বাবার পাঠাগারের প্রতি মুর্তজার ছিল তীব্র আকর্ষণ। বিশেষ করে যে সকল বইয়ে চিত্রকলার রঙ্গিন ছবি ও অলঙ্করণ ছিল সেগুলো ছিল তাঁর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। পরম আগ্রহে তিনি বইয়ের ছবিগুলো বারবার দেখতেন এবং আঁকতেন। শৈশবেই ছবির রঙ রেখা তাঁকে মুগ্ধ করেছে। ইমেজের প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ জন্মেছে তাঁর মায়ের কাছ থেকে। আকাশে মেঘ জমলেই মা মুর্তজাকে ডেকে দেখাতেন-ওই যে গরুর পাল, মানুষের মুখ। বশীর আকাশে তাকিয়ে মেঘের সমাবেশে কল্পনায় অনেক কিছুর রূপ আবিষ্কার করতেন। নিজের কল্পনা শক্তি প্রয়োগের সূচনা এভাবেই হয় এই শিল্পীর।
শৈশবে ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও, ঠিক শিল্পী হয়ে ওঠার বাসনা তাঁর ছিলনা। চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির দিক নির্দেশনায়। ১৯৪৭ সালে মুর্তজা যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখনই তিনি আকৃষ্ট হন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের জন্য মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের ছবি আঁকতে আঁকতে অংকনে হাতেখড়ি হয় তাঁর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন ব্যানার শিল্পীদের গ্রাফ করে ছবি আঁকার কৌশল, ঘরে ফিরে করতেন অনুশীলন। তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত নেতা ভবানী সেন ১৯৪৮ সালে বগুড়ায় এসে পার্টি অফিসে বশীরের আঁকা ছবি দেখে তাঁর অটোগ্রাফ বইতে লিখেছিলেন-“আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।” -এই বাণী কিশোর বশীরকে আলোড়িত করেছিল বলেই তিনি হয়েছেন দেশের একজন অন্যতম চিত্রশিল্পী। তবে তিনি শুধু দেশের একজন অন্যতম চিত্রশিল্পীই নন তিনি একাধারে শিল্পকলার শিক্ষক, কবি, উপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পনির্দেশক, গবেষক ও মুদ্রাতত্ত্ব বিশারদ।
১৯৩২ সালের ১৭ আগষ্ট ঢাকায় এক সম্ভ্রান্ত-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে মুর্তজা বশীরের জন্ম। তাঁর বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং মা মরগুবা খাতুন। বাবা নবজাতকের নাম রাখলেন আবুল খয়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম পুত্র ও কনিষ্ঠ সন্তান। পরে বাবার পরিচয়ে পরিচিত হবেন না বলেই তিনি নামের সামনের ও পেছনের অংশবিশেষ ছেটে নাম ধারণ করলেন- মুর্তজা বশীর।
১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনষ্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)-এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মুর্তজা বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্প শিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাকসহ বেশ ক’জন গুণী শিল্পীকে। প্রথম থেকেই বশীর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে তাঁর চিত্রকলার বিষয়বস্তু করেছেন। শিল্পী জীবনের সূচনা থেকেই মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ও মমতা ছিল প্রগাঢ়। পরবর্তীতে তিনি বিমূর্ত ও অর্ধবিমূর্ত ধারায় অগ্রসর হলেও তাঁর সব ছবির পেছনে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা অটুট আছে।
সেইসময় শিল্পী জীবনের ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত ও সংগ্রাম মুখর। সেকারণে মুর্তজা বশীরের আর্ট স্কুলে পড়ার ব্যাপারে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কিছুটা বাধা এসেছিল। শিল্পকলার প্রতি মুসলিম পরিবারগুলোর কিছুটা ধর্মীয় রক্ষণশীল মনোভাবও তখন কিছুটা প্রকট ছিল। বশীরের পরিবার শিক্ষিত ও আলোকিত হলেও সেখানে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পরিবেশ ছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাঁর সময়ের এক অগ্রসর আধুনিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়ার সত্ত্বেও চিত্রশিল্পী পেশার অনিশ্চয়তার কারণে প্রথমে তিনি পুত্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইতস্তত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুত্রের প্রতি গভীর স্নেহের কারণে পুত্রের ইচ্ছা মেনে নেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দিনরা মুসলিম রক্ষণশীলতা অতিক্রম করে যখন এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন-তখন তাঁর পুত্রও পারবে। তিনি শেষে খুশি মনেই বশীরের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।
মুর্তজা বশীরের চিত্রকলায় নাগরিক জীবন থেকে বেশী এসেছে গ্রামীন জীবনের কথা। অঙ্কনশৈলীতে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের দৃঢ়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর্ট ইনষ্টিটিউটে পড়ার সময় তাঁর সবচেয়ে বেশি সখ্যতা ছিল এক শ্রেণীর ওপরের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলামের সাথে। তাঁর সান্নিধ্যে এসে মুর্তজার কাছে ড্রইং আরো প্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়। আরো বেশি করে আমিনুল অনুরাগী হবার উপলক্ষ ঘটে ১৯৫০ সালে। হাজং বিদ্রোহের সময় রাস্তার দেয়ালে পোস্টার সাঁটার সময় মুর্তজা বশীর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পাঁচ মাস জেলে বন্দী থেকে জামিনে বের হয়ে ছবি আঁকার প্রতি একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরে জয়নুল আবেদীনের পরামর্শে আগ্রহ ফিরে পান তিনি। এরপর পাঁচ মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য তিনি আমিনুলের বাড়ীতে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সাহচর্যে ড্রইং করেছেন ও তেলচিত্র এঁকেছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে আরও অন্যান্য সহযোদ্ধার সাথে হাসপাতালে নিয়ে যান। ১৯৫৪ সালে ফাইন আর্টের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল বেরোবার আগেই তিনি কলকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে চার মাসের একটি আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে যোগ দেন। বশীর এখানেই প্রথম পাশ্চাত্য আর্টের ইতিহাস, ভারত শিল্পের ইতিহাস, শিল্পের তত্ত্ব ও নান্দনিকতা বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ পান। এখানে তিনি অর্দ্ধেন্দু কুমার গাঙ্গুলী, বাগেশ্বরী অধ্যাপক কল্যাণকুমার গাঙ্গুলী, মিউজিয়াম কিউরেটর দেবপ্রসাদ ঘোষ, ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত প্রমুখ গুণী ব্যক্তিদেরকে শিক্ষক হিসেবে পান। কলকাতায় চার পাঁচ মাসের প্রবাসজীবনের সময় তিনি উপন্যাস লেখায় হাত দেন। ১৯৭৯ সালে তাঁর একটি আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ ‘আলট্রিমেরিন’ প্রকাশিত হয়।
আর্ট স্কুল থেকে পাশ করার পর ১৯৫৫ সালে বছর খানেক নবাবপুর সরকারী স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাবার অর্থে ইতালীর ফ্লোরেন্সে যান। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাঁকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছে, তাঁর শিল্পকর্মের ভিত্তিকে করেছে শক্তিশালী । এ সময় অধ্যাপক কাপুকিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তাঁর কাজে ফিগারের সরলীকরণ ও নূন্যতম রঙ ব্যবহারের শৈলী বশীরকে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্লোরেন্সে বশীর পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। অ্যাকর্ডিয়ান বাদক, জিপসির খেলা দেখানো, মা ও মেয়ের বাজার করে ফেরার দৃশ্য এঁকেছেন তিনি।
ইতালিতে দু’বছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ফ্লোরেন্স ছেড়ে আসার আগে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল ‘লা পার্মানেন্ট’ গ্যালারীতে। এতে ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালীন আঁকা চৌদ্দটি তৈলচিত্র ছিল। ১৯৫৮ সালে বশীর ইতালিয়ান চিত্রকর রাপিসার্দি ও ভাস্কর ম্যাডোনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে ‘মুভিমেন্টো প্রিমোরডিও’ (আদিমতার আন্দোলন) নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং ফ্লোরেন্সের অদূরে এম্পোলি শহরে গ্রুপ প্রদর্শনী করেন ১৯৫৮ সালের ১৩ থেকে ২৫ এপ্রিল । লন্ডনে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যান কিন্তু ছ’মাস কাটিয়ে বাবার আদেশে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। লন্ডনে জীবিকা নির্বাহের জন্য নানা কাজ করতে হতো বলে তেমন একটা ছবি আঁকতে পারেননি। এ সময় তিনি বিবিসি’র বাংলা অনুষ্ঠান ‘আন্জুমান’- এ খবর ও অন্যান্য কথিকায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেসময় তিনি লন্ডন প্রবাসী বন্ধু ফজলে লোহানীর উৎসাহে লাইব্রেরীতে বই পড়েছেন আর এভাবেই সমসাময়িক ইংরেজী সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ জন্মায়।
দেশে ফেরার পর ঢাকায় চাকুরী না পাওয়ায় ভাগ্যান্বেষণে করাচী যান তিনি। করাচী তখন পাকিস্তানের রাজধানী, সব সুযোগ-সুবিধা সেখানেই। প্রথমে কিছুদিন তাঁর কাটলো বন্ধু, আমলা ও নাট্যকার সাঈদ আহমেদের সঙ্গে সামরিক অফিসারদের সার্ভিসেস ক্লাবে। আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব মিডল ইস্ট সংস্থার পাকিস্তান প্রধান মি. ওয়াটসনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় তাঁর একক প্রদর্শনী আয়োজনের সুযোগ ঘটে। ১৯৫৯-এর মে মাসে ওই সংস্থার উদ্যোগে তাঁদের অফিসে ফ্লোরেন্স ও করাচীতে আঁকা বশীরের ২৪টি ছবি নিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁর বাবা উপস্থিত ছিলেন। করাচীতে এটি ছিল কোন বাঙালি শিল্পীর প্রথম একক আয়োজন। সেই সময় তাঁর কাজ শিল্পী ও শিল্পের সমঝদারদের মধ্যে বেশ আলোচিত হয়েছে।
১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় প্রেসক্লাবে ফ্লোরেন্স ও করাচীতে আঁকা ২০টি ছবি নিয়ে তাঁর পরবর্তী প্রদর্শনীর আয়োজন হয়।
প্রদর্শনী চলাকালে বিশিষ্ট উর্দু কবি ও শিল্পরসিক ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ঢাকা এসেছিলেন। তিনি তখন পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল লাহোর শাখার সচিব ছিলেন। বশীরকে তিনি লাহোরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তাঁর আমন্ত্রণে বশীর লাহোরে গেলেন। ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল লাহোরের ‘আল হামরায়’ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল-‘পেইন্টিংস, ড্রয়িং এ্যান্ড লিথোগ্রাফস বাই মুর্তজা বশীর’। প্রদর্শিত ৩০টি পেইন্টিংয়ের অর্ধেক ফ্লোরেন্সে, বাকী অর্ধেক করাচীতে আঁকা। এছাড়া জয়নুল আবেদিনের উপদেশে ৬টি লিথোগ্রাফও এঁকেছিলেন তিনি যা এই প্রদর্শনীর অংশ ছিল। বশীরের ছবিতে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি দর্শক সমালোচকদের আকৃষ্ট করে এবং তাঁরা শিল্পীর কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ১৯৬১ সালের জুনে লাহোরে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলে বশীরের সমসাময়িক চিত্রকর্মের দ্বিতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। লাহোরে আঁকা আটাশটি ছবির এই প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলো পাখির মটিফ নিয়ে আঁকা।
১৯৬২ সালে শিল্পী মুর্তজা বশীর ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম আমিনা। তাঁর দুই কন্যা যুঁই ও যূথি এবং একমাত্র পুত্র যামী।
১৯৬৭ সালের আগষ্টে সারগোদায় ‘দেয়াল’ সিরিজের আঁকা ২১টি তৈলচিত্র নিয়ে লাহোরে ও সেপ্টেম্বরে রাওয়ালপিন্ডিতে দু’টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ‘দেয়াল’ সিরিজের সর্বশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে করাচীতে। এ প্রদর্শনীতে ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আঁকা ৩৯টি ছবি প্রদর্শিত হয়। ১৯৬৮ সালে তাঁর একটি রেট্রোস্পেক্টিভ আয়োজিত হয় ঢাকায় ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত আঁকা চিত্রকর্ম দিয়ে। ৫৭টি পেইন্টিং এবং ৩২টি ড্রয়িং স্থান পায় এতে।
১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্বাধীনতার দাবিতে আয়োজিত বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পীদের মিছিলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। গ্রেপ্তার হতে পারেন এমন আশংকার কথা জেনে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে সপরিবারের দেশত্যাগ করে প্যারিসে চলে যান। সেখানে মোজাইক ও এচিং-এর প্রশিক্ষণ নেন। প্যারিসে ‘দেয়াল’ সিরিজের ১৬টি ছবি এঁকে সমাপ্তি টানেন তিনি। তারপর একদিন বাসার উঠোনে নুড়ি পাথর তুলে তার ভেতরকার বিন্যাস, শুদ্ধ ও সরল রূপ অবলোকন করে ভাবলেন-এই রূপের শুদ্ধতাই হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এপিটাফ। সে সময় প্যারিসে তিনি ‘এপিটাফ’ নামে এই সিরিজের ১১টি ছবি এঁকেছেন । বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং হানাদারদের আক্রমণ কেন্দ্রিক ৮টি ড্রয়িংও করেছেন তখন।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় বশীর জনতা ব্যাংকে মুরাল আঁকার জন্য প্যারিস থেকে লন্ডন যান। প্যারিসে থাকাকালীন ক্যানে-স্যুর মে শহরে এক চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। দেশে ফিরে ১৯৭৩ সালের আগস্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। চট্টগ্রামে তিনি ১৯৭৬ সালের মার্চের মধ্যে ‘এপিটাফ’ সিরিজে আরো ২০টি ছবি আকেঁন। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসাবে অবসর নিয়েছেন। চট্টগ্রামে তিনি সহপাঠী শিল্পী রশীদ চৌধুরী ও বন্ধু দেবদাস চক্রবর্তীকে পেয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষকতা ও শিল্পী জীবনের বিকাশের জন্য তিনি চট্টগ্রামকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। প্রায় তিনদশক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ও বসবাস শেষে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুর্তজা বশীর সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৭৬ সালে মে মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে ‘এপিটাফ ফর দি মার্টায়ারস’ শিরোনামে তাঁর একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। এসব চিত্রকর্মে শহীদদের আত্মত্যাগকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়েছে। মৃত্যু এখানে হয়েছে মহান ও গৌরবময়। এসব কাজের লিরিক ধর্মিতা লক্ষ্য করে কবি শামসুর রাহমান এগুলোকে ‘পাথরের কবিতা’ এবং সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত ‘আত্মাকে প্রসারিত করার মহাকাব্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া তাঁর আরও অনেক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে।
মুর্তজা বশীর মূলত চিত্রশিল্পী হলেও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়ও তিনি বিচরণ করেছেন। বিশেষ করে সাহিত্য সাধনায় এবং চলচ্চিত্র শিল্পে তিনি অনেকটা সময় সক্রিয় থেকেছেন। চিত্রকলায় তিনি বাস্তববাদী ও সমাজমনষ্ক হলেও সাহিত্যে তিনি অনেক রোম্যান্টিক। তবে তাঁর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সমাজ বাস্তবতার প্রাধান্য দেখা যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে- গল্পগ্রন্থ ‘কাঁচের পাখির গান’ (১৯৬৯), উপন্যাস ‘আলট্রামেরিন (১৯৭৯), কবিতাগ্রন্থ- ‘এসরেণু’ (১৯৭৬), ‘তোমাকেই শুধু’ (১৯৭৯) এবং ‘এসো ফিরে অনসূয়া’ (১৯৮৫) ও নির্বাচিত রচনা ‘মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত’ (২০০১)।
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে তিনি সমাজ বাস্তবতা ও শিল্পীত রুচির স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘নদী ও নারী’র সঙ্গে তিনি আদ্যোপান্ত জড়িয়ে ছিলেন চিত্রনাট্য’ সংলাপ লেখক, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে। কারওয়াঁ চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তাঁর লেখা। ‘ক্যায়সেকহু’ চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এসবের পূর্বে ১৯৬১ সালে লাহোরে থাকাকালীন চলচ্চিত্রকার ডাব্লিউ. জেড. আহমেদের সহকারী রূপে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৮০’র দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামে সংগ্রহ কমিটির দায়িত্বপালন করতে যেয়ে প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ ও গবেষণায় আকৃষ্ট হন মুর্তজা বশীর। ১৯৮৯ সালে জার্নাল অর ল্যুমেসমেটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া নামে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নালে তাঁর সুলতানী আমলের মুদ্রা সংক্রান্ত ৬টি প্রবন্ধ ছাপা হয়। হাবশী সুলতানদের বিষয়ে বিশদ কোন প্রকাশনা না থাকায় তিনি এ বিষয়ে উৎসাহী হয়ে লেখেন- যা ২০০৪ সালের একুশে বইমেলায় ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি বিভিন্ন চারুকলা প্রদর্শনীতে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ্ বাংলাদেশ ও বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য।
তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে বাংলা ১৪০০ বছর উপলক্ষে চট্টগ্রাম আইনজীবী সহকারী সমিতি কর্তৃক সম্মাননা, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার প্রদত্ত একুশে মেলা পদক, ২০০৩ সালে সুলতান স্বর্ণপদক, ২০০৭ সালে কবি চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদকসহ আরও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মান অর্জন করেছেন তিনি।
আর্টস কাউন্সিল অফ পাকিস্তান, করাচী ও পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল, লাহোর; জাতীয় আর্ট গ্যালারি, ঢাকা; বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, চট্টগ্রাম; বাংলাদেশ দূতাবাস, প্যারিস, ফ্রান্স, ব্রাসেলস্, বেলজিয়াম; জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ জুট মিলস্ কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ বিমান, ঢাকা; বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্ কর্পোরেশন, ঢাকা; বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা, ঢাকা; বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা; বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, ঢাকা; ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা; পূবালী ব্যাংক, ঢাকা; জনতা ব্যাংক, ঢাকা; উত্তরা ব্যাংক, ঢাকা; আরব বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা; ইউসিবিএল ব্যাংক, ঢাকা; ব্র্যাক, ঢাকা; র্যাংগস লিমিটেড, ঢাকা; ডানকান ব্রাদার্স, ঢাকা; এ্যাডকম, ঢাকা; সাইনেজ, ঢাকা; শামস্ গ্রুপ, ঢাকা; শিল্প মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং দেশ-বিদেশে ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাঁর চিত্রকলা সংরক্ষিত রয়েছে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: ১৯৩২ সালের ১৭ আগষ্ট ঢাকায় এক সম্ভ্রান্ত-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে মুর্তজা বশীরের জন্ম।
বাবা-মা: তাঁর বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং মা মরগুবা খাতুন। বাবা নবজাতকের নাম রাখলেন আবুল খয়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ। নয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম পুত্র ও কনিষ্ঠ সন্তান। পরে বাবার পরিচয়ে পরিচিত হবেন না বলেই তিনি নামের সামনের ও পেছনের অংশবিশেষ ছেটে নাম ধারণ করলেন- মুর্তজা বশীর।
পড়াশুনা ও চাকরি জীবন: ১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনষ্টিটিউট অফ আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)-এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মুর্তজা বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। শুরুতে ছাত্র হিসেবে তেমন ভালো ছিলেন না, কিন্তু কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আঁকাআঁকি চর্চা করার ফলে ১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্প শিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৫৫ সালে বছর খানেক নবাবপুর সরকারী স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাবার অর্থে ইতালীর ফ্লোরেন্সে যান। ইতালিতে দু’বছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ১৯৭৩ সালের আগস্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। চট্টগ্রামে তিনি ১৯৭৬ সালের মার্চের মধ্যে ‘এপিটাফ’ সিরিজে আরো ২০টি ছবি আকেঁন। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসাবে অবসর নিয়েছেন।
পরিবার: ১৯৬২ সালে শিল্পী মুর্তজা বশীর ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম আমিনা। তাঁর দুই কন্যা যুঁই ও যূথি এবং একমাত্র পুত্র যামী। প্রায় তিনদশক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ও বসবাস শেষে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুর্তজা বশীর সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
মৃত্যু: আগষ্ট ১৫, ২০২০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র :
“মুর্তজা বশীর : তাঁর জীবন ও সৃষ্টি”- হাসনাত আবদুল হাই, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘আর্ট অব বাংলাদেশ’ ‘সিরিজ-১১ নং’ গ্রন্থ।
গবেষক : জাহিদ মুস্তফা
পুনর্লিখন : মৌরী তানিয়া