“তোমায় দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া আর মোটে হবে না। খামোখা তোমার পেছনে মাস গেলে টাকা গুনে যাওয়া। এম এ ডিগ্রির নামে বিলাসিতা, তা আমাদের মোটে পোষায় না। এখন বাদ দাও ঐ সব। তার চাইতে দেশের বাড়িতে চিঙ্গাশপুরে চলে যাও। চাষবাসের কামটাম শেখো গে। তা হলে শেষ পর্যন্ত কিছু একটা করে খেতে পারবে।”
বাবার লেখা চিঠির উপরে উল্লিখিত অংশটি পড়ার পর তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তিনি ভাবলেন, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে একেবারে গণ্ডগ্রামে নির্বাসন!
কিন্তু বাবার নির্দেশ মতো চিঙ্গাশপুর গ্রামে হালচাষ করতে যেতে হয়নি তাঁকে। বাবার আশংকাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন। পিএইচডি করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এতক্ষণ যাঁর কথা বলছি তিনি জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। অনেক অবদান তাঁর। ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। প্রবাসে থেকেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন নিরন্তন।
বগুড়া শহরতলী পেরিয়ে পশ্চিমপাশে রেললাইনের গা ঘেঁসা গ্রাম নিশানদারা। এই গ্রামেই ১৯২৭ সালের ১ মে গাছগাছালিতে ঢাকা নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে নানাবাড়িতে জন্মেছিলেন তিনি। চিরাচরিত গ্রাম্য দাই এর হাতেই তাঁর জন্ম। নানা ছিলেন মাধ্যমিক স্কুল-পন্ডিত।
দাদাবাড়ি মহাস্থানগড় লাগোয়া গ্রাম চিঙ্গাশপুর। মহাস্থান, অতীতে যা ছিল পুণ্ড্রনগর। দাদার নাম সানিরউদ্দিন আখন্দ। বগুড়ার নবাব বাহাদুর আলতাফ আলী চৌধুরী থেকে বন্দোবস্তো নেয়া তালুকদারি ছিল তাঁদের। অনেক কৃষি জমিও ছিল। বাড়ির ছবিটা এখনও তাঁর চোখে ভাসে। বাড়ির বাইরে বিশাল উঠান। আঞ্চলিক ভাষায় যাঁর নাম খুলি। খুলির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত বিশাল আকারের ধানের গোলা। সামনে কলা পাতা বিছিয়ে খেত-চাষের কামলারা সবাই খুলি জুড়ে দুপুর বেলা খেতে বসে। ওদের জন্য বাড়ির ভেতর থেকে আসে মোটা লাল চালের ভাতের সঙ্গে ডাল আর তরকারি। ভেতর বাড়ির মাঝখানে ছিল বিশাল উঠান। উঠানের চারপাশে ছিল অনেকগুলো ঘর। এছাড়া রান্নাঘর, ঢেঁকিঘর, আঁতুরঘর ছিল আলাদাভাবে। গোসলখানা ছিল কোনার দিকে একটু আড়ালে। তখন মহিলাদের পরদা পুশিদা ছিল। তবে ঘেরাটোপ দেয়া কালো রং এর বোরখার চল ছিল না। ক্ষেত্র বিশেষে ঘোমটা বড় করে টানা হত।
তাঁদের বংশ উপাধি খানদানি ”আকন্দ’ হলেও ধান, পাট, পান এসব কৃষির উপরই তাঁরা নির্ভরশীল। তাঁর দাদা সানিরউদ্দিন আকন্দ মিডল ইংলিশ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এজন্য সবাই তাঁকে তালুকদার সাহেব আর পন্ডিত সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। পূর্ব পুরুষের কৌলীন্য নিয়ে তাঁর দাদার এক ধরনের অহংকার ছিল। তাঁর দাদা তাঁদেরকে তমিজ সম্ভ্রমের ডাক শিখিয়েছিলেন। যেমন- দাদীআম্মা দাদাজান, আব্বাজান আম্মাজান, চাচাজান চাচীআম্মা ইত্যাদি।
বাবা সা’দত আলি আকন্দ ইতিহাসে অনার্স গ্র্যাজুয়েট করেছেন কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে। পরে তিনি আইনেও ডিগ্রী নিয়েছেন। জ্ঞান হবার পর থেকে নিজ নামের সাথে কখনও তিনি পারিবারিক ‘তালুকদার’ উপাধি যোগ করেননি। সা’দত আলি আকন্দের জমি-বিত্তে বিশ্বাস ছিল না। তবে দরাজ কন্ঠে উচ্চহাসি আর মেজাজে সামন্ত গর্জন তিনি উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। তাঁদের সময় থেকেই গ্রামে প্রথম দু’একটা বাড়িতে ইংরেজি শিক্ষার ঢেউ শুরু হয়েছিল। তিনি স্কুলে খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রতি বছর তিনি মুহসিন স্কলারশিপ পেতেন। স্কুল শেষ করে কলকাতা জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে কলেজ পাস করেন। এরপর রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে অনার্স পাস করেন। মাস্টার্স করার জন্য আলিগড় থেকে ডাক এসেছিল। তিনি আংশিক স্টাইপেন্ডও পেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে হাওয়ায় সানিরউদ্দিন আকন্দ রাজি হননি। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁর যাওয়া হয়নি। সা’দত আলি আকন্দের খুব ইচ্ছে ছিল এম এ পাশ করার পর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করবেন। কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি তাঁর। হয়েছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। পুলিশে চাকরি করেন তিনি।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার ইচ্ছেটা বাবা সা’দত আলি আকন্দর পূরণ না হলেও ছেলে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ায় বাবার দু:খটা আর ছিল না।
সারদা পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং শেষে জলপাইগুড়ি জেলার এক থানাতে বাবা সা’দত আলী আকন্দর প্রথম পোস্টিং হয়। কিছুদিন পর ১৯২৬-২৭ সালের দিকে কলকতায় বদলি হন তিনি। শেয়ালদার কাছাকাছি ৮৫ নম্বর বৈঠকখানা রোডের একটা বাড়িতে থাকতেন তাঁরা। ৮৫ নম্বর বৈঠকখানা রোডের এই বাড়িটির চারপাশ দেড় মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। পুরো প্রাচীরের উপরে কাঁটাতারের বেড়া ছিল। এই বাড়িতেই পাঁচ বছর বয়সে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের হাতেখড়ি হয়। হাতেখড়ি উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁর বাবা কাছের দোকান থেকে বর্ণ পরিচয়, আদর্শ লিপি, ধারাপাত আর স্লেট পেন্সিল কিনে এনেছিলেন। স্লেট শব্দটি তিনি তখন উচ্চারণ করতে পারতেন না। বলতেন সেলেট। নিউমার্কেটের দরজি দিয়ে বানানো হয়েছিল হাফশার্ট, হাফ প্যান্ট। বাটার দোকান থেকে জুতাও আনা হয়েছিল। ঘরের মেঝেতে রঙ্গিন পাটি বিছিয়ে তাঁর বাবা বসেছিলেন। আর পরিপাটি করে ছেলেকে সেজেগুজে নিয়ে তাঁর কোলের উপর বসিয়েছিলেন। ছেলের দু আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল গুঁজে দিয়ে বাবা ছেলের ডান হাতটা ধরে স্লেটের উপর লেখালেন অ আ ক খ, সাথে সংখ্যাও লেখালেন ১ ২ ৩ ৪। আর মুখ দিয়ে অক্ষরগুলি উচ্চারণ করিয়ে নিলেন। এভাবেই হাতেখড়ি হয়ে গেল মুস্তাফা নুরউল ইসলামের। বাড়িতে রান্না করা হয়েছিল পোলাও-কোরমাসহ সব ভাল ভাল খাবার দাবার। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশিরা এসেছিলেন। তিনতলায় থাকতেন সৈয়দ এমদাদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার, কবি আবদুল কাদির। হাতেখড়ি পাঁচবছর বয়সে হলেও তাঁকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল আরও পরে। বাবা তাঁকে পড়ার রুটিন বেঁধে দিয়েছিলেন। বাবার পড়ার ঘরের একপাশে বসানো হলো ছোট টেবিল আর নীচু চেয়ার। সকালে নাস্তার পর মুস্তাফা নুরউল ইসলাম ঘন্টাখানেক পড়াশুনা করতেন। সুর করে পড়তেন- স্বরে অ’তে ‘অজগরটি আসছে তেড়ে’, স্বরে আ’তে ‘আমটি আমি খাব পেড়ে। প্রতিদিনের দেখাশুনা করতেন তাঁর মা। বাবা মাঝে মাঝে তাঁর বিদ্যার্জন কতটা এগুচ্ছে সেই খবর নিতেন।
পড়াশুনার পাশাপাশি ঐ বাড়িতে তাঁর খেলাধুলারও হাতেখড়ি হয়েছিল।। কত বিচিত্র রকমের খেলা খেলতেন তিনি। মার্বেল-লাট্টু-ডাংগুলি-দাঁড়িয়াবান্ধা থেকে ব্যাডমিন্টন-টেবিল টেনিস, ফুটবল-ক্রিকেট-বাসকেট বল-ভলিবল আরও কত খেলা। এই বাড়িতে ফাঁকা জায়গা তেমন ছিল না। নীচে কিছুটা জায়গা পাকা ছিল। সেখানেই সব ফ্ল্যাটের ছেলেরা একসাথে বিকেলে খেলতেন। তাঁরা কখনও বাইরে বের হতে পারতেন না। গেট সবসময় বন্ধ থাকত আর গেটে সবসময় পাহাড়া দিত রাইফেল কাঁধে গুরখা পাহারাদার।
মিউনিসিপ্যালিটি স্কুলের শিক্ষক হরিচরন স্যার তাঁর ছোট দুভাইকে বাসায় পড়াতে আসতেন। তাঁর কাছেই তিনি দিনের পর দিন শুনেছেন মাস্টার দা সূর্য সেন, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহের কথা। তাঁদের পাহাড়তলিতে জীবনপণ অভিযান, অস্ত্রাগার লুন্ঠন আর জালালাবাদ পাহাড়ের লড়াইয়ের কথা তিনি হরিচরণ স্যারের কাছেই শুনেছেন। মাস্টার দা সূর্য সেন ধরা পড়ার পর জেলের ভেতরে তাঁর ফাঁসি, তাঁর সাথের অনেকের কালাপানি যাবজ্জীবন দীপান্তর। এসবের কিছু বুঝতেন আর কিছু বুঝতেন না। তবে দু:সাহসী ভয়ংকর সেসব লড়াই আর অভিযান তাঁকে খুব আকর্ষণ করত। সূর্য সেনের বাড়ি নোয়াপাড়া থেকে মাইল তিন চারেক দূরে ছিল হরিচরণ স্যারের গ্রামের বাড়ি।
এই হরিচরণ স্যারই প্রথম তাঁর ভেতরে লড়াই সংগ্রামের বীজ বপন করেছিলেন। আর সেকারণে পরবর্তীতে তিনি ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতা আর রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। প্রবাসে বসেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন।
বাবার বদলির চাকরির কারণে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনার পর ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। আর এখানকার আনন্দমোহন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
তাঁর বাবার শখ ছিল ছেলেকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কোনটি হওয়ার শখ ছিল না তাঁর। কিন্তু বাবার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে না বলবেন এমন সাহসও হয়নি তাঁর। মাকে অনুরোধ করলেন বাবাকে বুঝানোর জন্য। কিন্তু যখন দেখলেন মা বাবাকে বুঝানোর পরিবর্তে মাও বাবারই দলে, তখন এক কাকভোরে কাউকে কিছু না বলে দিনাজপুরের বাড়ি থেকে পালালেন তিনি। এখানে সেখানে কিছুদিন ঘুরে ফিরে অবশেষে বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়ি ফিরে মাথা নীচু করে বাবার তর্জন গর্জন শুনলেন। অবশেষে তিনি ভর্তি হলেন দিনাজপুরের রিপন কলেজে আর্টসে। কলকাতায় জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে এটি শিফট করা হয়েছিল দিনাজপুরে। কলেজের নিজের বাড়ি ছিল না, মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে সকাল সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত সময় রিপন কলেজের জন্য বরাদ্দ ছিল। এই রিপন কলেজই পরবর্তীতে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের নাম ধারন করে। তিনি তখন এই কলেজের ছাত্র হলেন। এই কলেজ থেকে বি এ পাস করলেন তিনি।
এবার বাবার চাপ আইন পড়ার জন্য। তাঁর স্বপ্ন ছেলে বার-এ্যাট-ল হবে। শুনতেও ভাল লাগবে তাঁর। আর তা যদি না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবে। আর এ উদ্দেশ্যে ছেলেকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। ঢাকায় যাওয়ার সময় ছেলেকে পইপই করে বুঝালেন তিনি। বললেন, ‘ঢাকায় যেয়ে ইভনিং ক্লাশে ল’তে ভরতি হয়ে যা, সাথে ডে ক্লাশে হিস্ট্রিতে। তবে হিস্ট্রি ভাল না লাগলে ইংরিজি নিবি।’
বাবার কথামতো ল’তে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে তাঁর ভাল লাগেনি। এরপর বাবার কথামতো আসে হিস্ট্রি। হিস্টির সন , তারিখ, রাজা-রাজড়াদের নাম এসব মনে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব। এরপর বাবার লিষ্ট অনুযায়ি বাকি থাকে ইংরিজি। স্কুলে বরাবরই তিনি গ্রামার আর বানানে গোলমাল করতেন। অতএব এটাও বাদ। সবশেষে ভর্তি হলেন বাংলায়। কারণ ছেলেবেলা থেকে এপর্যন্ত পড়া হয়েছিল প্রচুর বই। সেকারণে বাংলাতেই তাঁর আগ্রহ। তাঁর বাবা আশাহত হয়েছিলেন তবে আপত্তি করেননি। এরপর ১৯৬৯ সালে স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন যান। সেখানে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করেন।
১৯৪৬ সালের আগষ্ট মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর ড. গোবিন্দ চন্দ্রের উদ্যোগে তাঁরা সর্বদলীয় শান্তি কমিটি গঠন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র রাজনীতি করতেন তিনি। ১৯৪৮-৪৯ সালে আ্যাটাসড স্টুডেন্ট হিসেবে রেকর্ড পরিমান ভোট নিয়ে সলিমুল্লাহ হল স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট(ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে সর্ব প্রথম বাংলায় বাজেট পেশ করেছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। দিনাজপুরে তাঁরা মুসলিম ছাত্রলীগ দাঁড় করিয়েছিলেন।
১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ সেক্রেটারি আবুল হাশিম একবার দিনাজপুরে এসেছিলেন। সামনে প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারণা সংগঠিত করাই আবুল হাশিমের মূল উদ্দেশ্য ছিল। মুস্তাফা নুরউল ইসলামসহ আরও অনেককে নিয়ে তিনি বৈঠক করেছিলেন। মুস্তাফা নূরউল ইসলামরা টিনের তৈরী চোঙ্গা নিয়ে পাড়ায়-পাড়ায়, রাস্তায়-রাস্তায় প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন। তিনি ভাল পোস্টার লিখতেন। চাঁদার পয়সায় কুলোতনা বলে তখন পোস্টার ছাপানো হত না। গাছের ডাল কেটে ছেঁচে তুলির মতো করা হত। ঐ ছ্যাঁচানো ডাল পিরিচে গোলা কালির মধ্যে চুবিয়ে খবরের কাগজের উপর মিটিং এর স্থান, বক্তার নাম, তারিখ, সময় এসব লেখা হত। এরকম অসংখ্য পোস্টার তিনি লিখেছেন।
সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক এক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার খবর পেলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। ঢাকায় যাওয়ার ডাক এল তাঁদের। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুদিন ধরে বৈঠক হওয়ার পর গঠিত হল ‘ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথ লীগ অফ পাকিস্তান’। সংক্ষিপ্ত নাম ‘ডি ওয়াই এল পি’ । এটি গঠিত হওয়ার পর নতুন করে দীক্ষামন্ত্র তাঁদের-‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ মানুষের অধিকার-এটাই শেষ চরম সত্য। কিন্তু এই সংগঠনটি বেশি দিন টেকেনি।
৪৮ এর বিক্ষুব্ধ মার্চ মাস। সবার দাবি একটাই ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। মুস্তাফা নূরউল ইসলামরা সবাই বিরামহীন পরিশ্রম করছেন। রমনায় এবং পুরান ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় হরতালের ডাকে প্রচারনা চালিয়েছেন। ছোট ছোট গ্রুপ মিটিং করেছেন, মিছিল করেছেন। বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু থেমে থাকেননি। এভাবেই তাঁদের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছে মাতৃভাষা আদায়ের দাবি।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্রিটিশ জনমত সংগঠিত করার জন্য তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। মিটিং করতেন লন্ডনের হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার, অক্সফোর্ড সার্কাসে । মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে অন্যান্য প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের কে নিয়ে তিনি একটা সাহায্য রজনী সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এই সঙ্গীতানুষ্ঠানের সমুদয় অর্থ বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য সাহায্য তহবিলে দিয়েছিলেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে বিবিসিতে সংবাদ পাঠ করতেন তিনি। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে তাঁরা মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারিত ডাকটিকেট প্রকাশনা-উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। এই উৎসব আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে জানিয়ে দেয়া- আমাদের প্রবসী সরকারের রয়েছে আপন ডাকটিকেট। লন্ডনের হাইড পার্কে হাজার হাজার মানুষের গণসমাবেশ করেছেন তাঁরা। এই সমাবেশ থেকে দুটো দাবি তোলা হয়েছিল- এক. অনতিবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ২.অনতিবিলম্বে পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি। এসব কারণে তাঁর স্কলারশিপ বাতিল হয়েছিল। দেশে তাঁর ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। যার ফলে তিনি দেশে তাঁর স্ত্রী ও বাবাকে টাকা পাঠাতে পারতেন না। দেশে তাঁর বাবার বাড়ি আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি । চালিয়ে গেছেন তাঁর আন্দোলন সংগ্রাম। ছোটবেলা থেকে প্রচুর বই পড়তেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। তাঁর বাবা ধারাবাহিক লিখতেন ‘বুলবুল’-এ। খুব উঁচু মানের রুচিরিদ্ধ পত্রিকা ছিল বুলবুল। এই পত্রিকায় লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র, নজরুল, কাজী আবদুল ওদুদ, অন্নদাশংকর, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রমুখ অনেকেই। তাঁর বাবার বইও প্রকাশ হয়েছে। তাঁর বাবা অফিস শেষে যতটুকু সময় পেতেন পুরোসময় বিচিত্র রকম বই পড়তেন। আর অবসরে যেতেন ১১ নম্বর ওয়েলেসলী স্ট্রীটে। সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের উদার আতিথেয়তায় সেখানে বসত ‘সওগাতী’দের আসর। বাবার গা ঘেঁসে হাত আঁকড়ে চুপচাপ বসে থাকতেন তিনি। বড়দের সেসব কথা শুনতেন। সেসব কথা মাথায় না ঢুকলেও ভাল লাগত তাঁর। আর এসবের মধ্যদিয়েই ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে লেখালেখির বীজ বপিত হয়েছে। চট্টগ্রামে থাকার সময় প্রতিবেশি কমলদা তাঁকে বই পড়ার নেশায় ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শুরুটা হয়েছিল রূপকথা, ভূতের গল্প, কিসসা কাহিনী দিয়ে। ১৯৪৫ সালে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে অনুষ্ঠিত সারস্বত সম্মেলন উপলক্ষে উত্তরবঙ্গে আন্ত:কলেজ রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। বিষয় ছিলো- রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ও সমাজ ভাবনা। দিনাজপুর কলেজ থেকে তিনি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানকার প্রতিভা মৈত্রেয় এবং তিনি একত্রে দু’জনে ব্র্যাকেটে ফার্স্ট হয়েছিলেন।
স্কুল জীবনের শেষ দিকে পত্রিকা প্রকাশ করার নেশায় পেয়ে বসেছিল তাঁকে। ‘বাহাদুর’ নামে হাতে লেখা ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। সেখানে তিনি অ্যাডভেঞ্চারের একটা বড়ো গল্প লিখেছিলেন। এরপর ‘হাতিয়ার’ ও ‘অগত্যা’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকেই আবৃত্তি করতেন তিনি। এসময় থেকেই বিভিন্ন্ নাটকে অভিনয়ও করতেন।
হিমালয়ের ভয়ংকর, কাউন্ট অব মন্টেক্রিস্টো, জাপানি ভূত এগুলি তাঁর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা বই। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলি হলো-নজরুল ইসলাম, সমকালে নজরুল ইসলাম, সাময়িক পত্রে জীবন ও জনপদ, Bengalee Muslim Public Opinion, আমাদের মাতৃভাষা চেতনা ও ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশ:বাঙালি আত্মপরিচয়ের সন্ধানে, আবহমান বাংলা, আমাদের বাঙালিত্বের চেতনার উদ্বোধন ও বিকাশ, সময়ের মুখ তাহাদের কথা, শিখা সমগ্র, নির্বাচিত প্রবন্ধ, নিবেদন ইতি পূর্ব খণ্ড, নিবেদন ইতি উত্তর খণ্ড ।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম দৈনিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাব এডিটর হিসেবে চাকরি করেন। সংবাদে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন তিনি। কিন্তু এটি বেশি দিন চলেনি। এনলিষ্টেড রেডিও আর্টিষ্ট ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে নাটকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছিলেন পাঁচ টাকার চেক।
পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ও সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজে অধ্যাপনা করেন তিনি। সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজই এখনকার নটারডাম কলেজের আদি প্রতিষ্ঠান। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন তিনি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করেন তিনি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ও বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা, সংস্কৃতি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন তিনি ।
সিরাজগঞ্জের মোশারফ হোসেনের মেয়ে ইরার সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৫৭ সালের ১১ এপ্রিল। তাঁর শ্বশুর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর তিন সন্তান ইমন, রুমনী ও রাজন।
জাতীয় একুশে পদক,বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কারসহ আরও অন্যান্য পুরস্কারে ভূষিত হন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ।
মৃত্যু- ৯ মে, ২০১৮ সালে (বয়স ৯১) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: ‘নিবেদন ইতি’ পূর্ব খণ্ড লেখক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, প্রকাশক- মাজহারুল ইসলাম, প্রকাশনী- অন্যপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ২০০৫ এবং ‘নিবেদন ইতি’ উত্তর খণ্ড লেখক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, প্রকাশক- মাজহারুল ইসলাম, প্রকাশনী- অন্যপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ২০০৭
লেখক: মৌরী তানিয়া