিয়ে এগিয়ে যাবার পেছনে কিছু কৃত্রিমতা থাকে, রিপ্রেজেন্টেশনটি তখন অপ্রকৃত হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর ছবিতে এই সমস্যাটি নেই। প্রশান্তির বিষয়টি অবশ্য সহজেই বোঝা যায়। কিবরিয়ার ছবিতে প্রশান্তির মানসিক দিকটির বাইরেও একটি দার্শনিক, এমনকি অস্তিত্বসূচক ইঙ্গিতও আছে। আগে ‘চন্দ্রাহত ঘোড়া’ বা ‘গোরস্তানে নৃত্য’- পর্যায়ে একটি পরিব্যাপ্ত বিষণ্নতাবোধ ছিল তাঁর কাজে, একটি পরাবাস্তব বিষাদের দ্যোতনা ছিল এখন সেটি পেছনেই ফেলে এসেছেন তিনি। তবে বিষণ্নতা যে নেই তা নয়, আছে। তাঁর নীল রঙ আছে, স্পেসের পরিচর্যায় একটি সূক্ষ অপ্রাপ্তিবোধের প্রকাশও আছে, অনুপস্থিতির একটি অনুভূতিও আছে। কিন্তু ছবিগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, কোথায় যেন একটি প্রশান্তির ছোঁয়া লেগে আছে। সে শুধু রঙ নয়, শুধু ফর্মের নান্দনিক সংস্থাপন নয়, বরং এসবের সম্মিলিত একটি ব্যঞ্জনা।
কিবরিয়া একক এবং যৌথ অনেক প্রদর্শনী করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একক প্রদর্শনীগুলো হলো- ১৯৬০ সালে জাপানের টোকিওতে গ্যালারি ইয়োসিদো, ১৯৬৩ সালে একই শহরের বিজুতসু শিপ্পানশায়। দিল্লীতে দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক উত্সবে ১৯৭৯ সালে কিবরিয়া ২০টি চিত্রকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী করেন। ২০০০ সালে বেঙ্গল ফাইন আর্টসএ একক প্রদর্শনী করেন। এছাড়া জাপানের মারুনিচি গ্যালারি, আর্ট ফ্রন্ট গ্যালারি এবং যুগোস্লাভিয়ার দ্য যোসেফ ব্রজ টিটো আর্ট গ্যালারিতে কিবরিয়ার একক চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে।
যৌথ প্রদর্শনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বার্ষিক প্রদর্শনী, ঢাকা আর্ট গ্রুপ, ঢাকা জাদুঘর। ১৯৫৪ সালে সর্ব পাকিস্তান চারুকলা প্রদর্শনী, পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল, ঢাকা। ১৯৫৬ সালে এ ভিউ অব দ্যা নিউ আর্ট ইন পাকিস্তান, ইউসিস, ঢাকা। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানি চিত্রশিল্পীর প্রদর্শনী, ওয়াশিংটন ডিসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৬০ সালে সর্ব জাপান প্রিন্ট প্রদর্শনী, টোকিও, জাপান। ১৯৬১ সালে ৩য় জাতীয় চিত্রকলা ও ভাস্কর্য প্রদর্শনী, আর্টস কাউন্সিল অফ পাকিস্তান, করাচি, পাকিস্তান। একই বছর তিনি সমকালীন চিত্রকলা প্রদর্শনীর জন্য ইটালি এবং পাকিস্তানে প্রদর্শনী করেন। ১৯৬২ সালে ৫ম সমকালীন জাপানি চিত্র প্রদর্শনী, টোকিও,জাপান। ১৯৬৩ সালে জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী, পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল, লাহোর। ১৯৬৪ সালে শিক্ষার মাধ্যমে যোগাযোগ, লাহোর পাকিস্তান। ১৯৭৫-৯৮ সালে ১ম,২য়, ১১তম ও ১৩তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা। ১৯৮১-২০০৩ সালে ১ম, ২য়, ৩য়, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ১০ম এবং ১১তম এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী, ঢাকা। এছাড়া দেশে-বিদেশে তাঁর অসংখ্য চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে।
কিবরিয়া ১৯৫৭ সালে ঢাকায় আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে চিত্রকলায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে জাপানের টোকিওতে আয়োজিত প্রথম তরুণ শিল্পী প্রদর্শনীতে স্টারলেম পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬০ সালে জাপানে সর্ব জাপান প্রিন্ট প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত হন। ১৯৬৯ সালে চিত্রকলায় বিশেষ অবদানের (প্রাইড অফ পারফরম্যান) জন্য প্রেসিডেন্ট পদক লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন। ২০০২ সালে জাপানী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মাননা লাভ করেন।
বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার উন্মেষকালে যে ক’জন শিল্পী পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ কিবরিয়া নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রকৃতির মধ্যে যে-প্রাণ খোঁজেন, অথবা নিমগ্নতা, অথবা বিষাদ, তাতে আধুনিকতার ধারণাটি সপ্রাণ হয়ে দাঁড়ায়। কিবরিয়ার কাজে আধুনিক নগরজীবনের নির্বেদ আর ক্লান্তিকে যতটা পাওয়া যায়, তারও বেশি পাওয়া যায় প্রকৃতির ভিতরের সুর আর স্পন্দন এবং মানুষের ওপর এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে, তার নানা বোধ-অনুভূতিকে। এই বহু বোধ সঞ্চারী ছবি আঁকা খুব বেশি শিল্পীর পক্ষে সম্ভব হয় না।
২০১১ সালের ৭ জুন তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: মোহাম্মদ কিবরিয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জেলার বীরভূমে ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ রফিক এবং মাতা সায়েরা বেগম।
পড়াশুনা: মোহাম্মদ কিবরিয়া বীরভূম জেলা স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেন। স্কুল শেষ করে ১৯৪৫ সালে ষোল বছর বয়সে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে কলকাতার স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস থেকে পেইন্টিংয়ে গ্রাজুয়েট হন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অফ ফাইন আর্টস অ্যান্ড মিউজিক থেকে পেইন্টিং ও গ্রাফিকসে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।
কর্মজীবন: ১৯৫০ সালে কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে বেরুলেন কিবরিয়া এবং ১৯৫১ সালের শেষের দিকে চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে তিনি নওয়াবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ড্রয়িং-শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ততদিনে জয়নুল আবেদিন তাঁর কয়েকজন সতীর্থের সহায়তায় ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট খুলেছেন এবং এর অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন। জয়নুল কিছু সময়ের জন্য লন্ডন গেলে কিবিরিয়া আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার সুযোগ পান, জয়নুল ফিরে এলে তিনিও ফিরে যান নওয়াবপুর স্কুলে। তবে ১৯৫৪ সালে পাকাপাকিভাবে আর্ট ইনস্টিটিউটে (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে: মোহাম্মদ কিবরিয়ার স্ত্রীর নাম আনজুম কিবরিয়া। তিনি দুই ছেলের জনক।
মৃত্যু : ২০১১ সালের ৭ জুন তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
মূল লেখক: কামরুন ঝুমুর
পুনর্লিখন : গুণীজন দল