‘মেয়েকে কি এমন জজ-ব্যারিস্টার বানাইবে যে এতো লেখাপড়া শিখাইতেছ।’ হামিদা খানমের বড় চাচা মৌলভী আবদুল হামিদ খাঁ তাঁর বাবাকে লেখা চিঠিতে উপরের এই উক্তিটি করেছেন।
বি.এ. পাশ করার পর হামিদা খানম ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবারো হোস্টেল জীবন। বিখ্যাত ডান্ডাস হোস্টেল। তবে এখানকার মুক্ত পরিবেশ যেন অনেক বেশি উদার। ছেলেমেয়ে একসাথে পড়াশোনা করছে। কিন্তু হামিদার বড় চাচা মৌলভী আবদুল হামিদ খাঁ এতে খুবই আপত্তি করলেন। তিনি রেগে গিয়ে হামিদা খানমের বাবাকে চিঠি লিখে উপরের উক্তিটি করলেন। শুধু নিজের পরিবারেই নয়, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও অনেকেই এরকম ধারণা পোষণ করতেন। কারণ তখনকার দিনে মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করা বারণ ছিল। কিন্তু এসব বাধা হামিদা খানমের পড়াশুনা থামিয়ে দিতে পারেনি। তিনি নিজে বা তাঁর বাবা-মা কেউই এসব বিষয়ে বিচলিত হননি। আর তাই সকল বাধা অতিক্রম করে তিনি তাঁর পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে সমাজে স্থান করে নিয়েছেন।
হামিদা খানমের জন্ম রাজশাহীতে ১৯২৩ সালের ২ জানুয়ারি। তাঁদের আদিবাড়ি ফরিদপুর জেলায়। বাবা আবদুস সামাদ খাঁ ছিলেন সরকারি স্কুল পরিদর্শক। ফলে তিনি তাঁর চাকুরি জীবনের পুরো সময়টাই প্রায় ছিলেন রাজশাহী ও পাবনা শহরে। হামিদা খানমের শিক্ষা জীবন শুরু হয় পাবনার গার্লস স্কুলে। হামিদার মা হাসিনা খাতুন সামাজিক বিধি নিষেধের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজে খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু তিনি চাইতেন তাঁর ছেলে- মেয়েরা যেন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। হাসিনা খাতুন তাঁর নিজের জীবনে যে সাধ পূরণ করতে পারেননি, ছেলেমেয়েদের মধ্য দিয়ে তিনি সেই স্বপ্নকে সফল করতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তাঁকে পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও অনেক বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে।
বস্তুত তখনকার মুসলমান পশ্চাৎপদ সমাজে জেঁকে বসেছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি। কিন্তু হামিদা খানমদের পরিবারটি ছিল এসব গোঁড়ামির বাইরে। সেইসময়ে মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া প্রায় নিষেধই ছিল। যারা স্কুলে পড়ত তাদেরও খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যেত। ফলে শিক্ষা-দীক্ষা কী জিনিস তা তাদের বোধেই আসত না। কিন্তু হামিদা খানম আর তাঁর বড় বোন, মা ও খালার উৎসাহেই এসব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর খালা কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ছিলেন খুবই সাহসী। তিনি সেই সময়ে তাঁদেরকে গানের অনুষ্ঠান বা বিশেষ কোনো কর্মসূচিতে নিয়ে যেতেন। কবি মাহমুদা খাতুন নিজে নানা সাহিত্য-সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন তখন। তিনি বছরে দু’তিনবার পাবনা থেকে কলকাতায় যেতেন সাহিত্য সভায় যোগ দেয়ার জন্য। এই খালাই তাঁদেরকে নিয়ে গিয়েছিলেন পাবনায় মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষ বোসের জনসভা দেখানোর জন্য। আবার কখনোবা পরিবারের সবাই মিলে যেতেন সিনেমা দেখতে। তখন নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ। তাঁর নানা ছিলেন একজন বিদ্যোৎসাহী মানুষ।
পাবনার গালর্স স্কুলে প্রথমে ভর্তি হন হামিদা খানমের বড় বোন লিলি। পরে যিনি চিত্রশিল্পী মোহসিনা আলী নামে খ্যাতি অর্জন করেন। স্কুলের পরিবেশ দেখে ভাল লেগে যাওয়ায় তাঁর মা এই স্কুলে হামিদা খানমকেও ভর্তি করিয়ে দেন। তিনি তখন এতোটাই ছোট ছিলেন যে মাঝে মাঝেই ক্লাসে ঘুমিয়ে যেতেন। পরে অবশ্য হামিদা খানম দু’বার ডবল প্রমোশন পেয়ে ক্লাস থ্রি থেকে বড় বোন লিলির সঙ্গে একসাথেই পড়া শুরু করেন। ক্লাস ফোরে থাকতেই এই স্কুলের নাম হয়ে যায় পাবনা গার্লস এইচ ই স্কুল। ১৯৩৬ সালে এই স্কুল থেকেই হামিদা খানম মেট্রিক পাশ করেন।
তিনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন এদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন অনেকটাই তুঙ্গে। ছেলেদের সাথে মেয়েরাও নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অল্প অল্প করে অংশ নিচ্ছে। পাবনায় তখন একটি আখড়া ছিল যেখানে মেয়েদের আত্মরক্ষার্থে ছোরা খেলা, লাঠি খেলা ইত্যাদি শেখানো হতো। হামিদা খানম আর তাঁর বড় বোন লিলি সেখানে যেতেন। এক সময় স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাবে স্কুলের মেয়েরা সবাই বিলেতি কাপড়ের ফ্রক-পরা বন্ধ করে দিয়েছিল। ছাত্রীরা সবাই দেশি কাপড় পরে স্কুলে আসত। হামিদার মা সেসময় পাবনায় গরিব তাঁতীদের তৈরি করা তাঁতের শাড়ি পরতেন। যদিও তাঁরা ছিলেন বেশ স্বচ্ছল।
তাঁদের বাড়িতে সেসময় অনেক পত্র-পত্রিকা আসত। হামিদার মা বই পড়তে ভীষণ ভালবাসতেন। তিনি নিজে দু’টি পত্রিকা রাখতেন ‘বিচিত্রা’ আর ‘নবশক্তি’। এগুলো কলকাতা থেকে ডাকে আসত। কবি মাহমুদা সিদ্দিকার কাছে আসতো ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘মানসী’, ‘মর্মবাণী’, ‘উদয়ণ’, ‘খেয়ালি’, ‘অগ্রগতি’ ইত্যাদি। আর ঢাকা থেকে আসত ‘শান্তি’ ও ‘জয়শ্রী’। বাড়িতে মাসিক-সাপ্তাহিক পত্রিকার ছড়াছড়ি। এসব পত্রিকায় মাহমুদার কবিতা ছাপা হতো। তখন সকলকেই তিনি এসব আবৃত্তি করে শুনাতেন। এছাড়াও বাড়ির বড়দের জন্য কলকাতা থেকে আসত ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’ এবং ‘দি মুসলমান’। এছাড়া বাড়ি ভর্তি বিভিন্ন গানের ক্যাসেট তো ছিলই। হামিদার বড় ভাই প্রখ্যাত শিল্পী আবদুল আহাদ। তিনি নিজে কলকাতায় প্রখ্যাত পণ্ডিতদের কাছে গান শিখতেন। বাড়িতে এলেই বোনদের গান শেখাতেন। সেই সুবাদে হামিদার রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখা।
স্কুল জীবন শেষ করার পর হামিদার মা’র প্রবল ইচ্ছায় তাঁর বাবা তাঁকে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। থাকতেন কলেজেরই হোস্টেলে। তখন বেথুন কলেজ ছিল খুবই নামকরা। এর আগেও তিনি বেশ কয়েকবার কলকাতায় এসেছেন বাবা বা খালার সাথে। কিন্তু এবার একা। বেশ স্বাধীন মনে হল নিজেকে হামিদার। বড় ভাই আবদুল আহাদ অবশ্য তখন কলকাতায় গান গেয়ে বেশ নাম করেছেন। যদিও তখন মুসলমানদের মধ্যে গানের চর্চা একবারেই কম ছিল। সেসময় দু’জন মুসলমান গায়ক বেশ নাম করেছিলেন সঙ্গীত জগতে। একজন কে. মল্লিক। কে. মল্লিকের আসল নাম ছিল কাসেম মল্লিক। রেকর্ডে মুসলমান গায়কের নাম থাকলে বিক্রি কম হবে ভেবেই বোধহয় কে. মল্লিক লেখা হত। অপরজন পল্লীগীতির শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ।
হামিদাদের সময়ে মেয়েদের প্রাণ খুলে জোরে হাসাটা অনেকেই অশোভন মনে করত। কিন্তু বিপরীত দিকে বেথুন কলেজে পড়তে এসে হামিদা ছাত্রীদের মধ্যে ধর্মীয়-সামাজিক বাধা নিষেধ ভাঙ্গার একটা প্রবল উদ্যোম লক্ষ্য করলেন। কলেজের পরিবেশ, ছাত্রীদের চিন্তাভাবনা, পোষাক-পরিচ্ছদ সব মিলিয়ে যেন মেয়েরা যুগের চাইতে এগিয়ে চলেছে। কলেজে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রভাব বোঝা যেত না। কিন্তু ছাত্রীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। এর কারণ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন জোরদার হয়ে উঠেছে। আর তারই প্রভাব পড়েছিল ছাত্রীদের উপর। সেই যুগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে বেথুনের ছাত্রীদের একাত্মবোধ ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর একটা প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের ওপর পড়েছিল সন্দেহ নেই।
বেথুন কলেজের হোস্টেল জীবনে হামিদা বেশ ভাল ছিলেন। খেলাধুলা, দল বেঁধে মেট্টোতে ছবি দেখতে যাওয়া, কলেজের নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এ সবকিছুই তখন তাঁর মানসিক বিকাশে অনেক সহায়ক হয়েছিল। এখান থেকেই ১৯৩৮ সালে হামিদা খানম ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪১ সালে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর এম.এ. পড়ার জন্য ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা ছিল হামিদার জন্য একেবারেই নতুন পরিবেশে নতুন অভিজ্ঞতা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কলকাতা তখন অনেকটাই যুদ্ধের শহর। সারা বাংলা জুড়ে শুরু হয়ে গেছে দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষের চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের তুলি জীবন্ত করে রেখেছে আর তাঁর শিল্পকর্মকে করেছে অবিস্মরণীয়। এসব দৃশ্যই হামিদা প্রত্যক্ষ করেন কলকাতায়। যদিও তখন হোস্টেলের ছাত্রীদের এই দুর্ভিক্ষ একেবারেই নাগাল পায়নি। একই সঙ্গে ১৯৪২ সালেই শুরু হয় গান্ধীর নেতৃত্বে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন। ১৯৪২ সালেই হামিদা খানম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করেন। এরপর কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করেন।
কলকাতা লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ স্থাপিত হয় ১৯৩৯ সালে। এই সালেই বাংলার ইংরেজ গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্ন-এর স্ত্রী মারা যান। তাঁর নামেই এই কলেজের নামকরণ করা হয়। অ্যাডহক ভিত্তিতে কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই কলেজেই প্রথম চাকুরি শুরু করেন হামিদা খানম। ১৯৪৫ সালে ৫ জানুয়ারি কলেজে দর্শনের স্থায়ী প্রভাষক পদে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট দেশ বিভাগ হয়ে যায়। ১৩ আগস্ট হামিদা খানম কলেজে গিয়ে একটি অর্ডার পান। অর্ডারে তাঁকে ঢাকার ইডেন কলেজে যোগদান করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এর আগেই তিনি লণ্ডনে পড়তে যাওয়ার একটি স্কলারশিপ পেয়ে যান। ২২ তারিখেই তাঁর লণ্ডন যাবার কথা। ফলে বুঝতে পারলেন না কী করবেন। নিকটাত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁরা লণ্ডনে পড়তে যাওয়ার পরামর্শ দেন তাঁকে। সেই অনুয়ায়ী তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন দর্শনে অনার্স ছিল ইন্টার কলেজিয়েট কোর্স। ফলে সেসময় বেডফোর্ড, বারবেক, কিংস কলেজ ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে হামিদাকে পড়াশোনা করতে হয়। লন্ডনে দুই বছর ছিলেন তিনি। এই দুই বছরের ছাত্রী জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল। বদ্ধ সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে-ওঠা অধিকাংশ ছাত্রীকে কীভাবে মুক্ত মনের অধিকারী করা যায় শিক্ষক হিসেবে সেটাই হামিদা খানমের অন্যতম দায়িত্ব বলে মনে হতো।
১৯৪৬ সালেই কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার পর পরিচয় হয় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমেদের সাথে। সালাহউদ্দীন তখন ইন্ডিয়ান রেডক্রস সোসাইটিতে কাজ করেন, কুমিল্লায় থাকেন। সালাহ্উদ্দীন আহমেদ ছিলেন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মানবতাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। রাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট আন্দোলনের সমর্থক। ১৯৪৭ সালে আগষ্ট মাসে লণ্ডন যাওয়ার আগেই বিয়ের কথা হয় দুজনের। কিন্তু লণ্ডন থেকে ফিরে এসে বিয়ে করার কথা জানান হামিদা। দু’জনের সম্পর্ক ছিল অনেকটাই বন্ধুর মতো। শেষে ১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় বিয়ে করেন তাঁরা।
লন্ডন থেকে ফিরেই ১৯৪৮ সালের ৭ আগষ্ট হামিদা খানম ইডেন গার্লস কলেজে যোগদান করেন। তদানীন্তন বাংলাদেশে এটাই ছিল মেয়েদের একমাত্র সরকারি কলেজ। ১৯৫০ সালে ছাত্রীদের ভোটে কলেজ ইউনিয়নের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। তখন এক অদ্ভুত নিয়ম ছিল ইডেনে। কেউ নির্বাচনে দাঁড়াত না। ছাত্রীরা যাকে খুশি তাঁকে ভোট দিত। কেউ দশ ভোট পেত, কেউবা একটা ভোটও পেত না। ভিপি নির্বাচিত হয়েই তিনি কলেজে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ আরম্ভ করলেন। ১৯৫১ সালে তিনি দ্বিতীয়বার ভিপি নির্বাচিত হলেন।
১৯৫১ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর স্ত্রী একবার ইডেন কলেজ পরিদর্শনে আসেন। তিনি ছাত্রীদের মাঝে কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। তিনিও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাদের মতো উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললেন। এই কথা শোনামাত্রই ছাত্রীদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, পেছন থেকে বেশ কয়েকজন ছাত্রী সমবেত স্বরে ‘শেম শেম’ বলে ওঠে। এরপর মন্ত্রীর স্ত্রী বক্তৃতা না দিয়েই বেরিয়ে যান। হামিদা খানম তখন কলেজ ইউনিয়নের ভিপি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো ছাত্রীকে বহিষ্কার করা যাবে না।
১৯৫০ সালের প্রথম দিকে নারী নেত্রী বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের আগ্রহেই হামিদা খানম যুক্ত হন ‘অল পাকিস্তান ওমেনস্ এসোসিয়েশন’-এর পূর্ব পাকিস্তান শাখায়। এর আগে যদিও সংগঠনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তবু সকলে মিলে তাঁকে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকা বানিয়ে দিলেন। সংগঠনের সভানেত্রী হলেন তৎকালীন গভর্নরের স্ত্রী লেডি ফিরোজ খান নুন আর সহসভানেত্রী হলেন বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ। প্রথম দিকে সমাজকল্যাণমূলক কাজ করতে গিয়ে যতোটা ভয় পেয়েছিলেন কাজে নেমে তা কেটে গেল। অভিজ্ঞতার এক নতুন জগৎ খুলে গেল তাঁর সামনে। ১৯৫২ সালে অধ্যাপিকা হামিদা খানম ফুলব্রাইট ফেলোশিপ নিয়ে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির টিচার্স কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। সেসময় খুব আগ্রহ নিয়ে বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে লন্ডন, প্যারিস, রোম, জেনেভা হয়ে ঢাকা ফিরে আসেন। এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি আবার জাপান ভ্রমণ করেন। ইতিমধ্যে তিনি ইডেন কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
জাপান থেকে ফিরে এসে জানতে পারেন ঢাকায় হোম ইকোনমিক্স নামে একটি নতুন কলেজ হচ্ছে। সেখানে ইন্টারভিউ দিলেন। ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে তিনি নব প্রতিষ্ঠিত কলেজের অধ্যক্ষার পদে নিযুক্তি পান। এবং সাত দিনের মধ্যে রওনা দেন আমেরিকার হোম ইকোনমিক্স কলেজের প্রশাসন বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও ট্রেনিং নেয়ার জন্য। ১৯৬০ সালে দেশে ফিরে ৪ এপ্রিল নতুন কাজে যোগ দেন। শুরু হয় হামিদা খানমের কর্মজীবনের এক নতুন অধ্যায়। কাজটি যে বিশাল তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। তবে ব্যতিক্রমধর্মী এই কাজের ব্যাপারে তাঁর পরিশ্রমের কোনো অন্ত ছিল না। শুরু থেকেই তাঁকে সবকিছু গুছিয়ে নিতে হল এবং সফল হলেন। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে হামিদা খানম বিস্টলে ইন্টারন্যাশনাল হোম ইকোনমিক্স কনফারেন্স-এ যোগদান করেন। অধ্যাপিকা হামিদা খানমকে ১৯৬৯ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড-এ ভূষিত করে।
ইতিমধ্যে অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থির হয়ে উঠে। মূলত ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই সারা বাংলার আবহাওয়া গরম হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রথম হত্যাকাণ্ড চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হামিদা খানম তখন পরিবার নিয়ে হোম ইকোনমিক্স কলেজের ভেতরে একটি কোয়ার্টারে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেটা কয়েক হাতের দূরত্ব। ফলে সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারকীয় তাণ্ডব দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ইকবাল হলের আশেপাশে গুলি, মেশিনগান, মর্টারের শব্দে কান পাতা দায়। সারা ক্যাম্পাস জুড়ে শুধুই আগুন। যেন মৃত্যু উপত্যকা। সবাই ঘরের বাইরে কান পেতে বসে থাকেন। সারা রাত মৃত্যু আতঙ্কে কাটে সবার। ভোরে কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মি বাড়ির গেইটে এসে আঘাত করতে শুরু করে। ভিতর থেকে তখন গেইট খুলে দেওয়া হয়। জোয়ানরা তেমন কিছু না করেই চলে যায়। এরপর আরো একদিন আসে পাকিস্তানি হানাদাররা। কিন্তু সেদিনও মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যায় হামিদা খানমের পরিবার। শেষে কলেজ কোয়ার্টার ছেড়ে চলে আসেন ইস্কাটনে বড় ভাইয়ের বাসায়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো মাসটিই জীবন-মৃত্যুকে সাথী করে ঢাকায়-ই ছিলেন তিনি এবং তাঁর পরিবার।
হামিদা খানম ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। তারপর দুই বৎসর তিনি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১১ সালের ১৮ই মার্চ অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: হামিদা খানমের জন্ম রাজশাহীতে ১৯২৩ সালের ২ জানুয়ারি।
বাবা-মা: বাবা আবদুস সামাদ খাঁ ছিলেন সরকারি স্কুল পরিদর্শক। মা হাসিনা খাতুন।
পড়াশুনা: পাবনা গার্লস এইচ ই স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে হামিদা খানম মেট্রিক পাশ করেন। স্কুল জীবন শেষ করার পর হামিদার মার প্রবল ইচ্ছায় তাঁর বাবা তাঁকে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। থাকতেন কলেজেরই হোস্টেলে। এখান থেকেই ১৯৩৮ সালে হামিদা খানম ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫১ সালে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর এম.এ. পড়ার জন্য ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪২ সালেই হামিদা খানম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করেন। এরপর কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করেন।
কর্মজীবন: কলকাতা লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ স্থাপিত হয় ১৯৩৯ সালে। এই সালেই বাংলার ইংরেজ গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্ন-এর স্ত্রী মারা যান। তাঁর নামেই এই কলেজের নামকরণ করা হয়। অ্যাডহক ভিত্তিতে কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই কলেজেই প্রথম চাকুরি শুরু করেন হামিদা খানম। ১৯৪৫ সালে ৫ জানুয়ারি কলেজে দর্শনের স্থায়ী প্রভাষক পদে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করেন। লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৪৮ সালের ৭ আগষ্ট হামিদা খানম ইডেন গার্লস কলেজে যোগ দেন।
১৯৫০ সালের প্রথম দিকে নারী নেত্রী বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের আগ্রহেই হামিদা খানম যুক্ত হন ‘অল পাকিস্তান ওমেনস্ এসোসিয়েশন’-এর পূর্ব পাকিস্তান শাখায়। এর আগে যদিও সংগঠনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তবু সকলে মিলে তাঁকে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকা বানিয়ে দিলেন। তিনি ইডেন কলেজে ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
জাপান থেকে ফিরে এসে জানতে পারেন ঢাকায় হোম ইকোনমিক্স নামে একটি নতুন কলেজ হচ্ছে। সেখানে ইন্টারভিউ দিলেন। ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে তিনি নব প্রতিষ্ঠিত কলেজের অধ্যক্ষার পদে নিযুক্তি পান। হামিদা খানম ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।
বিয়ে: ১৯৪৬ সালেই কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার পর পরিচয় হয় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমেদের সাথে। সালাহ্উদ্দীন তখন ইন্ডিয়ান রেডক্রস সোসাইটিতে কাজ করেন, কুমিল্লায় থাকেন। সালাহ্উদ্দীন আহমেদ ছিলেন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মানবতাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। রাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট আন্দোলনের সমর্থক। ১৯৪৭ সালে আগষ্ট মাসে লন্ডন যাওয়ার আগেই বিয়ের কথা হয় দুজনের। কিন্তু লন্ডন থেকে ফিরে এসে বিয়ে করার কথা জানান হামিদা। দু’জনের সম্পর্ক ছিল অনেকটাই বন্ধুর মতো। শেষে ১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় বিয়ে করেন তাঁরা। এই দম্পতি নিঃসন্তান।
পুরস্কার: অধ্যাপিকা হামিদা খানমকে ১৯৬৯ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড-এ ভূষিত করে।
মৃত্যু: হামিদা খানম ২০১১ সালের ১৮ই মার্চ অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: লেখাটি তৈরীর জন্য হামিদা খানম ও ড. সালাহ্উদ্দিন আহমেদ-এর সাক্ষাৎকার (জানুয়ারী, ২০১০) এবং হামিদা খানমের রচিত স্মৃতিলিপি ‘ঝরা বকুলের ঘ্রাণ’ (প্রকাশক – সাহিত্য প্রকাশ, প্রকাশকাল – ফেব্রুয়ারী, ২০০১) থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।
লেখক : চন্দন সাহা রায়