জন্ম ও বংশ পরিচয়
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সমাজচিন্তাবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ সিলেট জেলায় সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মৌলানা কাজী মুফজ্জল হোসেন সর্বজন পরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সফল রাজনীতিবিদ ও শিক্ষক। মৌলানা মুফজ্জল হোসেন অখন্ড ভারতের আসামের প্রাদেশিক ব্যবস্থাপনা সংসদের সদস্য (এমএলএ) ছিলেন (১৯৪৬ সালে নির্বাচিত)।
১৯৫০ এর দিকে তিনি সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন রাজনগর (বর্তমান মৌলভীবাজার জেলায়) পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে মৌলভীবাজার কলেজ স্থাপিত হলে সেখানে দীর্ঘ দেড় দশক অধ্যাপনা করে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। খলীকুজ্জমানের মাতা বেগম ছহিফা খাতুন শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তিনি ২০০২ সালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘদিন তিনি শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ‘মৌলানা মুফজ্জল হোসেন ট্রাস্ট’ এর চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেন। খলীকুজ্জমানেরা চার ভাই ও এক বোন; তিনি পিতা-মাতার বড় সন্তান।
শৈশবকাল
শৈশবকাল পুরোটাই কেটেছে বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে। বাবা ছিলেন ব্যস্ত মানুষ, তবু বাবার সরাসরি তত্ত্বাবধানে তিনি অনেক দিন পড়াশোনা করেন। বাবা খুবই যত্ন সহকারে তাঁকে পড়াতেন। প্রথমে বুঝিয়ে দিতেন, তারপর লিখতে বলতেন। ইংরেজি এবং অংকের মত বিষয়কে তিনি এমন সহজভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে, পরবর্তীতে খলীকুজ্জমান যখন স্কুলে ভর্তি হলেন তখন দেখলেন তিনি এই দুইটা বিষয়ে সহপাঠিদের থেকে অনেক এগিয়ে। ছোটবেলার সবকিছু মনে নেই তবে এইটুকু মনে আছে যে, পুরোটা শৈশব জুড়েই ছিল বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করা।
শিক্ষা জীবন
খলীকুজ্জমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল রাজনগর (বর্তমান মৌলভীবাজার জেলায়) পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার মধ্যে দিয়েই মূলত তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। এর আগে তিনি পারিবারিকভাবেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, যেখানে শিক্ষক ছিলেন তাঁর পিতা। ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কখনো স্কুলে যাননি।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ১৯৫৬ সালে রাজনগরের পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি এই পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান লাভ করেছিলেন। তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। এর চার বছর পর এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অর্থনীতিতে সম্মানসহ এমএ পাশ করেন। দুই পর্যায়েই তিনি বৃত্তি পান। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স (The London School of Economics and Political Science (LSE), London University থেকে অর্থনীতিতে এমফিল এবং ১৯৭৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি-তে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল The Jute Manufacturing Industry of Bangladesh 1947-74 (PhD Thesis, London University, 1976).
কর্মজীবন
‘বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী, সত্ ও স্বাধীনচেতা। বহু শতাব্দীব্যাপী পরাধীন এই দেশে পরনির্ভরশীলতার সংস্কৃতি গোটা সমাজ দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনই দৃঢ়মূল ছিল যে, এখানে প্রকৃত সত্য স্বাধীনচেতা ও স্পষ্টবাদী মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠা কঠিন। সেই কঠিন কাজটিকেই তিনি শুরু থেকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষে তাঁর মতো আরো অনেকের জন্য সহজ কিন্তু লোভনীয় পথ হতো যেটি তিনি তাঁর ধার দিয়েও গেলেন না। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের হাতছানি তখনকার উচ্চকাঙ্ক্ষী উঠতি বাঙালী পরিবারের তরুণদের কাছে ছিল অপ্রতিরোধ্য, এর মোহ ছিল দুর্নিবার। মনে রাখতে হবে যে, ১৯৬০-এর দশক ছিল পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসনাধীন বাঙালী মধ্যবিত্তের উত্থানের যুগ। শিক্ষিত, জেগে ওঠা বাঙালী তরুণেরা তখন পথ খুঁজছিল নিজেদের বিকাশের, প্রকাশের ও প্রতিষ্ঠার। সে লক্ষ্যে অর্থনীতিবিদের পেশাটি তখন দেশে ছিল স্বল্প পরিচিত ও দুরূহ। সিভিল সার্ভিসের তুলনায় এ পেশায় গ্ল্যামার বা চাকচিক্যও তেমন ছিল না। কিন্তু এ পেশায় স্বাধীনভাবে কাজ করার সম্ভাবনা ও সুযোগ ছিল প্রচুর। তবে হ্যাঁ, সে সুযোগ ব্যবহার করতে পারার ইচ্ছা ও ক্ষমতা দুটোরই প্রয়োজন ছিল। বলা বাহুল্য অন্য আর দশ জনের চেয়ে ড. আহমদের দুই-ই ছিল বেশি।’ (উদ্বৃতি, ‘আমার কিছু কথা’, সম্পাদনা নিলুফার বানু ও ফোরকান আহমদ, প্রকাশকঃ বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ, ১৯৯৬)।
উপরের উদ্বৃতিটুকু যে শতভাগ সত্য তার প্রমাণ ড. খলীকুজ্জমান তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে রেখে চলেছেন। গবেষণা কর্মকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশের পর করাচীতে (তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তান) তত্কালীন পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকনমিক্স-এ (PIDE)গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন (১৯৬৩ সাল)। আর্থ-সামাজিক গবেষণাকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করে যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন, নিরলস পরিশ্রম, একাগ্রতা ও কঠিন মানসিক শক্তির দ্বারা সেই চ্যালেঞ্জকে তিনি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছেন। যেমন:
- On the research staff of PIDE/Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS) 1964- 1987, was Research Director when he left BIDS in 1987.
- Consultant to Economic Development Institute (EDI) of the World Bank (1975 & 1976).
- President, Bangladesh Economic Association (BEA) (2002-।); Vice President, BEA (1979-81); General Secretary, BEA (1977-79).
- President, (Kuala Lumpur-based) Association of Development Research and Training Institutes of Asia and the Pacific (ADIPA), (October 1979-June 1983); was Vice President of ADIPA from 1977-79.
- Member, Research Advisory Committee, Press Institute of Bangladesh (1979- 80).
- Member, Research Advisory Committee, Bangladesh Management Development Centre (1978-81).
- Member of the Senate, Jahangirnagar University, (1985- 88).
- President, Bangladesh Unnayan Parishad (BUP) 1980- 1985 and again (Chairman as the post was re-designated) since February 1987).
- Member, Executive Board, Foundation for Research on EducationalPlanning and Development, Dhaka (1995-).
- Visiting Scholar at the OECD Development Centre, Paris, France (October- November 1980).
- Editor, ‘Unnayan Bitarka’ Quarterly Journal of Bangladesh Unnayan Parishad (December 1981- ).
- Member of the Board of Trustees of BIDS (from 1983 to September 1987 and again from 1991 to December 1994).
- Convener, Steering Committee, National Association of Social Sciences, Bangladesh (November 1983-November 1984); Member of the Presidium and Secretary General of the Association (November 1984-January 1987); and Vice President, 1987-91).
- Global Vice President, (Rome-based) Society for International Development (SID) (March 1988-May 1991); President, SID-Bangladesh Chapter (March 1986-March 1991); and Chairman, SID- South Asia Committee, (December 1985- March 1987).
- Member of the Senate, Jahangirnagar University (June 1985- 1988).
- Member, Social Science Research Evaluation Committee,Bangladesh University Grants Commission (1986-89).
- Expert Member, Selection Committee for the Appointment of Research Professor (Social Science) Bangladesh University of Engineering and Technology (February 1987- 94).
- Consultant, Asian Development Bank (ADB), Manila/Centre on Integrated Renal Development of Asia and Pacific (CIRDAP), Dhaka, February-June 1988
- Member, Bangladesh-UNESCO National Commission for Education (during 1990s
- Member of the Senate, Dhaka University (1991-94).
- Taught courses in economics to MA Final year in the University of Dhaka during 1973-79.
- Consultant, UN Fund for Agricultural Development (IFAD) in 1991-carried out a one-member IFAD Strategy Mission to Pakistan.
- Short-term Consultant to United Nations Food & Agriculture Organization (FAO), Rome (during 1981, 1982, 1984, 1985 and 1991-96). Led UN FAO/WFP Crop and Food Supply Assessment Missions, over the years, to many countries facing severe food shortages, including: (a) Laos, February- March 1994; (b) Somalia, November 1994; (c) Angola, April- May 1995; (d) Iraq, August-September 1995; (e) Laos, October 1995; (f) Cambodia, January-February 1996; (g) Angola, April-May 1996; (h) Cambodia, January-February 1997; (i) Uganda, February- March 1997; (j) Iraq, July 1997; (k) Mozambique, April-May 1998; (l) North Korea, October-November 1998; (m) Afghanistan, May-June 1999 and May 2000; (n) Baluchistan, Pakistan concurrently with Mission to Afghanistan, May- June 2000; (o) Tajikistan, July 2000: (p) ।Afghanistan, May 2001; (q) DPR Korea, September-October 2001; (r) Zimbabwe, April-May 2002; (s) Zimbabwe, April-May 2003; (t) Eritrea, October-November 2003; (u) Zimbabwe, April-May 2004.
- Member, ILO TSS1 Multidisciplinary Mission on Employment Promotion and the Development of Small and Micro Enterprises. Led or participated in ILO Missions, including, to: (a) Sri Lanka, 6-21 June 1994; (b) Nepal, 20 March-7 April 1995
- Have directed the following seminal studies, among others:(a) Greenhouse Effect and Climate Change: An Assessment of the Effects on Bangladesh (started in 1993 and completed in 2000 in two phases); (b) Resources, Environment, and National Development with Particular Reference to Ganges, Brahmaputra, and Barak Basins (started in 1991 and completed in 2001 in two phases).
- Co-Editor, Asia Pacific Journal on Environment and Development, published twice a year by Bangladesh Unnayan Parishad (BUP), Dhaka (June 1994- ).
- Member, Selection Committee for Professors and Associate Professors, Faculty of Commerce, University of Dhaka, for several years in the 1990s.
- Member, Academic Council, Jahangirnagar University, Savar, Dhaka (1995-97).
- Member, Governing Board, Institute of Flood Control and Drainage Research and also of Academic Council, Bangladesh University of Engineering & Technology (BUET), Dhaka (1995-1998).
- Adviser, National Water Management Plan (1997-2001).
- Member, National Water Council, Government of Bangladesh (January 1997-2001.
- Council Member, Asiatic Society of Bangladesh (January 1998- 99).
- Member of the Syndicate (1997-1999), Shahjalal University of Science & Technology, Sylhet (1997- 1999).
- Convener, Committee on Reorganization of Bangladesh Shilpa Bank and Bangladesh Shilpa Rin Shangstha, 1998-99.
- Member of the Committee that designed Education Policy 2000 (based on an evaluation of 1997 report of Committee on Education, and proposing implementation and financing measures), 1998- 2001.
- Coordinating Lead Author, Working Group II (Chapter 2), Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC), 1999-2001. Lead Author, Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-Fourth Assessment, 2004-2007.
- Member of the Syndicate, Bangladesh University of Engineering & Technology (BUET), Dhaka, 2000-2004.
- Chairman, Steering Committee, Bangladesh Social and Economic Forum 2001 held in Dhaka, May 2001.
- Convener of the Task Force on Climate Change and Its Impact on Water Sector set up by the South Asia Technical Advisory Committee (SASTAC) of GWP, Stockholm, Sweden, 2001.
- Member of The Energy Task Force set up by the South Asia Centre for Policy Studies (SACEPS), 2001-
- Member, Steering Committee, Flood Study Programme of Stockholm-based Global Water Partnership (GWP), Sweden, August 2001- 2003.
- Chairman, South Asia Adaptation Network (SAAN), 2004-
- Founding Member, International Flood Network (IFNET), Japan, set up in 2003.
[ Note: Blank after dash means continuation of the responsibility.]
কর্মজীবন থেকে এখনো তিনি অবসর গ্রহণ করেননি বরং দায়িত্ব এখন আরো বেড়েছে। খলীকুজ্জমান এখনো তাঁর গবেষণা ও ডায়লগ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংগঠনের সাথে এখনো তিনি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।
পারিবারিক জীবন
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের স্ত্রী ড. জাহেদা আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন গবেষণা ও লেখালেখির সাথে যুক্ত। তিনি দীর্ঘকাল অধুনা বিলুপ্ত ‘সাপ্তাহিক সময়’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পারিবারিক জীবনে আহমদ দম্পতি দুই পুত্র সন্তানের জনক-জননী। বড় ছেলে রুশদী আহমদ, দ্বিতীয় ছেলে কাজী উরফী আহমদ ।
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সমাজ চিন্তাবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ-এর চেয়ারম্যান। তিনি অর্থনীতিবিদদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি-র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা সেলে কর্মরত ছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একদিকে তিনি বিভিন্ন গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন, অন্যদিকে প্রচুর লেখালেখি, বক্তৃতা ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করে উন্নয়ন বিষয়ক সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেন। দেশ গঠনে বিভিন্নভাবে তাঁর অবদান রাখার প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। তিনি টেকসই উন্নয়ন ধারণায় বিশ্বাসী (অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সাম্য, অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্র ও পরিবেশ সংরক্ষণ এই ধারণার মূল উপাদানগুলোর অন্যতম)। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দেশে ও বিদেশে তাঁর অসংখ্য গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাধীনতা লাভের আগে ও পরে ড. আহমদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে এবং দেশের পরিকল্পনাবিদ ও চিন্তাবিদদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী সম্পদ পাট-এর উপর তিনি অনেক গবেষণা পরিচালনা করেছেন। পাট শিল্পের সমস্যা চিহ্নিত করে বিশ্বের বাজারে এটিকে আরো চাহিদা উপযোগী করে তোলার জন্য বিভিন্ন সময় তাত্পর্যপূর্ণ গবেষণা পরিচালনা করেছেন।
স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে BIDS (Bangladesh Institute of Development Studies)-এ কর্মরত থাকাকালীন সময়ে ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ শিল্প সমীক্ষা (Rural Industry Study project) শীর্ষক একটি বড় গবেষণা এবং ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দেশের ৪০টি জেলায় ব্যাপকভাবে পরিচালিত গ্রামীণ শিল্প উন্নয়ন (Studies on Rural Industries Development) শীর্ষক আরো একটি গবেষণায় নিয়োজিত বহু দেশী বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত টিমের নেতৃত্ব দেন তিনি। গ্রামীণ শিল্প বিষয়ক এই গবেষণা দুটি দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে বাস্তবমুখী দিক নিদের্শনা দিতে সক্ষম হয়।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পটি বাংলাদেশে পরিবেশ সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানের পথ খোঁজার ক্ষেত্রে একটি দিশারী গবেষণা কর্ম। আমাদের দেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য এই গবেষণা কাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। ৭টি গুরুত্বপূর্ণ দলিল তৈরির মাধ্যমে ১৯৯৪ সালে গবেষণাটির প্রথম পর্ব শেষ হয় এবং দ্বিতীয় পর্বের কাজ শেষ হয়েছে ২০০০ সালে। এই গবেষণা কর্মটি যুক্তরাজ্যের East Anglia University ও নিউজিল্যান্ডের University of Waikato--এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছে। ড. আহমদ এবং ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রিচার্ড ওয়ারিকের যৌথ সম্পাদনায় গবেষণাভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই “The Implications of Climate and Sea Level Change for Bangladesh” হল্যান্ডের Kluwer প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ১৯৯৬ সালে প্রকাশ করে। এই বিষয়ে বাংলাদেশের ওপর এটিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা।
বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা পানির উপর বিভিন্ন ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণা পরিচালনায়ও তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ কতৃর্ক পরিচালিত একটি আঞ্চলিক গবেষণার প্রথম পর্ব শেষে ১৯৯৪ সালে যে দুটি বই এবং ২০০১ সালে দ্বিতীয় পর্ব শেষে যে একটি বই বেরিয়েছে সেগুলোতে ভারত ও নেপালের সঙ্গে পানি বন্টন সমস্যা এবং এর আশু সমাধানের দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে পানি সম্পদের উপর এ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হয়নি।৷ পরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর আরো বই ও অনেক গবেষণা প্রবন্ধ দেশে বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ মনে করেন, দারিদ্র্য নিরসনে উত্পাদনশীল ও টেকসই কর্মসংস্থান একটি জরুরি বিষয়। বাংলাদেশে এ ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও যারা উত্পাদন কাজে নিয়োজিত তাদের উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর বিভিন্ন দিক নিয়েও তিনি দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করছেন এবং লেখালেখি করছেন।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে ড. আহমদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথেষ্ট পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। দেশে-বিদেশে খ্যাত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। স্বাধীনতা লাভের পর দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশ বিষয়ে স্বাধীনভাবে গবেষণা কাজ পরিচালনা করার জন্য দেশের কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদ বেসরকারিভাবে একটি গবেষণা সংস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। সেই অনুভব থেকেই ১৯৮০ সালে এই গবেষণা সংস্থাটি তাঁরই নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন চিন্তা, গবেষণা ও কর্মক্ষেত্রকে আরো সম্প্রসারিত এবং ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেন। তাঁর নেতৃত্বে এ পর্যন্ত প্রায় ১২০টি আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছে এই প্রতিষ্ঠান। আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্মানজনক দুটি নির্বাচিত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮৮-৯১ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি (SID)– এর আন্তর্জাতিক সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় উন্নয়ন গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সমিতি (ADIPA)-র সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ রাজনগর উপজেলায় শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে জনউদ্যোগ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষক, অভিভাবক, বিভিন্ন পেশাজীবী এবং শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি শিক্ষা তদারকী কমিটি গঠন করা হয়। এর নাম দেয়া হয় ‘প্রত্যাশা’। উপজেলার সবগুলো বিদ্যালয়ে পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ফাইনাল পরীক্ষার আগে নির্বাচনী পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। এক স্কুলের শিক্ষক অন্য স্কুলে পরীক্ষা পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কোড নাম্বারের মাধ্যমে নিজ বিদ্যালয় ছাড়া অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। পরপর কয়েক বছর ‘প্রত্যাশা’র মাধ্যমে এভাবে মূল্যায়ন মানদন্ড পরীক্ষা গ্রহণের ফলে এলাকায় শিক্ষার মান উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয়।
সম্মাননা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা
অর্থনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জীবনে অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন, সংবর্ধিত হয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন থেকে।
২০০৫ সালে ড. আহমদকে ‘মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার-২০০৫’ প্রদান করা হয়। যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক বিবলিওগ্রাফিক সেন্টার (International Bibliographical Centre) আন্তর্জাতিক সফল নেতা ৩য় সংস্করণে(International leaders in Achievement 3rd Edition) এবং আমেরিকান বিবলিওগ্রাফিক ইনস্টিটিউট(American Bibliographical Institute) ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত বিশ্বের প্রভাবশালী পাঁচশত নেতা (Five Hundred Leaders of Influence) গ্রন্থে তাঁর নাম অন্তভূর্ক্ত করেছে। তিনি ১৯৯৪ সালে নিউ ইয়র্ক একাডেমী অব সাইন্সেস (New York Academy of Sciences)-এর সদস্য নির্বাচিত হন। (সূত্রঃ ‘আমার কিছু কথা’)।
প্রকাশনা ও সৃষ্টিকর্মের বিবরণ
দেশে ও বিদেশে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গবেষণাভিত্তিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তাঁর গবেষণা ভিত্তিক ৩০টি বই এবং প্রায় ৩০০ গবেষণা রিপোর্ট ও প্রবন্ধ (একক ও অন্যদের সঙ্গে যৌথভাবে) প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই লেখেন। দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন এবং অনবরত লিখেই চলেছেন। নিচে কয়েকটি বইয়ের নাম দেয়া হলো:
১. Shaping the Future of Bangladesh, Bangladesh Economic Association (BEA)/ Bangladesh Young Economists Association (BYEA), Dhaka, 2006.
২. Emerging Global Economic Order and the Developing Countries, (editor), University Press Ltd., Dhaka, 2006.
৩. Climate Change and Water Resources in South Asia, (co-editor with M. Q. Mirza), Tailor and Francis, London, UK, 2005.
৪. The Implications of Climate and Sea Level Change for Bangladesh, (co-editor with R. A. Warrick), Kluwer Academic Publishers, The Netherlands, 1996.
৫. Energy Security in Bangladesh, (author and co- editor), Academic Publishers Ltd., Dhaka, June 2005.
৬. Democracy and Development, BUP/Masro Printing and Packaging Ltd., Dhaka, 1995
সর্বোচ্চ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কাজের বিবরণ ও মূল্যায়ন
ড. আহমদ যে কাজকে জীবনের সর্বোচ্চ কাজ বলে মনে করেন তা হচ্ছে দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ। পাকিস্তানী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৬০-এর দশকে অর্থনীতিবিদ হিসেবে এবং প্রতিবাদী বাঙালী হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭০ সালের শেষদিকে Pakistan Institute of Development Economics (PIDE)- এর প্রধান কার্যালয় করাচী থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের ব্যাপারে যে কয়েকজন বাঙালী অর্থনীতিবিদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে খলীকুজ্জমান ছিলেন অন্যতম। স্বাধীনতার পর এই প্রতিষ্ঠান প্রথমে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স (BIDE) এবং পরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (BIDS) নামে পরিচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্তে স্বাধীনতা অর্জনের পর অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা কেমন করে করা হবে তা নিয়ে যে কয়জন অর্থনীতিবিদ কাজ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ড. আহমদ অন্যতম।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্ত্রী ও দুই শিশু পুত্রসহ অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে জকিগঞ্জ হয়ে আসামের (ভারতের একটি প্রদেশ) করিমগঞ্জে চলে যান। সেখান থেকে যান দিল্লীতে, তারপর আবার কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিনি সেই সরকারের অধীনে পরিকল্পনা সেলে কাজ করেন এবং দেশমাতৃকার জন্য কাজ করতে থাকেন। কলকাতা থেকে ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মাস দুয়েক দেশের বিভিন্ন স্থানে জরুরি ত্রাণকার্য তদারকির দায়িত্ব পালন করে পুনরায় তাঁর পূর্বের কর্মস্থল BIDS-এ ফিরে আসেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান ও স্বীকৃতিই তিনি জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি বলে মনে করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার গৌরব তাঁর কাছে জীবনের যে কোনো প্রাপ্তির চেয়ে অনেক বড়। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন বলে তিনি সব সময় নিজেকে গর্বিত মনে করেন।
প্রত্যাশা
ড. খলীকুজ্জামানের প্রত্যাশা অদূর ভবিষ্যতে ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে সকলের জন্য সমসুযোগের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সুশাসিত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হউক – যেখানে থাকবে না দূর্নীতি-কালোটাকা, দারিদ্র্য-বৈষম্য ও সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্য; যেখানে মানুষ-মানুষের-জন্য এবং উন্নয়ন-মানুষের-জন্য এই মৌলিক ধারণাগুলোর আবেদন হবে দেশের সকলের নাগরিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম উপাদান। অর্থাত্ তাঁর সবচেয়ে বড় চাওয়া দেশের সকল নাগরিকের জন্য একটি সুখী, সমৃদ্ধ, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবে এমন বাংলাদেশ। ২০২৫ সাল নাগাদ এই লক্ষ্য অর্জনে দেশপ্রেমিক সকলকে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
লেখক : মীর মোফাখখারুল আলম