‘বাংলাদেশের যে কোন স্থানে এমনকি দেশের বাইরেও আমার ছাত্ররা আমাকে সম্মান জানায়। আমার তখন ভাল লাগে। তাঁরা আজও যেমন আমাকে ভালবাসার সাথে মনে রেখেছে তেমনি আমিও তাঁদের ভালবাসার সাথে স্মরণ করি। আমার অনেক ছাত্রই আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশিষ্ট অবস্থানে আছে, অর্থনীতিবিদ হিসেবেও অনেকে সুনাম অর্জন করেছে। একথা ভেবে একজন শিক্ষক হিসেবে অহংকারে আমার বুক ভরে যায়। ভাবতে গর্ব অনুভব করি যে, এঁরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র।’
কথাগুলি বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রখ্যাত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং তৈরি করেছেন এদেশের অর্থনীতির বহু দিকপাল আর উজ্জ্বল নক্ষত্রদের। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা এবং দারিদ্র্য জয়ের অসীম আশা নিয়ে তিনি সবসময় অসত্য এবং অসুন্দরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়েই রয়েছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। বাংলাদেশ তাঁর হৃদয়ে, তাঁর শরীরের প্রতিটি রক্তকণায়। তাঁর লেখনি বারবারই কথা বলেছে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পক্ষে। নিভৃতচারী সৌম্যদর্শন অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাঁর প্রতিটি লেখায় সত্যকে দৃপ্ত উচ্চারণে প্রকাশ করেছেন।
রেহমান সোবহান ১৯৩৫ সালের ১২ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কে. এফ. সোবহান ছিলেন পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা যিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর পাকিস্তানের প্রথম প্রজন্মের একজন যিনি ঢাকায় প্রথম দিককার ট্যানারী ফ্যাক্টরীগুলোর মধ্যে একটি ফ্যাক্টরী স্থাপন করেন। ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর মা হাসমত আরা বেগম। তাঁর সন্তানদের তিনি মানুষ করেছেন পরম স্নেহে ও মমতায়। তিনি শিখিয়েছেন সত্যিকারের মানুষ হতে, মানুষকে ভালবাসতে। রেহমান সোবহানের জীবনবোধ তাঁরই প্রতিচ্ছবি। যার ভিত্তিভূমি তৈরী হয়েছিল তাঁর পরিবারেই।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম.এ. করার আগে রেহমান সোবহান তাঁর ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেছেন দার্জিলিং-এর ঐতিহ্যবাহী সেন্ট পলস্ স্কুলে (১৯৪২-৫০) এবং লাহোরের অ্যাচিসন (Aitchison College) কলেজে (১৯৫১-৫২) । তিনি ১৯৫৬ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও তাঁর শিক্ষাজীবন বিস্তৃত হয়েছে অক্সফোর্ড ও হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পৃথিবী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে।
স্কুল জীবনে তিনি সব বিষয়েই পারদর্শী ছিলেন। পড়াশুনায় ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যেই থাকতেন সবসময়। খেলাধুলায়ও বেশ আগ্রহ ছিল। স্কুল জীবনের শেষদিকে তিনি ফুটবল, হকি, ক্রিকেট-অ্যাথলেটিকস্ আর বক্সিং টিমেও ছিলেন। তাঁর মামা স্কুলের বক্সিং টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন, এরও আগে আরেক বাঙালি পল রিচিভ এই টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তাঁদেরকে দেখেই তিনি বক্সিং খেলার প্রতি উৎসাহিত হন।
স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিন বছর তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। ক্যামব্রিজে এসেই তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ তৈরী হয় । ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে অপসারণ করলেও যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতা নিতে পারেনি। তাঁরা সবাই এর বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁরা প্রগতিশীল অংশের সদস্য হিসেবে মিলিটারি শাসকদের বিরোধী ছিলেন। ক্যামব্রিজে সেসময়ই তিনি অমর্ত্য সেন, মনমোহন সিং, মাহবুবুল হককে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন।
১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে দেশে ফিরে আসার পর রেহমান সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। কেমব্রিজে যখন তাঁর রেজাল্ট বের হলো তখন পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান তাঁকে একটি চাকরির প্রস্তাব দেন। বেতন হিসেবে ৮০০ টাকা দেবার প্রস্তাব করেন তিনি। সেইসময় টাকার বিষয়টি অগ্রাহ্য করা যেত না। তাছাড়া তখনো তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে চাকরির প্রস্তাব পাওয়ায় তাঁর খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু তিনি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধানকে লিখে জানান, ‘আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনি আমাকে একটা চাকরির প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু আমি স্থির করেছি আমি আমার জীবন বাংলাদেশেই কাটাব।’
তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বাইশ বছর। নতুন হওয়ার পরও তাঁকে এম.এ. ক্লাসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর প্রথম বর্ষের ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ইউনুস, ফখরুদ্দিন, মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি যেদিন প্রথম ক্লাস নেন সেদিন ঐ তিন জনই ক্লাসে ছিলেন। এরপর তাঁকে শেষবর্ষের ক্লাস নেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়। শেষবর্ষের ক্লাস নেবার জন্য প্রথম যেদিন তিনি ক্লাসে গেলেন সেদিন তাঁর সামনে যাঁরা বসেছিলেন তাঁদের অনেকেই বয়সে তাঁর বড় ছিলেন। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন রেহমান সোবহান।
অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণের পূর্বে তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদমর্যাদায়); শিল্প, বিদ্যুত্ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং অবকাঠামো বিভাগে (১৯৭২-৭৪) যথাক্রমে চেয়ারম্যান, গবেষণা পরিচালক, মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিআইডিএস- এ এমিরিটাস ফেলো হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও কুইন এলিজাবেথ হাউজে ১৯৭৬-৭৯ পর্যন্ত ভিজিটিং ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট এর এ্যাডভাইজরী কাউন্সিল (ক্যবিনেট মিনিস্টার এর পদমর্যাদায়), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (১৯৯১) সদস্য ছিলেন। তিনি সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি ষ্টাডিজ-এ (২০০১-২০০৫) নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯৯৪- ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি সিপিডির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রেহমান সোবহান পাকিস্তানের তৃতীয় (১৯৬৫) এবং চতুর্থ (১৯৭০) পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পর্যালোচনার জন্য প্যানেল ইকোনমিষ্টদের সদস্য; পাকিস্তান ইকোনমিক জার্নাল (১৯৬৩-৬৬) এর সম্পাদক এবং সাপ্তাহিক ফোরামের সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের ইকোনোমিক এ্যাফেয়ার্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ দূত; বাংলাদেশ জাতীয় অর্থ, ব্যাংকিং এবং ফাইনান্স (১৯৮৭) কমিশনের সদস্য; ইউ এন কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং এর সদস্য (১৯৮২-৮৬); ইউ এন ইউনিভার্সিটি, টোকিও এর (১৯৮৬-৯১) গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য; কমিশন ফর এ নিউ এশিয়া, কুয়ালালামপুর (১৯৯৪)-এর সদস্য; আন্তর্জাতিক ইকোনোমিক এসোসিয়েশন (১৯৯৪- ৯৯)-এর নির্বাহী কমিটির সদস্য; সার্ক এর ভবিষ্যত পর্যালোচনা করার জন্য সার্ক দেশসমূহের প্রধানদের কর্তৃক নিয়োজিত ‘গ্রুপ অফ ইমিনেন্ট পারসন’-এর সদস্য। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রতীচী ট্রাষ্টের (বাংলাদেশ)-এর চেয়ারম্যান এবং এ্যাশ ইন্সটিটিউট, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক এ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য। এছাড়া তিনি আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন।
১৯৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন রেহমান সোবহান। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় একটি সুষম অর্থনীতির সুবিধা পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে প্রথিতযশা এই অর্থনীতিবিদ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখছেন তাঁর প্রিয় স্বদেশ একদিন সত্যি সত্যি সোনার বাংলায় রূপ নেবে। তিনি সবসময় নতুন প্রজন্মকে প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষ, জাতীয়তাবাদী বোধ এবং জীবন পরিচালনার বিষয়ে প্রভাবিত করেছেন।
১৯৬৫ সালে রেহমান সোবহান বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সালমা সোবহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বড় ছেলে তৈমুর সোবহান ১৯৮১ সাল আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মেজ ছেলে বাবর সোবহান একজন অর্থনীতিবিদ। ছোট ছেলে জাফর সোবহান আইনজীবি। ২০০৩ সালে সালমা সোবহানের মৃত্যুর পর রেহমান সোবহান ড. রওনক জাহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৫৭ সালে রেহমান সোবহান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার এক বছরের মধ্যেই সামরিক আইন জারি হলো। সংবিধান স্থগিত করা হলো এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপরও বাধা এল। লেখালেখির মাঝেই তিনি এর প্রতিবাদ করতেন। সামরিক আইনের পুরোটা সময় জুড়েই তিনি বিভিন্ন সভায় দ্বৈত অর্থনীতির বিষয়টি নিয়ে বক্তৃতা করতেন। সেসময় এক সভায় সভাপতির আসনে বসে ছিলেন একজন পশ্চিম পাকিস্তানী ভদ্রলোক। তিনি রেহমান সোবহানের এক বন্ধুকে ডেকে বলেছিলেন- তিনি কি জানেননা এদেশে এখন মার্শাল ল’ চলছে? তাঁর সেদিনের ঐ বক্তৃতা সব বড় বড় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি পাকিস্তান অবজারভারও ঐ বক্তৃতা তাদের প্রথম পাতায় ছেপেছিল। ঐ সময় বাংলাদেশের মানুষদের ওপর অত্যাচার, আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা সবাই জানলেও সংবাদপত্রে কেউ প্রকাশ করবার সাহস পেত না। তাঁর বক্তৃতার কারণে তিনি তখন জনগণের কন্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন।
এদেশের প্রান্তিক, অধিকার বঞ্চিত, বাকস্বাধীনতাহীন এবং ভোটাধিকার বঞ্চিত মানুষদের জন্য রেহমান সোবহান সব সময়ই কাজ করে চলেছেন। সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা, সমতা এবং সবার জন্য সমান সুযোগ এই প্রশ্নের দ্বারা তাঁর সকল সাহিত্যকর্মের ভিত্তি নির্মিত হয়েছে। তিনি আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কার্যকর অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একজন যাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং অবস্থান ভবিষ্যত্ প্রজন্মের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং প্রবল উৎসাহ তৈরি করেছে। সারাজীবন এদেশের মানুষের কল্যাণে ধ্যাণরত, প্রচন্ড আশাবাদী এই মানুষটির লেখনী কাঁপিয়ে দিয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারকে।
সবার কাছে তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধের অর্থনীতিবিদ’ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানিদের দ্বৈত অর্থনীতির বিরুদ্ধে তাঁর অদম্য লেখনীর জন্য ১৯৭১-এর কালরাত্রির পরপর হানাদারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন তিনি। তাঁর সুভাকাঙ্খীরা তাঁকে ঢাকা ছেড়ে যাবার জন্যে পরামর্শ দিলেন। তাঁদের ধারণা এরপর তাঁকে ধরবার জন্যে বাড়ি বাড়ি সার্চ করা হবে। ফলে যাঁরা তাঁকে আশ্রয় দেবেন তাঁদের জন্যেও ব্যাপারটা হবে খুব ঝুঁকিপূর্ণ। একারণে তিনি কয়েকজনের সঙ্গে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন এবং ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ রাতে তাঁরা দিল্লি পৌঁছেন।
তাঁরা যখন দিল্লিতে পৌঁছেন তখন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদও দিল্লিতে এসে হাজির হন এবং ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে আরো বেশি কর্তৃত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করতে সক্ষম হন। দিল্লিতে পৌঁছানোর অল্প সময়ের মধ্যেই রেহমান সোবহান তাজউদ্দিন আহমদের সংস্পর্শে আসেন।
তাঁরা দিল্লিতে একত্রিত হওয়ার পর পরই রেডিওর মাধ্যমে জানতে পারলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ড. কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করেছে। এই খবরে তাঁরা খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। এরপর খবর পেলেন, একের পর এক আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতারা সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে আসতে শুরু করেছেন। কত দ্রুত সীমান্তে উড়ে যেয়ে তাঁর দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে মিলিত হবেন এই নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন । এছাড়া তাঁদের নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবার বিষয়টি নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন হন।
এরকম একটি সরকারের ঘোষণা দেবার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রথমেই অনুভব করেন, একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার খসড়া তৈরি করা দরকার। অবশ্য এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথমে আওয়ামী লীগের আবদুল হান্নান এবং পরে মেজর জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা হয়েছে। এখন শুধু এ দুটোকে মিলিয়ে স্বাধীনতার একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া প্রয়োজন।
স্বাধীনতা ঘোষণার খসড়া তৈরি করা ছাড়াও ঘোষণাপত্রের প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে একটি পৃথক বিবৃতি তৈরি করার জন্য তাজউদ্দিন আহমদ রেহমান সোবহানের ওপর দায়িত্ব দিলেন। এই দায়িত্ব তিনি নিলেন খুবই ভয়ে ভয়ে, কেননা এ কাজগুলো এক সময় ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হবে। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের যে খসড়া রেহমান সোবহান তৈরি করলেন, তাতে মূল ঘোষণার সমস্ত কিছুই রাখলেন। পাশাপাশি খালেদ মোশাররফের অনুরোধ অনুযায়ী তিনি উল্লেখ করলেন, যেসব বাঙালি প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীতে ছিলেন এবং এখন একাত্তরের ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের জন্যে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা সকলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নবগঠিত সেনাবাহিনীতে পুনরায় কমিশনপ্রাপ্ত বলে গণ্য হবেন।
যদিও রেহমান সোবহান জেনেছিলেন এধরনের দলিলের আইনগত দিকগুলো ঠিক করার জন্যে তাঁর তৈরি ঘোষণাপত্রের মূল খসড়া সংশোধন করা হবে, তবু তাঁর মূল খসড়ার কোনো কোনো জায়গা ঘোষণাপত্রের মর্মবাণী রক্ষা করছিল। তবে ঘটনার প্রেক্ষাপটে তাঁর খসড়া যা ছিল হুবহু তাই রাখা হল এবং ১৪ এপ্রিল কুষ্টিয়ার আম্রকাননে (যেটি এখন মুজিবনগর নামে পরিচিত) বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই ঘোষণাপত্র সারা বিশ্বের কাছে উত্থাপন করলেন।
এরপর একদিন বিবিসিতে তাঁরা শুনলেন, ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম.এম. আহমেদ ওয়াশিংটন যাচ্ছেন পাকিস্তানের দাতাদেশগুলোর কনসোর্টিয়ামে তাদের সাহায্য অব্যাহত রাখার আবেদন নিয়ে। তাজউদ্দিন বুঝতে পারলেন, সাহায্যের নামে পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় কোনো রকম সহায়তাকে তাঁদের সকল রাজনৈতিক শক্তির বিনিময়ে হলেও প্রতিহত করতে হবে।
তাজউদ্দিন আহমদ রেহমান সোবহানকে দায়িত্ব দিলেন, অবিলম্বে লন্ডন ও ওয়াশিংটন যাওয়ার জন্যে। যাতে ওখানে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পাকিস্তানের প্রধান দাতাদেশগুলোর কাছে তাদেরকে এধরনের সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার জন্যে প্রচার চালাতে পারেন তিনি। তাঁর দ্বিতীয় কাজ ছিল, পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে কর্মরত সকল বাঙালি কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁদের সমর্থন দানের জন্যে উদ্বুদ্ধ করা। তাঁর নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশন-যেখানে অসংখ্য বাঙালি কর্মচারি রয়েছে-তাঁদের সমর্থন আদায় করা। কারণ তাঁদের সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালানোর পক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।
তাজউদ্দিন আহমদের কথামতো রেহমান সোবহান এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে ও এপ্রিলের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় ও প্রবাসী বাঙ্গালিদের সংগঠিত করেন তিনি। এরপর আসে চিরকাঙ্খিত সেই স্বাধীনতা, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তিনি অন্যান্যদের সাথে ঢাকা বিমান বন্দরে পৌঁছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরীতে তাঁর সহজাত অংশগ্রহণ দ্বৈত অর্থনীতি তত্ত্ব হিসেবে সুপরিচিত, এই অর্জনই এক জীবনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তিনি কখনও থেমে থাকেননি। বাংলাদেশের অতিবাহিত অতীত সময়ের উন্নয়ন বিষয়ক বিতর্ক, নিবন্ধ এবং অভিজ্ঞতার সত্যিকার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর লেখায়।
এ পর্যন্ত রেহমান সোবহানের ৪২টি বই আর মনোগ্রাফ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন জার্নালে প্রায় ২০০ এর উপরে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর কাজের প্রধান বিষয়বস্তু হলো আইয়ুব খানের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর রাজনৈতিক সম্পর্ক, মধ্যবর্তী শাসন পদ্ধতিতে সার্বজনীন সাহসী উদ্যোগের ভূমিকা, বৈদেশিক নির্ভরশীলতার সংকট, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা, কৃষিজ সংস্কার, সমন্বয় নীতি সংস্করণের সমালোচনামূলক নিবন্ধ, দুঃশাসনের ব্যবচ্ছেদ, এবং সর্বশেষে দারিদ্র বিমোচনের কৌশল। সময়ের প্রয়োজন উপলব্ধির ক্ষেত্রে তিনি সর্বদাই পারদর্শী। সেভাবেই তিনি নির্বাচন করেন তাঁর কাজের ক্ষেত্র। আর এসব কিছুর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০৮ সালে স্বাধীনতা পদক অর্জন করেছেন।
তিনি সবসময় স্বপ্ন দেখেন সুখী সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশের। আর তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি কখনো বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থা আর সুশীল সমাজের উদ্যোক্তা আবার কখনোবা পৃষ্ঠপোষক হয়ে আজও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: অধ্যাপক রেহমান সোবহান ১৯৩৫ সালের ১২ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা:বাবা কে.এফ. সোবহান ছিলেন পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা যিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
মা: তাঁর মা হাসমত আরা বেগম।
পড়াশুনা:কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম.এ. করার আগে রেহমান সোবহান তাঁর ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেছেন দার্জিলিং-এর ঐতিহ্যবাহী সেন্ট পলস্ স্কুলে (১৯৪২-৫০) এবং লাহোরের অ্যাচিসন (Aitchison College) কলেজে (১৯৫১-৫২) । তিনি ১৯৫৬ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও তাঁর শিক্ষাজীবন বিস্তৃত হয়েছে অক্সফোর্ড ও হাভার্র্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পৃথিবী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিন বছর তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন।
কর্মজীবন: ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে দেশে ফিরে আসার পর রেহমান সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন রেহমান সোবহান।
পরিবার: ১৯৬৫ সালে রেহমান সোবহান বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সালমা সোবহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বড় ছেলে তৈমুর সোবহান ১৯৮১ সাল আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মেজ ছেলে বাবর সোবহান একজন অর্থনীতিবিদ। ছোট ছেলে জাফর সোবহান আইনজীবি। ২০০৩ সালে সালমা সোবহানের মৃত্যুর পর রেহমান সোবহান ড. রওনক জাহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
তথ্যসূত্র
১. আমার সমালোচক আমার বন্ধু, রচনা সংকলন, রেহমান সোবহান।
২. বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত সাক্ষাত্কার।
৩. সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ।
লেখক : ফাতেমা বেগম লাবনী
পুনর্লিখন : গুণীজন দল