ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। আর তাইতো মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে সেই দূরের শহর কলকাতায় গিয়েছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস দেখার জন্য। সেখান থেকে ঘুরে আসার পর সাধারণ পড়াশুনায় মন বসাতে পারছিলেন না কোনভাবেই। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের সাধারণ পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস-এ ভর্তি হন। তাঁর মা ছেলের এই আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার এই আর্ট স্কুলে পড়তে যেতে সাহায্য করেছেন। আর ছেলেও মায়ের এই ঋণ শোধ করেছেন দেশের সুনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।
দেশের সুনামধন্য ও অন্যতম এই শিল্পী হলেন জয়নুল আবেদিন। তিনি শুধুমাত্র এদেশের একজন সুনামধন্য শিল্পীই ছিলেন না তিনি ছিলেন এদেশের আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃত্।
জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯শে ডিসেম্বর বর্তমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। (সরকারি নথিপত্রে তাঁর জন্ম তারিখ অবশ্য ১৮ই নভেম্বর, ১৯১৪)। বাবার নাম তমিজউদ্দিন আহমেদ এবং মা জয়নাবুন্নেছা। বাবা ছিলেন পুলিশের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর। তিনি ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র। ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অববাহিকার অত্যন্ত শান্ত, সুনিবিড় ও রোমান্টিক পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তাঁর শৈশব এবং তারুণ্যের প্রধানতম অর্জন ছিল বলতে গেলে এই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের অভিজ্ঞতা। তাঁর শৈল্পিক মানসিকতা নির্মাণে প্রকৃতির প্রভাব ছিল অসামান্য ও সুদূরপ্রসারী। তিনি বলতে ভালোবাসতেন, “নদীই আমার শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক”।
১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩৮ সালেই নিখিল ভারত চিত্র প্রদর্শনীতে গভর্নরের স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। এ পুরস্কার ছিল ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে আঁকা তাঁর একগুচ্ছ জলরং ছবির জন্যে। এরপর আরো কিছুকাল পর্যন্ত জয়নুল আবেদিন প্রাকৃতিক পরিবেশেরই এক রোমান্টিক রূপকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তখন ছিলেন একজন বিশ্বস্ত নিসর্গশিল্পী। কিন্তু ১৯৪৩-এর বাংলার দুর্ভিক্ষ জয়নুল আবেদিনকে একেবারে বদলে দেয়। গ্রাম-বাংলার রোমান্টিক নিসর্গ শিল্পীকে রূপান্তরিত করে ফেলে এক দুর্দান্ত বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে। তারপর থেকে সারাটি জীবনই বিক্ষুব্ধ থেকে গেছেন তিনি।
দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পরপরই জয়নুল তাঁদের ময়মনসিংহের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানেও দুর্ভিক্ষের যে মর্মান্তিক দৃশ্যাবলি দেখতে পান তাতে তিনি ভীষণভাবে ব্যথিত হন এবং আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত দুস্থ মানবতা যেন সে যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হয়ে আসে। তেতাল্লিশের কলকাতা মহানগরে ঘটেছে মানবতার চরম অবমাননা। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্যান্বেষণে তীব্র প্রতিযোগিতা চলেছে মানুষ আর কুকুরের মধ্যে। ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক জয়নুল এ রকম অমানবিক দৃশ্যে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত হন, আতঙ্কে শিউরে ওঠেন, আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কিন্তু সে আবেগকে তিনি কাজে লাগান সেসব দৃশ্যাবলির শিল্পরূপ দিতে। অন্যভাবে বলা যায় সেই আবেগই তাঁকে তাড়িত করে, বাধ্য করে অমানবিক পরিস্থিতির এক মানবিক নির্মাণে। তিনি রাতদিন শুধু কলকাতার দুর্ভিক্ষের সেসব নারকীয় দৃশ্যাবলির স্কেচ করতে থাকেন।
জয়নুল তখন আর্ট স্কুলের একজন শিক্ষক, তাঁর আয় সামান্য। দুর্ভিক্ষের বাজারে উন্নতমানের শিল্পসামগ্রী তখন যেমন ছিল দুর্লভ তেমনি দুর্মূল্য। সে কারণে তিনি বেছে নেন শুধু কালো কালি আর তুলি। শুকনো তুলিতে কালো চীনা কালির টানে স্কেচ করতে থাকেন অতি সাধারণ সস্তা কাগজের ওপর। ব্যবহার করেছেন কার্টিজ পেপার। এসব কাগজ ছিল ঈষত্ পীত বর্ণের। এমনকি তিনি প্যাকেজিং কাগজও ব্যবহার করেছেন। সাধারণ স্বল্পমূল্যের এসব অঙ্কন সামগ্রী ব্যবহার করে তিনি যে শিল্প সৃষ্টি করলেন তাই পরিণত হলো অমূল্য সম্পদে। এমন এক অসাধারণ শক্তিশালী অঙ্কন শৈলীর মাধ্যমে তিনি দুর্ভিক্ষের করুণ বাস্তব দৃশ্যাবলি চিত্রায়িত করলেন, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের চিত্র ঐতিহ্যে ছিল না। জয়নুলের দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলো দেখার পর ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ শ্রীমতি সরোজিনি নাইডু মন্তব্য করেছিলেন, “সব চাইতে মর্মস্পর্শী ও আবেগময় বর্ণনার চাইতেও তাঁর এসব ছবির আবেদন অধিকতর।” ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে সে বছরই কলকাতায় যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল তাতে জয়নুল তাঁর দুর্ভিক্ষ নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৩৮ সালে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পান। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তারপর জয়নুল পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর চাকরিটি ছেড়ে ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত নর্মাল স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু তখন থেকেই তিনি এদেশে শিল্প আন্দোলন শুরুর গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকাতে প্রদেশের প্রথম আর্ট স্কুল, গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অফ আর্টস প্রতিষ্ঠার যাবতীয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন তিনি। তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁর এই উদ্যোগটি ছিল রীতিমতো বিপ্লবাক্তক ঘটনা।
তাঁর শিল্পী হিসেবে খ্যাতি, অসাধারণ সাংগঠনিক মেধা, তত্কালীন শিল্পী সহকর্মী ও বন্ধুদের সহযোগিতা এবং কতিপয় বাঙালি সরকারি কর্মকর্তার সাহায্য ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়েই সম্ভব হয়েছিল ১৯৪৮ সালে এদেশের প্রথম আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা। তখন এর নাম ছিল ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস’। এই ইনস্টিটিউটকে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষরূপে। মাত্র দু’কামরার সেই ইনস্টিটিউটটিকে ১৯৫৬ সালের মধ্যেই তিনি এক অতি চমত্কার আধুনিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন। পরবর্তীকালে এটি পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় এবং স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। (আরো পরে মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয় এবং এর বর্তমান পরিচয় চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে)। কলেজ ক্যাম্পাসের নকশা নির্মাণে জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্থপতি মাজহারুল ইসলামকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। চারুকলা ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসের যে নান্দনিকতা তা এদেশের ক্যাম্পাস স্থাপত্যের এক মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে ১৯৫১-৫২তে জয়নুল আবেদিন সরকারি বৃত্তি নিয়ে এক বছরের জন্যে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন চারুকলা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে তাঁর নিজের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীও করেন। তাঁর কাজ ইংল্যান্ডের বিদগ্ধজনের অকুন্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। তাঁর এই ইংল্যান্ড ভ্রমণটি শুধুমাত্র যে তাঁকে পাশ্চাত্য জগতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তাই নয়, এতে করে তাঁর দৃষ্টি আরো প্রসারিত হয় এবং সম্ভবত এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের চারুকলা চর্চা শুরু থেকেই এক প্রাণবন্ত আধুনিকতার চরিত্র গ্রহণ করতে পেরেছিল। আবেদিনের এই ইউরোপ ভ্রমণ তাঁকে বাংলার সমৃদ্ধ লোকশিল্পের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কেও বিশেষভাবে সচেতন করে তোলে।
১৯৫২ সালে বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি এদেশের স্থানীয় শিল্প-ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্প-আন্দোলন ও কৌশলাদির সমন্বয় সাধনে ব্রতী হন। ইতিমধ্যে তিনি নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তিনি তখন থেকেই চিত্রকলায় এক ধরনের আধুনিক বাঙালিত্ব ফুটিয়ে তোলার পক্ষে সুস্পষ্ট ও জোরালো মত ব্যক্ত করতে থাকেন। তাঁর এই মানসিকতা তাঁর নিজের কাজের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৫১ সালে এবং এর অব্যবহিত পরে আঁকা তাঁর ছবিতে একটি অসাধারণ আঙ্গিকের পরিচয় পাওয়া যায়। এই আঙ্গিকের প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায়, জয়নুল গ্রাম বাংলার অতি সাধারণ প্রাত্যহিক অথচ অত্যন্ত প্রতীকী গুরুত্বসম্পন্ন দৃশ্যাবলি এঁকেছেন। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার সেই তুলির বলিষ্ঠতা ও সাবলীলতা আবার প্রাণ পেয়েছে এ সময়ের কাজে। অধিকাংশ কাজ জলরঙ বা সোয়াশে করা। ব্যবহৃত জলরঙের বৈশিষ্ট্য হালকা এবং অনুজ্জ্বল, তুলির টান এবং কম্পোজিশন বা স্পেস ব্যবহার অত্যন্ত প্রাচ্যধর্মী। অন্যদিকে বিষয় উপস্থাপনা ও ড্রইং পাশ্চাত্য-বাস্তবধর্মী। এভাবে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের এক অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে তাঁর শিল্পকর্মে।
তাঁর ‘ঝড়’ শীর্ষক ছবিটি এক অসাধারণ কাজ। এতে বাংলাদেশের কালবৈশাখীর আকস্মিকতা ও উদ্দামতা ধরা পড়েছে অতি চমত্কারভাবে। বিন্যাসের সংক্ষিপ্ততায় ছবিটি আকর্ষণীয়। একইভাবে আরেকটি সুন্দর জলরঙ ছবি ‘মই দেয়া’। তবে এই সিরিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্ভবত মাঝারি সাইজের একটি জলরঙ, যার শিরোনাম ‘বিদ্রোহী’। পরবর্তী সময়ে এটি একটি প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে। একটি অবাধ্য গাভী ষাড়ের মতো প্রচণ্ড শক্তিতে তার বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে যাচ্ছে। তুলির টানের শক্তি ও সাবলীলতা অসাধারণ। ক্ষিপ্রতার সাথে আঁকা হলেও ছবিতে বিভিন্ন অংশের সূক্ষ উপস্থাপনায় চরম মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে। পাকানো দড়ি কিংবা গরুটির পায়ের খুর, এসবের ডিটেলস লক্ষণীয়। এই আঙ্গিকে তিনি ছবি এঁকেছেন সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে। সুগঠিত সুন্দর সাঁওতাল নরনারীকে বিষয় করে চিত্তাকর্ষক ছবিও এঁকেছেন তিনি।
এর পরপরই ‘৫২-৫৩-তে জয়নুল গড়ে তোলেন এক চমত্কার নতুন ঢঙ, যাকে আধুনিক বাঙালি ঢঙ বলা চলে। এই ঢঙের কাজের সাথে যামিনী রায়ের ছবির ঢঙের সামঞ্জস্য দেখা যায়। জয়নুলের এই ঢঙের কাজে বাংলার লোকশিল্পের নানা মটিভ এবং রং বিন্যাসের প্রভাবও লক্ষণীয়। তাঁর এ সময়ের কাজগুলোকে রোমান্টিক মেজাজের বলে চিহ্নিত করা যায়। অধিকাংশ ছবি মহিলাদের জীবনযাপন নিয়ে, এসব ছবিতে পল্লী-রমণীগণ নদীর ঘাটে যাচ্ছে জল আনতে বা স্নান করতে। অনাবিল প্রশান্তিতে প্রসাধানে নিযুক্ত, একক, যুগল কিংবা ত্রয়ী মহিলার চিত্র। মা ও শিশুও রয়েছে। গ্রামীণ কর্মী পুরুষের জীবনও ধরা পড়েছে এই সময়কার কাজে। একটি গোটা সিরিজ গড়ে উঠেছে এসব ছবি নিয়ে। এগুলোর মধ্যে কিছু স্মরণীয় কাজ হলো ‘নৌকোর গুণটানা’, ‘পল্লী-রমণী’, ‘আয়না নিয়ে বধূ’, ‘একাকী বনে’, ‘পাইন্যার মা’, ‘মা ও শিশু’, ‘তিন পল্লী রমণী’, ‘মুখ চতুষ্টয়’ ইত্যাদি।
১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াস্থ ‘কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটি’র সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
জয়নুল আবেদিন ছিলেন মুক্তিকামী মানুষ। স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্যে যাঁরা সংগ্রাম করেন তাঁদের সবার সাথেই একাত্মতা জানাতে উত্সাহী ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে যখন তাঁর বয়স প্রায় ৫৬, তিনি আরব লীগের আমন্ত্রণে ছুটে যান মধ্যপ্রাচ্যের সমর ক্ষেত্রে। আল-ফাতাহ গেরিলাদের সাথে চলে যান যুদ্ধফ্রন্টে। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকেন, তাঁর সেসব ছবির প্রদর্শনী হয় একাধিক আরব দেশে। মুক্তিযোদ্ধারা তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
সেখান থেকে দেশে ফিরতে না ফিরতে এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় আঘাত হানে জয়নুলের নিজের দেশের উপকূলীয় এলাকায়। তিন লক্ষাধিক মানুষ এই ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারায়। প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা খান জয়নুল আবেদিন। কিন্তু বসে না থেকে একটি রিলিফ টিমের সাথে ছুটে যান দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায়। দুঃখী জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। পরে তিনি সেখানকার মর্মস্পর্শী দৃশ্যাবলির কিছু কিছু তুলে ধরেন তাঁর তুলিতে, কালিতে।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সেরে উঠতে না উঠতেই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। নিজ দেশে বন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন জয়নুল। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালেন কিন্তু সর্বক্ষণই তাঁর দুর্ভিক্ষের সময় আঁকা চিত্রমালা আঁকড়ে ধরে রাখলেন। মুক্তিযুদ্ধ জয়নুলের মনে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিজয় অর্জনের পর পরই তিনি পূর্ণোদ্যমে লেগে যান শিল্পচর্চা সংগঠনের কাজে। এবারে লোকশিল্প তাঁর কাছে প্রাধান্য পেতে থাকে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের সরকার জয়নুল আবেদিনকে দায়িত্ব দেন বাংলাদেশের সংবিধানটির অঙ্গসজ্জার জন্যে। তিনি প্রবল উত্সাহের সাথে কাজটি সমাধা করেন। তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করেন আরো কয়েকজন শিল্পী। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক সংকট তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। তাঁর কর্মচাঞ্চল্যে কিছুটা ভাটা পড়তে থাকে। তাঁর মন খারাপ হতে থাকে। সুপুরুষ স্বাস্থ্যবান দীর্ঘদেহী জয়নুলের স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে। তিনি যেন বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি ছুটলেন তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন ‘লোকশিল্প জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার কাজে। জয়নুল আবেদিনের ঐকান্তিক প্রচেস্টায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প জাদুঘর স্থাপিত হয়। তাঁর ইচ্ছে ছিল এই জাদুঘরে সংরক্ষিত হবে দেশের মূল্যবান লোকশিল্প, ভবিষ্যত্ প্রজন্ম এখান থেকেই নতুন প্রেরণা পাবে।
জয়নুল তাঁর নিজের ছবি সংগ্রহের জন্য একটি সংগ্রহশালা নির্মাণের পরিকল্পনা করেন এবং এই সংগ্রহশালাটির জন্য স্থান নির্বাচন করেন ময়মনসিংহে তাঁর অতি প্রিয় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের একটি পুরাতন ভবনে। ১৯৭৫ সালে ময়মনসিংহে জয়নুল আবেদিন এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানকার নৈসর্গিক পরিবেশই গড়ে তুলেছিল তাঁর শিল্প মানস, এখানকার জেলা বোর্ডই কলকাতায় তাঁর শিল্পকলা শিক্ষাকালের প্রথম পর্যায়ের অতি জরুরি বৃত্তিটি দিয়ে তাঁকে উত্সাহিত করেছিল। তাঁর মা নিজের গলার হার বিক্রি করে সেই দূরের অচেনা শহর কলকাতায় ছেলেকে আর্ট স্কুলে পড়তে যেতে সাহায্য করেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন ময়মনসিংহে কর্মরত ছোট দারোগা। অনেক কষ্টে তিনি ছেলের জন্যে মাসে মাত্র দশটি টাকা পাঠাতে পারতেন। সেই তিরিশের দশকেও এটা খুব সামান্য পরিমাণ টাকাই ছিল। তখন ময়মনসিংহ জেলা বোর্ড আর্থিক সাহায্য না করলে প্রায় অসম্ভব হতো জয়নুলের শিল্প-শিক্ষা গ্রহণ। কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল দে-র জোর সুপারিশে কাজ হয়েছিল। জেলা বোর্ড জয়নুলকে মাসিক পনেরো টাকা করে বৃত্তি অনুমোদন করেছিল। এতে করে আর্ট স্কুলের জীবনটা তাঁর কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছিল।
জয়নুল আবেদিন তাঁর এসব ঋণের কথা ভোলেননি কখনও। তিনি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তখন থেকেই তিনি পত্র-পত্রিকার অঙ্গসজ্জা করে যে সামান্য আয় করতেন তা দিয়েই তাঁর পিতার অস্বচ্ছল পরিবারে আর্থিক অবদান রেখেছেন। তাঁর মাকে দিয়েছেন ভালোবাসা। তাঁর জন্মস্থান ময়মনসিংহকে উপহার দিয়েছেন একটি আর্ট গ্যালারি আর বাংলাদেশের জনগণকে দিয়েছেন তাঁর সারা জীবনের শিল্পকর্মের বৃহত্ সম্ভার। এসবের মধ্যে মহামূল্যবান দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার অধিকাংশ স্কেচও রয়েছে। তাঁর এই শিল্পসম্ভার বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জয়নুল গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে।
১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জয়নুল আবেদিন তিন পুত্রের জনক। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইফুল আবেদিন (টুটুল) স্থপতি। দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন (টুকুন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে এম.এ এবং কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন (মিতু) প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি-সম্পদ প্রকৌশল বিদ্যায় স্নাতক।
তাঁর অসাধারণ শিল্প-প্রতিভা এবং তাঁর মহত্ মানবিক গুণাবলির জন্যে তিনি দেশে ও বিদেশে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, সরকার এবং জনগণের কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মান। রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশে চারুকলার উন্নয়নে জয়নুল আবেদিন তাঁর অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘শিল্পাচার্য’ সম্বোধনে। এ শিরোপা তাঁকে উপহার দিয়েছে তাঁরই দেশের গুণমুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ জনগণ।
জয়নুল আবেদিনের জন্ম সাধারণ পরিবারে। তিনি জীবনযাপনও করেছেন সাধারণ বাঙালির মতোই। সরল কিন্তু আত্মবিশ্বাসী জয়নুল সমাজের শক্তিধর ব্যক্তিত্ব এবং দরিদ্র চাষী সবার সাথেই অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে মেলামেশা করতে পারতেন। তাঁরাও তাঁকে আপন মানুষ মনে করতেন। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ মজলিশি মানুষ, অক্লান্ত আড্ডা দিতে পারতেন। ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতার টান ছিল তাঁর ভাষায়। তিনি ছিলেন যেমন আমুদে, তেমনি রসিক। তিনি ভালোবাসতেন শিশুদের, ভালোবাসতেন ভালো খাবার, বিশেষ করে গ্রামবাংলার খাবার। তিনি ছিলেন চা প্রেমিক এবং ধূমপানে আসক্ত। নিরবচ্ছিন্নভাবে সিগারেট খেতেন। এই অভ্যাসই হয়তো শেষে তাঁর কাল হয়েছিল। তিনি প্রকৃতির সবকিছুই ভালোবাসতেন, শুধু কাক পছন্দ করতেন না। অথচ কাকের ছবিই বার বার তাঁর হাতের তুলির পরশে কী জীবন্ত রূপ পেয়েছে। তাঁর কাছে কাক ছিল সুযোগ সন্ধানী চালাকদের প্রতীক। দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে তিনি মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি আঁকার কাজ অব্যাহত রাখেন। তাঁর মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে হাসপাতালে শুয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব ঢঙে শেষ ছবিটি আঁকেন- দুটো মুখ। বলিষ্ঠ মোটা রেখায়, কালো কালি আর মোম ব্যবহার করে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯শে ডিসেম্বর বর্তমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। (সরকারি নথিপত্রে তাঁর জন্ম তারিখ অবশ্য ১৮ই নভেম্বর, ১৯১৪)।
বাবা-মা: বাবার নাম তমিজউদ্দিন আহমেদ এবং মা জয়নাবুন্নেছা। বাবা ছিলেন পুলিশের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর। জয়নুল আবেদিন ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র।
পড়াশুনা: মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে সেই দূরের শহর কলকাতায় গিয়েছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস দেখার জন্য। সেখান থেকে ঘুরে আসার পর সাধারণ পড়াশুনায় মন বসাতে পারছিলেন না কোনভাবেই। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের সাধারণ পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস-এ ভর্তি হন। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি কলাকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টসের ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন: ১৯৩৮ সালে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পান। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তারপর জয়নুল পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর চাকরিটি ছেড়ে ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত নর্মাল স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর শিল্পী হিসেবে খ্যাতি, অসাধারণ সাংগঠনিক মেধা, তত্কালীন শিল্পী সহকর্মী ও বন্ধুদের সহযোগিতা এবং কতিপয় বাঙালি সরকারি কর্মকর্তার সাহায্য ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়েই সম্ভব হয়েছিল ১৯৪৮ সালে এদেশের প্রথম আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা। তখন এর নাম ছিল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস। এই ইনস্টিটিউটকে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষরূপে। মাত্র দু’কামরার সেই ইনস্টিটিউটটিকে ১৯৫৬ সালের মধ্যেই তিনি এক অতি চমত্কার আধুনিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন। পরবর্তীকালে এটি পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় এবং স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। (আরো পরে মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয় এবং এর বর্তমান পরিচয় চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে)।
১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াস্থ কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
বিয়ে ও ছেলেমেয়ে:১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জয়নুল আবেদিন তিন পুত্রের জনক। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইফুল আবেদিন (টুটুল), দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন (টুকুন) এবং কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন (মিতু)।
মৃত্যু: দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে তিনি মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি আঁকার কাজ অব্যাহত রাখেন। তাঁর মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে হাসপাতালে শুয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব ঢঙে শেষ ছবিটি আঁকেন- দুটো মুখ। বলিষ্ঠ মোটা রেখায়, কালো কালি আর মোম ব্যবহার করে।
তথ্য ও ছবি সূত্র – আর্ট অব বাংলাদেশ সিরিজ; জয়নুল আবেদিন, প্রকাশ-১৯৯৭-জুন। লেখক-নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
লেখক : গুণীজন দল