বাসার সামনে দিয়ে সারাদিন সুর করে ডাকতে ডাকতে ফেরিওয়ালারা চলে যেত। কি এক অমোঘ আকর্ষণে তিনি চলে যেতেন তাদের কাছে। আসতো বায়স্কোপওয়ালা, নানা রকম ছবি দেখাত। রানীর ছবি, তাজমহল, নায়িকাদের ছবি আরো কত কি। পাঁচটা ছবির জন্য দিতে হতো পাঁচ পয়সা। ছোট্ট প্রিয়ভাষিণীর মন মানতে চাইতো না। সময় শেষ হলেও তিনি নড়তেন না বায়স্কোপের সামনে থেকে। তাঁর চোখ আটকে থাকতো বায়স্কোপওয়ালার নানা রকম ছবির উপর। জোর করে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেয়া হতো।
ছোট্টবেলায় বায়স্কোপওয়ালার ছবির প্রতি আটকে থাকা সেই চোখ জোড়া দিয়েই তিনি পরবর্তীতে প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পেয়েছেন এক শৈল্পিক রূপ। প্রকৃতির মগ্নতার মাঝেই তাঁর চিন্তার মূর্তরূপ ভেসে ওঠে। নিতান্তই তুচ্ছ গাছের ডাল, শেকড়-বাকড় আর পরিত্যক্ত কাঠের টুকরা, পোড়া কাঠ আর শেওলা ধরা ভাঙ্গা বাঁশের টুকরা, পচতে থাকা কাঠের টুকরা, অযত্নে বেড়ে ওঠা কোনো উদ্ভিদ এর মাঝে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন নানা শৈল্পিক অবয়ব। তাঁর মায়াময় হৃদয়ের ছোঁয়ায় এই সব পরিত্যক্ত সামগ্রী হয়ে উঠে স্নিগ্ধতায় ভরা এক একটি শিল্পকর্ম। শুধু তাঁর শিল্প কর্মই নয়, সংগ্রামী জীবন আর গভীর জীবন বোধের কারণেও তিনি এদেশে আজ সমাদৃত। তীব্র বঞ্চনাবোধ আর যুদ্ধময় জীবন। তবুও থেমে থাকেননি তিনি।
তিনি হলেন আমাদের প্রিয় ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তিনি এমনই একজন অনন্য অসাধারণ শিল্পী যাঁর শিল্পকর্ম শিল্পের ইতিহাসের চেনা পথে অগ্রসর হয়নি। আমাদের দেশের শিল্পচর্চায় তিনি যুক্ত করেছেন এক নতুন ধারার। এ ছাড়া তাঁর সংগ্রামী জীবন মানব সমাজে অনুসরণীয় ও বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনা শহরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। ডাক বাংলোর মোড়ের সেই বাড়ির নাম ছিল ‘ফেয়ারী কুইন’ (Fairy Queen /’পরীর রাণী’)। তাঁর মা রওশন হাসিনা ও বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক। প্রিয়ভাষিণীর ব্যক্তি ও শিল্পী জীবনে নানা বাড়ির প্রভাব অপরিসীম। এই নানা বাড়িতেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোরের মধুর দিনগুলো। প্রকৃতির সাথে মিলে-মিশে একাত্ম হবার প্রথম সুযোগ ঘটে এখানেই। ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর নানা এ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম কংগ্রেস করতেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শাসনকালে স্পীকার হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে তাঁর নানা সুপ্রিম কোর্টে কাজ করার উদ্দেশ্যে ঢাকা চলে আসেন। প্রিয়ভাষিণীও নানার পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে আসেন। তখন তাঁর বয়স পাঁচ পেরিয়েছে। জীবনে প্রথম বারের মতো স্কুলে যাওয়া শুরু করেন-টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দির-এ। নানা স্পীকার হবার সুবাদে তাঁরা চলে আসেন মিন্টো রোডে, ভর্তি হন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন তখন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। পরীক্ষায় ফলাফল যাই হোক, প্রিয়ভাষিণী নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত থাকার জন্য প্রতি বছর পুরস্কার পেতেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘পড়াশোনার টানে যে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম, তা কিন্তু নয়। স্কুলে যেতাম আসলে জাহানারা ইমামকে দেখতে। তাঁকে একদিন না দেখে থাকতে পারতাম না।’
স্কুলের পাশাপাশি প্রিয়ভাষিণী পরিবারেও পেয়েছিলেন শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ। সেই সাথে খালাদের কঠোর শাসন। বড় মামা নাজিম মাহমুদ নাটক লিখতেন, গান লিখতেন, নিজে গান করতেন, আবৃত্তি করতেন। মেজ মামা সেলিম বুলবুল গান করতেন। তবলার উপর একটা বইও লিখেছেন তিনি। আর খালারাও ছিলেন আবৃত্তি ও গানে পটু। কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই এঁদের মননশীলতার ছোঁয়া প্রিয়ভাষিণীকেও আলোড়িত করে। তখন থেকেই আবৃত্তি আর গানের প্রতি তাঁর ঝোঁক তৈরি হয়।
প্রিয়ভাষিণীর মা-বাবার জীবন ছিল কিছুটা এলোমেলো। সৈয়দ বংশের বাবার ছিল বংশ গরিমা। বাবা তাঁর মাকে প্রায়ই অত্যাচার করতেন। তাই তাঁর নানা সব সময় চাইতেন মাসহ প্রিয়ভাষিণীকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে। কিন্তু তাঁর বাবা তাঁদের নানা বাড়িতে থাকা নিয়ে ঝামেলা করতেন। তাই বাধ্য হয়েই ১৯৫৬ সালের দিকে ৯ বছর বয়সে প্রিয়ভাষিণীকে চলে আসতে হয় বাবার কাছে। তাঁর বাবা তখন খুলনার দৌলতপুর কলেজে কমার্স এর অধ্যাপক ছিলেন। যদিও তাঁর দাদার বাড়ি ফরিদপুর শহরের চর কমলাপুর রোডে। বর্তমানে যার নাম হয়েছে খান বাহাদুর ইসমাইল হোসেন রোড। দাদা সৈয়দ জহুরুল হক ছিলেন বড় লাটের কেয়ারটেকার। তাঁর চিন্তাভাবনাও ছিল তত্কালীন ইউরোপীয় সাহেবীদের দ্বারা প্রভাবিত। তিনি বাড়িটিও তৈরি করেছিলেন ইউরোপীয় ঢঙে। প্রিয়ভাষিণীর বাবা ঘরের মানুষদের উপর অত্যাচার করলেও বাইরে তাঁর ভাল মানুষ আর জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে বেশ সুনাম ছিল।
বাবার কর্মস্থল দৌলতপুরে এসে তিনি বীনাপানি পাঠশালায় ভর্তি হন। এই পাঠাশালার স্মৃতি তাঁর জীবনে আজও অম্লান হয়ে আছে। পাঠশালার বেঞ্চে আর খুঁটিতে লেখা থাকতো টুকরো টুকরো নানান অর্থহীন কথা- ‘I love you‘, ‘খুকি+রমজান’, ‘আমরি বাংলা ভাষা’ আরো কত কি। এর সবই পরবর্তীতে তাঁর করা ভাস্কর্য ‘বীনাপানি পাঠশালা’-তে ঠাই পেয়েছে। নানা সমস্যার মধ্যেও অনিয়মিত হিসেবে খুলনা পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে তিনি এস.এস.সি. ও গার্লস কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. ও ডিগ্রি পাস করতে সক্ষম হন।
বাবা-মায়ের ১১ সন্তানের মধ্যে প্রিয়ভাষিণী সবার বড়। বয়সে বড় হওয়ায় মায়ের কাজে সহযোগিতা করতে ছোট ভাইবোনদের সামলে রাখতে হত প্রিয়ভাষিণীকেই। আর এ কারণে প্রায়ই তাঁর বিকেলের খেলা মাটি হয়ে যেত। এত সব ঝামেলার পরও পুতুল খেলা কামাই হতো না কখনও। পাড়ার মেয়েদের সাথে দুপুরের নির্জন সময়ে তিনি মেতে উঠতেন পুতুল খেলায়। বর-কনে সাজিয়ে রীতিমত ঘটা করে পুতুলের বিয়ে দিতেন। প্রিয় পুতুল মঞ্জুরিকাকে নিয়ে অনেক সময় বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতেন।
খুব ছোট বেলা থেকেই অনেক মহত্ মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন তিনি। অম্লান দত্ত, সুফিয়া কামাল, এস এম সুলতান থেকে শুরু করে খান সরওয়ার মুর্শিদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ছাড়াও আরো অনেকের নৈকট্য লাভ করেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও বাবার শাসনে মনটা প্রায়ই হাপিয়ে উঠত তাঁর। মনে মনে ভাবতেন কবে ষোল বছর পূর্ণ হবে, কবে স্বাধীন হবেন। এই স্বাধীনতার লোভেই হয়তো ষোল বছর বয়সে প্রিয়ভাষিণী জীবনে প্রথমবারের মতো ভুল করে ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে যান। প্রিয়ভাষিণী যার নাম দিয়েছেন ‘ষোড়শ সমস্যা’। এই সমস্যায় পড়ে তিনি ওই অল্প বয়সেই পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে ফেলেন। কিন্তু সেই মানুষটির প্রতি বিমুখ হতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। কারণ হিসেবে তিনি জানান, তিনি প্রচুর মিথ্যাচার করতেন আর খুবই রক্ষণশীল ও মৌলবাদী ছিলেন। তাঁর প্রথম স্বামী তখন মেট্রিক পাশও করেননি অথচ তাঁকে বলেছিলেন তিনি গ্র্যাজুয়েট।
কিন্তু তিনি দমে গেলেন না। ভাবলেন, যে মানুষকে ভালবাসা যায় তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই বলেই তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া নৈতিক নয়। তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। স্বামী কোনো কাজ করতেন না। ইতিমধ্যে সন্তানের মাও হয়েছেন প্রিয়ভাষিণী। পরিবারের খরচ, সন্তানের খরচ সেই সাথে স্বামীর পড়ার খরচ-সব মিলিয়ে তীব্র অর্থ কষ্ট শুরু হয় তাঁর। ধার-দেনা যতটুকু করা সম্ভব সবই হয়েছে। তখন আর কেউ ধার দিতে চাইতো না। তাই প্রিয়ভাষিণী চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৩ সালে খুলনার আগা খান স্কুলে মাত্র ৬০ টাকা বেতনে চাকরি নিলেন তিনি। ২০/৩০ টাকা বেতনে তিন চারটা টিউশনি নিলেন। না খেয়ে থাকতে হয়েছে অনেক দিন। পরে স্কুলের চাকরি ছেড়ে একটা মিলে টেলিফোন অপারেটরের কাজ নেন তিনি। কিন্তু এত কিছুর পরও স্বামীর সাথে সম্পর্ক দিন দিন আরো খারাপ হতে থাকে। স্বামীকে ছেড়ে হয়তো তখনই চলে আসতেন, কিন্তু তিনি ভাবলেন, “তার সাথে আমার সম্পর্ক যতই খারাপ হোক, সে এখন আমার উপর নির্ভর করে আছে, আমার উপরই নির্ভর করে তার লেখা-পড়া, ভবিষ্যত্। আশ্রিত ব্যক্তিকে ফেলে চলে যাওয়াটা আমার ঠিক মনে হলো না। ফলে তার পড়ালেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ কষ্টটা আমাকে করতেই হলো।” নিজের পড়ালেখা বন্ধ করে প্রচন্ড পরিশ্রম করে, পারিবারিক, সামাজিক নির্যাতন সহ্য করে তিনি স্বামীকে ইঞ্জিনিয়ার বানালেন, যদিও জানতেন তার সাথে বসবাস করা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। এত অল্প বয়সেই এ রকম পরিণত বিবেক এবং বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে তাঁর সাথে প্রথম স্বামীর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। যদিও বহুকাল আগেই তার সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে গিয়েছিল। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর যুদ্ধের সেই ভয়াবহতার মাঝে একা একজন নারী হয়েও তিনি সন্তানদের নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবছিলেন। আর ঠিক এরকম সময়ই তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ১৯৭১ সালে এদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়েদের মতো তিনিও পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে শেষ হয় ঠিকই কিন্তু তিনি যে জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন তার আর শেষ হলো না। তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই তাঁকে নিয়ে একটা কানাঘুষা চলতো। কিন্তু তিনি কখনও বিচলিত হতেন না। সব সময় মাথা উঁচু করে চলেছেন। কারণ নিজের কাছে তিনি খুবই স্বচ্ছ ছিলেন। তিনি জানতেন তিনি কোন অন্যায় করেননি, কাজেই তাঁর কোন অসম্মান নেই। তবে সেই সংগ্রাম যে একটা মানুষের জীবনে কি দুর্বিষহ যন্ত্রণা সৃষ্টি করতে পারে তা বোঝা যায় তাঁর কথাতে, ‘যে খালার সাথে একই জামা পড়ে, একসাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি, সেই খালা-মামারা, যারা সারা জীবন এত সংস্কৃতি চর্চা করেছেন তাঁরা আমার উপর পাক হানাদারদের নির্যাতনের কারণে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু বড় মামা, মেজ মামা আর মা উদারভাবে কথা বলেছেন। কোন অনুষ্ঠান বা দাওয়াতে গেলে দেখা যেত সব মহিলারা একদিকে জটলা করে আমাকে নিয়ে কথা বলছে। আমি গেলেই সবাই একে একে সেখান থেকে সরে যেত। আমার দ্বিতীয় স্বামী যিনি সবকিছু জেনে বুঝেই আমাকে বিয়ে করেছেন, তিনিও একবার এই পরিস্থিতি দেখে আমাকে কোন দাওয়াতে বা অনুষ্ঠানে যেতে নিরুত্সাহিত করেছেন। আমি প্রতিবাদ করেছি, না আমি যাবই। আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। তাহলে আমি কেন যাব না? যুদ্ধ শুধু নয় মাসই আমাকে ঠেকায়নি- সারা জীবনের জন্য সংগ্রামে ফেলে গেছে।’
এ সময়ের কথা ভাবতে গিয়ে প্রিয়ভাষিণী বলেন, ‘ঐ সময়ের কথা আমি ভাবতেও পারি না। গভীরভাবে যখন আমি উপলব্ধি করতে যাই, তখন আমার সকল স্নায়ু শিথিল হয়ে যায়। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আবার সুস্থ হয়ে উঠতে আমার অনেক সময় লেগে যায়।’
প্রথমবার যখন তিনি তাঁর বড় মামাকে জানালেন যে যুদ্ধের নয় মাসে তিনি কিভাবে নির্যাতিত হয়েছেন তা দেশবাসীকে জানাতে চান। তাঁর মামা তখন অসুস্থ শয্যাশায়ী-সেই অবস্থাতেও তিনি তাঁকে উত্সাহ দিয়েছেন, শক্তি আর সাহস যুগিয়েছেন। এমনই উদারমনা আর প্রগতিশীল ছিলেন তিনি। প্রিয়ভাষিণী বলেন, ‘আমি খুব বড় হবার জন্য, মানুষের স্বীকৃতি পাবার জন্য যে এ নির্যাতনের কথা সবাইকে বলেছি তা নয়, আমি বলেছি আমার মতো আরো লাখো মা-বোনেরা যাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে, তাদের কথা ভেবে। তাঁরা যাতে শক্তি পায়, সাহস পায়, খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসে-সে জন্য তাঁদের সামনে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছি।’
যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে প্রিয়ভাষিণী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী আহসান উল্লাহ আহমেদ ছিলেন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। যেখানেই যেতেন একটা বিশেষ মর্যাদার আবরণ তাঁকে ঘিরে থাকতো। নানা রকম নিয়মকানুন আর রীতি মেনে তাঁকে চলতে হতো। সামাজিক প্রত্যাশা পূরণের চাপ ছিল। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত এই ছয় বছর প্রিয়ভাষিণী একজন গৃহবধু হিসেবেই জীবন-যাপন করেছেন। কিন্তু যেখানেই যেতেন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে তাঁকে নানা বিষয় হিসেব করে চলা-ফেরা করতে হতো। বাসে চড়া যাবে না, রিকশায় চড়া যাবে না-এমনি নানান কিছু। তাই তিনি ঠিক করলেন আবার চাকরি করবেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি একটানা কাজ করে গেছেন। টেলিফোন অপারেটর হিসেবে যেমন কারখানায় কাজ করেছেন, তেমনি UNDP, UNICEF, FAO, কানাডিয়ান দূতাবাস প্রভৃতি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছেন। কাজ করতে গিয়েও তাঁকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। বাচ্চাদের রেখে কাজে যেতে সমস্যা হতো। কেউ তাদের দেখাশোনা করতো না। তাঁকেই সবদিক সামাল দিতে হয়েছে। স্বামীর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে নানাভাবে নির্যাতন করতেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর নির্যাতনের বিষয় নিয়ে তাঁকে নানা কথা বলতেন।
এতকিছুর পরও তিনি পরম যত্নে বড় করে তুলেছেন তাঁর ছয় সন্তানকে। বড় ছেলে কারু তিতাস, মেজ ছেলে কাজী মহম্মদ নাসের, ছোট ছেলে কাজী মহম্মদ শাকের (তূর্য্য)। তিন মেয়ে-রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনী, রত্নেশ্বরী প্রিয়দর্শিনী, ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী।
তীব্র বঞ্চনাবোধ থেকেই বের হয়ে এসেছে প্রিয়ভাষিণীর শিল্প। ১৯৭৭ সালে তিনি নিজেকে আবার ফিরে পেলেন। উপলব্ধি করলেন, না একটা কিছু করতে হবে। আর সেকারণে তিনি সেসময় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতেন। কিন্তু হাজার মানুষের মাঝেও তাঁর একাকীত্বটা তাঁকে পেয়ে বসতো। প্রকৃতির মাঝে যে মৌনতা আছে, যে একাকীত্ব আছে তাই আবার বহুকাল পরে তাঁকে টেনে নিল। তাঁর বিষন্নতা, মোহময়তা তাঁর মাঝে নানা ছবি গড়ে তুলতে শুরু করলো। তখনই তিনি ঝরা পাতা, মরা ডাল আর গাছের গুড়িতে অবয়ব খুঁজে পেলেন। বিষন্নতা তাঁর খুব ভাল লাগে, প্রকৃতির মগ্নতার মাঝে তাই তিনি তাঁর চিন্তার মূর্তরূপ খোঁজেন। স্বামীর চাকরির কারণে যখন গ্রামে থাকতেন, তখন চারপাশের প্রকৃতিতে যা কিছু পেতেন তাই দিয়ে সুন্দর করে ঘর সাজাতে চেষ্টা করতেন। তখন ফুলের টবে গাছ লাগাতেন সুন্দর করে। মূলত ঘর সাজানো এবং নিজেকে সাজানোর জন্য দামী জিনিসের পরিবর্তে সহজলভ্য জিনিস দিয়ে কিভাবে সাজানো যায় তার সন্ধান করা থেকেই তাঁর শিল্পচর্চার শুরু।
ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম দেখে অনেকেই মুগ্ধ হতেন। শিল্পী এস এম সুলতান এসে তাঁর চোখ খুলে দেন। শিল্পী সুলতানের সাথে তাঁর খুব ছোটবেলায় দেখা হয়েছিল-১৯৫৯ সালে, দৌলতপুর কলেজে। তখনও এস এম সুলতান শিল্পী হিসেবে এত সুনাম অর্জন করেননি। বড় অদ্ভূতভাবে তখন তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল প্রিয়ভাষিণীর। এরপর দীর্ঘদিন আর তাঁর দেখা মেলেনি। ২৬ বছর পর ১৯৮৫ সালে আবারো দেখা হয় এস এম সুলতানের সাথে। একদিন সুলতান তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘তুমি তো একজন শিল্পী! হেনরি মুরের সৌন্দর্য্য নিয়ে এসেছ তুমি তোমার ভাস্কর্যে।’ সুলতান তাঁকে বড়মাপের শিল্পী হিসেবে তুলে ধরেছেন জাতির সামনে।
ভাস্কর্যের প্রদর্শণী করা প্রিয়ভাষিণীর পছন্দের নয় কিন্তু বাধ্য হয়ে তাঁকে করতে হয়। কারণ তাঁর বাসায় এগুলো রাখার মত জায়গা নেই, অন্যদিকে এগুলো করতে অনেক ব্যয় হয় তাঁর। তিনি নিজ হাতে কাঠ কাটা, ঘষা-মাজা করা এখন আর করতে পারেন না। এজন্য দুজন লোক রাখতে হয়। তাদের থাকা খাওয়া আর বেতন বাবদ মাসে অনেক টাকা খরচ হয়। এ টাকা তাঁকেই জোগাড় করতে হয়। সংসারের খরচ তো আছেই। সবকিছু চিন্তা করেই তিনি তাঁর ভাস্কর্য নিয়ে প্রদর্শনী করেন।
তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয় যশোরে শিল্পকলা একাডেমীতে। এস এম সুলতান সে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রিয়ভাষিণী দেখিয়েছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা কিভাবে মাত্র দশ হাজার টাকার মধ্যে সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে পারে। বাঁশ আর কাঠের বিভিন্ন আসবাবপত্রের প্রদর্শনী ছিল সেটা। প্রিয়ভাষিণীর প্রদর্শনী দেখে বিশিষ্ট শিল্পী হাশেম খান মন্তব্য করেছেন, “প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম দেখে আমি বিস্মিত। তিনি অত্যন্ত উঁচু মানের ভাস্কর্য তৈরি করছেন। তাঁর এই সৃষ্টি আমাদের দেশের ভাস্কর্য নির্মাণে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে।”
এরপর আরো কয়েকবার তাঁর কাজের প্রদর্শনী হয়েছে। এর মধ্যে আছে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে বেঙ্গল গ্যালারির প্রদর্শনী, ২০০৮ সালের আগস্টে ডট গ্যালারিতে প্রদর্শনী এবং অন্যান্য।
প্রিয়ভাষিণী যে ভাবে ফেলে দেওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া কাঠের টুকরা, শেকড়, গাছের গুড়িকে তুলে এনে নতুন জীবন দিচ্ছেন তা অসাধারণ। এটা তাঁর নিজের জীবনের সাথে মিলে যায়। কারণ যুদ্ধের সময় তিনি পাক সেনাদের অত্যাচারে প্রায় ফুরিয়েই যেতে বসেছিলেন কিন্তু সেখান থেকে তিনি আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। এদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে তাঁর কাজ স্থায়ী জায়গা করে নেবে বলে বোদ্ধামহলের বিশ্বাস। তিনি নীরবে-নিভৃতে কাজের মাধ্যমে বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে যেতে চান। কুমারী মায়েদের পুনর্বাসন, আশ্রয়হীন শিশুদের জন্য কাজ করারও ইচ্ছে আছে তাঁর। রোড আইল্যান্ডগুলোকে কাজে লাগানোর কথা ভাবেন। আর স্বপ্ন দেখেন সারা বাংলায় পথে পথে গাছ লাগিয়ে দেয়ার। ইতিমধ্যে তিনি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু করেছেন। বাংলাদেশে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের স্ত্রী মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘তাদের দেশে প্রিয়ভাষিণীর এ মডেল তারা অনুসরণ করবেন।’
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সৃষ্টি করে যেতে চান। যুদ্ধকালীন নির্যাতনে বিধ্বস্ত প্রিয়ভাষিণী ধৈর্য্য আর পরিশ্রমকে পুঁজি করে সমাজে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। শেষ বয়সে এসে কারুশিল্পের একজন নিপুন কারিগর হিসেবে আবির্ভুত হলেন তিনি। তাঁর নিপুন হাতের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ুক গ্রামবাংলার প্রতিটি আনাচে-কানাচে।
২০১০ সালে তিনি স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন।
এক নজরে ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী
নাম: ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী।
মাতার নাম: রওশন হাসিনা।
পিতার নাম: সৈয়দ মাহবুবুল হক।
জন্ম: ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি।
জন্মস্থান: খুলনা জেলা শহরে নানার বাড়িতে (ডাকবাংলো মোড়ের কাছে)।
পড়াশুনা: খুলনার পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন।
পরিবার-পরিজন:
বাবা-মায়ের ১১ সন্তানের মধ্যে প্রিয়ভাষিণী সবার বড়। ১৯৬৩ সালে প্রথম বিয়ে করেন। পরে ১৯৭২ সালে প্রিয়ভাষিণী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী আহসান উল্লাহ আহমেদ ছিলেন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। তাঁর ছয় সন্তান। তিন ছেলে ও তিন মেয়ে।
কর্মজীবন:
১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি অনেকটা পেটের দায়ে চাকরি করেছেন। কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। টেলিফোন অপারেটর হিসেবে যেমন কারখানায় কাজ করেছেন, তেমনি UNDP, UNICEF, FAO,কানাডিয়ান দূতাবাস প্রভৃতি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করেছেন। শেষ বয়সে এসে নানা শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন এবং তা অবিরামভাবে অব্যাহত রেখেছেন।
শিল্পকর্ম:
মূলত ঘর সাজানো এবং নিজেকে সাজানোর জন্য দামী জিনিসের পরিবর্তে সহজলভ্য জিনিস দিয়ে কিভাবে সাজানো যায় তার সন্ধান করা থেকেই তাঁর শিল্পচর্চার শুরু। তিনি দেখিয়েছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা কিভাবে অল্প খরচে সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে পারে। ঝরা পাতা, মরা ডাল, গাছের গুড়ি দিয়েই মূলত তিনি গৃহের নানা শিল্প কর্মে তৈরি করেন।
প্রদর্শনী:
তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয় যশোরে শিল্পকলা একাডেমিতে। এস এম সুলতান সে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর আরো কয়েকবার তাঁর কাজের প্রদর্শনী হয়েছে।
মৃত্যু- মার্চ ৬, ২০১৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য সূত্র: ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী নিজেই সাক্ষাত্কারের (২০০৬ সাল) মাধ্যমে তথ্য দিয়েছেন।
মূল লেখক : রকিবুল হাসান
পুনর্লিখন : গুণীজন দল