ড. সফিউদ্দিন আহমদের বাবা মোঃ আবদুস সামাদ মোল্লা কংগ্রেস পার্টি করতেন। বই কেনা, বই পড়া ও যত্নের সাথে বই সাজিয়ে রাখা ছিলো তাঁর বড়ো সখ। কয়েক হাজার বই নিয়ে তাঁদের পারিবারিক পাঠাগার। তাঁর কংগ্রেসপন্থী ও শিক্ষক বাবা সেদিনকার মডার্ণ বিভিউ, ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বসুমতি, শনিবারের চিঠি নিয়মিত রাখতেন এবং এসব পত্রিকা তিনি বাঁধিয়ে সাজাতেন। আজও তাঁদের বাড়ির পারিবারিক পাঠাগারে এসব পত্রিকা আছে।
স্কুল জীবন থেকেই বাবার মতো ড. সফিউদ্দিন আহমদেরও বই কেনা এবং পড়ার নেশা ছিল। আট-দশ মাইল দূর থেকে পায়ে হেঁটে বই আনতেন তিনি। ছাত্র জীবনে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষার ‘ফি’ না দিয়ে ঐ টাকায় বই কিনেছেন তিনি। অধ্যাপনা জীবনেও বাজার করতে গিয়ে বাজারের টাকায় বই কিনে বাজারপত্র না নিয়েই ফিরেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও আছে কয়েক হাজার বই। তবে শুধু নিজে বই পড়েই খান্ত হননি। গ্রামের মানুষরা যেন বই পড়ার সুযোগ পায় সেজন্য খালবিল পার হয়ে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে পাঠাগার স্থাপন করেছেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও সংগঠক ড. সফিউদ্দিন আহমদ। গ্রামীণ পাঠাগার আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ড. সফিউদ্দিন আহমদ ১৯৪৩ সালে তাঁদের পুরানো বাড়ি বাহের চরে ১৯ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর স্থায়ী আবাস রায়পুরা সদরে ‘ছায়াবীথি’ নামক ইতিহাস বিখ্যাত বাড়িতে। প্রগতিশীল কর্মকাণ্ড ও সংস্কৃতি চর্চা বিশেষকরে সঙ্গীত চর্চার জন্য এই বাড়িটি তখনকার গুণী ব্যক্তিত্বদের কাছে পরিচিতি ছিলো। আজও এ বাড়িটি এ আদর্শের উত্তাপ বুকে ধারণ করে আছে। এই বাড়িতে এসেছিলেন সরোজিনী নাইডু, শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সত্যেন সেন, জীতেন ঘোষ, জ্ঞান চক্রবর্তী, জসীম উদ্দিন মন্ডলসহ আরো অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। প্রগতিশীল নেতাকর্মী ও আত্মগোপনকারীদের জন্য এই বাড়িটি ছিলো একটি নিরাপদ দুর্গ । এদেশের অনেক বিখ্যাত আত্মগোপনকারী কমিউনিষ্ট নেতা-কর্মীরা এবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর বাবা মোঃ আবদুস সামাদ মোল্লা কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষকতা ও কংগ্রেস পার্টির কর্মকান্ডের সাথে সাথে তিনি সমাজ সেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর মা বদরুন্নেসা প্রগতিশীল আত্মগোপনকারী নেতাকর্মীদের আশ্রয় দিতেন। এবং তিনি একজন সমাজ সচেতন মহিলা ছিলেন।
স্কুল জীবন থেকেই সফিউদ্দিন আহমদ বামপন্থী নেতা কর্মীদের সাথে একাত্মতায় ন্যাপ, কৃষক সমিতি, কমিউনিষ্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়নের জন্য কাজ করেছেন। তাঁর কিশোর মনে আবেগ সৃষ্টি করতো রায়পুরায় পদসঞ্চারী মৌলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সোমেন চন্দ, কবি বেনজির আহমদ, রবি নিয়োগী, খোকা রায়, অমূল্য লাহিড়ী, দেবপ্রসাদ, মদন বসাক, অনিল মুখার্জী, জসিম মন্ডল, সুনীল রায়, জিতেন ঘোষ, সত্যেন সেন, হাতেম আলী খান, জ্ঞান চক্রবর্তী প্রমুখ গুণী ব্যক্তিত্ব।
স্কুলে পড়ার সময় তিনি তাঁর ভাই শামসুল হক, আবদুল হাই, রামানন্দ, রহমান প্রমুখের কাছে যখন লেনিন ও রুশ বিপ্লবের কথা এবং সমাজতন্ত্র ও কমিউনিষ্ট পার্টির গোপন সভা ও বৈপ্লবিক বিজয়ের কথা শুনতেন তখন তাঁর মনে হতো, আমি নিজেই বিপ্লবী হবো এবং ‘স্পন্দিত বুকে আমি নিজেই লেনিন।
বামপন্থীদের প্রচেষ্টায় তখন রায়পুরায় প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা সম্পর্কিত পড়াশুনার একটা পরিবেশও গড়ে উঠেছিল। হাতে লেখা কিছু পত্রিকা চালাচালি হতো। এর মধ্যে ‘শিখা’ পত্রিকার নাম আজও সফিউদ্দিন আহমদের হৃদয়ে উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে। ‘জানবার কথা’ সিরিজ নিয়ে তাঁদের মধ্যে তখন কাড়াকাড়ি হতো। বই পড়া ও পঠিত বইয়ের উপর আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলতো। ‘ছোটদের অর্থনীতি’ ‘ছোটদের রাজনীতি’ গোগ্রাসে পড়েছেন তিনি । সুকান্তের ‘ছাড়পত্র’ তখন হাতে হাতে থাকতো। ‘আনন্দ মঠ’ ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদ’, ও ‘জিঞ্জির’ তখন তাঁদের গড়গড়ে মুখস্থ। অশোকগুহ অনূদিত গোর্কীর ‘মা’, তুর্গেনিয়েভের ‘অনাবদী জমি’, দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতীয় লোকায়ত দর্শন’, ‘নিষিদ্ধ দেশ ও নিষিদ্ধ কথা’, এসব ছাড়াও ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’ ও ‘প্রশ্নোত্তরে সোভিয়েত রাশিয়া’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলো তাঁর পড়া হয়ে গিয়েছিলো এই মহান বামপন্থীদের বদৌলতেই।
তখন ফয়েজ আহমদ এবং রামানন্দ মাঝে মাঝে তাঁদেরকে গোপন ক্লাসের কথা বলতেন। এই গোপন ক্লাসে দেশের কথা, মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা, পুঁজিবাদী শোষণের কথা আলোচনা হতো। সরদার ফজলুল করিম ও অন্যরা ক্লাস নেন গোপনে, রাতের অন্ধকারে গোপন জায়গায়। এসব কথা অন্য কারো কাছে বলা নিষেধ ছিলো। কৈশোরের প্রথমেই এমন কিছু গোপন ক্লাসে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো সফিউদ্দিন আহমদের। আর এসব ক্লাসে এমন সব মৌলিক বিষয় ও তথ্যসূত্র আলোচনা হতো যা সারাজীবন পড়াশুনা করেও উদ্ধার করা সম্ভব হতো না। অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, নৃ-বিজ্ঞান ও চিত্তসাহিত্যের উপর আলোচনা হতো। সমস্ত বিষয়ই তুলনামূলক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হতো।
মহান ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি মাত্র পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। এই সময় স্কুল থেকে যে বিরাট মিছিল বের হয়-এর অগ্রভাগে পতাকাবাহি ছিলেন আজকের গবেষক সাহিত্যিক, প্রফেসর ড. সফিউদ্দিন আহমদ। রায়পুরা নিয়ে ড. সফিউদ্দিন আহমদের গর্বের সীমা নেই। কেউ রায়পুরা নামটি উচ্চারণ করলেই তিনি উচ্ছ্বসিত ও আবেগ প্রবণ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, রায়পুরা আমার বাড়ি- আমার জন্মস্থান। রায়পুরার মাটি আমার কপালে গৌরবোজ্জ্বল এক পবিত্র তিলক।
অতীতে রায়পুরা ছিলো মেঘনা নদী বিধৌত একটি বিখ্যাত নদী বন্দর। কলকাতা, আসাম ও বার্মার সাথে ছিলো নৌপথে ব্যবসা বাণিজ্য। বড়ো বড়ো স্টিমার এসে ভিড়তো এ নদী বন্দরে। সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে চলতো সঙ্গীত চর্চা। সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় রায়পুরায় তখন কলকাতা কেন্দ্রিক একটি আবহ গড়ে উঠেছিলো। বিশ্বনন্দিত সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কৈশোর ও যৌবনের অনেক উচ্ছল দিন কেটেছে এ রায়পুরায়। রায়পুরার জমিদাররা যখন পূজা-পার্বন ও বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে কলকাতা হতে ফিরতেন তখন মনে হতো সমস্ত রায়পুরাই যেনো উৎসবে মেতে উঠেছে।
ড. সফিউদ্দিন আহমদ রায়পুরা আর.কে.আর.এম. ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মেট্রিক পাশ করেন। আই. এ. পাস করেন ১৯৬২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে। আই.এ. পরীক্ষায় তিনি লজিক ও বাংলায় লেটারসহ কৃতিত্বের সাথে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হন এবং অনার্স শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এম.এ. পাস করেন। পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তুলনামূলক সাহিত্য ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর উচ্চতর পর্যায়ে পড়াশোনা ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৫ সালের শেষ দিকে তিনি নেত্রকোণা কলেজে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথম চাকুরী পাবার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক মুনীর চৌধুরী। সেখানে ছিলেন বছর চারেক। মহকুমা শহর নেত্রকোণা তখন সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আর এর পটভূমি রচনা করেছিল বাম প্রগতিশীল রাজনীতি। ১৯৬৯ সালে তিনি যোগ দেন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে। এই কলেজে তিনি ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৬ সালের মে মাসে তিনি যোগ দেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহে ছিলেন। এর পর চলে যান সিলেটে । সেখানে ছিলেন পনের বছরের অধিককাল সময়। ১৯৮১ সালে যোগ দিয়েছিলেন মুরারীচাঁদ কলেজে। ছিলেন ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। সেখান থেকে অবসর নেবার পর ২০০৫ সালে যোগ দেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসাবে কর্তব্যরত অবস্থায় অবসর নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ২০০৫ সালের শেষের দিকে কিছুদিন কাজ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতার নেশা আজো ছাড়তে পারেননি এই কর্মবীর। এখনো তিনি নিয়মিত ক্লাস নেন নটরডেম কলেজে।
জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত এই শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে একজন আদর্শ, সৃজনশীল ও সম্মোহক শিক্ষক। তাঁর নির্ধারিত ক্লাসে তাঁর বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও অন্যান্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী এবং নবীন শিক্ষকেরা উপস্থিত থাকেন। তাঁর তথ্য সমৃদ্ধ মৌলিক বক্তব্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এক উজ্জ্বল সঞ্চয় বিশেষ।
প্রফেসর ড. সফিউদ্দিন আহমদ একজন তথ্যনিষ্ঠ ও শিকড় সন্ধানী মৌলিক গবেষক। তিনি একজন সার্থক অনুবাদক ও বিশ্বসাহিত্যে অবাধ সঞ্চারী আলোকিত ব্যক্তিত্ব। ড. আহমদ শরীফ, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিমসহ দেশ ও বিদেশের পণ্ডিতজন তাঁর গবেষণা ও অনুবাদকর্মের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
একজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মৌলিক গবেষক হিসেবে দেশে এবং দেশের বাইরেও তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। অধ্যাপক হিসেবে কলকাতা, যাদবপুর, বর্ধমান, কল্যাণী ও ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি নিখিল ভারত সাহিত্য সম্মেলন, বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন, আসাম রাজ্যের শিলচরে মাতৃভাষা সম্মেলনে যোগদান করেন।
বাংলা একাডেমী হতে প্রকাশিত তাঁর ১০টি গবেষণা গ্রন্থসহ মোট ৩০টি গবেষণা গ্রন্থ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে পাঠ করা হয়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা পত্রিকায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী পত্রিকায় তাঁর ৫০টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ভারতের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে সেখানকার পণ্ডিতদের কাছে সুনাম ও প্রশংসা অর্জন করেছেন। এটি আমাদের শিক্ষক সমাজ ও সমস্ত বাংলাদেশের গর্ব ও গৌরবের বিষয়।
ড. সফিউদ্দিন আহমদ অনেক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ আমাদের উপহার দিয়েছেন। যেমন ‘উনিশ শতকের রেনেসাঁ’, ‘বাংলা গদ্যের বিবর্তন’, ‘উনিশ শতকের নবজাগরণ ও সমাজ চিন্তা’, ‘সাময়িক পত্রে ভাষা সাহিত্য ও শিক্ষাচিন্তা’, ‘বাংলা গদ্য ও গদ্যশৈলী’, ‘সাহিত্যের কাল ও কালান্তর’, ‘সাহিত্যের সেকাল ও একাল’, ‘ডিরোজিও জীবন ও সাহিত্য’, ‘রবীন্দ্র সাহিত্যে শেক্সপিয়ার’, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও শিক্ষাচিন্তা’, ‘রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা’ ও ‘বৃত্তাবন্ধ রবীন্দ্রনাথ’ প্রভৃতি। ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর গবেষণা কর্মের মৌলিকত্ব এখানেই যে, তিনি প্রথাবদ্ধ গবেষণার বৃত্ত ভেঙ্গে যুক্তি ও বিচার বিশ্লেষণে নতুন তথ্য ও বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
ছাত্র জীবনে তিনি প্রচুর কবিতা ও গল্প লিখেছেন। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে ‘দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত তাঁর গল্প- ‘মানুষ গড়ার কারিগর’, ‘ডাক পিয়ন’, ‘মেরুদন্ড’, ‘উত্তরণ’, ‘ঈদ মানে আনন্দ’ খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ‘ডাক পিয়ন’ গল্পটি ইভানভ কুদ্রভ কর্তৃক রুশভাষায় এবং ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ নোয়েল গানিয়ে কর্তৃক ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। ড. সফিউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ অনুবাদক। অনুবাদকর্মে তিনি স্বকীয়তা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্লেটোর লেখা “The Last Days of Socrates– নামক মহা গ্রন্থটি তিনি ‘সক্রেটিসের শেষ দিনগুলো’ নামে অনুবাদ করেছেন, বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। এ ছাড়াও তিনি পাবলো নেরুদার কবিতা ও ডিরোজিও এর কবিতা অনুবাদ করে পন্ডিতজনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জন করেছেন। ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘মানুষ ও শিল্পী বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থটি বের হবার সাথে সাথেই উভয় বাংলার পণ্ডিতজন বইটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি যেমন শিকড় সন্ধানী মৌলিক গবেষক তেমনি পরিশ্রমী লেখক। তাঁর কোন কোন বইয়ের কলেবর বারোশত পৃষ্ঠা ও হাজার পৃষ্ঠা। তাঁর সাতশত, আটশত পৃষ্ঠার বইয়ের সংখ্যাও অনেক।
ড. সফিউদ্দিন আহমদ একজন কৃতী সংগঠক। তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন কয়েকজন কিশোর ও তরুণ মিলে গড়ে তোলেন ‘রায়পুরা জাগরণী সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংঘ’। এই সংঘের অভিষেক অনুষ্ঠানে তাঁদের শপথ বাক্য ছিলো-
১. আমাদের কর্মকাণ্ড ও জীবনাচরণে এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় আমরা সব সময় সত্যকে ধারণ করবো এবং সত্যকে প্রকাশ করবো।
২. ন্যায়, সত্য ও প্রগতি এবং মানব কল্যাণ ও মানব সম্প্রীতিই আমাদের মূল আদর্শ। কোন অন্যায়, অসত্য ও মিথ্যের কাছে আমরা কখনো মাথা নত করবোনা।
৩. অপসংস্কৃতি, রক্ষণশীলতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আমাদের লেখনি হবে শাণিত অস্ত্র।
৪. এই সংঘের সদস্যদের ধর্মীয় পরিচয়কে কখনো প্রাধান্য দেয়া হবে না।
৫. অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার বেদীমূলে আমাদের বিশ্বাস ও আদর্শকে আমরা অটুট রাখবো।
শপথ বাক্য শেষে সদস্যরা সমবেত কন্ঠে উচ্চারণ করেন-
‘অসতো মা সদগময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
অর্থাৎ অসৎ হতে আমাকে সৎপথে নিয়ে যাও। অন্ধকার থেকে আমাকে আলোকে নিয়ে যাও। মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃত লোকে নিয়ে যাও।
১৯৫৮ সালে ছিলো এই সংঘের জয়যাত্রা। সভাপতি সফিউদ্দিন আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক সুধীরচন্দ্র দাস। ১৯৬০ সালে তিনি গড়ে তোলেন ‘রায়পুরা সবুজের খেলাঘর’ আসর। দীর্ঘদিন ধরে এই আসরের কর্মকাণ্ড চলে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি ও উদীচীর সাথে। সমগ্র বাংলাদেশের তখনকার পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাথে তিনি বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। ড. সফিউদ্দিন আহমদ কেন্দ্রীয় খেলাঘরের দ্বিতীয় সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ড. সফিউদ্দিন আহমদ যেমন একজন সম্মোহক শিক্ষক তেমনি তিনি একজন মহোত্তম সংগঠক। গ্রামীণ পাঠাগার আন্দোলন তাঁর জীবনের এক মহোত্তম কীর্তি। এ কৃতিত্বের জন্য তিনি দেশে বিদেশে বহুল প্রশংসিত হয়েছেন।
দীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি কটিয়েছেন সিলেটে। প্রথমে এম.সি. কলেজে এবং পরে ১৯৯১ থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরে বৃহত্তর সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় ছাত্র ও শিক্ষকদের সহায়তায় তিনি বহু পাঠাগার স্থাপন করেছেন।
উচ্চশিক্ষিতা সুগৃহিনী স্ত্রী শিরিয়া আহমদ এবং দুই মেয়ে ও এক পুত্রকে নিয়ে তাঁর সংসার। বড়ো মেয়ে সোহেলী সায়লা আহমদ, পুত্র সাকী আহমদ এবং ছোট মেয়ে সেঁজুতি।
ড. সফিউদ্দিন আহমদ জাতিসংঘ মানবাধিকার পুরস্কার; বিদ্যাসাগর গবেষণা পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ; পশ্চিমবঙ্গ লেখক সমিতি পুরস্কার; শেরে বাংলা স্মৃতি একাডেমি পুরস্কার; বঙ্গবঙ্গু স্মৃতি পুস্কারসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার ও সংবর্ধনায় ভূষিত হয়েছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: ড. সফিউদ্দিন আহমদ ১৯৪৩ সালে তাঁদের পুরানো বাড়ি বাহের চরে ১৯ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর স্থায়ী আবাস রায়পুরা সদরে ‘ছায়াবীথি’ নামক ইতিহাস বিখ্যাত বাড়িতে।
বাবা ও মা: বাবা মোঃ আবদুস সামাদ মোল্লা কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষকতা ও কংগ্রেস পার্টির কর্মকান্ডের সাথে সাথে তিনি সমাজ সেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর মা বদরুন্নেসা প্রগতিশীল আত্মগোপনকারী নেতাকর্মীদের আশ্রয় দিতেন। এবং তিনি একজন সমাজ সচেতন মহিলা ছিলেন।
পড়াশুনা: ড. সফিউদ্দিন আহমদ রায়পুরা আর.কে.আর.এম. ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মেট্রিক পাশ করেন। আই.এ. পাস করেন ১৯৬২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে। আই.এ. পরীক্ষায় তিনি লজিক ও বাংলায় লেটারসহ কৃতিত্বের সাথে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হন এবং অনার্স শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এম.এ. পাস করেন। পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তুলনামূলক সাহিত্য ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর উচ্চতর পর্যায়ে পড়াশোনা ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন: ১৯৬৫ সালের শেষ দিকে তিনি নেত্রকোণা কলেজে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথম চাকুরী পাবার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক মুনীর চৌধুরী। সেখানে ছিলেন বছর চারেক। মহকুমা শহর নেত্রকোণা তখন সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আর এর পটভূমি রচনা করেছিল বাম প্রগতিশীল রাজনীতি। ১৯৬৯ সালে তিনি যোগ দেন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে। এই কলেজে তিনি ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৬ সালের মে মাসে তিনি যোগ দেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহে ছিলেন। এর পর চলে যান সিলেটে । সেখানে ছিলেন পনের বছরের অধিককাল সময়। ১৯৮১ সালে যোগ দিয়েছিলেন মুরারীচাঁদ কলেজে। ছিলেন ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। সেখান থেকে অবসর নেবার পর ২০০৫ সালে যোগ দেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসাবে কর্তব্যরত অবস্থায় অবসর নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ২০০৫ সালের শেষের দিকে কিছুদিন কাজ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতার নেশা আজো ছাড়তে পারেননি এই কর্মবীর। এখনো তিনি নিয়মিত ক্লাস নেন নটরডেম কলেজে। তিনি জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক।
সংসার জীবন: উচ্চশিক্ষিতা সুগৃহিনী স্ত্রী শিরিয়া আহমদ এবং দুই মেয়ে ও এক পুত্রকে নিয়ে তাঁর সংসার।
মূল লেখক: সৌমিত্র দেব
পুনর্লিখন: গুণীজন দল