মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের মা মায়মুন্নিসা ছেলেকে কোরানে হাফেজ বা ক্বারী বানাতে চেয়েছিলেন। আর সে জন্য ইসলামী শিক্ষার প্রাথমিক পাঠদানের শুরুটা তাঁর বাড়িতেই হয়েছিল। গৃহশিক্ষা শেষ হওয়ার পর তাঁকে মরিচার নিকটবর্তী বর্ধনপুর জুনিয়ার মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়। ক্বারী হওয়ার তাগিতে তিনি তিন পারা কোরান শরীফ মুখস্ত করেছিলেন। খান্দানী ভাষা হিসেবে মায়ের ইচ্ছানুসারে উর্দুও তিনি পড়াশুনা করেন।
শুধু যে মায়ের তাগিদে এসব করেছেন তা কিন্তু নয়, ছেলেবেলায় তার নিজেরও ছিল আল্লাহর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস। ছেলেবেলায় মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা ছিল তাঁর নেশা। গাছপালা, পশুপাখি, মাঠক্ষেত ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। একদিন মিষ্টি আলুর ক্ষেতে গিয়েছেন নদীর ধারে। মাটি ফেটে হা হয়ে আছে, তার ভিতরে সাদা-সাদা আলুগুলি দাঁত মেলে হাসছে। এমন সময় তিনি দেখলেন একখানা বড় মাকড়সার জাল উঠেছে। এত সূক্ষ্ম পাতলা ও সাদা সূতোগুলো দেখে তাঁর মনে হলো ওগুলো কারও চুল হবে। এত সুন্দর চুল কার হবে? নিশ্চয় আল্লাহর বউয়ের চুল। তাঁর সাথে বড় ভাই ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা ওগুলো কি আল্লাহর বউয়ের চুল?
ছেলেবেলার আল্লাহভক্ত এই ছেলেটি মায়ের কথামতো কোরাণে হাফেজ বা ক্বারী না হয়ে হয়েছেন দেশের একজন কৃতী শিক্ষক ও খ্যাতনামা ভাষাতত্ত্ববিদ মুহম্মদ আবদুল হাই। বিভাগোত্তর বাংলাদেশে যেসব চিন্তাবিদ আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি তাঁদের অন্যতম। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির আশ্রয়ে ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তিনি ছিলেন পথিকৃত। উপরন্তু সাহিত্যের গবেষণা সংগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে কেন্দ্র করে মুহম্মদ আবদুল হাই গড়ে তুলেছিলেন অনন্য পরিবেশ। তাঁর সম্পাদিত ‘সাহিত্য পত্রিকা’ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসাবে এখনো বিবেচিত।
মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯১৯ সালের ২৬শে নভেম্বর বুধবার রাত দশটায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার রাণীনগর থানার মরিচাগ্রাম। তাঁর পুরো নাম আবুল বশার মুহম্মদ আবদুল হাই। তাঁর বাবা আবদুল গণি, মা মায়মুন্নিসা খাতুন। সেসময় প্রবেশিকা পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় অনেকেই প্রকৃত বয়স কমিয়ে নাম রেজিস্ট্রেশন করতো। কিন্তু মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। তিনি বয়স বাড়িয়ে রেজিস্ট্রেশন করেন। সে কারণে প্রবেশিকা পরীক্ষার সনদপত্রে তাঁর জন্মতারিখ দেওয়া আছে ২রা মার্চ ১৯১৯। মুহম্মদ আবদুল হাই যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পদ্মার ভাঙনে সেই গ্রামটি বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু মরিচার অধিবাসীরা নতুন বসতি নির্মাণ করতে গিয়ে সেই পুরাতন বসতির নামটিই ধরে রেখেছেন। কীর্ত্তিনাশা পদ্মার ভাঙাগড়া খেলার সাথে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের শৈশব ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ছেলেবেলায় পদ্মার সেই ভীষণ গর্জনে মায়ের কোলে থেকেও তাঁর গা ছম ছম করত, ভয়ে ঘুম আসত না। বিকালে যেখানে দেখেছেন সুন্দর গাছ পালা, শ্যামল মাঠ পরের দিন ঘুম থেকে উঠে সেখানে দেখেছেন অথৈই পানি। তাঁদের বাড়ি সাত বার পদ্মার ভাঙনের মুখে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত তাঁদের বাড়িঘর সহায়-সম্পদ সবকিছুই সর্বনাশা পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে।
পুরুষানুক্রমে শিক্ষকতা করে এসেছিলেন বলে হাই পরিবার ‘ওস্তাদ পরিবার’ নামে আখ্যায়িত হয়েছিলো। মুহম্মদ আব্দুল হাইয়ের বাবা মৌলভী আবদুল গণি রাজশাহীর পোরশা গ্রামে বিখ্যাত ‘সাহু’ পরিবারে শিক্ষকতা ও ইমামতি করতেন। আবদুল হাই ছিলেন পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্র। দুই ভাই ও সাত বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। শিক্ষকতা ও ইমামতি পেশার কারণে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের বাবা আবদুল গণি পোরশা গ্রামে বছরের অধিকাংশ সময় থাকতেন বলে তাঁর বড় ছেলে মুহম্মদ আবদুল আজিজকেই পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে হতো। মায়ের দিক থেকেও মুহম্মদ আবদুল হাই উজ্জ্বল পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশীদার। তাঁর মায়ের পিতৃ-পুরুষ নবাব আলীবর্দীর আমলে মুর্শিদাবাদ জেলার মরিচা ও রাণীতলা এলাকার এক বিস্তীর্ণ পরগণার জায়গীরদার ছিলেন। পদ্মার ভাঙনে জমিজমা নিঃশেষিত হয়ে গেলে আবদুল হাইয়ের মাতুলেরা রাজশাহী শহরে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মা মায়মুন্নিসার প্রথম স্বামী অকালে মারা যাওয়াতে তিনি বাল্যবিধবা হন এবং আবদুল হাইয়ের বাবার সঙ্গে তাঁর পুনরায় বিয়ে হয়।
গ্রামের মাদ্রাসার পাঠ শেষ করে মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯৩২ সালে রাজশাহী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তাঁর বড় ভাই আবদুল আজিজ সিনিয়ার মাদ্রাসায় নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করার পর রাজশাহীতে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ছোট ভাই মুহম্মদ আবদুল হাইকে রাজশাহীতে নিয়ে আসেন। তিনি আবদুল হাইকে জুনিয়ার মাদ্রাসায় ক্লাস সেভেনে ভর্তি করান। তাঁর শিক্ষকেরা তাঁকে খুব ভালবাসতেন। এই সময় ‘কালো’ নামক একটা প্রবন্ধ লিখে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১৯৩৬ সালে রাজশাহী মাদ্রাসা থেকে তিনি উচ্চ মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এরপর পড়াশোনার জন্য তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন। ছুটিতে বাড়ি গেলে ১৯৩৬ সালে ২৮শে ডিসেম্বর তাঁর বিয়ে সম্পন্ন হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ১ মাস ২ দিন। তাঁর স্ত্রী আনিসা বেগমের বয়স ১১ কি ১২ বছর।
১৯৩৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাতে প্রথম বিভাগে ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। তখন ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত ইংরেজি কিংবা অর্থনীতি পড়তে চাইতেন। মুহম্মদ আবদুল হাইও ভেবেছিলেন তিনি ইংরেজিতে অনার্স পড়বেন। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাঁকে বাংলায় অনার্স পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র আকর্ষণেই তিনি ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হন এবং মানুষ হন তাঁরই স্নেহচ্ছায়ায়। অনার্সে তাঁর কাছে তাঁরা বৌদ্ধ গান ও দোহা পড়তেন, পড়তেন ভাষাতত্ত্ব। আর এম.এ. শেষ পর্বে পড়তেন ‘বাংলাভাষার ইতিহাস।’
ছাত্র জীবনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই। ১৯৩৮ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি ক্ষুদ্র ছাত্রদল শান্তিনিকেতনে যান। মুহম্মদ আবদুল হাই সে দলের সদস্য ছিলেন। সেখানে তাঁরা বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। একদিন সন্ধ্যার সময় কবিগুরুকে দেখলেন তাঁরা। তাঁদের অনুযোগ তাঁর দেখা পাওয়াই যায় না। কবিগুরু বললেন, “আমি তো দুর্লভ দর্শন নই। দিনের শেষ, জীবনেরও শেষ, আমি ব্যস্ত, লোকে আমাকে করে আরো ব্যতিব্যস্ত। তা না হলে দেখা কেন পাবে না?” রবীন্দ্রনাথের স্নেহ পাওয়ার সৌভাগ্য মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের হয়েছিল। তিনি তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন, ‘তুমি বড় শিক্ষক হবে’। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের জীবনে কবির আশীর্বাদ সফল হয়েছিল। আজীবন গভীর আবেগে রবীন্দ্র-স্মৃতি লালন করেছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই। রবীন্দ্রকবিতা তিনি আবৃত্তি করতেন আবেগমুগ্ধ হয়ে।
মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯৪১ সালে বি.এ. অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪২ সালে তিনি এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এম.এ. পাশ করার পরই মুহম্মদ আবদুল হাই কর্ম-জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি প্রথম ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন চাকরি করেননি। ১৯৪৩ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি বাংলার প্রভাষক হিসেবে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে যোগ দেন। সেখানে মাত্র ষোল দিন চাকরি করার পর ১৯৪৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম কলেজে একই পদে যোগ দেন। সেখান থেকে বদলী হয়ে তিনি ১৯৪৩ সালের ৫ মার্চ কৃষ্ণনগর কলেজে বাংলার প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কৃষ্ণনগর কলেজে এসে স্থির হন। এই কলেজে তিনি ১৯৪৭ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত চাকুরি করেন। মাত্র সতের বছর বয়সে বিয়ে করলেও মুহম্মদ আবদুল হাই যথারীতি সংসার জীবন শুরু করেন কৃষ্ণনগর কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেয়ার পর। নদীয়া জেলার প্রধান শহর হলো কৃষ্ণনগর। দেশভাগ হওয়ার ফলে নদীয়া জেলা পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় তাঁদেরকে কৃষ্ণনগর ছাড়তে হলো। মুহম্মদ আবদুল হাই সপরিবারে রাজশাহী চলে আসেন। ১৯৪৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি রাজশাহী কলেজে যোগদান করেন। রাজশাহীতে রিকুইজিশন করা একটি সরকারি বাড়িতে তিনি ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ে যোগদানের জন্য তিনি রাজশাহী কলেজের চাকুরি ছেড়ে দেন। তিনি ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর তিনি ১৯৫০ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলেত যান। মুহম্মদ আবদুল হাই লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্ট্যাডিজ-এ প্রফেসর জে. আর. ফার্থের অধীনে তুলনামূলক শব্দতত্ত্ব বা কম্পারেটিভ ফিলোলজিতে (ধ্বনিতত্ত্ব) সম্মানসহ এম.এম. ডিগ্রী লাভ করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. করতে গিয়ে তিনি সাধারণ ভাষাবত্ত্ব; ধ্বনিতত্ত্বের বিশেষ কোর্স; আরবী, দ্রাবিড়, ইংরেজী ও সংস্কৃত ধ্বনিতত্ত্ব পড়াশোনা করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভ ‘A phonetic and phonological study of Nasals and Nasalization in Bengali পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। বিদেশে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯৫৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পুনরায় যোগদান করেন। ১৯৪২ সালে কর্মজীবন শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯৫৩ সালে বিদেশ থেকে ফেরা পর্যন্ত দশ বছরের বেশি সময় ধরে মুহম্মদ আবদুল হাই লেকচারার পদেই নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র দ্বিতীয়বার বিভাগ থেকে অবসর নেওয়ার পর মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা বিভাগে রীডার পদে উন্নীত হন। ১৯৫৪ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি একই সঙ্গে রীডার পদে উন্নীত হন ও বিভাগীয় অধ্যক্ষের দায়িত্ব লাভ করেন। মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা, ইংরেজি, আরবি, সংস্কৃত, উর্দু ও প্রাথমিক ফরাসি এই ছয়টি ভাষা জানতেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব, ছন্দ, অলঙ্কার ও ব্যাকরণ, মধ্যযুগীয় ভক্তি সাহিত্য ও পুথিসাহিত্য, আধুনিক বাংলা গদ্য ও কবিতা, বাংলা নাটক, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের কবিতা পড়াতেন। ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ফজলুল হক হলের হাউজ টিউটর নিযুক্ত হয়েছিলেন কিন্তু সে কাজ বেশি দিন করেন নি।
১৯৫৪ সালের ৩রা নভেম্বর থেকে মুহম্মদ আবদুল হাই ইংরেজি বিভাগে Spoken English কোর্সের শিক্ষক/অতিথি বক্তা হিসেবে কাজ করতে থাকেন। তখন বিভাগীয় প্রধান ছিলেন জে.এস. টার্নার। মুহম্মদ আবদুল হাই দেড় বছর সেখানে Spoken English পড়িয়েছেন। অধ্যক্ষ টার্নারের অবসর গ্রহণের পর ১৯৬০ সালের ১লা জুলাই থেকে Spoken English কোর্সটি তুলে দেওয়া হয়। আবদুল হাইও উল্লেখিত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান। ১৯৬২ সালের ২২শে জুন মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা বিভাগের প্রফেসর ও অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত হন। এই বিভাগকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাঁর নীরব সাধনা ও নিরলস কর্মতৎপরতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ অচিরেই সুশৃঙ্খল, সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুখ্যাতিসম্পন্ন একটি বিভাগে পরিণত হয়। মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা বিভাগকে যোগ্য শিক্ষক দ্বারা সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, ড. আনিসুজ্জামান ও আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতো শিক্ষককে তিনি এই বিভাগে একত্রিত করতে পেরেছিলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পঠন পাঠন ব্যাপকতা লাভ করে। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষা শিক্ষা সংস্কৃতি ও এই সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে নীতি নির্ধারণ ও আলোচনা পরামর্শ করার তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে মুহম্মদ আবদুল হাই এ সব তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে পূর্বতন ইণ্ডিয়া অফিসের সম্পদ হস্তান্তর বিষয়ক কমিটিতে পাকিস্তান সরকারের আহ্বানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে শিক্ষা-উপকরণ তৈরির বিশেষজ্ঞ কমিটিতে তাঁর ডাক পড়ে। নবগঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে প্রার্থী নির্বাচন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, প্রশ্নপত্র সমন্বয় প্রভৃতি কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও ঢাকা বোর্ডের শিক্ষা ও পাঠক্রম সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৫৭ সালের ১৯ থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত করাচীতে অনুষ্ঠিত ভাষা-শিক্ষা বিষয়ক কনফারেন্সে তিনি যোগদান করেন। ঐ বছরই পুনার ডেকান কলেজে অনুষ্ঠিত ভাষাতত্ত্ব সেমিনারেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় যোগ দিতে তিনি মাদ্রাজে আন্নামালাই নগরে যান। এগুলি ছাড়া তিনি আরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তবে তিনি শুধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই নয় দেশের নানাবিধ ছোট খাটো সাংস্কৃতিক সভাসমিতিতেও যোগদান করেন। মুহম্মদ আবদুল হাই মিযোরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে দশ মাসের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (১লা সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ থেকে ৩০শে জুন ১৯৬৯) গমন করেন।
রাজশাহী মাদ্রাসায় থাকতেই মাদ্রাসার শিক্ষক এ.এস.এম. সেরাজউদ্দাহার কাছে তাঁর সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়। দোহার অনুপ্রেরণাতেই মুহম্মদ আবদুল হাই মাদ্রাসার পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। লেখালেখির সেই শুরু এরপর থেকে লিখেছেন অবিরাম। আবদুল হাইয়ের সবচেয়ে বড় সামাজিক দায়িত্ব ছিল ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে তৎকালীন যুগের ভাষা রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন করা। আর তাইতো তিনি লিখেছেন ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ভাষা ও সাহিত্য’ ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’, ‘বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ হ্যান্ডবুক’, ‘তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা’ প্রভৃতি বইগুলি। তিনি ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনীগুলো স্মৃতিচারণমূলক। যেমন ‘বিলাতে সাড়ে সাতশ দিন’ ‘শিলিং-এ মে মাস’। ‘বিলাতে সাড়ে সাতশ দিন’ গ্রন্থটি বেশ কয়েক বছর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দ্রুত পঠন হিসেবে প্রচলিত ছিল।
ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর পরই মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের অধ্যাপনা জীবন শুরু হয়। তখন থেকে তিনি ‘মোহাম্মদী’, ‘আজাদ’, ‘ঢাকা প্রকাশ’, ‘জিন্দেগী’ ইত্যাদি পত্রিকায় লিখতে থাকেন। এ সময়ে তিনি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন ও কয়েকটি গল্প লেখেন। তাঁর ‘মুসলিম ভারতের স্ত্রীশিক্ষা’ (১৯৪৬), ‘মুসলিম ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা’ (১৯৪৫), ‘ইসলামে শাসন সংহতি’ (১৯৫৩), ‘বাংলাদেশে মুসলিম অধিকারের যুগ ও বাংলা সাহিত্য’ (১৯৫১), ‘বাংলার ধর্মান্দোলন ও ঊনবিংশ শতাব্দী’ (১৯৪৮), ‘ইসলামের বৈপ্লবিক ভূমিকা’ (১৯৫০) ইত্যাদি প্রবন্ধগুলি উল্লেখযোগ্য। মুহম্মদ আব্দুল হাই ইসলাম বিষয়ক বই অনুবাদও করেছেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ইংরেজি বই ‘The Historical Role of Islam’ তিনি ‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই।
বাংলাভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনা করতে গিয়ে মুহম্মদ আবদুল হাইকে ছাত্রদের জন্য পাঠ্য বিষয় প্রস্তুত করতে হয়েছে। সেই সূত্রে ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ (১৯৪৫), ‘নাট্যকার গিরিশ ঘোষ’ (১৯৫০), ‘রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা’ (১৯৫০), ‘রবীন্দ্রকাব্যে মানবতা’ (১৯৫০), ‘মানুষের প্রেম ও আলাওল’ (১৯৪৯), ‘কবিগুরু আলাওল’ (১৯৪৯), ‘কবি সৈয়দ সুলতান’ (১৯৫০), ‘বাংলা কাব্যের বৈশিষ্ট্য’ ১৯৪৪), ‘নজরুল প্রতিভার বৈশিষ্ট্য’ (১৯৪৫), ‘ভারতচন্দ্রের মানসিংহ’ (১৯৫৪), ‘নজরুল সাহিত্যের নতুন ধারা’ (১৯৫৪), ‘বিদ্যাপতি ও রাধিখা’ (১৯৫৩), ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ (১৯৫২) ইত্যাদি প্রবন্ধগুলি তিনি রচনা করেছেন। মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসানের যৌথ উদ্যোগে রচিত হয়, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ (আধুনিক যুগ)। এটা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দফতরের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার পরিকল্পনার অংশ বিশেষ।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় বাংলা বই পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। এই অভাব পূরণের জন্য মুহম্মদ আবদুল হাই প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনা করে প্রকাশ করার কথা চিন্তা করেন। প্রকৃতপক্ষে ‘সম্পাদনা’ বলতে যা বোঝায় এ তা ছিল না। দুষ্প্রাপ্য ভারতীয় পুস্তক ছাত্র-ছাত্রীদের প্রয়োজনে পুনর্মুদ্রণের কৌশল হিসেবে মুহম্মদ আবদুল হাইকে এ সম্পাদনার কাজ হাতে নিতে হয়েছিল। বিভাগীয় কাজকর্মের ব্যস্ততা, বিভিন্ন কমিটিতে দায়িত্ব পালন, দেশ-বিদেশে সেমিনার সিম্পোজিয়ামে প্রতিনিধিত্ব করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মধারায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি কারণে মুহম্মদ আবদুল হাই সম্পাদনার ‘ঝঞ্ঝাট’ সহযোগী সম্পাদকের উপর ন্যস্ত করে নিশ্চিন্ত ছিলেন। এ সব সম্পাদিত পুস্তক এখনও তাদের উপযোগিতা বিন্দুমাত্রও হারায়নি।
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের কয় ছেলেমেয়ে তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে বিলেত থেকে তিনি তাঁর মেয়ে রওশন জাহানের কাছে চিঠি লিখতেন।
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৬৯ সালের ৩রা জুন। জরা কিংবা ব্যাধির কারণে নয়, চলন্ত ট্রেনের চাকার তলায় চাপা পড়ার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর কোনো কোনো পত্র-পত্রিকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে খবর প্রকাশিত হয়। রেলওয়ে পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- “মুহম্মদ আবদুল হাই সাতটায় বাসা থেকে বের হয়ে মালিবাগ হয়ে খিলগাঁওয়ের দিকে যাত্রা করেছিলেন। মালিবাগ ডিআইটি ক্রসিং থেকে রেললাইনের ধার দিয়ে পদব্রজে চলছিলেন। অকুস্থলের রেলসড়কটি ছিল সংকীর্ণ ও ভাঙ্গা। তিনি দক্ষিণ থেকে উত্তরে ‘আপ’ লাইনটি অতিক্রম করছিলেন। এ সময়ে চলন্ত ট্রেনটি তাঁর বিশ ফিট দূরত্বের মধ্যে এসে গিয়েছিল। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের পরনে ছিল সেন্ডেল স্যু। স্থূলদেহী হাইয়ের সেন্ডেল স্যু লাইনের সঙ্গে আঁটকে গিয়েছিল। ৮.৩৫ মিনিটে ট্রেনটি তাঁকে চাপা দেয়। মুহম্মদ আবদুল হাই নিজেকে মুক্ত করার সময় পাননি এবং লাইন থেকে সরে যাওয়ারও সুযোগ পাননি। চালক বাষ্প ছেড়ে দিয়ে ইঞ্জিন থামিয়ে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।” রেলওয়ে পুলিশের এই প্রতিবেদন যদি সত্যি হয় তবে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের মৃত্যুর এটাই অন্যতম প্রত্যক্ষ বর্ণনা।
চলন্ত ট্রেনটি তাঁর জীবনের গতি চিরদিনের মতো থামিয়ে দিলেও তাঁর লেখা গ্রন্থগুলি সবার মনে তাঁর গতিশীলতারই চিহ্ন বহন করবে সবসময়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯১৯ সালের ২৬শে নভেম্বর বুধবার রাত দশটায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার রাণীনগর থানার মরিচাগ্রাম। তাঁর পুরো নাম আবুল বশার মুহম্মদ আবদুল হাই।
বাবা-মা: তাঁর বাবা আবদুল গণি, মা মায়মুন্নিসা খাতুন।
পড়াশুনা: মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের মা মায়মুন্নিসা ছেলেকে কোরাণে হাফেজ বা ক্বারী বানাতে চেয়েছিলেন। আর সে জন্য ইসলামী শিক্ষার প্রাথমিক পাঠদানের শুরুটা তাঁর বাড়িতেই হয়েছিল। গৃহ-শিক্ষা শেষ হওয়ার পর তাঁকে মরিচার নিকটবর্তী বর্ধনপুর জুনিয়ার মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়।গ্রামের মাদ্রাসার পাঠ শেষ করে মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯৩২ সালে রাজশাহী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তাঁর বড় ভাই আবদুল আজিজ সিনিয়ার মাদ্রাসায় নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করার পর রাজশাহীতে ব্যাবসা শুরু করেন। তিনি ছোট ভাই মুহম্মদ আবদুল হাইকে রাজশাহীতে নিয়ে আসেন। তিনি আবদুল হাইকে জুনিয়ার মাদ্রাসায় ক্লাস সেভেনে ভর্তি করান। তাঁর শিক্ষকেরা তাঁকে খুব ভালবাসতেন। এই সময় ‘কালো’ নামক একটা প্রবন্ধ লিখে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১৯৩৬ সালে রাজশাহী মাদ্রাসা থেকে তিনি উচ্চ মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এরপর রাজশাহী থেকে পড়াশোনার জন্য তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন।
১৯৩৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাতে প্রথম বিভাগে ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। তখন ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত ইংরেজি কিংবা অর্থনীতি পড়তে চাইতেন। মুহম্মদ আবদুল হাইও ভেবেছিলেন তিনি ইংরেজিতে অনার্স পড়বেন। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাঁকে বাংলায় অনার্স পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র আকর্ষণেই তিনি ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হন।
মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯৪১ সালে বি.এ. অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪২ সালে তিনি এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর তিনি ১৯৫০ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলেত যান। মুহম্মদ আবদুল হাই লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্ট্যাডিজ-এ প্রফেসর জে. আর. ফার্থের অধীনে তুলনামূলক শব্দতত্ত্ব বা কম্পারেটিভ ফিলোলজিতে (ধ্বনিতত্ত্ব) সম্মানসহ এম.এম. ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্মজীবন: এম.এ. পাশ করার পরই মুহম্মদ আবদুল হাই কর্ম-জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি প্রথম ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন চাকরি করেননি। ১৯৪৩ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি বাংলার প্রভাষক হিসেবে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে যোগ দেন। সেখানে মাত্র ষোল দিন চাকরি করার পর ১৯৪৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম কলেজে একই পদে যোগ দেন। সেখান থেকে বদলী হয়ে তিনি ১৯৪৩ সালের ৫ মার্চ কৃষ্ণনগর কলেজে বাংলার প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কৃষ্ণনগর কলেজে এসে স্থির হন। এই কলেজে তিনি ১৯৪৭ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত চাকুরি করেন। মাত্র সতের বছর বয়সে বিয়ে করলেও মুহম্মদ আবদুল হাই যথারীতি সংসার জীবন শুরু করেন কৃষ্ণনগর কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেয়ার পর। নদীয়া জেলার প্রধান শহর হলো কৃষ্ণনগর। দেশভাগ হওয়ার ফলে নদীয়া জেলা পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় তাঁদেরকে কৃষ্ণনগর ছাড়তে হলো। মুহম্মদ আবদুল হাই সপরিবারে রাজশাহী চলে আসেন। ১৯৪৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি রাজশাহী কলেজে যোগদান করেন। রাজশাহীতে রিকুইজিশন করা একটি সরকারি বাড়িতে তিনি ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ে যোগদানের জন্য তিনি রাজশাহী কলেজের চাকুরি ছেড়ে দেন। তিনি ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।
বিয়ে ও ছেলেমেয়ে: ছুটিতে বাড়ি গেলে ১৯৩৬ সালে ২৮শে ডিসেম্বর তাঁর বিয়ে সম্পন্ন হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ১ মাস ২ দিন। তাঁর স্ত্রী আনিসা বেগমের বয়স ১১ কি ১২ বছর। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের কয় ছেলেমেয়ে তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে বিলেত থেকে তিনি তাঁর মেয়ে রওশন জাহানের কাছে চিঠি লিখতেন।
মৃত্যু: মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৬৯ সালের ৩রা জুন। জরা কিংবা ব্যাধির কারণে নয়, চলন্ত ট্রেনের চাকার তলায় চাপা পড়ার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র: লেখক মনসুর মুসার লেখা ‘মুহম্মদ আবদুল হাই’ গ্রন্থ , প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮। প্রকাশক: বাংলা একাডেমী।
লেখক : মৌরী তানিয়া