বিসিকে কাজ করার সময় প্রধান নকশাবিদ হিসেবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মেলাকে শহরে ছড়িয়ে দিতে ইমদাদ হোসেন উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় সেসময় সারা দেশে বৈশাখী মেলা, বসন্ত মেলা এবং যশোরে মধু মেলা আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে যে ব্যাপকভাবে মেলার প্রচলন ঘটেছে নিঃসন্দেহে এর পেছনে মূল প্রভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন ইমদাদ হোসেন।
এছাড়া দেশীয় পোষাক ও তাঁতশিল্পকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। এর উন্নতির জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এ খাতে মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাত থেকে যেন গরিব তাঁতিরা বাঁচতে পারে সেজন্য তিনি বিসিকের উদ্যোগে বেশ কয়েকবার মেলার আয়োজন করেন। সেখানে বিভিন্ন স্টলের মাধ্যমে তাঁত বস্ত্রের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন। যেখান থেকে গ্রাহকরা সরাসরি তাঁতীদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করত। এভাবে বস্ত্রশিল্পের প্রচার ও প্রসারের পাশাপাশি তাঁতশিল্প সংশ্লিষ্ট মানুষদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
তিনি মেলা উপলক্ষে গ্রাম-গঞ্জের ক্ষয়িঞ্চু মৃৎশিল্প, পাটশিল্প সহ বিভিন্ন কারু ও হস্তশিল্পের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন যা আজ নিজ দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্ববাজারে স্থান করে নিয়েছে। এসবই শিল্পী ইমদাদ হোসেনের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফসল।
ইমদাদ হোসেনের জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ নভেম্বর চাঁদপুরে। তাঁর বাবার নাম মজিদ বক্স (ধনু মিয়া)। তিনি ছিলেন চাকুরিজীবী। চাঁদপুরে ‘চিটাগাং জুট মিল’-এ কাজ করতেন। মা সাবেদুন নেসা ছিলেন গৃহিনী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে ইমদাদ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ইমদাদ হোসেনের বাবা ও ভাই-বোন সবারই আঁকার হাত ছিল চমৎকার। পরিবারটি ছিল শিল্পরসিক।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে চারদিকে প্রচন্ড অভাব-অনটন শুরু হয়ে যায়। ইমদাদের বাবাও আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হন। ইমদাদ হোসেন তখন পরিবারের কথা বিবেচনা করে কিছুদিন পাটকলে মেকানিক্যাল ওয়ার্কসপ-এ চাকুরি করেন। কিছুদিন সেখানে কাজ করার পর আরো একটু বেশি উপার্জনের আশায় ১৯৪৪ সালে তিনি কাশিপুর গান ও শেল ফ্যাক্টরিতে আর্টিসান হিসেবে চাকুরি নেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে দেশের পরিস্থিতি একটু স্থিতিশীল হলে তিনি আবার পড়াশুনায় ফিরে আসার চেষ্টা করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা আর্ট ইন্সটিটিউটে ভর্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর আবেদন পত্র নিদিষ্ট সময়ে পৌঁছেনি বলে তিনি সেবছর ভর্তি হতে পারেননি। বন্ধু কামরুল হাসান তাঁকে পরবর্তী বছর পুনরায় আবেদন করার পরামর্শ দেন।
এই সময় তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। কিন্তু তখন হাতে কোনো কাজ না থাকায় কর্মচঞ্চল এই মানুষটি বসে না থেকে নিজ গ্রামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু করেন পাঠাগার আন্দোলন। এলাকার তরুণদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য তিনি পরিশ্রম করতে থাকেন। ছাত্রদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাদেরকে পাঠাগারে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেন। একসময় তিনি এই আন্দোলনকে সফল করে তোলেন। সেসময় তিনি শিশু সংগঠন মুকুল ফৌজের সাথেও ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ জুড়ে শুরু হয় প্রচন্ড দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এসময় তিনি রেডিও মেকানিজম শেখার জন্য দিল্লী চলে যান। ইমদাদের মেজভাই তখন দিল্লীতে থাকতেন। ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার মধ্যেই তিনি ১২ আগষ্ট দিল্লী থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৪ আগষ্ট দেশ স্বাধীন হয়। তার দু’সপ্তাহ পর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথমদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দেশব্যাপী আনসার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এটি এখনকার আনসার বাহিনীর মতো ছিল না। ছিল স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের সংগঠন। ইমদাদ নিজে ছিলেন প্রচন্ড সাহসী। ফলে তিনি কেরাণীগঞ্জ আনসার বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি খুবই সফলভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় তাঁকে সরকার থেকে একটি বন্দুকও দেয়া হয়।
১৯৪৮ সালে ইমদাদ হোসেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত গভর্ণমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। প্রথম ব্যাচে ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র পনের জন। সেসময় তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রাহমান, শামসুল কাদির, মকসুদুস সালেহীন, খালেদ চৌধুরী, আবদুর রহমান ভূঁইয়া প্রমুখ। প্রথম থেকেই ইমদাদ হোসেন ক্লাসে প্রায়ই দেরী করে আসতেন এবং ধমক খেতেন আনোয়ার স্যারের হাতে। এর কারণ ছিল প্রতিদিনই তিনি কেরাণীগঞ্জের নিজ গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ক্লাসে আসতেন। কেরানীগঞ্জের দূরত্ব ছিল প্রায় সাত মাইল। দু’ঘন্টার উপরে সময় লাগত।
১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে যে ড্রয়িং ক্লাসগুলি হতো তাতে অধিকাংশ ছাত্রেরই প্রাণ ভরতো না। এর উপর প্রতিদিন এতো দূর থেকে যাওয়া-আসা ছিল কষ্টকর। ফলে ইমদাদ হোসেন একেবারেই ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিলেন। পরবর্তী বছর আগের অনেকের সঙ্গে তিনি আবার ভর্তি হলেন প্রথম বর্ষে। ফলে ইন্সটিটিউটে তিনি দুই ব্যাচেই বন্ধু পেয়েছিলেন। ততদিনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন করাচী থেকে এসে স্থায়ী অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তাঁকে পেয়ে ছাত্রদের মধ্যে প্রাণ ফিরে এল।
১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ইমদাদ হোসেন দাঙ্গা প্রতিরোধের জন্য গ্রাম থেকে বন্দুক সংগ্রহ করেছেন। এরপর তাঁদের গ্রামের হাটে সেইসব বন্দুকের প্রদর্শনী করেছেন। এই প্রদর্শনী দেখে দাঙ্গাকারীরা ভয় পেয়ে যায়। তিনি বলেছেন, ‘কেউ দাঙ্গার উসকানী দিলে রক্ষা নেই’। দাঙ্গায় সন্তান-স্বজন হারিয়ে প্রতিবেশি দেশ থেকে ফিরে এসে যাঁরা আহাজারী করে গ্রামবাসীদের কাছে দাঙ্গার বিভৎস বর্ণনা দিচ্ছিলেন, ইমদাদ হোসেন তাঁর দল-বল নিয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেন। বলেন, ‘আপনার আহাজারী বর্ণনা এখানেও অনেক সর্বনাস ডেকে আনতে পারে। আপনার বেদনায় আমরাও ব্যথিত। কিন্তু আর একটি অনাসৃষ্টি এখানে না হোক তার জন্যই একটু সাবধানতা। একটু ধৈর্য।’ এভাবেই তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার কারণে তখন কেরাণীগঞ্জে দাঙ্গা বিস্তৃত হতে পারেনি।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন-এর ভাষা বিতর্কিত উক্তিতে ছাত্রসমাজ উত্তাল হয়ে উঠে। এই সময়ই অগ্রণী শিল্পী সঙ্ঘের জন্ম হয়। ইমদাদ হোসেন ছিলেন এর অন্যতম গায়ক-সংগঠক। অবশ্য গ্রুপ হিসেবে অগ্রণীর অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। ১৯৫০ সালেই এটি তৈরি হয়। কিন্তু তখন নামকরণ করা হয়নি। ১৯৫২ সালের শেষ সপ্তাহে সঙ্ঘটি ‘অগ্রণী’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
অগ্রণী শিল্পী সঙ্ঘের সাথে সেসময় আরো যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন, অজয় রাও বর্মণ, আনন্দ পাল, আব্দুল করিম, বিশ্বনাথ রায় মল্লিক, বদরুল হাসান (কামরুল হাসানের ভাই), মন্টু খান, মাসুদ আলী খান, নাসিম আলী, আব্দুর রাজ্জাক, আবদার রশিদ ও আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনসহ আরও অনেকে। এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ঢাকায় ছাত্রদের প্রতিটি মিছিলের সম্মুখ সারিতে ছিলেন ইমদাদ হোসেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ইমদাদ হোসেন ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। তিনি আর্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সারা রাত তিনি সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়ে পোষ্টার-ব্যানার লেখার কাজ করেন। পরদিন যথারীতি তিনি সমাবেশে যোগ দেন।
১৯৫২ সালে ২২-২৪ আগষ্ট পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায়। এ অনুষ্ঠানে ইমদাদ হোসেনের নেতৃত্বে ঢাকা আর্ট গ্রুপ অংশগ্রহণ করে। সঙ্গী ছিলেন মুর্তজা বশির, বিজন চৌধুরী, সবুর প্রমুখ। অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে অগ্রণী শিল্পী সংঘ (এই সংগঠনটির তিনি অন্যতম প্রধান গায়ক ছিলেন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ, প্রান্তিক (চট্টগ্রাম), রেলওয়ে শিল্পী গোষ্ঠী (চট্টগ্রাম), মুসলিম সাহিত্য সংসদ (সিলেট), পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ ও অগত্যা উল্লেখযোগ্য।
পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ তখন নিজামুল হকের নেতৃত্বে সারাদেশে বছর জুড়ে অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছে। এর সাথেও ইমদাদ হোসেন যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৩ সাল থেকে ছাত্রাবস্থাতেই কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে নানান বইয়ের প্রচ্ছদ এবং অন্যান্য কাজ করে ইমদাদ হোসেন স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেন। আর আন্দোলন সংগ্রাম তো ছিলই। নিজের শত দুর্দিনেও তিনি কখনোই সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকতে পারেননি।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ইমদাদ হোসেন সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল কেরাণীগঞ্জ-ঢাকা ও সাভার এলাকায় নির্বাচনী প্রচার কাজ চালানো। এসময় তিনি অগ্রণী শিল্পী সঙ্ঘের মহড়া, আর্ট ইন্সটিটিউটে লেখাপড়া সব একসঙ্গে চালাতেন।
১৯৫৪ সালে ইমদাদ হোসেন আর্ট ইন্সটিটিউট থেকে পাস করেন। তারপরই কামরুল হাসান, ইমদাদ হোসেন, বিজন চৌধুরী, সরদার জয়েনউদ্দিন ও আবদুস সবুর মিলে VIBGYOR নামে একটি কমার্শিয়াল আর্ট ফার্ম গড়ে তোলেন। কিন্তু এক বছর পর তিনি সংগঠনটি ছেড়ে দেন।
১৯৫৪ সালের ২১ নভেম্বর ইমদাদ হোসেন তাঁরই মামাত বোন মনোয়ারা বেগম বকুলির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই মেয়ে ও চার ছেলে।
১৯৫৫ সালে কামরুল হাসান তাঁকে Silver Band H. Co. of Newyork নামে একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু চার মাস পর কোম্পানিটি ওঠে যাওয়ায় তিনি বেকার হয়ে পড়েন। এরপর তিনি Usic-এ চাকুরি নেন এবং ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এখানেই কাজ করেন।
১৯৬০ সালে EPSIC-এর তদারকিতে এবং ASIA Foundation-এর অর্থায়নে গঠিত East Pakistan Design Centre–এ চাকরি নেন। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। কাইয়ুম চৌধুরী ও ইমদাদ হোসেন হলেন ডিজাইনার। এবং সেখানে পাঁচজন ছিল এসিস্ট্যান্ট। এসময় ইমদাদ হোসেনEPSIC-এর মনোগ্রাম ডিজাইন করেন। এক বছরের মাথায় ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে দিয়ে তিনি USAID Communication & Media Centre-এ আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন।
১৯৬৩ সালে তিনি ইউএস এইড-এর কাজ ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এ (Institute Of Education Research) সিনিয়র লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৬৪ সালে তিনি সুইডিস-পাক ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার প্রজেক্টে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্রে চীফ ডিজাইনার হিসেবে যোগ দেন। টেলিভিশন কেন্দ্রটি ছিল তখন ডিআইটি ভবনে। এই সময়ই তিনি নাজিমত আরী, শুভ রহমান, সোলায়মান প্রমুখের সাথে মুক্তধারা নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন। বহুজন এর শেয়ার হোল্ডার ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তধারা নামটি কীভাবে যে পুঁথিঘরের মালিকের হাতে চলে যায় তা তিনি জানতে পারেননি।
১৯৬৯-এ উত্তাল গণজোয়ার। ইমদাদ তখন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্পূর্ণ নিয়োজিত। তিনি গড়ে তোলেন শিল্পীদের সর্বপ্রথম সংগঠন চারু শিল্পী সংস্থা । কামরুল হাসানকে এই সংগঠনের সভাপতি ও ইমদাদ হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এসময় বড় বড় Installation এর পোষ্টার এবং ব্যানার-এর প্রায় সব কটিতেই ছিল ইমদাদ হোসেনের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
১৯৭০ সালে তিনি শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে নিজ গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর পূর্ব পাকিস্তানের সকল প্রগতিশীল দল ও সংগঠন মহাসমারোহে পালন করে লেনিন জন্মশতবার্ষিকী। সকল অনুষ্ঠানে সকল প্রকার দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা ইমদাদ হোসেনের নেতৃত্বে শিল্পীরা সম্পন্ন করেন। এ সময় ইমদাদ হোসেন বহু নাটকের সেট ডিজাইনও নির্মাণ করেন। তার মধ্যে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ অন্যতম। ইমদাদ হোসেন টেলিভিশন অফিসার্স সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন অনেক দিন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিজবাড়ী কেরাণীগঞ্জ থেকে টেলিভিশনে এসে চাকরির ছলে নানা গুরুত্বপূর্ণ খবরা-খবর সংগ্রহ করতেন আর গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করতেন। বিভিন্ন স্থানে এমনকি নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আশ্রয় দিতেন, খাবারের ব্যবস্থা করতেন, খবরা-খবর সরবরাহ করতেন। মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে সহায়তা করতেন।
এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে ইমদাদ হোসেনর প্রাণের যোগ ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির আত্মগোপনকারী নেতারা তাঁর গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিতেন প্রায় সময়ই। নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সভা হত তাঁর বাড়িতে। তিনি বুক আগলে বামপন্থী নেতা-কর্মীদের রক্ষা করতেন, কখনো ঢাকার ভাড়া করা বাড়িতে আবার কখনো বা নিজের গ্রামের বাড়িতে। কমিউনিস্ট পার্টির গোপন ‘সেল’-এর বৈঠকে আমন্ত্রিত হতেন তিনি। পার্টিকে নিয়মিত চাঁদা দিতেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোনোদিনই পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। অথচ তাঁর কাজকর্ম দেখে অনেকেই মনে করতেন তিনি পার্টির সদস্য। যাঁরা জানতেন তাঁরা যখন তাঁকে পার্টির সদস্য হওয়ার কথা বলতেন তখন তিনি বলতেন, আমি তো আছিই। আনুষ্ঠানিকতার দরকার কী। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ধার ধারেননি শিল্পী ইমদাদ হোসেন। সে কারণেই বোধ হয় প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা জ্ঞান চক্রবর্ত্তীর কাছে তিনি ছিলেন ‘বুঝের কমরেড’।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তিনি আবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের বর্তমানে ব্যবহৃত লোগোটি ইমদাদ হোসেনের করা। আর এতে বাংলাদেশ টেলিভিশন লেখাটি মুস্তাফা মনোয়ারের।
১৯৭৪ সালে সারাদেশে জাঁকজমকের সাথে মহান একুশে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে সময় প্রথম শহীদ মিনারের পেছনে লাল সূর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন করে শহীদ মিনার বিনির্মাণ এবং স্থাপনের পূর্ণ কৃতিত্ব শিল্পী ইমদাদ হোসেন ও সহশিল্পীদের।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবুন্ধ হত্যাকান্ডের পর বহু সুবিধাবাদী মানুষের রূপ পাল্টে যায়। প্রচন্ড ব্যথাহত ইমদাদ হোসেন এতে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। ১৯৭৬-এ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিটিভির একজন কর্মকর্তা রসিকতা করলে ইমদাদ হোসেন তৎক্ষণাৎ ক্ষোভে-দুঃখে টেলিভিশনের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন। EPSIC ততদিনে BSIC হয়ে গেছে। ইমদাদ হোসেন পুনরায় BSIC-এর ডিজাইন সেন্টারে যোগ দেন। এবং এখান থেকেই ১৯৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর থেকে ইমদাদ হোসেন অনুজশিল্পী ফরিদ আহমদের প্রতিষ্ঠান ‘কালার স্ক্যান লিমিটেড’-এর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।
২০১০ সালে ইমদাদ হোসেনকে শিল্পকলায় একুশে পদক দেওয়া হয়।
২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর ৮৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: ‘জীবন শিল্পী ইমদাদ হোসেন’- ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ, ২১ নভেম্বর, ২০০৫; সাক্ষাৎকার-ইমরান হোসেন ও নাসিমা হোসেন (ইমদাদ হোসেনের ছেলে ও মেয়ে), জানুয়ারি, ২০১০
লেখক : চন্দন সাহা রায়