সাখাওয়াত আলী খানের বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তু অনেকটা বন্ধুদের উৎসাহে তাঁর ঝোঁক চলে যায় সাহিত্যের দিকে। সিদ্ধান্ত নেন সাহিত্য পড়বেন। কিন্তু সাহিত্য পড়ার বিষয়ে বাবার অমত ছিল প্রচন্ড, বাবা এবার ছেলেকে অর্থনীতিতে পড়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ছেলে এবারও বাবার কথা শুনলেন না। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায়। সাহিত্যে ভর্তি হওয়ার ঘটনায় তাঁর বাবা খুব মন খারাপ করেছিলেন। তাঁর বাবা হয়তো ভেবেছিলেন সাহিত্য পড়লে তাঁর ছেলে জীবনে উন্নতি করতে পারবে না। কিন্তু বাবার সেই ধারণা ভূল প্রমাণিত করে সাখাওয়াত আলী খান হয়েছেন এদেশের একজন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান শিক্ষক, গণমাধ্যম এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতাসম্পন্ন গবেষক এবং খ্যাতিমান লেখক।
সাখাওয়াত আলী খানের জন্ম ১৯৪১ সালের ৩০ নভেম্বর, ঢাকায়। বাবা ওয়াজেদ আলী খান। মা খলিকা আক্তার নুর বেগম। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সাখাওয়াত আলী খান। তাঁদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে। বাবা ওয়াজেদ আলী খান প্রধানত সমবায় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ছাত্র জীবনে তিনি যুক্ত ছিলেন কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে খান সাহেব উপাধিতে ভূষিত করলেও বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িত হয়ে তিনি সেই খেতাব বর্জন করেন।
বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ সাখাওয়াত আলী খানের শিক্ষাজীবন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে অবস্থিত মে ফ্লাওয়ার স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। বাবা তখন কলকাতায় এয়ার রেইড প্রটেকশন (এআরপি)-এর ইকুইপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে মাসহ গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। ধানুয়া প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন।
১৯৪৭ সালে বাবা কলকাতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। নতুন চাকরি নেন ঢাকা কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিয়নে। সাখাওয়াত আলী খানও ঢাকায় চলে আসেন। বাবা-মাসহ আশেক লেনে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন । দাঙ্গার কারণে এবং আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ ভারত ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে। স্বভাবতই ঢাকার ভালো স্কুলগুলোর ওপর এর চাপ পড়ে। তাই ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হতে বেশ বেগ পেতে হয়। আরমানিটোলায় অবস্থিত হাম্মাদিয়া হাইস্কুল নামের একটা অখ্যাত স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি।
১৯৪৮ সালে আশেক লেনের বাসা ছেড়ে আরমানিটোলার কালীপ্রসন্ন ঘোষ স্ট্রিটে ভাড়া বাসায় ওঠেন। সেই সময় আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাইস্কুল ছিল ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কুল। এটি ছিল মূলত শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের ল্যাবরেটরি স্কুল। উচ্চপদস্থ কারো সুপারিশ নিয়ে বাবা তাঁকেসহ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করেন। প্রধান শিক্ষক জানিয়ে দিলেন, সিট নেই, তাই কোনোভাবেই চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করানো সম্ভব নয়। হতাশ হয়ে বাবা ফিরে আসতে উদ্যত, এমন সময় প্রধান শিক্ষক প্রস্তাব দিলেন, ক্লাস থ্রি-তে নেয়া যেতে পারে। তবে এজন্যে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে। বাবা প্রথমটায় রাজি হননি। মামাদের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত রাজি হন। ভর্তি পরীক্ষা দেন। খুব ভালো করেন পরীক্ষায়। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়েন – ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। প্রথম দিকে ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিলেন।
স্কুলের কাছে একটা ভাঙাচোরা সিনেমা হল ছিল। শো-এর সময় পেছন দিকে দাঁড়ালে সিনেমার গান-সংলাপ স্পষ্ট শোনা যেত। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময় বন্ধুদের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে সিনেমার গান শুনতেন।
১৯৫২-তে বাবা সমবায়ের চাকরি ছেড়ে দেন। মা গ্রামের বাড়ি চলে যান। ভাষা আন্দোলনের সময় সিনিয়র ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে যেতেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি কারফিউর ভেতর মানুষের ছোটাছুটি। সন্ধ্যায় গুরুতর অসুস্থ বাবার জন্যে ওষুধ কিনতে যেয়ে তিনি শোনেন মিছিলে গুলির কথা। বাবা সুস্থ হয়ে এই বছর হাউজ বিল্ডিং-এ চাকরি নেন। সাখাওয়াত আলী খান সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন কলেজিয়েট হাইস্কুলে। ১৯৫৬ সালে এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি।
১৯৫৭ সালে সাখাওয়াত আলী খান ঢাকা কলেজে আই.এস.সি.-তে ভর্তি হন । ঢাকা কলেজের বর্তমান ক্যাম্পাসে প্রথম দিকের ব্যাচ ছিলেন তাঁরা। এসময় বাম রাজনীতিকদের সংস্পর্শে আসেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত হন। ১৯৫৮-তে আই.এস.সি.-র ফাইনাল পরীক্ষায় ব্যবহারিক বিষয়ের পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। পরের বছর অর্থ্যাৎ ১৯৫৯ সালে আই.এস.সি. পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে তাঁর বাবা মৃত্যুবরণ করেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠেন। এই সময় আর্থিক টানাটানিতে পড়তে হয় তাঁকে। গ্রামে জমাজমির আয় আর টিউশনি করে লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৯৬২ সালে বাংলায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
এম.এ. পড়ার সময় উপার্জন ও জীবিকার প্রশ্নটি ভাবনায় প্রাধান্য পায় তাঁর। তখন একটা পত্রিকায় খণ্ডকালীন কাজ নেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে সান্ধ্যকালীন ডিপ্লোমা কোর্সে ছাত্র ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। সাংবাদিকতা যে একটা পড়ার সাবজেক্ট হতে পারে এটা তখন অনেকের ধারণার মধ্যেও ছিল না। তবুও তাঁর রুমমেট অর্থনীতির ছাত্র নুরুল আবেদিন এবং তিনি ভর্তি পরীক্ষা দেন।
ভর্তি পরীক্ষার পর ফলাফলের জন্য আর কোন খোঁজখবর নেননি তিনি। মৌখিক পরীক্ষার দিন নুরুল আবেদিনের কাছে খবর পান ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এটি ছিল তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। কয়েকশ’ ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা দিলেও প্রথম ব্যাচে মাত্র ১৫ জন ভর্তি করা হয়। দিনে এম.এ. এবং সন্ধ্যার পর সাংবাদিকতার ক্লাস করতেন সাখাওয়াত আলী খান। ১৯৬৩ সালে এম.এ. এবং সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
এরপর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। পুরোদস্তুর সাংবাদিক। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে যেতেন। সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান আতিকুজ্জামান খান, তরুণ শিক্ষক কিউএআইএম নুরউদ্দিনসহ অন্যদের সঙ্গে গল্প করতেন। ১৯৬৯ সালে একদিন আতিকুজ্জামান খান তাঁকে সাংবাদিকতায় এম.এ. শ্রেণীতে ভর্তির ফরম দিয়ে দ্রুত পূরণ করে জমা দিতে বলেন। যেহেতু তিনি কাজ করছেন তাই ক্লাস করার জন্য সময় বের করা কষ্টকর হবে ভেবে প্রথমটায় রাজি হননি। আতিকুজ্জামান তাঁকে ক্লাস করার ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দেওয়ার আশ্বাস দেয়ায় সাংবাদিকতায় মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন তিনি।
১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাপানি ভাষায় সার্টিফিকেট কোর্স শেষ করেন। ১৯৮৯ সালে ইন্টারপ্লে অব জার্নালিজম এ্যান্ড পলিটিক্স শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে।
ছাত্রজীবনে ১৯৫৮ সালে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত ‘দৈনিক মজলুম’-এ কিছুদিন কাজ করেন। পত্রিকাটি অল্প ক’দিন টিকে ছিল। সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করার পর শিক্ষানবীশ হিসেবে কিছুদিন ইত্তেফাক গ্রুপ থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা টাইমস’-এ কাজ করেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’ পত্রিকা ও দৈনিক আজাদ-এও কিছু দিন কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁর পত্রিকা দৈনিক পয়গাম-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গঠিত পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সেখানে বেছে বেছে উচ্চবেতনে লোক নেয়া হয়। তাঁর কাছেও সেখানে চাকরি করার প্রস্তাব আসে। ৫ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে হাসান হাফিজুর রহমানসহ দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেন তিনি। সিনিয়র সাব-এডিটর কাম শিফট ইন চার্জ ছিলেন। স্বাধীনতার আগে-পরে মিলিয়ে প্রায় আট বছর এই পত্রিকায় (পরবর্তীকালে দৈনিক বাংলা) চাকরি করেন। এসময় জুনিয়র সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্বও পালন করেন।
আবুল কালাম শামসুদ্দিন, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আহসান হাবিব, নির্মল সেন, ফজলুল করিম, ফওজুল করিম, খোন্দকার আলী আশরাফ, তোয়াব খান, মোজাম্মেল হক, আহমেদ হুমায়ুন, সানাউল্লাহ্ নূরী, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, মাফরুহা চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দীন, আফলাতুন প্রমুখ ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ (এবং পরবর্তীকালে ‘দৈনিক বাংলা’-য়) তাঁর সহকর্মী ছিলেন।
১৯৭২ সালে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা পরিত্যক্ত দৈনিক পাকিস্তান ভবন এবং প্রেস ঠিকঠাক করে ‘দৈনিক বাংলা’ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। প্রথমটায় অর্থায়ন একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পরে সরকার পত্রিকাটিকে ট্রাস্টভুক্ত করে। শুরু হয় ‘দৈনিক বাংলা’র যাত্রা।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ প্রায় শিক্ষকশূন্য হয়ে পড়ে। অধ্যাপক নুরউদ্দিনের অনুরোধে এই বিভাগে শিক্ষকতা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৭২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর সহকারী অধ্যাপক পদে এবং ১৯৯২ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।
১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তাঁর নেতৃত্বে সাংবাদিকতা বিষয়ে সম্মান কোর্স খোলা হয় এবং সাংবাদিকতার সান্ধ্যকালীন কোর্স উঠে গিয়ে দিবাকালীন কোর্স শুরু হয়। সম্মান কোর্স চালু সংক্রান্ত ফিজিবিলিটি কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন ড. আহমদ শরীফ, প্রফেসর সা’দউদ্দিন প্রমুখ। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা সম্মান কোর্সের সিলেবাস প্রণয়ন করেন। ১৯৭৭-এ বিভাগের সকল কোর্স দিনে চলে আসে, তিন বছরের সম্মান কোর্স চালু হয় এবং ডিপ্লোমা কোর্স উঠে যায়। যতদূর জানা যায়, তখন উপমহাদেশে এটিই ছিলো সাংবাদিকতায় প্রথম অনার্স কোর্স। ২০০২-২০০৪ সময়ে আবারো বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর দীর্ঘতম সময়ের কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন ২০০৭-এর ৩০ জুন।
বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সুপার নিউমেরারি অধ্যাপক। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে গণযোগাযোগের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে যোগ দেন।
ড. সাখাওয়াত আলী খান ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং মিডিয়া স্টাডিজ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ১৯৮০-৮২ সালে প্রেস কাউন্সিলের তিন সদস্য বিশিষ্ট জুডিশিয়াল কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৬-৭৯ ও ২০০২-০৪ সময়ে দু দফায় প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর ব্যবস্থাপনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৬ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের এক্সপার্ট স্টাডি গ্রুপের সদস্য। সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা কোর্স প্রণয়নের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন করা এডহক কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পিআইবিতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এম.এ. কোর্স চালুর জন্যে গঠিত কমিটির তিনি চেয়ারম্যান।
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশসহ জাপান, মেক্সিকো, শ্রীলংকা, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সেমিনার ও ওয়ার্কশপে যোগ দেন এবং কয়েকটি সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
প্রায় তিন দশক ধরে যোগাযোগ, সাংবাদিকতা, জনসংযোগ, বিজ্ঞাপনকলা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর পিআইবি, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট (নিমকো), ফরেন সার্ভিস একাডেমি, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস একাডেমি, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, বাংলাদেশ ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বাংলাদেশ বিমান ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট, সেন্টার পর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম এ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিসেডিজেসি), ম্যাস্-লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি), সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট এ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং লেকচার প্রদান করেন।
অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের পিএইচডি থিসিস-এর পরীক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, এবং সরকারি কর্মকমিশনের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পাঠক্রম প্রণয়ন এবং পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে কয়েকজন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বির্ভিন্ন জেলায় পিআইবি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আয়োজিত সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন তিনি।
সাংবাদিকতা, গণমাধ্যম, গবেষণা এবং সমাজসেবামূলক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত- সচেতন-সক্রিয় মানুষ- ড. সাখাওয়াত আলী খান। তিনি কুয়ালালামপুর থেকে প্রকাশিত ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন জার্নাল এর সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য এবং বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল এর অ্যাডভাইজার। এছাড়া তিনি আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি ‘৬৯-এর গণআন্দোলনের শহীদ আসাদের স্মৃতি রক্ষায় গঠিত আসাদ পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই। অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান নরসিংদী জেলার শিবপুরে শহীদ আসাদ কলেজের পরিচালনা পরিষদ সদস্য এবং শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস স্কুল ও কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা ড. সাখাওয়াত আলী খান।
একজন সফল শিক্ষক, প্রশিক্ষকের পাশাপাশি গবেষক এবং লেখক হিসেবেও সমান খ্যাতিমান তিনি। তাঁর ৩০টির মতো গবেষণা-প্রবন্ধ বিভিন্ন বই এবং জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের ওপর লেখা দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এর অষ্টম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়।
সাখাওয়াত আলী খান ১৯৬৩ সালে মালেকা খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁরা এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক-জননী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের এলাকায় চলে যান তিনি। গেরিলা যোদ্ধাদের সংগঠক এবং পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। যুদ্ধের ভেতরও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জুতা (কেডস) কিনতে কয়েকবার ঢাকায় আসেন। একবারে বেশি কিনলে পাকবাহিনীর সন্দেহ হতে পারে। তাই ২০-৩০ জোড়া করে কয়েকজনে মিলে কয়েকশ’ জোড়া কেডস কিনে নিয়ে যান। বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকে তাদের সহযোগিতা করেছেন তিনি।
একজন অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান তাঁর সময়কে সমৃদ্ধ করেছেন নিজের কীর্তি দিয়ে। নিজের দেশের আর দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা দিয়ে। নিজের চিন্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন- কথায়, লেখায়-অনেকের জীবনে। আর তাই পরবর্তী প্রজন্ম আলোকিত হবে তাঁর ব্যক্তিত্বের আলো থেকে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: সাখাওয়াত আলী খানের জন্ম ১৯৪১ সালের ৩০ নভেম্বর, ঢাকায়।
বাবা: ওয়াজেদ আলী খান।
মা: খলিকা আক্তার নুর বেগম। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সাখাওয়াত আলী খান। তাঁদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে।
পড়াশুনা: বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ সাখাওয়াত আলী খানের শিক্ষাজীবন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে অবস্থিত মে ফ্লাওয়ার স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। বাবা তখন কলকাতায় এয়ার রেইড প্রটেকশন (এআরপি)-এর ইকুইপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে মাসহ গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। ধানুয়া প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন।
১৯৪৭ সালে বাবার সঙ্গে সাখাওয়াত আলী খান ঢাকায় চলে আসেন। আরমানিটোলায় অবস্থিত হাম্মাদিয়া হাইস্কুল নামের একটা অখ্যাত স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি।
১৯৪৮ সালে আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়েন – ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। প্রথম দিকে ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিলেন। সাখাওয়াত আলী খান সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন কলেজিয়েট হাইস্কুলে। ১৯৫৬ সালে এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি।
১৯৫৭ সালে সাখাওয়াত আলী খান ঢাকা কলেজে আই.এস.সি.-তে ভর্তি হন । ঢাকা কলেজের বর্তমান ক্যাম্পাসে প্রথম দিকের ব্যাচ ছিলেন তাঁরা। এসময় বাম রাজনীতিকদের সংস্পর্শে আসেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত হন। ১৯৫৮-তে আই.এস.সি.-র ফাইনাল পরীক্ষায় ব্যবহারিক বিষয়ের পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। পরের বছর অর্থ্যাৎ ১৯৫৯ সালে আই.এস.সি. পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হন।
কর্মজীবন: ছাত্রজীবনে ১৯৫৮ সালে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত ‘দৈনিক মজলুম’-এ কিছুদিন কাজ করেন। পত্রিকাটি অল্প ক’দিন টিকে ছিল। সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করার পর শিক্ষানবীশ হিসেবে কিছুদিন ইত্তেফাক গ্রুপ থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা টাইমস’-এ কাজ করেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’ পত্রিকা ও ‘দৈনিক আজাদ’-এও কিছু দিন কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁর পত্রিকা ‘দৈনিক পয়গাম’-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গঠিত পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট ১৯৬৪ সালে ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সেখানে বেছে বেছে উচ্চবেতনে লোক নেয়া হয়। তাঁর কাছেও সেখানে চাকরি করার প্রস্তাব আসে। ৫ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে হাসান হাফিজুর রহমানসহ ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ যোগ দেন তিনি। সিনিয়র সাব-এডিটর কাম শিফট ইনচার্জ ছিলেন। স্বাধীনতার আগে-পরে মিলিয়ে প্রায় আট বছর এই পত্রিকায় (পরবর্তীকালে ‘দৈনিক বাংলা’) চাকরি করেন। এসময় জুনিয়র সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্বও পালন করেন।
আবুল কালাম শামসুদ্দিন, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আহসান হাবিব, নির্মল সেন, ফজলুল করিম, ফওজুল করিম, খোন্দকার আলী আশরাফ, তোয়াব খান, মোজাম্মেল হক, আহমেদ হুমায়ুন, সানাউল্লাহ্ নূরী, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, মাফরুহা চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দীন, আফলাতুন প্রমুখ ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ (এবং পরবর্তীকালে ‘দৈনিক বাংলা’-য়) তাঁর সহকর্মী ছিলেন।
১৯৭২ সালে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা পরিত্যক্ত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ ভবন এবং প্রেস ঠিকঠাক করে দৈনিক বাংলা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। প্রথমটায় অর্থায়ন একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পরে সরকার পত্রিকাটিকে ট্রাস্টভুক্ত করে। শুরু হয় ‘দৈনিক বাংলা’র যাত্রা।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ প্রায় শিক্ষকশূন্য হয়ে পড়ে। অধ্যাপক নুরউদ্দিনের অনুরোধে এই বিভাগে শিক্ষকতা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৭২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর সহকারী অধ্যাপক পদে এবং ১৯৯২ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।
তাঁর দীর্ঘতম সময়ের কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন ২০০৭-এর ৩০ জুন।
বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সুপার নিউমেরারি অধ্যাপক। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে গণযোগাযোগের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে যোগ দেন।
ড. সাখাওয়াত আলী খান ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং মিডিয়া স্টাডিজ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাখাওয়াত আলী খান ১৯৬৩ সালে মালেকা খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁরা এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক-জননী।
মূল লেখক: মীর মাসরুর জামান
পুনর্লিখন : গুণীজন দল