কামরুল হাসান যখন কলকাতা মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন তখন পড়ালেখার চাইতে ছবি আঁকায় মেতে থাকতেন বেশি। সে মাতামাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে পরীক্ষা দিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পরিবর্তে আর্ট স্কুলে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিলেন। পাস করে, ভর্তির ফরম নিয়ে সোজা তাঁর বাবার কাছে এসে বিনীতভাবে দাঁড়ালেন। ভুরু কুঁচকে তাঁর দিকে তাকালেন বাবা। কামরুল হাসান বাবাকে বললেন, ‘আগামীকাল আপনাকে আর্ট স্কুলে গিয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের সাথে দেখা করতে হবে এবং কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে একটি পরিচয় পত্রও নিয়ে যেতে হবে।’ তাঁর ভাবসাব দেখে বাবা হয়তো বুঝেছিলেন কোনরকম কড়া টান দিলেই ঘুড়ি কেটে যাবে। তাই ঢিলে দিলেন। পরিচয়পত্রের জন্যে নিয়ে গেলেন খান বাহাদুর ওয়ালিউল ইসলাম সাহেবের কাছে। তিনি খুব স্নেহভরে তাঁর ড্রইং খাতার ওপর চোখ বুলিয়ে তাঁর নিজস্ব প্যাডে কয়েক লাইন লিখে দিলেন। ওয়ালিউল ইসলাম সাহবের উৎসাহদানে, কেবল তিনিই নন তাঁর বাবাও উৎসাহিত হলেন। আর এভাবেই ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে কামরুল হাসান কলকাতার ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস’-এ ভর্তি হন।
আর্ট স্কুলে পড়ার যাবতীয় খরচ কামরুল হাসানকেই বহন করতে হয়েছে। এজন্য তাঁকে কঠোর পরিশ্রমও করতে হয়েছে। কারণ কামরুল হাসানের বাবা ধার্মিক ব্যক্তি হওয়ায় পুত্রের শিল্পকলা চর্চার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু কামরুল হাসানের প্রবল আগ্রহের কারণে তিনি তাঁকে আর্ট স্কুলে পড়ার সম্মতি দেন এই শর্তে যে, তাঁর পড়াশুনার যাবতীয় খরচ তাঁর নিজেকেই বহন করতে হবে। তবে পুত্রের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল। এছাড়া শিল্পকলা সম্পর্কে কামরুল হাসানের পরিবারের এই দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরবর্তীকালে কিছুটা পরিবর্তন আসে। বিশেষত মন্বন্তরের সময় (১৩৫০/১৯৪৩) গেজেট পত্রিকায় প্রকাশিত জয়নুল আবেদিনের স্কেচ দেখে তাঁর বাবা শিল্পকলার প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে কামরুল হাসানকে কবরের নকশা আঁকার কাজ দিয়ে তাঁর বাবা তাঁকে কিছু আয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে নিয়মিত আয়ের নিশ্চয়তা ছিল না। নিয়মিত উপার্জনের জন্য কামরুল হাসান এক পুতুল তৈরির কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন। সেখানে সেলুলয়েডের পুতুলের চোখ আঁকতে হতো তাঁকে। প্রখর আলোয় ওই চোখ আঁকতে গিয়ে কামরুল হাসানের নিজেরই দৃষ্টিশক্তি খানিকটা ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। এই অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীকালে তিনি ‘চক্ষুদান’ নামে একটি গল্পও লিখেছিলেন। এসব কাজের জন্য তাঁর ঘরে ফিরতে অনেক রাত হতো। তবে রাত যতই হোক তাঁর বাবা জেগে থাকতেন এবং নিজেই দরজা খুলে দিতেন।
অর্থ উপার্জনসহ নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে আর্ট স্কুলে ছ’বছরের কোর্স শেষ করতে কামরুল হাসানের ন’বছর লেগেছিল। আর্থিক সমস্যা ও পারিবারিক চাপে তাঁকে ভর্তি হতে হয়েছিল ড্রাফটসম্যানশিপ বিভাগে। কারণ ওই বিভাগ থেকে পাস করে বেরুলে চাকরি পাওয়া সহজ ছিল। ড্রাফটসম্যানশিপ বিভাগটি ছিল এমন একটা বিভাগ যে বিভাগে ফাইন আর্টসের ছেলেরা গিয়ে স্ট্যাণ্ড করে। আর তিনি সেখানে গিয়ে করলেন ফেল। ড্রাফটসম্যানশিপ বিভাগ থেকে পরে অবশ্য তাঁকে ভর্তি করে নেয়া হয়েছিল চারুকলা বিভাগে এবং চারুকলা বিভাগ থেকেই ১৯৪৭ সালে তিনি ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
এভাবে মাদ্রাসার শিক্ষাঙ্গন থেকে জোর করে বেরিয়ে এসে নিজ খরচে কঠোর পরিশ্রম করে শিল্পশিক্ষা শেষ করা শিল্পী কামরুল হাসান বিখ্যাত নানা স্কেচ এঁকে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা চর্চার সূচনা ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন । তিনি শুধু শিল্পচর্চা বা শিল্পকলার শিক্ষকতায়ই জড়িত ছিলেন না, এদেশের প্রতিটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কর্মযজ্ঞেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। লোকশিল্পের বিকাশেও তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর জীবন ছিল যেমন বৈচিত্রময় তেমনি বহু বর্ণিল ঘটনারাগে রঞ্জিত। সত্য উচ্চারণে তিনি সবসময়ই ছিলেন সাহসী।
কামারুল হাসান ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর বর্ধমান জেলার (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যাধীন) কালনা থানার নারেঙ্গা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম এ.এস.এম. কামরুল হাসান অর্থাৎ আবু শরাফ (শার্ফ) মোহাম্মদ কামরুল হাসান। তাঁর ডাকনাম ছিল সাতন। কামরুল হাসানের জন্মের আগে তাঁর মার পরপর কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু হলে তখনকার সংস্কার অনুযায়ী তাঁকে সাতকড়ির বিনিময়ে কেনা হয় বলে তাঁর নাম হয় সাতকড়ি; সংক্ষেপে সাতন। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ হাশিম ও মার নাম মোসাম্মৎ আলিয়া খাতুন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর (১৯৩৬) পর তাঁর বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। কামরুল হাসানের এ মায়ের নাম মালিহা খাতুন।
১৯৩০ সালে কলকাতার তালতলাস্থ ইউরোপীয়ন এসাইলাম লেনে অবস্থিত মডেল এম.ই. স্কুলের ইনফ্যান্ট ক্লাস থেকেই কামরুল হাসানের বিদ্যাশিক্ষার শুরু হয়। এই মডেল স্কুলগুলির পরিকল্পনা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্যবয়সে কয়েকদিনের জন্য এ স্কুলে পড়েছেন। এ স্কুলে কামরুল হাসান ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এরপর কামরুল হাসান ১৯৩৭ সালে বাবার আগ্রহে কলকাতা মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়ার সময় তিনি প্রচুর ছবি আঁকতেন। তাঁর তিনরঙা একটি ছবি মাদ্রাসার বার্ষিক ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। এরপর ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে কামরুল হাসান কলকাতার ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস’-এ ভর্তি হন এবং চারুকলা বিভাগ থেকেই ১৯৪৭ সালে তিনি ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
কামরুল হাসান ১৯৫৯ সালে মরিয়ম বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মরিয়ম বেগম বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগমের বোন। বিয়ের অনেক আগে থেকেই দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কামরুল হাসানের একমাত্র সন্তানের নাম সুমনা হাসান।
১৯৩৫ সাল থেকে তিনি নিয়মিত ব্যায়াম চর্চা শুরু করেন। অগ্রজ আবুল হাসানাতকে দেখে তিনি এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হন। কামরুল হাসান ১৯৪৫ সালে ইন্টার কলেজ বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় ‘বি’ গ্রুপে প্রথম স্থান অধিকার করেন ।
১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে বোমা আতঙ্কে কলকাতা শহর থেকে লোকজন ব্যাপকভাবে গ্রামমুখি হয়। স্কুল-কলেজ ও অফিস বন্ধ হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে সৃষ্টি হয় এ. আর. পি. (এয়ার রেইড প্রিকশন)। কলকাতা শহরে জাপানি বোমা হামলার বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সতর্ক করা এবং তাদের আত্মরক্ষার সাহায্যার্থে সরকার এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। সরকারের আবেদনে অনেকেই এ.আর.পি.-র কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন এবং এই কর্মীদের ভিড়ে শিল্পগুরু কামরুল হাসানও ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কামরুল হাসান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’-এ যোগ দেন। সুভাষচন্দ্র বসুর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েই তিনি এই দলের সঙ্গে যুক্ত হন। শুরু হয় ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকেন। জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষ বিষয়ক চিত্রমালাই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করে। এসব চিত্র কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘Peoples war‘ এবং ‘জনযুদ্ধ’-এ ছাপা হয়। কলকাতার কমিউনিস্ট পার্টি দুর্ভিক্ষ নিয়ে আঁকা চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। কামরুল হাসানের চিত্রও এই প্রদর্শনীতে ছিল। ‘মণিমেলা’ ও ‘মুকুল ফৌজ’ এই দুই শিশুকিশোর সংগঠনের সঙ্গে কামরুল হাসান ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ‘মুকুল ফৌজ’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। কামরুল হাসানের সাংগঠনিক দক্ষতায় মুকুল ফৌজের কার্যক্রম দ্রুত প্রসার লাভ করে।
১৯৪৬ সালের শেষ দিকে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে মুসলিম আর্ট এক্সিবিশন অনুষ্ঠিত হয়। তখন কামরুল হাসান আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। শুধু মুসলমান শিল্পীদের চিত্র প্রদর্শিত হয় এ প্রদর্শনীতে। কামরুল হাসানও এতে অংশগ্রহণ করেন। কলকাতা আর্ট স্কুলে পড়ার সময়ই কামরুল হাসান অলংকরণ ও সৌন্দর্য বর্ধনসূত্রে পত্র-পত্রিকার জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। এছাড়া সীমিত আকারে হলেও পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। কামরুল হাসান ১৯৪২ সালে কবি হাবীবুর রহমানের সঙ্গে একত্রে ‘আবীর’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা বের করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে কাজী আফসারউদ্দীন সম্পাদিত দ্বিমাসিক পত্রিকা ‘মৃত্তিকা’র প্রচ্ছদ ছিল তাঁরই আঁকা। এছাড়া ছিল সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় কামরুল হাসান নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন ‘ভীমরুল’ ছদ্মনামে। সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’ ছাড়া কামরুল হাসান ‘আলোড়ন’ পত্রিকায়ও নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন।
১৯৬০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি শিল্প প্রদির্শনীতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় কামরুল হাসানের একটি একক শিল্পকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডি সোসাইটি অফ কনটেমপোরারি আর্ট গ্যালারিতে তাঁর একটি একক শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিল্পী কামরুল হাসানের বেশ কয়েকটি একক শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া যৌথ প্রদর্শনীতে তাঁর অংশগ্রহণ অব্যাহত থাকে। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে শিল্পকলা একাডেমীতে কামরুল হাসানের একটি একক শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রদর্শনীটি ছিল নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তাঁর আঁকা ১৫৬টি শিল্পকর্ম।
১৯৪৭ সালের শুরুর দিকেই কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হকসহ আরও অনেকে ঢাকায় এসে একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করছিলেন। কামরুল হাসান তখনও ছাত্র। কিন্তু শিক্ষকদের এসব আলোচনা-পরিকল্পনার কথা তিনি জানতেন। তাঁদের সঙ্গে কামরুল হাসানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং আর্ট স্কুলের বাইরে নানা কাজে তিনি তাঁদের সঙ্গী ছিলেন। ফলে কামরুল হাসানও এসব আলোচনা পরিকল্পনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সবার সহযোগিতায় অবশেষে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস'( বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)। এই আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদেরকে যেমন আন্দোলন করতে হয়েছে তেমনি এই প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য পরিশ্রমও করতে হয়েছে।
তবে সে সময়কার পরিস্থিতি শিল্পকলা চর্চার অনুকূল ছিল না। পুরান ঢাকায় রক্ষণশীল সর্দারদের আধিপত্য ছিল প্রবল। এদের কারণে গোঁড়া মৌলভী ও পীর নামধারী কিছু ধর্মব্যবসায়ী ফতোয়া দেবার অবাধ অধিকার লাভ করেছিল। লালবাগের এমন এক ধর্মব্যবসায়ীর ঘাঁটি থেকে কেবল ছবি আঁকার বিরুদ্ধে ফতোয়াই দেওয়া হয়নি, রাস্তায় রাস্তায় পোস্টারও সাঁটা হয়েছিল। শুধু চারুশিল্প নয়, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায়ও তখন বাধা আসত এসব মহল থেকে। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীতের আসর বসলে হামলার আশংকায় বাইরে তরুণদের পাহারা বসাতে হতো। এ ধরনের পরিবেশে ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। উগ্র মুসলমানদের হাত থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে বাঁচানোর জন্য কামরুল হাসান স্থানীয় যুবকদের নিয়ে ওয়ারি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছিলেন। এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই ১৯৫০ সালে এখানকার শিল্পীরা আর্ট ইনস্টিটিউটের বাইরে শিল্প আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’। জয়নুল আবেদিন এই গ্রুপের সভাপতি এবং কামরুল হাসান সম্পাদক নির্বাচিত হন।
‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস'( বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) -এ কামরুল হাসান এগারো বছরেরও বেশি সময় শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস'( বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) -এ শিক্ষকতায় নিয়োজিত থেকেও কামরুল হাসান এ দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধই তাঁকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বরাবর সক্রিয় রাখে। ১৯৫২ সালে এদেশে প্রথম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে আর্টস ইনস্টিটিউটের ছাত্র আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, ইমদাদ হোসেন, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ সক্রিয় ছিলেন। লেখা হতো বিভিন্ন স্লোগান ও দাবি সম্বলিত ব্যানার। ছাত্র-শিল্পীদের সঙ্গে কামরুল হাসানও সেদিন এসব কাজে সক্রিয় ছিলেন।
আর্ট ইনস্টিটিউটে চাকরিরত অবস্থায় ১৯৫৭ সালের শেষ দিকে কামরুল হাসান বার্মা সফর করেন। ইউনেস্কোর উদ্যোগে নবশিক্ষিতদের জন্য পুস্তক প্রকাশনার ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য তিনি রেঙ্গুন যান। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে কলম্বো পরিকল্পনার আওতায় তিনি জাপান সফর করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের একটি সাংস্কৃতিক দল সে সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করে। শিল্পী কামরুল হাসান এই দলের নেতৃত্ব দেন। এছাড়া তিনি আরও বিভিন্ন দেশ সফর করেন।
এরপর ১৯৬০ সালের ১৬ মার্চ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার ডিজাইন সেন্টারে চিফ ডিজাইনার হিসেবে তিনি যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধে কামরুল হাসান সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শিল্পী হিসেবে এ পর্যায়ে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে- বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্তনকশা অঙ্কন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের যে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল সেই পতাকার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় পতাকার রূপ দেন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি প্রতীকেরও ডিজাইন করেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতীক অঙ্কন। বাংলাদেশের সংবিধানের কভার ডিজাইনেরও রূপকার তিনি।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে কামরুল হাসান তাঁর চাকুরিস্থল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে (বিসিক) বাংলার লোকশিল্প ও কারুশিল্প বিকাশের ব্যাপারে পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে প্রয়াসী হন। জামদানি শাড়ির উন্নয়ন ও বিকাশেও তিনি বিপুল অবদান রাখেন। জামদানি শাড়ির বহুবিধ ব্যবহারের ধারণাটিও তাঁরই সৃষ্টি। ঢাকা শহরে বৈশাখী মেলা আয়োজনেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন কামরুল হাসান। বাঙালিত্বের চেতনা প্রসারের লক্ষ্যেই কামরুল হাসান ঢাকায় বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেন।
১৯৭০ সালের নভেম্বরে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে শিল্পী কামরুল হাসান অসহায় মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর সর্বত্র প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ঢাকায় হাতিরপুল এলাকায় প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান হন শিল্পী কামরুল হাসান ।
১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি সম্বলিত পোস্টার এঁকে কামরুল হাসান বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। এখানে কামরুল হাসানের নেতৃত্বে কাজ করেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, জহির আহমদ প্রমুখ। এই শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রচনা করেন একাধিক পোস্টার। এসব পোস্টারের মাধ্যমে পাকবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে যেমন তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনে দেশের জন্য যুদ্ধের উৎসাহ ও উদ্দীপনাও সৃষ্টি হয়। এসব পোস্টারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি বিষয়ক কার্টুন সম্বলিত পোস্টারটি। পোস্টারটির ভাষা ছিল এইরূপ : (বাংলায়) এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই পোস্টারটি যেন সম্পৃক্ত হয়ে আছে।
কামরুল হাসান জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক ছিলেন, ছিলেন দেশাত্মবোধে পুরোপুরিভাবে উদ্বুদ্ধ। এ কারণে প্রগতিশীল সকল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। সকল প্রকার ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি সোচ্চার ছিলেন। স্বৈরতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। মানবকল্যাণই ছিল তাঁর আদর্শ।
১৯৬৫ সালে কামরুল হাসান প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (তমঘা-ই-পাকিস্তান) লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে কুমিল্লা ফাউন্ডেশন শিল্পী কামরুল হাসানকে তাঁর শিল্পকর্মের জন্য স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৭৯ সালে তিনি লাভ করেন ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’। ১৯৮৪ সালে কামরুল হাসান ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মান’ লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে কামরুল হাসান কাজী মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার লাভ করেন। ওই বছরই তাঁর বিখ্যাত তৈলচিত্র ‘তিনকন্যা’ অবলম্বনে একটি সুদৃশ্য ডাকটিকেট প্রকাশ করে তৎকালীন যুগোশ্লাভ সরকারের ডাক, তার ও টেলিফোন বিভাগ (২ ডিসেম্বর ১৯৮৫)। কোনো বিদেশী সরকার কর্তৃক বাংলাদেশি কোনো শিল্পীর শিল্পকর্ম সম্বলিত ডাকটিকেট প্রকাশের ঘটনা এটাই প্রথম। ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো মনোনীত হন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ তৃতীয় দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে কামরুল হাসানের ‘নাইওর’ চিত্রকর্মটি অবলম্বনে ৫ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে।
জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহের জন্য টিটোগ্রাদে স্থাপিত চিত্রশালা, লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউট, জাপানের ফূকুওকা মিউজিয়াম, ঢাকার শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর এবং পৃথিবীর বহুদেশের শিল্পরসিকদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে কামরুল হাসানের চিত্রকলা সংরক্ষিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ রয়েছে ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে। দেড় হাজার শিল্পকর্ম রয়েছে এখানে।
১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সকালে শিল্পী কামরুল হাসান একটি কবিতা উৎসবে যোগ দেন। সারাদিন তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। বিকেলের স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে তিনি সভাপতিত্ব করছিলেন এবং বসে বসে কবিতা শুনছিলেন এবং হাতের কাছে যা পাচ্ছিলেন তাতেই এঁকে যাচ্ছিলেন কিছু একটা। এভাবেই কবি রবীন্দ্র গোপের ডায়রির পাতায় আঁকেন সেসময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সামরিক স্বৈরাচারকে নিয়ে কার্টুনচিত্র ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে। সেখানেই রাত নটার দিকে হৃদরোগের আক্রমণটি তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। এই হাসপাতালে রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ চত্বরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
একনজরে কামরুল হাসান
নাম: আবু শরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান।
পিতার নাম: মোহাম্মদ হাশিম।
মাতার নাম: মোসাম্মৎ আলিয়া খাতুন।
জন্মতারিখ: ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর।
জন্মস্থান: বর্ধমান জেলার (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যাধীন) কালনা থানার নারেঙ্গা গ্রামে ।
পরিবার পরিজন: কামরুল হাসান ১৯৫৯ সালে মরিয়ম বেগমকে বিয়ে করেন। মরিয়ম বেগমের মালিকানায় ১৫/২ সেন্ট্রাল রোডের বাসায় তাদের দাম্পত্য জীবনের দীর্ঘ সময় কাটে। কামরুল হাসানের একমাত্র সন্তানের নাম সুমনা হাসান।
আন্দোলন-সংগ্রাম:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কামরুল হাসান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’-এ যোগ দেন। ১৯৫০ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটের বাইরে শিল্প আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’। জয়নুল আবেদিন এই গ্রুপের সভাপতি এবং কামরুল হাসান সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোতে কামরুল হাসান ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’-এর সদস্য হিসেবে এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ঢাকা শহরে বৈশাখী মেলা আয়োজনেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে তিনি ছিলেন পুরোপুরিভাবে সক্রিয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের পর সর্বত্র প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ঢাকায় হাতিরপুল এলাকার প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান হন শিল্পী কামরুল হাসান ।
কর্মজীবন:
১৯৬০ সালের ১৬ মার্চ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার ডিজাইন সেন্টারে চিফ ডিজাইনার হিসেবে তিনি যোগদান করেন। গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) এ কামরুল হাসান এগারো বছরেরও অধিককাল শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন।
বিদেশ ভ্রমণ:
চিত্রকর্মের প্রদর্শনীতে যোগ দিতে অথবা আন্তর্জাতিক কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে কামরুল হাসান মায়ানমার, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন।
প্রদর্শনী:
১৯৬৪ সালে ঢাকায় কামরুল হাসানের একটি একক শিল্পকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডি সোসাইটি অফ কনটেমপোরারি আর্ট গ্যালারিতে তাঁর একটি একক শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিল্পী কামরুল হাসানের বেশ কয়েকটি একক শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে শিল্পকলা একাডেমীতে তার একটি একক শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রদর্শনীটি ছিল নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তাঁর আঁকা ১৫৬টি শিল্পকর্ম।
নকশা অঙ্কন:
তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ-বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা অঙ্কন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি প্রতীকেরও ডিজাইন করেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতীক অঙ্কন। বাংলাদেশের সংবিধানের কভার ডিজাইনেরও রূপকার তিনি।
পড়াশুনা:
১৯৩০ সালে কলকাতার এম.ই. স্কুলের ইনফ্যান্ট ক্লাস থেকেই কামরুল হাসানের বিদ্যাশিক্ষার শুরু। এ স্কুলে কামরুল হাসান ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করেন। পরে পিতার আগ্রহে তিনি কলকাতা মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস-এ ভর্তি হন। আর্ট স্কুলে পড়ার যাবতীয় খরচ কামরুল হাসানকেই সংগ্রহ করতে হয়েছে। এজন্য তাঁকে কঠোর পরিশ্রমও করতে হয়েছে। অর্থ উপার্জনসহ নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে আর্ট স্কুলে ছ’বছরের কোর্স শেষ করতে কামরুল হাসানের ন’বছর লেগেছিল। ড্রাফটর্সম্যানশিপ বিভাগ থেকে পরে ১৯৪৭ সালে তিনি ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
পুরস্কার:
১৯৬৫ সালে কামরুল হাসান প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (তমঘা-ই-পাকিস্তান) লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে কুমিল্লা ফাউন্ডেশন তাঁকে শিল্পকর্মের জন্য স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৭৯ সালে তিনি লাভ করেন ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’। এ বছরই কামরুল হাসান ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মান’ লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি কাজী মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো মনোনীত হন। এ ছাড়াও শরীরচর্চায় বিশেষ পারদর্শিতার কারণে ‘মিস্টার বেঙ্গল’ (১৯৪০ ও ১৯৪১) উপাধিও লাভ করেন তিনি।
মৃত্যু:১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়।
তথ্য ও ছবি সূত্র – কামরুল হাসান; জীবন ও কর্ম, লেখক- সৈয়দ আজিজুল হক। বাংলা একাডেমি ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত। প্রকাশ কাল – ১৯৯৮, জুন।
লেখক : গুণীজন দল