ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করেন নুরুল ইসলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের বক্তব্য, প্রথম বর্ষেই ভর্তি হতে হবে। তিনি বললেন, ‘আমি এক বছর কলকাতায় পড়ে এসেছি, তাহলে কেন প্রথম বর্ষে ভর্তি হব?’
শেষ পর্যন্ত উপাচার্যের হস্তক্ষেপে তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে ভর্তি করা হয়। শর্তটি হলো, দ্বিতীয় বর্ষে ফল ভালো না করলে পিছিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পিছিয়ে পড়েননি তিনি। উল্টো দ্বিতীয় বর্ষ তো বটেই চূড়ান্ত পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। আর এই তুখোর ছাত্রই পরবর্তীতে এদেশের তুখোর অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম নামে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। তবে তিনি শুধু এদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদই নন। তাঁর আরও পরিচয় আছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক সহকারী মহাপরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। পাকিস্তান আমলে দুই অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা।
১৯২৯ সালে, চট্টগ্রামের পটিয়ায় ড. নুরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুর রহমান ছিলেন স্কুলশিক্ষক, পরে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষা কর্মকর্তা হয়েছিলেন। শিক্ষা কর্মকর্তার চাকরিটি ছিল বদলির। তাই কৈশোরে বাবার সাথে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়েছে তাঁকে। ফলে তিনি পড়াশুনাও করেছেন বিভিন্ন স্কুলে।
১৯৪৫ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক (এসএসসি সমমানের) পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ভর্তি হন। উচ্চমাধ্যমিকে অবিভক্ত বাংলায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। একজন মুসলমান ছাত্রের এ কৃতিত্বে সবাই বিস্মিত হয়েছিলেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান শ্রেণীতে তিনি ভর্তি হন। কলেজের কারও সঙ্গে পরিচিত হলে প্রথমেই তিনি জানতে চাইতেন, উচ্চমাধ্যমিকে কত নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছেন? প্রেসিডেন্সি কলেজে ৩০ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র তিনজন ছিল মুসলমান। প্রথম বর্ষ শেষ করতেই কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। নুরুল ইসলাম ফিরে আসেন ঢাকায়।
ঢাকায় এসে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে লাভ করেছিলেন কালী নারায়ণ বৃত্তি। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর নুরুল ইসলাম পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ডে চলে গেলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। চার বছর পর ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) পদে যোগ দিলেন। তা নিয়েও বিরোধিতা দেখা দিল। ২৬ বছরের তরুণ কি করে রিডার হবেন? কেউ কেউ উপাচার্য জেনকিনের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনলেন। জবাবে উপাচার্য বললেন, ‘আমি তো নুরুল ইসলামকে চিনিই না, স্বজনপ্রীতি করব কীভাবে? পরীক্ষার ফল দেখেই আমি তাঁকে নিয়েছি।’
শিক্ষকতা পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ ১১ বছর কাটিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। তিনি যখন শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্তমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গেটের সামনে একটি কক্ষ ছিল। সেখানে প্রক্টর বসতেন। সেখান থেকে নজরদারি করা হতো মেয়েরা মাথায় কাপড় দিচ্ছে কি না। না দিলে তাদের সাবধান করা হতো। শ্রেণীকক্ষেও মেয়েরা স্বাধীনভাবে যেতে পারত না। তারা শিক্ষকের জন্য অপেক্ষা করত। নুরুল ইসলাম তখন সবেমাত্র বিলাত থেকে ফিরেছেন, বিষয়টি তাঁর কাছে অস্বাভাবিক লাগত।
শিক্ষকতা, পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলা এবং দেশি-বিদেশি সংস্থায় গবেষণা-এই তিন পর্বে তাঁর কর্মজীবন বিভক্ত হলেও শিক্ষকতা পেশাটি তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। শিক্ষক হিসেবে তিনি কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। ছাত্রছাত্রীদেরও তা মেনে চলতে উৎসাহিত করতেন। একদিন তিনি ক্লাসে পড়াতে গিয়ে দেখলেন, এক ছাত্র বই পড়ছে, উপন্যাস। তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি ক্লাসে বসে বই পড়তে পারো না।’ ছাত্রটি বলল, ‘আমি তো কাউকে ডিসটার্ব করছি না।’ তিনি বললেন, ‘এতে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হচ্ছে।’ তারপরও ছাত্রটি নিবৃত্ত হলো না। এরপর তিনি বললেন, ‘দুটি কাজ একসঙ্গে চলতে পারে না। হয় তোমাকে বই পড়া বন্ধ করতে হবে, অন্যথায় আমাকে পড়ানো বন্ধ করতে হবে।’ এরপর ছাত্রটি নিঃশব্দে শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে চলে যায়।
বিষয়টি বিভাগীয় প্রধান পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তিনি একদিন নুরুল ইসলামকে বললেন, ‘আপনি যে ছেলেটিকে শ্রেণীকক্ষ থেকে বের করে দিয়েছেন, সে ক্ষমতাধর এক সরকারি কর্মকর্তার ছেলে। আমাদের ক্ষতি করতে পারে।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার কী ক্ষতি করবে?’ ক্ষতির ভয়ে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি ড. নুরুল ইসলাম।
তিনি যেখানেই কাজ করেছেন সেখানেই আনন্দ পেয়েছেন। একাগ্রতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছেন। শিক্ষকতা তাঁকে সব চেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে। তাঁর মতে, শিক্ষকতা তো শুধু পড়ানো নয়, নিজেকেও নবায়ন করা। ছাত্রছাত্রীদের সাহচর্য তাঁর খুব ভালো লাগত।
শিক্ষকতা পেশাতে থাকা অবস্থায় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বিভিন্ন কমিশনের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন দেশে বেশি অর্থনীতিবিদ ছিল না। তাঁকে মূল্য কমিশন, প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থ কমিশনের সদস্য করা হয়। কিন্তু এসব কমিশনে কাজ করে এই চৌকস অর্থনীতিবিদ বুঝতে পারলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা সব ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে ঠকাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় হত পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত অর্থনীতিবিদদের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগ দেন ড. এম এন হুদা, এ এফ এ হুসেইন, মাজহারুল হক, এম টি হক, এ সাদেক, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল্লাহ ফারুক ও নুরুল ইসলাম। ওই সম্মেলনে তাঁরা প্রথম দ্বৈত অর্থনীতির ধারণা উত্থাপন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রথম থেকেই সন্দেহ করে আসছিলেন, এ ধারণা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বিভক্তি ডেকে আনবে। পূর্বের অর্থনীতিবিদের যুক্তি ছিল, হাজার মাইল দূরত্বের দুটি দেশে এক অর্থনীতি চলতে পারে না। ষাটের দশকের শুরুতে সামরিক শাসক আইয়ুব খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপককে ডেকে পাঠান অর্থনৈতিক বিষয়ে তাঁদের মতামত জানার জন্য। এ দলেও ড. নুরুল ইসলাম ছিলেন, আরো ছিলেন এস এম হুদা, এ এফ এ হুসেইন, আবদুল্লাহ ফারুক। তাঁদের বক্তব্য আইয়ুব খান ধৈর্য সহকারে শোনেন কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেননি।
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস (পিআইডিই)। প্রথমে এর প্রধান ছিলেন একজন আমেরিকান। পরে সিদ্ধান্ত হয় দেশীয় অর্থনীতিবিদকেই এ পদ দেয়া হবে। ১৯৬৫ সালে বন্ধুদের পরামর্শে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সেখানে যোগ দেন । এ প্রতিষ্ঠানে যে সব গবেষণা হয়েছে তাতে পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য আরো স্পষ্ট হয়।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ঘোষিত হয়, তখন নুরুল ইসলাম এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। অন্য কোনো অর্থনীতিবিদ ছিলেন বলেও তাঁর জানা নেই। এর মূল সূত্রগুলো শেখ মুজিবেরই তৈরি। তাঁকে সহায়তা করেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান বিদায় নেওয়ার পর তিনি ছয় দফা অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়নে সহায়তা করেন। মার্চ-এপ্রিলের দিকে তত্কালীন স্টেট ব্যাংকে চাকরিরত তাঁদের বন্ধু রশিদ এসে জানালেন, বঙ্গবন্ধু দেখা করতে বলেছেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর দেখা হতো বিভিন্ন স্থানে। কখনো ঢাকার বাইরেও তাঁরা বৈঠক করেছেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন, ‘ছয় দফা বাস্তবায়ন করতে হলে এর অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনা কীভাবে সাজানো যায় সে ব্যাপারে সহযোগিতা করুন।’ এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ। তাঁরা কাজ করলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, নির্বাচনের আগেই তাঁরা খসড়া সংবিধান তৈরি করেছিলেন। ১৯৭১-এর মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকেও সেই রূপরেখা পেশ করা হয়। তাঁরা সরাসরি আলোচনায় যোগ দেননি; বৈঠকে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগের নেতারা এসে পরিস্থিতি জানাতেন, এরপর তাঁরা পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা করতেন।
প্রথম থেকেই নুরুল ইসলামের ধারণা ছিল, আলোচনা সফল হবে না। কেননা, পাকিস্তানিরা এটা মেনে নেবে না। আক্ষরিক অর্থে ছয় দফা বাস্তবায়ন হলে দেশ এক থাকে না। কিন্তু তারা এভাবে গণহত্যা চালাবে, সেটি ভাবেননি তিনি। এপ্রিলের শুরুতে তিনি আগরতলা হয়ে দিল্লি যান। সেখানে গিয়ে শুনতে পান তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায়। প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি এন ধরের সহায়তায় নুরুল ইসলাম আমেরিকা চলে যান। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখেন তিনি। নিক্সন প্রশাসন প্রচণ্ডভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও শিক্ষাবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন তাঁরা পান। স্বাধীনতার পর পরই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে চট্টগ্রামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় এসেই শুনতে পেলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। তখন তিনি ভাবলেন, দেখা করে যাই। তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘লন্ডনেই আপনার খোঁজ করেছি। আপনাকে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব নিতে হবে। কীভাবে করবেন, কাদের নিয়ে করবেন, তার একটি রূপরেখা দিন।’
বঙ্গবন্ধুর কথায় নুরুল ইসলাম কাজে লেগে পড়লেন। কমিশনের সদস্য হিসাবে যাঁদের নাম তিনি দিলেন বঙ্গবন্ধু তা মেনে নিলেন। একটি নতুন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ খুবই কঠিন কাজ হলেও সানন্দে তাঁরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন তাঁরা। লোকবল কম, প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা সীমিত। তাঁরা প্রথমে দুই বছরের জন্য একটি পুনর্বাসন কর্মসূচি নিলেন (১৯৭২-১৯৭৩)। এরপর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেন (১৯৭৩-১৯৭৮)। এসব কাজে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছেন। কিন্তু অনেক সরকারি কর্মকর্তাই নতুন ধারণা ও প্রতিষ্ঠানকে সহজে গ্রহণ করতে পারলেন না। পরিকল্পনা কমিশনকে সমান্তরাল ক্ষমতাকেন্দ্র ভাবতে শুরু করলেন। সরকার সমর্থক ও বিরোধী উভয় শ্রেণীর পত্রিকায় তাঁদের বিরুদ্ধে লেখালেখি হতে থাকে। ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন, জাতীয় নীতি গ্রহণে তাঁদের গুরুত্ব থাকছে না। তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, পরিকল্পনা কমিশন ত্যাগ করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সে কথা সরাসরি বললেন না। বললেন, কিছুদিনের জন্য ছুটি চাই। তিনি প্রথমে রাজি হলেন না, পরে তাঁর পীড়াপীড়িতে রাজি হলেন। বললেন, ‘এক বছর পর আপনাকে ফিরে আসতে হবে।’ সেটি পঁচাত্তর সালের মার্চ-এপ্রিলের ঘটনা। কিন্তু আর ফেরা হলো না। ১৫ আগষ্ট বিপদগামী সেনা সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হন।
ড. নুরুল ইসলাম প্রথমে গেলেন অক্সফোর্ডে। সেখানে তিন বছর ফেলো ছিলেন। এরপর যোগ দেন রোমভিত্তিক বিশ্ব খাদ্য সংস্থায় সহকারী মহাপরিচালক হিসেবে। বিদেশে গিয়েও তিনি দেশের কথা ভেবেছেন। যতটুকু সম্ভব সহায়তা করেছেন। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়। ঢাকায় এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র (CIRDAP) হয়েছে, যার উদ্যোক্তা ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। এ সংস্থার প্রথম মহাপরিচালক হন ড. আজিজুল হক। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পাট সংস্থাও (আইজেও) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সংস্থাটি টেকেনি। সিরডাপ এখনো আছে। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা থেকে অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ওই সংস্থার সংখ্যাতিরিক্ত ফেলো। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাজ না থাকলেও একটি কক্ষ তাঁকে দেওয়া হয়েছে, যেখানে বসে তিনি নিজের কাজ করতে পারেন। অতিথি শিক্ষক ছিলেন ইয়েল ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, নেদারল্যান্ডের স্কুল অব ইকোনমিকসে শিক্ষাসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতিসংঘের উন্নয়ন পরিকল্পনা নীতির চেয়ারম্যানের পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন।
ড. নুরুল ইসলামের গবেষণার ক্ষেত্র বিশাল। ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নীতিমালা নিয়ে তাঁর অসংখ্য নিবন্ধ ছাপা হয়েছে বিদেশি পত্রিকায়। প্রকাশিত গ্রন্থ: মেকিং অব এ ন্যাশন বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিস্ট’স টেল, বাংলাদেশ: জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা, ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ: এ স্ট্যাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি (ইউপিএল ১৯৭৯ পুনর্মুদ্রণ ১৯৯৩), ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি অব বাংলাদেশ, ১৯৭৮; ফুড প্রাইজ স্ট্যাবিলাইজেশন ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিজ: ইস্যুজ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স ইন এশিয়া (আইএফপিআরআই, ১৯৯৬) এবং এক্সপ্লোরেশন ইন ডেভেলপমেন্ট ইস্যুজ: সিলেক্টেড আর্টিকেলস অব নুরুল ইসলাম (আলগেট যুক্তরাজ্য ২০০৩), ননফার্ম এমপ্লয়মেন্ট ইন ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজ: কনসেপ্ট অ্যান্ড এভিডেন্স, রিডিউসিং রুরাল প্রভার্টি ইন এশিয়া (হাওয়ার্থ প্রেস, নিউইয়র্ক)।
২০১০ সালের মার্চ মাসে ড. নুরুল ইসলামকে প্রদান করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তারা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, প্রবীণ অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশই গর্বিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার গ্রহণ করে তিনি এ দেশের মানুষকে সম্মানিত করেছেন।
বর্তমানে তিনি বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। কিন্তু বিদেশে বসবাস করলেও তিনি দেশকে কখনই ভোলেননি। আর তাইতো সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে আসেন দেশে। এদেশের অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধির জন্য সবসময় পরামর্শ দেন তিনি।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম : ১৯২৯ সালে, চট্টগ্রামের পটিয়ায় ড.নুরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন।
পড়াশুনা ও কর্মজীবন : ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক (এসএসসি সমমানের) পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ভর্তি হন। উচ্চমাধ্যমিকে অবিভক্ত বাংলায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। একজন মুসলমান ছাত্রের এ কৃতিত্বে সবাই বিস্মিত হয়েছিলেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান শ্রেণীতে তিনি ভর্তি হন। প্রথম বর্ষ শেষ করতেই কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। নুরুল ইসলাম ফিরে আসেন ঢাকায়।
ঢাকায় এসে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে লাভ করেছিলেন কালী নারায়ণ বৃত্তি। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর নুরুল ইসলাম পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ডে চলে গেলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। চার বছর পর ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) পদে যোগ দিলেন।
শিক্ষকতা পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ ১১ বছর কাটিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। শিক্ষকতা, পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলা এবং দেশি-বিদেশি সংস্থায় গবেষণা-এই তিন পর্বে তাঁর কর্মজীবন বিভক্ত ছিল।
তথ্যসূত্র : প্রথম আলো, ছুটির দিনে, ০৩ এপ্রিল, ২০১০
পুনর্লিখন : গুণীজন দল