তখনকার ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের রীতি অনুযায়ী জন্মস্থান মাড়গ্রামে কুদরাত-এ-খুদার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল। একদিন বেশ আয়োজন করে, নতুন জামাকাপড় পরিয়ে বিসমিল্লাহ্ থেকে শুরু করে পবিত্র কোরানের কয়েকটি আয়াত লেখানোর মাধ্যমে তাঁর পড়ালেখার সূচনা হয়। মোনাজাতের মাধ্যমে সেদিনের মতো হাতেখড়ির কাজটি সম্পন্ন হয় এবং এ উপলক্ষে উপস্থিতদের মধ্যে মিষ্টিও বিতরণ করা হয়। এরপর মক্তবে গিয়ে হাফেজ হওয়ার উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরান শরীফ মুখস্থ করার কঠিন পর্বটিও আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে পড়ুয়াদের প্রতি হাফেয সাহেবের নির্দয় প্রহার দেখে কিছুদিনের মধ্যেই নিজের হাফেয হবার আগ্রহ উবে যায় তাঁর। বাড়িতে একমাত্র খেলার সঙ্গী ছোট মামাকে বাংলা পড়ার জন্য পাঠশালায় পাঠানো হলে হাফেয সাহেবের মক্তব ছেড়ে পাঠশালা যাওয়ার ইচ্ছে হয় তাঁরও। কিন্তু সেখানেও পড়া তৈরী না করার কারণে নির্দয় ও ভয়ঙ্কর শাস্তির ব্যবস্থা দেখে পরদিন থেকেই পাঠশালায় যাওয়া বন্ধ করেন। এরপর মেজো মামার কথামতো কুদরাত-এ-খুদাকে ভর্তি করানো হয় মাড়গ্রাম এম.ই. স্কুলে। এম.ই. স্কুলের পণ্ডিত মশাইয়ের স্নেহার্দ্র ব্যবহার কুদরাত-এ-খুদাকে পড়াশোনায় অনুপ্রাণিত করে। এই স্কুলে এসে তিনি পড়াশুনায় মনোযোগি হন এবং পরবর্তী জীবনে একজন বিজ্ঞানসাধক ও সফল সংগঠক ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার একজন পথিকৃৎ । কর্মজীবনের সকল পর্যায়ে দেশের নানাবিধ উন্নতির জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সার্বিক আলোচনা ও এর ভবিষ্যত রূপরেখা সম্বন্ধে আলোকপাত-সমৃদ্ধ “কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট” তাঁরই অসামান্য অবদান।
১৯০০ সালের ৮ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার মাড়গ্রাম গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা। বাবা সৈয়দ শাহ সুফী খোন্দকার আবদুল মুকিত ছিলেন ভারতের মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার সীমান্ত মৌ গ্রামের অধিবাসী। মা সৈয়দা ফাসিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিনী। জনাব আবদুল মুকিত আঠারো শতকের শেষদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পাস করেছিলেন। সরকারি চাকুরি তাঁর জন্য সহজলভ্য ছিল, কিন্তু তিনি তা না করে ধর্মচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। বাবা-মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান।
এম.ই. স্কুলে ভর্তি হয়ে পর পর দুইবছর ডবল প্রমোশন লাভ করেন তিনি। এরপর বড় মামার কাছে থেকে পড়াশোনা করার জন্য গ্রামের স্কুল ছেড়ে কলকাতার মিরজাপুর স্ট্রীটে অবস্থিত উডবার্ণ এম.ই. স্কুলে ভর্তি হন। বাংলা শেখার ব্যবস্থা না থাকায় তিনি উর্দুতে মাইনর স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন এবং বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বৃত্তিলাভ করেন। দু’বছর পর মধ্য ইংরেজি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন এবং কলকাতা মাদ্রাসায় অ্যাংলো পারশিয়ান বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় পণ্ডিত মশাইয়ের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলা পড়তে শুরু করেন তিনি। স্কুলে বরাবরই তিনি ক্লাসে প্রথম হতেন। ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো পারশিয়ান বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে রসায়নের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। রসায়নের পরীক্ষণ-সংক্রান্ত কাজগুলি তাঁর মনোযোগ এতটা আকর্ষণ করে যে, পরীক্ষণাগারেই অধিকাংশ সময় কাটাতেন তিনি। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অভিভাবকরা তাঁকে খুব সামান্য পরিমাণ অর্থ পাঠাতেন। এর বাইরে প্রায় সম্পূর্ণভাবে তাঁকে নির্ভর করতে হতো বৃত্তির টাকার ওপর। তাই জীবনের প্রয়োজনগুলোকে সীমিত রেখে, অত্যন্ত পরিশ্রম করে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কলেজের পাঠ শেষ করেন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজেই স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা শুরু করেন। ১৯২৪ সালে তিনি এই কলেজ থেকে রসায়নশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এসসি. ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এই ফলাফলের জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন।
এম.এসসি. পাস করার পর কুদরাত-এ-খুদা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরির আবেদন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের নিয়োগপত্র হাতে পান যথাসময়ে। এই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত স্টেট স্কলারশিপ লাভ করে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডনে পাড়ি জমান ১৯২৪ সালের শেষের দিকে। সেখানে তাঁর গবেষণাকাজের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক থর্প-এর কাছে ডি.এসসি. ডিগ্রির জন্য কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। প্রতিদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলতে থাকে তাঁর গবেষণাকাজ। ১৯২৯ সালে কুদরাত-এ-খুদার ডি.এসসি. ডিগ্রির গবেষণাকাজের পরীক্ষক হয়ে এসেছিলেন সে-কালের প্রসিদ্ধ রসায়নবিদ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক উইলিয়াম হেনরী পার্কিন জুনিয়র। তিনি কুদরাত-এ-খুদার কাজ দেখে ও তাঁর বিবরণ পড়ে অত্যন্ত খুশী হন এবং তরুণ এই গবেষককে অক্সফোর্ডে তাঁর ল্যাবরেটরিতে কিছুদিন গবেষণা করতে আমন্ত্রণ জানান। অধ্যাপক থর্পও তাঁর ছাত্রের কাজে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে সেখানে থেকে গবেষণাকর্ম চালাবার পরামর্শ দেন এবং বেশ উচ্চ পরিমাণে বেতনসহ কাজের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু নিজ দেশে ফিরে যাবার নির্দেশ এবং লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ মল্লিকের পরামর্শে কুদরাত-এ-খুদা দেশ সেবার প্রয়োজনের কথা উপলব্ধি করে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত হন। সে-বছরই তিনি লন্ডন ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ডি.এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে দেশে ফিরে কুদরাত-এ-খুদা তাঁর নতুন গবেষণার পরিকল্পনাগুলোকে বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু নবঅর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাবার জন্য উপযুক্ত সুযোগ না পেয়ে তিনি হতাশ হন। এ সময়ে অধ্যাপক বর্ধনের উৎসাহে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য একটি থিসিস প্রস্তুত করতে শুরু করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক রাজেন্দ্রনাথ সেন কলেজের গবেষণাগারে তাঁকে গবেষণার সুযোগ দেন। “টানহীন চক্রিক যৌগদের সম্বন্ধে” একটি গবেষণালব্ধ নিবন্ধ প্রস্তুত করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। নিবন্ধটি বিখ্যাত চিকিৎসক এবং রসায়নশাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কর্তৃক যাচাইয়ের পর কুদরাত-এ-খুদা প্রথম মুসলিম ছাত্র হিসেবে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলারের সম্মান অর্জন করেন। নিবন্ধের বিষয়টি বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা বিশ্বে অভিনন্দিত হয় টানহীন উপপত্তির প্রথম পরখগত প্রমাণ বলে। একই বছর তিনি মোআট স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এসসি. ডিগ্রি অর্জন করে ১৯২৯ সালে কুদরাত-এ-খুদা যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন সমগ্র ভারতবর্ষে ডি.এসসি. ডিগ্রি অর্জনকারী মুসলমান তরুণ ছিলেন একমাত্র তিনিই। তবুও নিজ দেশে একটি উপযুক্ত কাজের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় দুই বৎসরেরও বেশি সময়। অবশেষে ১৯৩১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন কুদরাত-এ-খুদা। শিক্ষকতার শুরুতেই তিনি কলেজে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ১৯৩৬ সালে উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে উন্নীত হওয়ার পর অনেক অসুবিধার মধ্যেও বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
১৯৩৬ সালে তদানীন্তন সরকারের আমন্ত্রণে কুদরাত-এ-খুদা প্রথম শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি বক্তৃতা করতে এবং সেটি প্রবন্ধের আকারে ছাপবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শিক্ষা সপ্তাহে কবিগুরু যে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন তার নাম ছিল “শিক্ষায় স্বাঙ্গীকরণ”। শিক্ষাকে হৃদয়ঙ্গম করতে একে নিজের ভাষায় আয়ত্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা লিখেছিলেন সেই প্রবন্ধে। ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা একই ধারায় চিন্তা করতেন এবং তাকেই রূপ দিয়েছিলেন প্রথম বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী গ্রন্থটি লিখে যা সেই সময়ে পাঠ্যপুস্তকরূপে মনোনীত হয়। এই শিক্ষা সপ্তাহের কিছুদিন পরেই বাংলার মাধ্যমে ম্যাট্রিকিউলেশনের সকল বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা হয়। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে. ফজলুল হক সাহেবের বিশেষ অনুরোধে কুদরাত-এ-খুদা ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অল্প কয়দিনের মধ্যেই তিনি এই কলেজে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেন। একই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের বিশেষ অনুরোধে তিনি প্রতিদিন চার ঘণ্টা প্রেসিডেন্সি কলেজে কাজ করতে থাকেন। এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিরে এসে এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর কুদরাত-এ-খুদা তাঁর পরিবার নিয়ে কলকাতা ত্যাগ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের পরামর্শে তিনি সে-বছরই পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রথম জনশিক্ষা পরিচালকের (ডিপিআই) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই দায়িত্ব গ্রহণ করার পর বিভিন্ন পল্লী অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি, বয়স্ক শিক্ষা জোরদার, নতুন বিদ্যালয় স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি শিক্ষাকে ব্যাপকতর করার চেষ্টা করেন। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ডিপিআই-এর দায়িত্ব পালন করার অন্তর্বর্তীকালে কুদরাত-এ-খুদা পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলা ভাষাকে বলবৎ রাখতে সচেষ্ট হন। জনাব ফযলী করিম সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদেরকে আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু পাঠ করতে প্রস্তাব করলে কুদরাত-এ-খুদা এর বিরোধিতা করেন। সে-বছরই কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেশক কমিটির প্রথম অধিবেশনে কুদরাত-এ-খুদা প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষাকে সমৃদ্ধ করা এবং এর মাধ্যমে শিক্ষাদান করার প্রস্তাব করেন। অধিবেশনে উর্দু ভাষাকে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রস্তাবনার তীব্র প্রতিবাদ করেন তিনি।
১৯৪৯ সালে তাঁকে করাচিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়। তিন বছর পর এই মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে কুদরাত-এ-খুদা ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়। সেখানে এক বছর দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে পূর্বাঞ্চলীয় শাখা গঠনের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই গবেষণাগারের পরিচালকের দায়িত্বে কর্মরত থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে কুদরাত-এ-খুদাকে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু আইয়ুব-মোনায়েম খানের চক্রান্তে সেখান থেকে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়।
পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (পিসিএসআইআর) পূর্বাঞ্চলীয় শাখার পরিচালক-সংগঠক হিসেবে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বনজ, কৃষিজ ও খনিজ সম্পদের সর্বোত্তম সঠিক ব্যবহারের জন্য গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু করেন। বনৌষধি ও গাছগাছড়ার গুণাগুণ, পাট, কাঠকয়লা এবং মৃত্তিকা, লবণ ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। স্থানীয় বিভিন্ন গাছগাছড়া থেকে জৈব রাসায়নিক উপাদান নিষ্কাশনে সক্ষম হন, যা ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আনারস ও কলার ছোবড়া থেকে অত্যন্ত সুন্দর রেশমী ঔজ্জ্বল্যবিশিষ্ট লম্বা আঁইশ বের করতে সক্ষম হন। কবিরাজ ও হেকিমদের ব্যবহৃত নাটাকরহ থেকে তিনটি রাসায়নিক উপাদান, তেলাকুচা থেকে বারোটি যৌগ ছাড়াও তিনি তুলসী, বিষ কাঁটালী, গুলঞ্চ, কালমেঘ, হরিদ্রা, কচুরীপানা, ক্যাসাভা ইত্যাদি থেকে বিভিন্ন জৈব পদার্থ নিষ্কাশন করেছিলেন যার সবই ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পাটখড়ি থেকে কাগজ তৈরি তাঁরই গবেষণার ফল। পাটকাঠি থেকে পারটেক্স উৎপাদন, চিটাগুড় ও তালের গুড় থেকে ভিনেগার প্রস্তুত ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। বিজ্ঞানী হিসেবে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা ও তাঁর সহকর্মীদের ১৮টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারেরর পেটেন্ট রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সঞ্চিত খনিজ দ্রব্যের ওপর তথ্য নিয়ে কোথায় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তার ইঙ্গিত লিপিবদ্ধ করে তিনি বাংলা একাডেমী থেকে একটি বই প্রকাশ করেন। লবণ, সিমেন্ট ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। বন বিভাগ, কৃষি বিভাগ, মৎস বিভাগ, পশুপালন বিভাগ, শিল্প বিভাগ, খনিজ সম্পদ বিভাগ-এই ছয়টি বিভাগের সমবায়ে “কেন্দ্রীয় গবেষণা আলোচক সংঘ” প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব করেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত হন ড. কুদরাত-এ-খুদা। এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে তিনি অল্প সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রতিবেদনে তিনি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর একটি সার্বিক আলোচনা এবং এর ভবিষ্যত রূপরেখা সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এক কর্মধারা উপস্থাপন করেন। এই প্রতিবেদনটি “কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট” নামে পরিচিত যা তাঁর কর্মজীবনের একটি বিশেষভাবে স্মরণীয় অবদান। ১৯৭৫ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে, লন্ডনের জার্নাল অব কেমিক্যাল সোসাইটিতে। এই প্রবন্ধে তিনি কার্বোক্সিসাইক্লোহেক্সেন এসিটিক এসিড তৈরি করা সম্বন্ধে আলোচনা করেন। ১৯২৯ সালে ঐ একই জার্নালে কার্বোক্সি এসিটিল ডাইমিথাইল বিউটিরিক এসিডের রিং চেন টাউটোমারিজম নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। তাঁর পরবর্তী গবেষণালব্ধ ফলের বিবরণও একই জার্নাল প্রকাশ করে তিনটি প্রবন্ধে। ১৯৩০ সালের দিকে ড. খুদা স্টেরিওকেমিস্ট্রি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সতেরো বছর তিনি ইন্ডিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে চৌদ্দটি গবেষণাপ্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত “নেচার” পত্রিকাতেও তিনি এ সময়ে “স্টেনলেস মনোসাইক্লিক রিং” এবং “মাল্টিপ্লেনার সাইকোহেক্সেন রিং” নামে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। রিং সিস্টেমের ওপর তিনি যে তত্ত্ব দিতে চেয়েছিলেন, জৈব রসায়নশাস্ত্রে তা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী আসন লাভ করতে না পারলেও তাঁর গবেষণার মৌলিকত্ব ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে তাঁর মোট ৯২টি বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে।
জাতীয় জীবনে বিজ্ঞানকে যথাযথভাবে প্রয়োগের জন্য কুদরাত-এ-খুদা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় বিশ্বাস করতেন। প্রথম গ্রন্থ বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী তৎকালীন ডিপিআই সাহেব কর্তৃক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক মনোনীত হওয়ার পাশাপাশি হিন্দী, উর্দু ও অহমীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল এই পুস্তকটি। প্রথম গ্রন্থের বিপুল জনপ্রিয়তার পর প্রকাশকদের অনুরোধে তিনি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য রচনা করেন বিজ্ঞানের সরল কাহিনী ও বিজ্ঞানের সূচনা নামে আরও দুইটি গ্রন্থ। তাঁর রচিত জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ক অন্য গ্রন্থগুলি হলো যুদ্ধোত্তর বাংলার কৃষি ও শিল্প, পরমাণু পরিচিতি, বিচিত্র বিজ্ঞান, পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প সম্ভাবনা, বিজ্ঞানের সূচনা, বিজ্ঞানের সরল কাহিনী এবং বিজ্ঞানের পহেলা কথা। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর পাঠ্যপুস্তকসমূহের মধ্যে রয়েছে চার খণ্ডে লিখিত প্রাথমিক পাটিগণিত, চার খণ্ডে লিখিত মুক্তামালা, জৈব রসায়ন (১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ভাগ) এবং কলেজ কিমিয়ার কথা। ইংরেজিতেও বেশ কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন তিনি। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পবিত্র আল-কুরআনের বাংলা অনুবাদ। তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বেশ কয়েকটি সহযোগী পাঠ্যপুস্তক। রয়েছে ভ্রমণমূলক রচনা চীন সফরের রোজনামচা।
মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা পারিবারিক জীবন শুরু করেছিলেন কলেজ জীবনেই। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি আকরামুন্নেছা উম্মাল উলুম সাদাত আকতারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আকরামুন্নেছা ছিলেন বারাসতের অধিবাসী প্রখ্যত আইনজীবী আলহাজ্জ্ব কাজী গোলাম আহমেদের কনিষ্ঠ কন্যা। কুদরাত-এ-খুদা ও আকরামুন্নেছা দম্পতির দুই পুত্র ও চার কন্যা।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে একুশে পদক প্রদান করে সম্মানীত করেন। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ ১৯৭৯ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদার নামে একটি স্বর্ণপদক প্রবর্তন করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে তাঁকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন। ১৯৯০ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার বসতভিটায় প্রতিষ্ঠিত হয় ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা গ্রামীণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশ কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা। একই বছর সেখানে রামপুরহাট থেকে মাড়গ্রাম পর্যন্ত সড়কটি “ড. কুদরাত-এ-খুদা সড়ক” নামকরণ করা হয়। ১৯৯৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই মহান বিজ্ঞানীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে ঢাকাস্থ নিউ এলিফ্যান্ট রোডের নাম পরিবর্তন করে “ড. কুদরাত-এ-খুদা সড়ক” নামকরণ করেন।
বার্ধক্যের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৭৭ সালের ৪ অক্টোবর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করনো হয়। সেখানেই ৩ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
পূর্ণনাম: মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা।
জন্ম ও জন্মস্থান: ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মে বাংলা ১৩০৭ সালের ২৬শে বৈশাখ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার মাড়গ্রাম গ্রামে।
বাবা-মা: সৈয়দ শাহ সুফী খোন্দকার আবদুল মুকিত, সৈয়দা ফাসিয়া খাতুন।
স্ত্রী: আকরামুন্নেছা উম্মেল উলুম সাদাত আকতার।
সন্তান-সন্ততি: দুই পুত্র ও চার কন্যা; প্রথম পুত্র ড. আবুল ফাজল আব্দুল হাই মোহাম্মাদ মাহবুব-এ-খুদা, দ্বিতীয় পুত্র ড. আবু রায়হান মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ মঞ্জুর-এ-খুদা, প্রথম কন্যা সৈয়দা আফজালুন্নেছা উম্মাল ফাসিহা ফজল-এ-খুদা, দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা হুসনে আরা শাহের বানু উম্মাল হাবিবা মাকবুলা-এ-খুদা, অপর দুই কন্যা সৈয়দা ফাতেমা-তুজ-জোহরা উম্মল হাসনাত মামুর-এ-খুদা শিরীন এবং সৈয়দা যিনাতুননেসা রওনাক মহল মমতাজ-এ-খুদা।
শিক্ষা: ঘরোয়া পরিবেশে লেখাপড়া শুরু। ছোটোবেলাতে বেশ কয়বার স্কুল পরিবর্তন করেন। ১৯১৮ সালে, কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো পারশিয়ান বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে দীর্ঘ ছয় বছর পড়াশোনা করেন। একই কলেজে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা করেন। ১৯২৪ সালে এই কলেজ থেকে রসায়নশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এসসি. ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এই ফলাফলের জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত স্টেট স্কলারশিপ লাভ করে উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডনে পাড়ি জমান। ১৯২৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এসসি. ডিগ্রি লন্ডন ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ডি.আই.সি. ডিগ্রি অর্জন করেন। “টানহীন চক্রিক যৌগদের সম্বন্ধে” একটি গবেষণালব্ধ নিবন্ধ প্রস্তুত করে প্রথম মুসলিম ছাত্র হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলারের সম্মান অর্জন করেন। একই বছর মোআট স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন।
কর্মজীবন: ১৯৩১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৬ সালে উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে উন্নীত হন। ১৯৩৬ সালে তদানীন্তন সরকারের আমন্ত্রণে প্রথম শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিরে এসে এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রথম জনশিক্ষা পরিচালকের (ডিপিআই) দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদেরকে আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু পাঠের প্রস্তাবের, উর্দু ভাষাকে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রস্তাবের এবং বাংলাকে আরবী ভাষায় লেখার প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন তিনি। ১৯৪৯ সালে করাচিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখা গঠনের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই গবেষণাগারের পরিচালকের দায়িত্বে কর্মরত থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁকে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু আইয়ুব-মোনায়েম খানের চক্রান্তে সেখান থেকে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনের সভাপতি হিসেবে তিনি অল্প সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রতিবেদনটি “কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট” নামে পরিচিত যা তাঁর কর্মজীবনের একটি বিশেষভাবে স্মরণীয় অবদান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
উদ্ভাবন: পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের পরিচালক-সংগঠক হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বনজ, কৃষিজ ও খনিজ সম্পদের সর্বোত্তম সঠিক ব্যবহারের জন্য গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু করেন। বনৌষধি ও গাছগাছড়ার গুণাগুণ, পাট, কাঠকয়লা এবং মৃত্তিকা, লবণ ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। স্থানীয় বিভিন্ন গাছগাছড়া থেকে জৈব রাসায়নিক উপাদান নিষ্কাশনে সক্ষম হন, যা ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাটখড়ি থেকে কাগজ তৈরি তাঁরই গবেষণার ফল। পাটকাঠি থেকে পারটেক্স উৎপাদন, চিটাগুড় ও তালের গুড় থেকে মল্ট ভিনেগার প্রস্তুত ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। বিজ্ঞানী হিসেবে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা ও তাঁর সহকর্মীদের ১৮টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারেরর পেটেন্ট রয়েছে।
প্রকাশনা: ১৯২৬ সালে লন্ডনের জার্নাল অব কেমিক্যাল সোসাইটিতে কার্বোক্সিসাইক্লোহেক্সেন এসিটিক এসিড তৈরির আলোচনা-সমৃদ্ধ প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালে ঐ একই জার্নালে কার্বোক্সি এসিটিল ডাইমিথাইল বিউটিরিক এসিডের রিং চেন টাউটোমারিজম নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। ১৯৩০ সালের দিকে স্টেরিওকেমিস্ট্রি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সতেরো বছর তিনি ইন্ডিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে চৌদ্দটি গবেষণাপ্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকাতেও তিনি এ সময়ে “স্টেনলেস মনোসাইক্লিক রিং” এবং “মাল্টিপ্লেনার সাইকোহেক্সেন রিং” নামে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে তাঁর মোট ৯২টি বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী, (হিন্দী, উর্দু ও অহমীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই পুস্তকটি), বিজ্ঞানের সরল কাহিনী, বিজ্ঞানের সূচনা, যুদ্ধোত্তর বাংলার কৃষি ও শিল্প, পরমাণু পরিচিতি, বিচিত্র বিজ্ঞান, পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প সম্ভাবনা, বিজ্ঞানের সূচনা, বিজ্ঞানের সরল কাহিনী এবং বিজ্ঞানের পহেলা কথা। বাংলায় প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকসমূহের মধ্যে রয়েছে চার খণ্ডে লিখিত প্রাথমিক পাটিগণিত, চার খণ্ডে লিখিত মুক্তামালা, জৈব রসায়ন (১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ভাগ) এবং কলেজ কিমিয়ার কথা। ইংরেজিতে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে Introduction to Organic Chemistry, Primrose Primer for Class III, Primrose Reader for Class IV, Proceedings of the Bengal Education Week (edited), Laboratory Manual of Chemistry Part-I, Laboratory Manual of Chemistry Part-II| ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পবিত্র আল-কুরআনের বাংলা অনুবাদ। এছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে স্কুলের সহযোগী পুস্তক হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে আঠারোটি পুস্তক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহযোগী বেশ কয়েকটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, ভ্রমণমূলক রচনা ‘চীন সফরের রোজনামচা’।
সম্মাননা: শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত একুশে পদক (১৯৭৬); বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) (১৯৮৪); এছাড়া চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ ১৯৭৯ সালে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার নামে একটি স্বর্ণপদক প্রবর্তন করে। ১৯৯০ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ড. মুহাম্মাদ খুদার বীরভূম জেলার মারগ্রামের বাসভিটায় প্রতিষ্ঠিত হয় ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা গ্রামীণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশ কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা। একই বছর সেখানে রামপুরহাট থেকে মাড়গ্রাম পর্যন্ত সড়কটি ‘ড. কুদরাত-এ-খুদা সড়ক’ নামকরণ করা হয়। ১৯৯৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই মহান বিজ্ঞানীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে ঢাকাস্থ নিউ এলিফ্যান্ট রোডের নাম পরিবর্তন করে ‘ড. কুদরাত-এ-খুদা সড়ক’ নামকরণ করেন।”
মৃত্যু: ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর, ঢাকায়।
তথ্যসূত্র:
১.ব্যক্তিগত যোগাযোগ: সৈয়দা যিনাতুননেসা রওনাক মহল মমতাজ-এ-খুদা; অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
২.মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা; স্মৃতিপটের আলেখ্য; বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ; ২০০৩।
৩.এ.এম. হারুন অর রশীদ; কিশোর বিজ্ঞানসমগ্র; অনুপম প্রকাশনী; ২০০৯।
৪.সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; বাংলা একাডেমী; ১৯৯৭।
লেখক: মো. কুতুব উদ্দিন সজিব