গ্রামের নাম ধলঘাট। উপজেলা বোয়ালখালী। জেলা চট্টগ্রাম। একসময় তা ছিল পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত। ধলঘাট ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। এ গ্রামেই জন্মেছিলেন এশিয়ার প্রথম নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ব্রিটিশদের সঙ্গে সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীদের সরাসরি লড়াই হয়েছিল এ গ্রামেই। এখানেই নিহত হন ইংরেজ বাহিনীর প্রধান ক্যামেরুন এবং বিপ্লবী নেতা নির্মল সেন। শুধু বিপ্লবধন্যই নয়, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, আধুনিক বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের পথিকৃত কবি ভাস্কর শশাঙ্ক মোহন সেনের জন্মও এই ধলঘাট গ্রামে।
ইতিহাসবহুল সেই ধলঘাট গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন বীরেন্দ্রলাল সেন। যিনি ব্রিটিশ শাসনামলেই ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ছিলেন। আর এই বীরেন্দ্রলাল সেনের সন্তান আজকের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিক্ষক, অধ্যাপক ড. অনুপম সেন। যিনি শৈশবে বিখ্যাত বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসা ও পরিচয় ঘটারও আগে আঁতুরঘরেই পেয়েছিলেন বিপ্লবের ছোঁয়া। বিপ্লবী প্রীতিলতার মা ছিলেন অধ্যাপক সেনের ধাইমা। পরবর্তীকালে যখন তিনি জেনেছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মা তাঁর ধাইমা ছিলেন তখন গর্বে তাঁর বুকটা ভরে উঠেছে ।
১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডের পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন অনুপম সেন। বাবা বীরেন্দ্রলাল সেন, মা স্নেহলতা সেন। তাঁদের দু’জনের কেউই আজ আর বেঁচে নেই। বাবা পেশায় ছিলেন আইনজীবী। পারিবারিক সূত্রে কবি নবীন সেন, কবি গুণাকর নবীন দাশ, বিখ্যাত পর্যটক ও তিব্বত বিশেষজ্ঞ শরৎচন্দ্র, কবি ভাস্কর শশাঙ্কমোহন সেন প্রমুখ বিদ্বজ্জন ছিলেন তাঁর পূর্বসুরি, নিকটজন। ফলে শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জ্যোতিতে স্নাত হওয়ার সুযোগ ঘটে তাঁর শৈশব থেকেই।
অনুপম সেনের জন্মের কিছুদিন পরই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধের বিষবাষ্প তাঁর জীবনেও ছায়া ফেলে। ১৯৪২-৪৩ সালের দিকে জাপানিরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছুটা এবং বার্মা দখল করে এ উপমহাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে পৌঁছে যায়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যেমন রেলওয়ে স্টেশন, বিমান বন্দর ইত্যাদিতে তারা বোমা বর্ষণ করে। ফলে বেশ কিছু লোক হতাহত হয়। জাপানি আগ্রাসন ও বোমার ভয়ে চট্টগ্রাম শহর প্রায় খালি হয়ে যায়। অধ্যাপক সেনদের পরিবার তখন শহর ছেড়ে আশ্রয় নেন গ্রামের বাড়ি, ধলঘাটে। ওইসময় শৈশবের কয়েক বছর গ্রামেই কাটে তাঁর। যুদ্ধ থেমে গেলে আবার চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে।
মাত্র আট বছর বয়সে পিতৃহারা হওয়ার পর মায়ের অভিভাবকত্বেই পথ চলতে থাকেন অনুপম সেন। শৈশবেই তাঁর সঙ্গীতপিপাসু বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর এই দিদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত। বয়সে কল্পনা কিছুটা বড় হলেও দু’জনের মধ্যে গভীর সখ্য ছিল। তাঁর সেজদিদি মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর সেই দিদি তাঁকে খুব আদর করতেন। তাঁর মৃত্যুর কথা মনে করতে গিয়ে যতীন্দ্র মোহন বাগচীর ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটি তাঁর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে।
১৯৪৭ পরবর্তী চট্টগ্রাম শহরের স্মৃতিটাই তাঁর মনে বেশি উজ্জ্বল। সে সময় চট্টগ্রাম ছিল অসাধারণ সুন্দর এক শহর। বেশিরভাগ পথ ছিল সুরকির। প্রায় প্রত্যেকটি পথের পাশে ছিল অনেক গাছ, খালি মাঠ, পুকুর ও দীঘি। রাস্তায় মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি দেখা যেত। মোটরগাড়ি কম থাকলেও ঘোড়ার গাড়ি ছিল প্রচুর। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ার মজাই ছিল আলাদা, বেশ আরামের। অধ্যাপক সেনের আবাসস্থল নালাপাড়া থেকে তখনকার নগরীর কেন্দ্রস্থল আন্দরকিল্লা পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া ছিল মাত্র দু’ টাকা। স্মৃতি হাতড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঠে মাঠে ঘুরে বেরিয়েছি, বৃষ্টিতে ভিজে খেলেছি। পুকুরে-নদীতে সাঁতার কেটেছি। কৈশোরে দলবেঁধে কর্ণফুলী নদী সাঁতরে পার হয়েছি। কর্ণফুলী তখন আজকের মতো দূষিত ছিল না। বহু সকাল-সন্ধ্যা বন্ধুদের নিয়ে কাটিয়েছি সদরঘাট ব্রিজে। কাছাড়ি পাহাড় ছিল প্রকৃতির এক লীলাভূমি। পাহাড়ের অসংখ্য গাছের মাঝখানে ছিল বিশাল এক বটগাছ। তার চারপাশটা ছিল বাঁধানো। সেখানে বসে আমরা কত সকাল-সন্ধ্যা খেলাধুলা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আড্ডা ও তর্কে মশগুল থাকতাম, তা এখনো ভোলা যায় না।’
এসব সুখস্মৃতির পাশাপাশি কিছু কষ্টের স্মৃতিও তাঁর মনে অহর্নিশ জেগে আছে। তারই একটি হলো- চট্টগ্রাম শহরের নালাপাড়া এলাকার পৈতৃক বাড়িটি প্রথমে ব্রিটিশ সরকার এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার অধিগ্রহণ করার বিষয়টি। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে উচ্চ রক্তচাপে ভুগে অকালে তাঁর বাবার মৃত্যুকেও এই বাড়ি হারানোর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মনে করতেন তাঁর মা।
শহরে জন্ম হলেও অনুপম সেনের স্কুলের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে, ধলঘাট ইংলিশ হাই স্কুলে। স্কুলের সামনেই ছিল বিশাল পুকুর, যার জল ছিল খুব স্বচ্ছ। পানির ওপর থেকে মাছের লুকোচুরি খেলা দেখা যেত।এ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। এরপর ১৯৪৭ সালে পুনরায় শহরে ফিরে এসে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে, তৃতীয় শ্রেণীতে। বছর দু’তিন যেতে না যেতেই ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে ছোটখাট একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সেজন্য তাঁর মা তাঁকে দিদিসহ মামার কাছে পাঠিয়ে দেন, কলকাতায়। তাঁর মামা ছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রসায়নের অধ্যাপক। মামার তত্ত্বাবধানে তাঁরা দু’জন ছিলেন ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। ওখানে পড়াশোনা করেন এলগ্রীন রোডে সুভাষ বোসের বাড়ির পাশে সেন্ট ক্যাথিড্র্যাল মিশনারী স্কুলে। পরে সেখান থেকে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল এইচ ই স্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সমাজতত্ত্বে ১৯৬২ সালে বি.এ. (সম্মান) ও ১৯৬৩ সালে এম.এ. পাস করেন।
পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ভর্তি হন কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি ১৯৭৫ সালে সমাজতত্ত্বে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করে পিএইচ.ডি. প্রোগ্রামে ভর্তি হন। এবং ১৯৭৯ সালে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল : ‘দি স্টেট, ইনডাস্ট্রিলাইজেশন এন্ড ক্লাস ফরমেশনস ইন ইন্ডিয়া’।
বেশ চমকপ্রদই বলা যায় অনুপম সেনের কর্মজীবনের শুরুটা। ১৯৬৫ সালের মার্চে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানের বুয়েট) সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরের বছরের মার্চে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে, প্রভাষক হিসেবে। আড়াই বছরের মতো সেখানে শিক্ষকতার পর তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে যুক্তরাজ্য যান। কিন্তু পারিবারিক কারণে কয়েক মাসের মাথায় দেশে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষা সহায়ক ও টিউটরের দায়িত্ব পালন করেন। প্রসঙ্গত, ওই সময়ে তিনি ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আবার তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেন। ওই বছরের নভেম্বর মাসেই সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ ও ১৯৮৪ সালের জুন মাসে অধ্যাপক হন। ২০০৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ১৯৮১-৮৪ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)-এর সমাজতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি এবং ১৯৮৪-৮৬ পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডীনের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭১-৭২ সালে চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ১৯৮৫-৮৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি, ১৯৮৫-৮৬ সালে চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি, ১৯৮৮-৯২ সালে বাংলাদেশ সমাজতত্ত্ব সমিতির সভাপতি এবং ২০০০-২০০১ সালে চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। অন্যদিকে বিভিন্ন সংস্থা ও কমিটিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর অনারারি সিনিয়র ফেলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) খণ্ডকালীন সদস্য, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য এবং কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য।
কর্মজীবনের শুরুর দিকে কলেজে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। এম.এ. পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন নিয়মিত তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ক্লাস নিয়েছিলেন, পরে বুয়েটে ও ঢাবিতে শিক্ষকতার সময়ও ছুটি পেলেই চট্টগ্রাম গিয়ে সিটি কলেজে ক্লাস নিতেন। ফলে সিটি কলেজের সঙ্গে তাঁর এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পরদিনই অর্থাৎ ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে তিনি বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম-এর উপচার্য হিসেবে যোগ দেন এবং এখনও পর্যন্ত তিনি সেখানে কর্মরত আছেন।
অধ্যাপক সেন দুটো জায়গায় অত্যন্ত উজ্জ্বল। প্রথমত, তাঁর একাডেমিক ক্ষেত্রে, যেখানে তাঁর পরিচিতি বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও বিস্তৃত হয়েছে। বিশেষভাবে তাঁর আলোচিত গ্রন্থ ‘দি স্টেট, ইনডাস্ট্রিলাইজেশন এন্ড ক্লাস ফরমেশনস ইন ইন্ডিয়া’ ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা প্রকাশক রাউটলেজ ও কেগানপল থেকে প্রকাশের পর ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে তাঁর পরিচিতি বৃদ্ধি পায়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ড. সেনের এই বইটি রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি গবেষণাক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর তত্ত্বাবধানে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী উচ্চতর পড়াশোনা করেছে, এম.ফিল. ডিগ্রি অর্জন করেছে। তিনি বহিঃস্থ (এক্সটার্নাল) সদস্য হিসেবে বিভিন্ন পিএইচ.ডি. গবেষকের থিসিস যেমন মূল্যায়ন করেছেন তেমনি গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছেন অনেকের।
শিক্ষকতা ও সাংগঠনিক কাজের বাইরে নিবিড় সাধনায় লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন ড. অনুপম সেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে তাঁর গবেষণা নিবন্ধ যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই বেশ কিছু গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে তিনি শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের নানা শাখায়ও লেখালেখি করে থাকেন। তাঁর রচিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘দি স্টেট, ইনডাস্ট্রিলাইজেশন এন্ড ক্লাস ফরমেশনস ইন ইন্ডিয়া’ (১৯৮২), ‘পলিটিক্যাল এলিটস অফ পাকিস্তান এন্ড আদার সোশিওলজিক্যাল এসেস’ (১৯৮৩), ‘বাংলাদেশ : রাষ্ট্র ও সমাজ-সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ’ (১৯৯৯), ‘বাংলাদেশ ও বাঙালী রেনেসাঁস: স্বাধীনতা চিন্তা ও আত্মানুসন্ধান’ (২০০২), ‘বিলসিত শব্দগুচ্ছ: প্রতীচী ও প্রাচ্যের কয়েকটি কালজয়ী কবিতার অনুবাদ’ (২০০২), ‘সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য : নানা কথা নানা ভাবনা নানা অর্ঘ্য’ (২০০৭), ‘দি পলিটিক্যাল ইকোনোমি অফ বাংলাদেশ’।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পুরস্কার, সম্মাননা এবং সংবর্ধনা পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে- সমাজবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য একুশে মেলা পরিষদ-চট্টগ্রাম-এর একুশে পদক-২০০৭, আলোকিত বোয়ালখালীর বর্ষপূর্তি সংবর্ধনা ২০০৭, অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী-চট্টগ্রাম-এর অবসর সাহিত্য পুরস্কার ২০০৭, লায়ন্স ক্লাব ও রোটারী ক্লাব-এর সম্মাননা ২০০৭, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন-এর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সম্মাননা ২০০৬, পটিয়া সমিতি-চট্টগ্রাম-এর গুণীজন সংবর্ধনা ২০০৬, জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক ইকো-ট্যুরিজম বর্ষ উপলক্ষে ইউনাইটেড নেশনস ডে অ্যাওয়ার্ড ২০০২, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী পূর্তি সংবর্ধনা ২০০৭, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির চট্টগ্রাম সম্মিলন ২০০১, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের গুণীজন সংবর্ধনা ১৯৯৯, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সংবর্ধনা ১৯৯৫, চট্টগ্রাম পরিষদ-কলকাতার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সম্মাননা, ধ্রুব পরিষদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মাননা এবং শাপলা সংঘের গুণীজন সংবর্ধনা উল্লেখযোগ্য।
স্ত্রী উমা সেনগুপ্তার সঙ্গে ড.অনুপম সেনের বিয়ে হয় ১৯৬৬ সালে। উমা একজন গৃহিণী, অত্যন্ত ধার্মিক। বিপরীতে ড. সেন ধর্মাচার পালনে অনেকটাই উদাসীন। একমাত্র মেয়ে ইন্দ্রানী সেন গুহ।
অনুপম সেন বেশ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সাংবাদিকতাসহ নানা পেশা ও কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সঙ্গে তাঁর বেশ খাতির। আড্ডায় বসলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া অবসর কাটান বই পড়ে, টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখে। ক্রিকেট খেলাটা ড. সেনের বেশ প্রিয়। শৈশব থেকে ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পৃক্ততা। কিশোর বয়সে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজ টিমের সদস্য হিসেবে ক্রিকেট খেলেছেন। ব্যাটিং ওপেন করতেন তিনি। ক্রিকেট খেলায় নানা নৈপুণ্যের জন্য তিনি বহু প্রশংসা লাভ করেছেন এবং পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন।
জ্ঞানের আলো ছড়ানোর অভিপ্রায়ে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ড.অনুপম সেন। দীর্ঘ ৪৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পথেই রয়েছেন। পাশাপাশি জড়িত থেকেছেন সাংগঠনিক নানা কাজের সঙ্গেও। অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন ছাত্রদের উন্নয়ন সাধনে। শুধু ক্লাসরুমে জ্ঞানদানেই সন্তুষ্ট না থেকে নিজের ভাবনাসিন্ধুকে, দেশ ও মানুষের কল্যাণে ছড়িয়ে দিতে নিয়মিত লেখালেখিও চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর অনেক লেখা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশবিভুঁইয়েও সমাদৃত হচ্ছে। এ যে দেশেরই গৌরব।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
জন্ম :
১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডের পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন অনুপম সেন। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানাধীন ধলঘাট গ্রামে, একসময় এই গ্রাম ছিল পটিয়া থানার অন্তর্গত।
পরিবার-পরিজন:
বাবা বীরেন্দ্রলাল সেন, মা স্নেহলতা সেন। তাঁদের দু’জনের কেউই আজ আর বেঁচে নেই। বাবা পেশায় ছিলেন আইনজীবী, সেই ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। স্ত্রী উমা সেনগুপ্তা। একমাত্র মেয়ে ইন্দ্রানী সেন গুহ।
পড়াশুনা:
স্কুলের পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে, ধলঘাট ইংলিশ হাই স্কুলে। এ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। এরপর ১৯৪৭ সালে শহরে ফিরে এসে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে, তৃতীয় শ্রেণীতে। বছর দু’তিন যেতে না যেতেই ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে ছোটখাট একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সেজন্য তাঁর মা তাঁকে দিদিসহ মামার কাছে পাঠিয়ে দেন, কলকাতায়। ছিলেন ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। ওখানে সেন্ট ক্যাথিড্র্যাল মিশনারী স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল এইচ ই স্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সমাজতত্ত্বে ১৯৬২ সালে বি.এ. (সম্মান) ও ১৯৬৩ সালে এম.এ. পাস করেন।
পরবর্তীতে কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে সমাজতত্ত্বে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করে পিএইচ.ডি. প্রোগ্রামে ভর্তি হন। এবং ১৯৭৯ সালে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল : ‘দি স্টেট, ইনডাস্ট্রিলাইজেশন এন্ড ক্লাস ফরমেশনস ইন ইন্ডিয়া’।
কর্মজীবন:
১৯৬৫ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানের বুয়েট) সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে, প্রভাষক হিসেবে। আড়াই বছরের মতো সেখানে শিক্ষকতার পর যুক্তরাজ্যে যান। কিন্তু পারিবারিক কারণে দ্রুতই দেশে ফিরেন। ১৯৬৯ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, সমাজতত্ত্ব বিভাগে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষা সহায়ক ও টিউটরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে পিএইডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেন। ওই বছরের নভেম্বর মাসেই সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ ও ১৯৮৪ সালের জুন মাসে অধ্যাপক হন। ২০০৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে তিনি বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম-এর উপচার্য হিসেবে যোগ দেন এবং অদ্যাবধি কর্মরত আছেন।
লেখালেখি:
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে তাঁর গবেষণা নিবন্ধ যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনি বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই বেশ কিছু গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে তিনি শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের নানা শাখায়ও লেখালেখি করে থাকেন। তাঁর রচিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘দি স্টেট, ইনডাস্ট্রিলাইজেশন এন্ড ক্লাস ফরমেশনস ইন ইন্ডিয়া’ (১৯৮২), ‘পলিটিক্যাল এলিটস অফ পাকিস্তান এন্ড আদার সোশিওলজিক্যাল এসেস’ (১৯৮৩), ‘বাংলাদেশ : রাষ্ট্র ও সমাজ-সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ’ (১৯৯৯), ‘বাংলাদেশ ও বাঙালী রেনেসাঁস: স্বাধীনতা চিন্তা ও আত্মানুসন্ধান’ (২০০২), ‘বিলসিত শব্দগুচ্ছ: প্রতীচী ও প্রাচ্যের কয়েকটি কালজয়ী কবিতার অনুবাদ’ (২০০২), ‘সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য : নানা কথা নানা ভাবনা নানা অর্ঘ্য’ (২০০৭), ‘দি পলিটিক্যাল ইকোনোমি অব বাংলাদেশ’।
পুরস্কার, সম্মাননা ও সংবর্ধনা:
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পুরস্কার, সম্মাননা এবং সংবর্ধনা পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে-একুশে মেলা পরিষদ-চট্টগ্রাম-এর একুশে পদক-২০০৭, আলোকিত বোয়ালখালীর বর্ষপূর্তি সংবর্ধনা ২০০৭, অবসর সাহিত্য পুরস্কার ২০০৭, লায়ন্স ক্লাব ও রোটারী ক্লাব-এর সম্মাননা ২০০৭, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সম্মাননা ২০০৬, পটিয়া সমিতি-চট্টগ্রাম-এর গুণীজন সংবর্ধনা ২০০৬, ইউনাইটেড নেশনস ডে অ্যাওয়ার্ড ২০০২, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী পূর্তি সংবর্ধনা ২০০৭, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির চট্টগ্রাম সম্মিলন ২০০১, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের গুণীজন সংবর্ধনা ১৯৯৯, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সংবর্ধনা ১৯৯৫, চট্টগ্রাম পরিষদ-কলকাতার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সম্মাননা, ধ্রুব পরিষদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মাননা এবং শাপলা সংঘের গুণীজন সংবর্ধনা উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসহযোগিতা নেওয়া হয়েছে-অনুপম সেনের সাক্ষাৎকার (দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ জুন ‘৯৯), নানা রঙের দিনগুলি-৪, আলোকিত চট্টগ্রাম (দৈনিক প্রথম আলো, ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৭), অনুপম সেনের সাক্ষাৎকার (পাক্ষিক চট্টলচিত্র, বর্ষ-১, সংখ্যা-৭, ১৫ জুন ২০০০), নানা রঙের দিনগুলি-৪, আলোকিত চট্টগ্রাম (দৈনিক প্রথম আলো, ২৫ অক্টোবর ২০০৭।
মূল লেখক : শাহাব উদ্দিন নীপু
পুনর্লিখন : সফেদ ফরাজী