স্কুলে পড়ার বয়সে প্রায় রাতেই ঘুম হতো না কিশোর ছেলেটার। বই বগলে নিয়ে হোস্টেলের দেয়াল টপকে চলে যেতেন বরিশালের জাহাজঘাটে। সেখানে রাস্তার ল্যাম্পের আলোয় বসে পড়তেন রাজ্যের সব বই। ছাত্র হিসেবেও ছিলেন বেশ ভালো। ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় তাঁর বন্ধু মোজাম্মেল হক তাঁকে এক রাতের মধ্যে ‘পথের দাবী’ পড়ে শেষ করতে দেন। শরত্চন্দ্রের লেখা এই বইটি তাঁর ভাবনার জগত্ পুরোপুরি বদলে দেয়। পরবর্তী জীবনে তিনি বলেন, পশ্চিম বঙ্গের বর্ষীয়ান বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মতো তিনিও রাজনীতিতে এসেছিলেন এই বইটি পড়ে। এখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বিপ্লবী চেতনায়। জেল খেটেছেন, শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-অনশন করেছেন আবার ছাত্রদের মাঝে দর্শনের জ্ঞান বিতরণ করেছেন, লেখালেখি তো আছেই।
জ্ঞান-পিপাসু বিপ্লবী এই শিক্ষাবিদ আমাদের অতি শ্রদ্ধেয় সরদার ফজলুল করিম। তাঁর জীবনের প্রতিটা অধ্যায়ই বৈচিত্রে ভরপুর। যখন যা মনে হয়েছে তখন তিনি সেভাবেই চলেছেন, মনে লালিত আদর্শকে কখনো বিসর্জন দেননি বরং প্রতিনিয়ত তাকে আরো দৃঢ় করেছেন। বৈপ্লবিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে চাকরি ছেড়েছেন, দীর্ঘ চার দফায় মোট ১১ বছর জেল খেটেছেন। তবুও জীবন নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ কিংবা অপ্রাপ্তি নেই বরং মনে করেন, তাঁর জীবনের পুরোটাই লাভ!
সরদার ফজলুল করিমের জন্ম ১৯২৫ সালের মে মাসে। বরিশাল জেলার উজিতপুর থানার আটিপাড়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে। বাবা খবিরউদ্দিন সরদার কৃষিকাজ করতেন। মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তাঁরা দুই ভাই তিন বোন। সরদার ফজলুল করিমের শৈশবকাল কেটেছে গ্রামে। ছেলেবেলায় বড় ভাইয়ের ঘাড়ে চড়ে তাঁর কর্মস্থলে যাওয়ার বায়না ধরতেন। ফজলুল করিমের পীড়াপীড়িতে তিনি মাথায় করে তাঁকে কর্মস্থল নাজিরপুরে নিয়ে যান।
বর্ণ পরিচয়ের পর থেকে তিনি গড়গড় করে বাংলা পড়তেন। তাঁর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় মামাবাড়ি আটিপাড়া গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন শিক্ষক বাঁশের কলম কালিতে চুবিয়ে সিদ্ধ তালপাতায় বর্ণ লিখে দিতেন। সেটাই তিনি দেখে দেখে পড়তেন। আর সবাই মিলে সুর করে নামতা পড়তেন। এরপর ১৯৩৫ সালে রহমতপুর বয়েজ হাইস্কুলে সরদার ফজলুল করিম চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। বড় বোন মেহেরুন্নেসা ও তিনি এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়তেন। থাকতেন বড় ভাইয়ের কোয়ার্টারে। রহমতপুরের আইনজীবী ওহাব খানের বাড়িটাকে সরকার সাব রেজিস্ট্রারি অফিস হিসেবে ব্যবহার করে। নিচতলায় অফিস আর দোতলায় ছিল সাব রেজিস্ট্রারের কোয়ার্টার। প্রতিদিন দুই ভাইবোন কোয়ার্টার থেকে মাইলখানেক পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতেন। সরদার ফজলুল করিম গণিত ভালো পারতেন না।
১৯৪০ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। থাকতেন কলেজের হোস্টেলে। উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইংরেজি বিভাগে বি.এ. অনার্স ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন তিনি ইংরেজি বিভাগে থাকলেন। ঘুরে ঘুরে শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনতেন। কোন শিক্ষক কিভাবে বক্তৃতা দেন তা দেখলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। তিনি সব ক্লাশের পাশ দিয়ে ঘুরতেন। করিডোর দিয়ে যাবার সময় এপাশে-ওপাশের বিভিন্ন ক্লাশ দেখতেন। দর্শনের হরিদাস ভট্টাচার্য্যের বক্তৃতা শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে যেতেন। তাঁর বক্তৃতা সরদারকে আকৃষ্ট করে। তিনি ‘সত্য’ এবং ‘মিথ্যা’ কি, এ নিয়ে একদিন আলোচনা করছিলেন। সরদার ফজলুল করিম কাছে গিয়ে বললেন, ‘স্যার, আমি দর্শনে ভর্তি হব।’ চলে এলেন দর্শন বিভাগে। তিনি দর্শনের বাইরে অন্য ক্লাসও করতেন। আব্দুল হাদী তালুকদার ছিলেন দর্শনের শিক্ষক। তাঁর ইংরেজি বক্তৃতা তিনি বাংলায় অনুবাদ করে দিতেন। ১৯৪৫ সালে সরদার ফজলুল করিম দর্শনশাস্ত্রে বি.এ. অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৪৬ সালে এম.এ.-তে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। রাজনীতির কারণে তিনি লন্ডনের স্কলারশীপ প্রত্যাখ্যান করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এন রায়ের ভাই বিনয় রায় ছিলেন দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। সরদার ফজলুল করিমের এম.এ. পরীক্ষার ফল বেরুতেই বিনয় রায় তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতে বললেন। তিনি পরদিন থেকে অর্থাত্ ১৯৪৬ সালে লেকচারার হিসেবে ক্লাস নিতে শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে রাজনীতির কারণে স্বেচ্ছামূলকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ইস্তফা দেন তিনি। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমীর অনুবাদ শাখায় যোগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর সংস্কৃতি শাখার বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কারাগারে থেকে পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
ছাত্রাবস্থায়ই সাম্যবাদী আন্দোলনের সাথে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ১৯৩৯-৪০ সালে স্কুলে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ছিল শতকরা ৫ থেকে ১০ জন। হিন্দু কিশোর বন্ধুদের মধ্যে তিনি বৃটিশ-বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের আভাস পান। তখন তিনি বরিশাল জেলা স্কুলের নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র। সহপাঠী মোজাম্মেল হক মুসলমান হলেও একটু ভিন্ন ধরনের ছিলেন। তিনি তাঁকে পড়তে দিলেন ‘প্রেসক্রাইবড’, ‘পথের দাবী’। এরপর দিলেন লাল অক্ষরে মুদ্রিত বিপ্লবী ইশতেহার, স্বাধীনতা এবং সমাজতন্ত্রের ইশতেহার। তিনি গোপনে তাঁকে জানান তিনি যোগ দিয়েছেন বেআইনি গুপ্তদলে। সে দলের নাম বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল: আর.এস.পি। মোজাম্মেল তাঁকে সাবধান করে দেন, কেউ যেন কথাটি না জানে। কেউ যেন টের না পায়র
১৯৪৫ সালে ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র রবি গুহের সাথে তিনি নেত্রকোণা কৃষক সম্মেলন দেখতে যান। তিনি দেখেন দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে কৃষক প্রতিনিধির দল এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। পাহাড়ি এলাকা থেকে এসেছে হাজং কৃষকের দল। তাদের মাঝেই মাঠের এককোণে জায়গা করে নেন সরদার ফজলুল করিম। মঞ্চে একে একে নেতারা বক্তৃতা দেন। এই মঞ্চে মণি সিংহ বক্তৃতা দেন। মণি সিং এর নাম ঘোষণার সাথে সাথে হাজং কৃষকরা সকলে সোজা হয়ে বসে। কেউ মন লাগাতে দেরি করছে দেখতে পাওয়া মাত্রই অন্যরা ধমক দিয়ে বলে উঠে- ‘শোন শোন আমাদের মণি বেটা বলছে।’ কৃষকদের এই কথাটি তাঁর মনকে শিহরিত করে দেয়। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি আত্মগোপনরত কমিউনিস্ট পার্টির কাজে মনোনিবেশ করেন।
আণ্ডারগ্রাউণ্ডে থেকে কাজ চালিয়ে যান তিনি। পুলিশ তাঁকে খুঁজছে। দিনের বেলা বের হন না। রাতের অন্ধকারে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। রাজনীতির অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। সংগঠনের সিদ্ধান্ত ও ডাককে পোস্টারে লিখে সেই পোষ্টার শহরের দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দেন। পূর্ব বাংলার সরকার বুঝতে পারে আন্দোলনরত রাজনীতির মূলে রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। সে পার্টি বেআইনি না হলেও তাঁর প্রকাশ্যে চলাফেরা অসম্ভব করে দেয় সরকারি পুলিশ। ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে জিন্নাহ্ ঢাকা আগমন এবং তাঁর উক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের পর সরকারি এই আক্রমণ অধিকতর তীব্র হয়। উপযুক্ত আশ্রয় ও খাবারের অভাবে তাঁর শরীর একেবারে ভেঙে পড়ে। ঢাকা বা পূর্ববঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে বন্ধুদের পরামর্শে তিনি কলকাতায় চলে যান। কিন্তু কলকাতাতেও কমিউনিস্টদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে। তাঁর ভরসা ছিল তিনি পূর্ববঙ্গের কর্মী, সুতরাং সেখানে তাঁকে কেউ চেনে না। আর সেখানে তাঁকে হয়রানি কেনইবা করবে? এই ভরসাতে তিনি উত্তরবঙ্গ ঘুরে সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতা পৌঁছেন। কলকাতায় যে বন্ধুর বাড়িতে যান, সেখানে খাওয়ার যদিওবা বন্দোবস্ত হয়, থাকার সমস্যা দেখা দেয়। একটি বাড়িতে তাঁরা অসংখ্য লোক বসবাস করতেন। ফলে তিনি অন্যত্র আশ্রয়ের খোঁজ করেন। ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় সাহিত্য বিভাগের পরিচালক ছিলেন আহসান হাবীব। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরেই তিনি আহসান হাবীবের সঙ্গে দেখা করে রাতে তাঁর আশ্রয়ে থাকার কথা বলেন। আহসান হাবীব তাঁকে বলেন, ‘তোমার শরীর খারাপ হয়েছে। তুমি সংগ্রামী আদর্শে অনুপ্রাণিত। তোমাকে ওপথ থেকে ফেরাবার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু তুমি আমার বাসায় কয়েকদিন থাকবে। এটুকু আমি করতে না পারলে, আমারও তাতে দুঃখ কম হবে না।’
সরদার ফজলুল করিম আহসান হাবীবের দক্ষিণ কলকাতার পার্ক এভিনিউর ভাড়া করা দোতলা বাড়িতে ওঠেন। কলকাতায় সরদার ফজলুল করিমের কোনো রাজনৈতিক কাজ না থাকায় সারাদিন ঘুরে বেড়ান। কখনো চৌরঙ্গীর চৌমাথায় দাঁড়িয়ে রেলিং-এ ভর করে চলমান জনতাকে দেখেন। কখনো কলেজ স্কোয়ারের ফুটপাথে বইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটেন।
একদিন রাত দুটো কিংবা তিনটের দিকে হঠাত্ আহসান হাবীবের দরজায় অস্বাভাবিক আঘাত পড়ে। সরদার ফজলুল করিমের এ শব্দের তাত্পর্য বুঝতে দেরি হয়নি। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে আগন্তুকরা রূঢ় গলায় বলে, ‘আমরা পুলিশের লোক, দরজা খুলুন।’
সরদার ফজলুল করিম বুঝলেন, এবার আর এড়াতে পারলেন না। তাঁর হাতে কিছু রাজনৈতিক কাগজপত্র ছিল। সেগুলো সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেও বিপদ এড়ানো যাবে না। আহসান হাবীব তাঁকে ভেতরের ঘরে দিয়ে সামনের ঘরে গিয়ে দরজা খুলে দেন। স্পেশাল ব্রাঞ্চের বাহিনী ঘরে ঢুকে পড়ে। সরদার ফজলুল করিম ভেতর ঘর থেকেই শুনতে পান, পুলিশের ইন্সপেক্টর বলছেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি, আপনার এখানে পলাতক রাজনৈতিক নেতা আছে। পলিটিক্যাল এ্যাবস্কনডার আছে।’
আহসান হাবীব সঙ্গে সঙ্গে তাদের এই বক্তব্যকে অস্বীকার করলেন। পুলিশ জেরা শুরু করতেই তিনি স্ত্রী ও একজন অতিথির কথা জানান। পুলিশ ইন্সপেক্টর অতিথিকে দেখতে চাইতেই সরদার ফজলুল করিম পুলিশের সামনে হাজির হন। পুলিশ একটু অবাক হয়ে জেরা শুরু করে। আপনার নাম কি?
আমার নাম ফজলুল করিম।
আপনার বাড়ি কোথায়?
আমার বাড়ি বরিশাল।
আপনি কি করেন?
আমি কলেজে পড়ি।
কোন কলেজে?
চাখার কলেজে।
কি পড়েন?
আই.এ. পড়ি।
এখানে কেন এসেছেন?
বেড়াতে এসেছি।
এরপর তাঁর আপাদমস্তক আর একবার নিরীক্ষণ করে হতাশার সুরে বলেন, ‘না। এ নয়। হি মাস্ট বি সামবডি এলস। কোনো এক সরদার। পূর্ববঙ্গের বড় কমিউনিস্ট নেতা, ঢাকার। ঢাকা থেকে এসেছে। সে খবরই আমরা পেয়েছি। এ লোক নয়।’ এ বলে ঘরের ভেতরটা আরেকটু দেখে ইন্সপেক্টর দলবল নিয়ে চলে যান। পরের রাতেই সরদার ফজলুল করিম কলকাতা ছেড়ে ঢাকার পথে যাত্রা করেন। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে কিছুকাল ঢাকার গ্রামাঞ্চলে, কৃষকদের মধ্যে, ঢাকার চালাক চর, পোড়াদিয়া, সাগরদি, হাতিরদিয়া অঞ্চলে আত্মগোপনে থাকেন।
১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে ঢাকা জেলে রাজবন্দিরা ৪০ দিন ব্যাপী অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন। সরদার ফজলুল করিম তখনও গ্রেফতার হননি। এ অনশনের খবর পাওয়ার ভিত্তিতে কর্মীরা দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার দেওয়ার চেষ্টা করে। সেসময় দেওয়ালে পোস্টার লাগানো ছিল বিপজ্জনক। তরুণ কর্মীরা রাতের আঁধারে দেওয়ালে পোস্টার লাগাবার চেষ্টা করত। তা লাগাতে গিয়ে অনেক ছাত্র ও তরুণ কর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। এদের মধ্যে ছিলেন আলমুতী, কিশোর আলী আকসাদ প্রমুখ।
৪০ দিনের অনশনে রাজবন্দিরা কোনো দাবি আদায় করতে পারেননি। জেল কর্তৃপক্ষ এবং মুসলিম লীগের কোনো কোনো নেতার প্রতিশ্রুতিতে সে অনশন তাঁরা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু তাঁদের উপর নির্যাতনের আদৌ কোনো উপশম না হওয়ায় ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকা জেলের রাজবন্দিরা আবার অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা শহরের তাঁতী বাজার থেকে সরদার ফজলুল করিম তাঁর কয়েকজন বন্ধুসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তিনি যখন কারাগারে যান তখন রাজবন্দি হিসেবে মর্যাদা আদায়ের দাবিতে রাজবন্দিদের অনশন ধর্মঘট চলছিল পুরোদমে এবং কারাগারে ঢুকে সাথীদের সঙ্গে তিনিও অনশনে যোগ দেন রাজবন্দি হিসেবে মর্যাদা আদায়ের দাবিতে।
অনশনের প্রথম ছ’দিন ‘সেলের’ মধ্যে দিনরাত মেঝেতে চোখ বুজে শুয়ে থাকতেন। মাথার কাছে জেলের সিপাহী জমাদার সকাল বিকাল ভাত-তরকারি থালায় করে রেখে যায় তাঁর সামনে। কিন্তু তিনি সেগুলি ছুঁতেন না। শুধু মাঝে মধ্যে কেবল সামান্য লবন মিশিয়ে পানি খেতেন। ছ’দিন পর সরদার ফজলুল করিম স্বেচ্ছায় অনশন না ভাঙ্গার কারণে তাঁকে হাসপাতালে আনা হয় এবং তাঁকে অন্যান্য অনশনরত বন্দিদের সঙ্গে জবরদস্তি করে খাওয়ানোর বা ‘ফোর্সড ফিডিং’ ব্যবস্থার অন্তভূর্ক্ত করা হয়। রোজ সকালে দশটার দিকে তাগড়া, জোয়ান একদল সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীসহ জেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডার বা ডাক্তার একটা বাহিনী নিয়ে এসে চড়াও হত। তাদের হাতে থাকত বালতির মধ্যে পানির সঙ্গে দুধের পাউডার মেশানো ‘দুধ-পানি’। ফোর্সড ফিডিং এর এই বাহিনী প্রত্যেক বন্দির কাছে গিয়ে বন্দিরা যেন বাধা দিতে না পারে সেজন্য তাঁর হাত পা চেপে ধরত। তাঁদের হাত পা চেপে ধরে তাঁদের নাকের মধ্য দিয়ে একটা রবারের নল পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করত। এই রবারের নলের উপর দিকে রাখা বাটি বা কুপিতে সেই দুধ মেশানো পানি একসের কি আধসের ঢেলে দিত। এভাবেই খাওয়ানো হতো অনশনরত বন্দিদের। গোড়া থেকে যারা অনশন করেছিলেন তাঁদের ৫৮ দিন পুরো হওয়ার পরে একটা ফয়সালা হয়। আর সরদার ফজলুল করিম ত্রিশ দিন পুরো অনশন করে। এর মাধ্যমে কাপড়-চোপড় এবং থাকা খাওয়ার ব্যাপারে কিছু মর্যাদা এবং উন্নত অবস্থার স্বীকৃতি দেয়া হয় তাঁদের। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে দীর্ঘ পাঁচ বছর বন্দী জীবনের পর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর তিনি আরও তিনবার কারাবরণ করেন।
১৯৫৭ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি সুলতানা রাজিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পর সুলতানা রাজিয়া সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে চাকরি নেন। এছাড়া তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রেষণে চার বছর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের এক মেয়ে এবং দুই ছেলে। বড় মেয়ে আফসান করিম ১৯৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সরদার ফজলুল করিম তখন জেলে। বড় ছেলে সরদার মারুফ, ছোট ছেলে সরদার মাসুদ করিম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সরদার ফজলুল করিম পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই ছিলেন। এইসময় তিনি বাংলা একাডেমীর সংস্কৃতি শাখার বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি ১০টা সাড়ে ১০টার সময় অফিসে পৌঁছেন। এর কিছুক্ষণ পর কয়েকজন লোক এসে তাঁকে ধরে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়। জেলে তাঁর উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার খবরটা তিনি জেলে বসেই শুনতে পেলেন। ১৭ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা এসে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের দরজা খুলে দেয়। ঐ দিন অন্য সব কয়েদির সাথে তিনি মুক্তি পান এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বহু স্মৃতি-বিজড়িত গেটটি পার হয়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন।
সরদার ফজলুল করিম ছাত্রাবস্থায়ই প্রগতি লেখক সংঘের কাজে সম্পৃক্ত হন। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে হাতে লেখা পত্রিকা বের করতেন। এছাড়া তিনি অনেক বই রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে- প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, এ্যারিস্টটলের পলিটিক্স, রুশোর সোশ্যাল কনট্রাকট, পাঠপ্রসঙ্গ, চল্লিশের দশকের ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ, সেই সে কাল: কিছু স্মৃতি কিছু কথা, নানা কথা, নানা কথার পরের কথা এবং নূহের কিসমত ইত্যাদি। এছাড়া ‘দর্শনকোষ’ নামে দর্শনের একটি অভিধান লিখেছেন তিনি। বইটি বের করেছে বাংলা একাডেমী।
সরদার ফজলুল করিম নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-১৯৯৮ সালে সিধু ভাই স্মৃতি সংসদ তাঁকে স্মৃতিপদক প্রদান করে। ১৯৯৯ সালের ২১ মার্চ গুণমুগ্ধজন পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালে দৈনিক জনকন্ঠ গুণীজন সম্মাননা দেয়। ২০০০ সালের ১৩ মে বরিশাল বিভাগ সমিতি, ঢাকা শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য শেরে বাংলা পদক-এ ভূষিত করে। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার থেকে শিক্ষাবিদ হিসাবে শিক্ষা পুরস্কার পান। ২০০১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ তাঁকে গুণীজন সম্মাননা দেয়। ২০০৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা সংস্কৃতি সংসদের পক্ষ থেকে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক পান। অনুবাদের জন্য পান বাংলা একাডেমী পুরস্কার।
সরদার ফজলুল করিম ২০১৪ সালের ১৫ই জুন ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: সরদার ফজলুল করিমের জন্ম ১৯২৫ সালের মে মাসে। বরিশাল জেলার উজিতপুর থানার আটিপাড়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে।
বাবা-মা: বাবা খবিরউদ্দিন সরদার কৃষিকাজ করতেন। মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তাঁরা দুই ভাই তিন বোন।
পড়াশুনা: তাঁর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় মামাবাড়ি আটিপাড়া গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ১৯৩৫ সালে রহমতপুর বয়েজ হাইস্কুলে সরদার ফজলুল করিম চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। থাকতেন কলেজের হোস্টেলে। উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইংরেজি বিভাগে বি.এ. অনার্স ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন তিনি ইংরেজি বিভাগে থাকলেন। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে সরদার ফজলুল করিম দর্শনশাস্ত্রে বি.এ. অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৪৬ সালে এম.এ.-তে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। রাজনীতির কারণে তিনি লন্ডনের স্কলারশীপ প্রত্যাখ্যান করেন।
কর্মজীবন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এন রায়ের ভাই বিনয় রায় ছিলেন দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। সরদার ফজলুল করিমের এম.এ. পরীক্ষার ফল বেরুতেই বিনয় রায় তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতে বললেন। তিনি পরদিন থেকে অর্থাত্ ১৯৪৬ সালে লেকচারার হিসেবে ক্লাস নিতে শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে রাজনীতির কারণে স্বেচ্ছামূলকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ইস্তফা দেন তিনি। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমীর অনুবাদ শাখায় যোগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর সংস্কৃতি শাখার বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কারাগারে থেকে পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
বিয়ে ও ছেলেমেয়ে: ১৯৫৭ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি সুলতানা রাজিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পর সুলতানা রাজিয়া সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে চাকরি নেন। এছাড়া তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রেষণে চার বছর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের এক মেয়ে এবং দুই ছেলে। বড় মেয়ে আফসান করিম, বড় ছেলে সরদার মারুফ ও ছোট ছেলে সরদার মাসুদ করিম।
মৃত্যু : ২০১৪ সালের ১৫ই জুন, ঢাকা।
তথ্যসূত্র
১. সাক্ষাত্কার সরদার ফজলুল করিম, তারিখ :১২.০২.০৭, ২৭.১০.০৭, ২৮.১১.০৭।
২. রুমীর আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ : সরদার ফজলুল করিম; ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯।
৩. মধ্যরাতের অশ্বারোহী – ট্রিলজির প্রথম পর্ব :ফয়েজ আহ্ মদ, জুলাই ২০০৩; পৃষ্ঠা ১১৩-১১৫, ১২০-১২২।
৪. দৈনিক সমকাল, ১২ আগস্ট ২০০৭।
৫. নানা কথার পরের কথা:সরদার ফজলুল করিম, জুন ১৯৮৪।
৬. সেই সে কাল: কিছু স্মৃতি কিছু কথা।
৭. নূহের কিসমত এবং অন্যান্য প্রবন্ধ :সরদার ফজলুল করিম জুন ১৯৯৩।
মূল লেখক : রীতা ভৌমিক
পুনর্লিখন : গুণীজন দল