ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার। বর্তমানে যেটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগ সেটিই বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর দিকে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল গ্রন্থাগার হিসেবে। সেই গ্রন্থাগারে একজন বইপাগল, শান্ত, সৌম্য, শুভ্র-শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তি মোটা ফ্রেমের চশমা পরে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো ডুবে আছেন মোটা মোটা বইয়ের গুরুগম্ভীর লেখার জ্ঞান সমুদ্রে। দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমের রক্তিম সূর্য যখন তার লাল আভা মিলিয়ে দিয়েছে নীলিমায়, তখনও তিনি পড়েই চলেছেন। আর ততক্ষণে গ্রন্থাগারের দারোয়ান তালা লাগিয়ে চলে গেছে।
ঢাকার চকবাজারের লাগোয়া বেগমবাজার। বেগমবাজারের দক্ষিণ উপপ্রান্তে জনাকীর্ণ পথের কোণাকুণি জায়গাটায় একখানি দ্বিতল পাকাবাড়ি, নাম ‘পেয়ারা ভবন’। বাড়িটির মাঝখান দিয়ে একটা সরু করিডর। করিডর দিয়ে সামনের দিকে এগুলে সিঁড়ি বেয়ে সোজা দোতলায় ওঠা যায়। নিচ তলায় একটি পড়ার ঘর এবং লাইব্রেরী। সেখানে বিভিন্ন ভাষার হরেক রকমের অসংখ্য বই। বাংলা, ইংরেজী, জার্মান, ফরাসী, ল্যাটিন, হিব্রু, আরবী, ফার্সী, উর্দু, হিন্দী, অসমীয়া, উড়িয়া, মারাঠি, তামিল, গুজরাটি, সিংহলীসহ দেশী-বিদেশী নানা ভাষার লক্ষ লক্ষ শব্দ বন্দী হয়ে আছে সেই বইগুলিতে। আর বইগুলি থরে থরে সাজানো আছে আলমারীতে ও শেলফে এবং প্রত্যেকটি বই আচার্যের বহু বিনিদ্র রজনীর পড়াশুনার সাক্ষর বহন করছে। যিনি হামেশা বলতেন ‘দেখো, ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার না হলে কেউ লেখক হতে পারে না। হতে পারে না গবেষক ও পণ্ডিত। লেখক ও সাহিত্যিক হওয়ার পূর্বশর্ত হলো মূল্যবান গ্রন্থের সংগ্রহশালা।’
এতক্ষণ যাঁর কথা বলছি তিনি এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাতত্ত্ববিদ, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাবিদ, গবেষক, লোকবিজ্ঞানী, অনুবাদক, পাঠসমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষাসৈনিক এবং একজন খাঁটি বাঙালি মুসলিম ও দেশপ্রেমিক। জ্ঞানপ্রদীপ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষার গবেষণায় অদ্বিতীয়। তিনি ছিলেন একটি কাল, একটি শতাব্দী, একটি জাতি, একটি সংস্কৃতি; অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, ধর্মবেত্তা ও সূফীসাধক।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মার পঞ্চম সন্তান। তাঁর বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন ইংরেজ আমলে সরকারি জরিপ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। শহীদুল্লাহ মাতা হরুন্নেছা খাতুনের শিক্ষার প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। তিনি বাড়িতে তাঁর পরিবার ও পেয়ারা গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের শিক্ষা দিতেন। প্রথম দিকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম রাখা হয় মুহম্মদ ইব্রাহীম। কিন্তু পরবর্তীকালে পিতার পছন্দে আকিকা করে তাঁর নাম পুনরায় রাখা হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। পরিবারে তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে শহীদুল্লাহ ছোটবেলায় ছিলেন দারুণ আমুদে ও আত্মভোলা। বাড়ীর সবাই আদর করে তাঁকে ডাকত ‘সদানন্দ’ বলে। গ্রামের পাঠশালায় পণ্ডিত মশাইরা তাঁকে ডাকতেন ‘সিরাজ দৌল্লাহ’ নামে। কিন্তু তিনি নিজের নাম রেখেছিলেন ‘জ্ঞানানন্দ সংগ্রামী’।
ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে শহীদুল্লাহ উর্দু, ফার্সী ও আরবি শেখেন এবং গ্রামের পাঠশালায় সংস্কৃত পড়েন। পাঠশালার পড়া শেষ করে ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। স্কুলের ছাত্র থাকতেই বই পড়ার এবং নানা বিষয়ে জানার প্রতি ছিল তাঁর দারুণ নেশা। হাওড়া স্কুলের স্বনামখ্যাত ভাষাবিদ আচার্য হরিনাথ দে’র সংস্পর্শে এসে শহীদুল্লাহ ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি আরবী-ফার্সী-উর্দুর পাশাপাশি হিন্দি ও উড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্ত্বের সাথে সংস্কৃতসহ প্রবেশিকা পাশ করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে থেকে ১৯০৬ সালে এফ.এ. পাশ করেন। অসুস্থতার কারণে অধ্যায়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ. পাস করেন ১৯১০ সালে। বাঙালি মুসলমান ছেলেদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম অনার্স নিয়ে পাস করেন।
সংস্কৃতিতে অনার্স পাস করার পর সংস্কৃত নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করতে চাইলে তৎকালীন হিন্দু পণ্ডিতগণ তাঁকে পড়াতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এ বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর দু’বছর পর ১৯১৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে বি.এল. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ গমন করেন। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শণ চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্যে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা লাভ করেন।
আঠারো শতকের মুসলিম সমাজ, পারিবারিক ঐতিহ্য ও পৈত্রিক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। ভাষাবিজ্ঞানের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি সচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, আয়ত্ত করেছিলেন বাইশটি ভাষা। তিনি বাংলা, উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী, সংস্কৃত, পালি, আসাম, উড়িয়া, আরবী, ফার্সী, হিব্রু, আবেস্তান, ল্যাটিন,তিব্বর্তী, জার্মান, ফরাসী, প্রাচীন সিংহলী, পশতু, মুন্ডা, সিন্ধী, মারহাটী, মৈথালী ইত্যাদি ভাষা জানলেও ভাষার ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সানন্দে বলতেন, আমি বাংলা ভাষাই জানি।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সিতাকুন্ডু উচ্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি কিছুদিন ওকালতি প্র্যাকটিস করেন। তিনি বশিরহাট মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দিনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে শরৎচন্দ্র লাহিরী রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সে বছরের ২ জুন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে স্থায়ী চাকুরিতে যোগদান করেন। একইসঙ্গে নিখরচে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সভাপতি নিযুক্ত হন। পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ১৯২৮ সালে দেশে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষকের এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষকের পূর্বপদে যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি রীডার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর তিনি সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং পরে ১৯৩৭ সালে স্বতন্ত্র বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালের ৩০ জুন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে রীডার ও অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং একইসাথে উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও ছয় বছর কলা অনুষদের ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষা গড়ে তোলার জন্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি সেখানে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের অস্থায়ী প্রাধ্যক্ষের এবং ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ইমেরিটাস নিযুক্ত হন। অধ্যাপনার বাইরে তিনি করাচির উর্দু উন্নয়ন সংস্থার উর্দু অভিধান প্রকল্প, ঢাকায় বাংলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ এবং ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশনের সদস্য, ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলা একাডেমীর বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজি সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রাজে Seminar on Traditional Culture in South-East Asia-তে তিনি UNESCO -র প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এর চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। এর প্রতিবাদে প্রথম লেখনী ধারণ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধে বলেন, ‘পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন পশতু, বেলুচি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা; কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষা রূপে চালু নয়। … যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়,তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করিতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবী বিবেচনা করা কর্তব্য। … বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার স্বপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি।’
এই প্রতিবাদ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে শুরু করেছিল রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের। শহীদুল্লাহ রয়ে গেলেন বিতর্কের কেন্দ্রে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালল-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাড়িতে ঢাকবার কোন জো-টি নেই।’ ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা দিবসে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ছাত্রদের আহ্বানে তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্রজনতার মাঝে সশরীরে উপস্থিত থেকে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পুলিশী হামলায় টিয়ার গ্যাসে নিগৃহীত হয়েছেন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবন-দর্শনের ভিত্তি ছিল ইসলামী বিশ্বাস। তিনি যেমন পারিবারিকভাবে ইসলামিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন, ঠিক তেমনি তাঁর সাংসারিক জীবন এবং কর্মক্ষেত্রের সর্বত্র ইসলামের প্রতিফলন ঘটেছিল। তিনি কখনো ধর্মীয় রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা এবং ধর্মের অপব্যবহারকে প্রশ্রয় দেননি। স্বধর্মে নিষ্ঠাবান থেকে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রচেষ্টা করে গেছেন আজীবন। ১৯৫০ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে সুধীজনেরা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তার খসড়া ছিল তাঁরই রচনা। বছরের শেষ দিকে ‘আঞ্জুমান-ই-ইশা আৎ-ই-ইসলাম’ নামে ইসলাম প্রচার সমিতি গঠন করেন তিনি।
বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীর ধর্মসম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত উদযোগী ছিলেন। তাঁর মতে, পর্দা দু’রকম এক রকম হলো- ইসলামিক পর্দা, সেটি হচ্ছে মুখ হাত-পা ছাড়া সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা, আর এক রকম হলো- অনৈসলামিক পর্দা, সেটি মেয়েদের চার দেয়ালের মধ্যে চিরজীবনের জন্যে কয়েদ করে রাখে। ইসলামি পর্দায় বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরুনো কিংবা অন্যের সঙ্গে দরকারি কথাবার্তা বলা মানা নয়; তবে অনৈসলামী পর্দায় এসব হবার জো নেই। সবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে এই অনৈসলামীক পর্দা সরিয়ে দিতে। তা না হলে সবার নারীহত্যার মতো মহাপাপ হবে। নারী যে মসজিদে যেতে পারে, পুরুষের ইমামতিতে নামাজ আদায় করতে পারে এবং শুধু প্রাচীন আরবে নয়, মুসলিম আমলের বাংলাদেশেও যে এ প্রথা প্রচলিত ছিল-তিনি তার প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন এবং ঢাকায় মেয়েদের জামাতে তিনিই প্রথম ইমামতি করেছিলেন।
তাঁর দীর্ঘ জীবনে তৎকালীন পরিবর্তনশীল সামাজিক রুচির যে ধারা চলছিল তার সাথে তিনি সহ-অবস্থান নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক থাকাকালীন তিনি ছাত্রদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। আবার Traditional culture of east Pakistan গ্রন্থে তিনি Folk Dance, Folk Music I Folk Arts সম্পের্ক প্রবন্ধ লিখেছেন; শুধু তাই নয়, একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “Educated and talented dancers of our country can draw profitable on this indigenous dances and add new colour and life to the art of dancing.”
স্বদেশী আন্দোলনের সময় চারদিকে যখন বিদেশী পণ্য বর্জনের ডাক শুরু হয়ে গেছে। ঠিক তখন থেকেই তিনি সাহেবী প্যান্ট-কোর্ট ছেড়ে দিয়ে খদ্দর কাপড়ের আচকান, পায়জামা ও পাঞ্জাবী পরিধান শুরু করে দিলেন। তিনি মনে করতেন, দেশী জিনিষ ব্যবহার করলে দেশে পয়সাটা থাকে আর বিদেশী জিনিস ব্যবহারে দেশের পয়সাটা বিদেশে চলে যাবে।
জ্ঞানতাপস এই শিক্ষাবিদ নিজে যেমন আজীবন জ্ঞান সাধনা করেছেন, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে নিজকে আত্মনিয়োগ করেছেন। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। তৎকালীন সরকারের অনুমোদিত নিউস্কীম মাদ্রাসা, ওল্ডস্কীম মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা এই তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেন তিনি। তাঁর মতে, এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাক্ষেত্রে কেবল গণ্ডগোলই সৃষ্টি করেছে এবং মুসলমান সমাজে অনৈক্য এনেছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় মানুষের অধিকার তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি। তাই শিক্ষার কথা যখনই বলেছেন তখনই তিনি সার্বজনীন শিক্ষার অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেছেন। দেশের প্রতিটি নাগরিকের ষোলো বৎসর বয়স পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করা সরকারের আশু কর্তব্য বলে তিনি বিবেচনা করতেন। মাদ্রাসা শিক্ষার বর্তমান প্রণালীকে তিনি সময় ও শক্তির অপচয় বলে মনে করতেন। শিক্ষাক্ষেত্রে যে একটি মাত্র ব্যবস্থার পরিকল্পনা তাঁর ছিল, সেখানে ধর্মশিক্ষার একটা বিশিষ্ট স্থান ছিল।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি নিজস্ব আসন আছে। এই দুই ক্ষেত্রেই তিনি কিছু মৌলিক ধারণার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯২০ সাল থেকে নানা প্রবন্ধ লিখে তিনি নিজের যে বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন তার চূড়ান্ত ও ধারাবহিক রূপ দেখা যায় তাঁর ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ (১৯৫৬) গ্রন্থে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক স্বতন্ত্র ধর্মী গবেষক ছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল জটিল দিকের গ্রন্থিমোচন এবং নবতর ব্যাখ্যা। বাংলা লোকসাহিত্যের প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য এবং শিশু সাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। বাংলার গঠন অনুসারে তিনিই প্রথম ১৯৪৩ সালে বাংলা ব্যাকরণ রচনায় হাত দেন । তাঁর অবিস্মরণীর কৃতিত্ব হলো বাংলা একাডেমী থেকে দু’খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষার আঞ্চলিক অভিধান’ সম্পাদনা। তিনিই প্রথম ১৯৪০ সালে ভারতের মুসলিম শিক্ষা কংগ্রেসে পূর্ব বাংলায় ভাষা চর্চা উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রস্তাব করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ সম্মেলনে তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বাংলা একাডেমী’ রাখার প্রস্তাব করেন।
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহু মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তিনি সম্পদনা করেছেন। তিনি আল এসলাম পাত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯২৫) ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯২৮-২১) হিসেবে যোগ্যতার প্রমাণ দেন। তাঁরই সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশু পত্রিকা ‘আঙ্গুর’ (১৯২০) আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ইংরেজী মাসিক পত্রিকা ‘দি পীস’ (১৯২৩), বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘বঙ্গভূমি’ (১৯৩৭) এবং পাক্ষিক ‘তকবীর’ (১৯৪৭) সম্পাদনা করেন। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত পাক্ষিক ও মাসিক জার্নাল সম্পাদনা করেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর স্ত্রীর নাম মরগুবা খাতুন। তিনি সাত পুত্র ও দুই কন্যার জনক। মাহযূযা খাতুন, আবুল ফযল মুহম্মদ সফীয়্যুল্লাহ, মাসব্দরা খাতুন, আবুল কালাম মোস্তফা ওলিয়্যুল্লাহ, আবুল করম মাহমুদ যকীয়্যুল্লাহ, আবুল জামার মহামেদ তকীয়্যুল্লাহ, আবুল বয়ান মুজতাবা নকীয়্যুল্লাহ, আবুল ফসল মুতাওয়াক্কিল ববীয়্যুল্লাহ, আবুল খায়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ।
তিনি ছিলেন আজীবন ছাত্র এবং আজীবন শিক্ষক। সারাটি জীবন শুধু জ্ঞানের পিছু ছুটেছেন এবং জ্ঞান বিলিয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে। অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ ও আবুল কাশেম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মিরপুরে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা কলেজ। মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই শিক্ষক তিনি; একই কারণে দেশপ্রেমিক এবং মনেপ্রাণে বাঙালী।
জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ এই জ্ঞানতাপস পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান’ এবং ১৯৬৭ সালে ফরাসী সরকার তাঁকে ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্স’ পদকে ভূষিত করেন। ১৯৮০ সালের সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পদকে ভূষিত করেন।
আজীবন উদ্যমী এই মানুষটি সর্বদা ছিলেন কর্মচঞ্চল। ১৯৬৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর প্রথম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন এই জ্ঞানানন্দ প্রবাদপুরুষ। জীবন সায়াহ্নে যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন ডান হাতের লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। খুব দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘ভাল হয়ে নিই, আমার বাম হাতে লেখার অভ্যাস করবো।’ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর। ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মূসা খাঁন মসজিদের পশ্চিম পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
নাম: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
পিতা: মফিজ উদ্দিন আহমদ
মাতা: হুরুন্নেছা খাতুন
স্ত্রী: মরগুবা খাতুন
সন্তান-সন্ততি: সাত পুত্র ও দুই কন্যার জনক। শিক্ষা: ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে সংস্কৃতসহ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর ১৯০৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে থেকে এফ.এ. পাশ করেন। তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ. পাস করেন ১৯১০ সালে। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালেয় তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এ বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর দু’বছর পর ১৯১৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে বি.এল. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ গমন করেন। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শণ চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
পত্রিকা ও সম্পাদনা: ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহু মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তিনি সম্পদনা করেন। তিনি আল এসলাম পাত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯২৫) ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯২৮-২১) হিসেবে যোগ্যতার প্রমাণ দেন। তাঁরই সম্পদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশু পত্রিকা আঙ্গুর (১৯২০) আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ইংরেজী মাসিক পত্রিকা দি পীস (১৯২৩), বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গভূমি (১৯৩৭) এবং পাক্ষিক তকবীর (১৯৪৭) সম্পাদনা করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত পাক্ষিক ও মাসিক জার্নাল সম্পাদনা করেন।
তাঁর প্রকাশনা গুলি হলো:
গবেষণাগ্রন্থ: সিদ্ধা কানুপার গীত ও দোহা (১৯২৬), বাংলা সাহিত্যের কথা (১ম খণ্ড ১৯৫৩, ২য় খণ্ড ১৯৬৫), বৌদ্ধ মর্মবাদীর গান (১৯৬০)।
ভাষাতত্ত্ব: ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাংলা ব্যাকরণ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৬৫) । প্রবন্ধ-পুস্তক: ইকবাল (১৯৪৫), আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), বাংলা আদব কি তারিখ (১৯৫৭), Essay on Islam (1945), Traditional culture in East Pakistan (মুহম্মদ আবদুল হাই-এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত; ১৯৬১)।
গল্পগ্রন্থ: রকমারী (১৯৩১)।
শিশুতোষ গ্রন্থ: শেষ নবীর সন্ধানে, ছোটদের রাসূলুল্লাহ (১৯৬২), সেকেলের রূপকথা (১৯৬৫) ।
অনুবাদ গ্রন্থ: দাওয়ানে হাফিজ (১৯৩৮), অমিয়শতক (১৯৪০), রুবাইয়াত-ই-ওমর খয়্যাম (১৯৪২), শিকওয়াহ ও জাওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২), বিদ্যাপতিশতক (১৯৪৫), মহানবী (১৯৪৬), বাই অতনা মা (১৯৪৮), কুরআন প্রসঙ্গ (১৯৬২), মহররম শরীফ (১৯৬২), অমর কাব্য (১৯৬৩), ইসলাম প্রসঙ্গ (১৯৬৩), Hundred Sayings of the Holly Prophet (1945), Buddist Mystic Songs (1960)।
সংকলন: পদ্মাবতী (১৯৫০), প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে শেষ নবী (১৯৫২), গল্প সংকলন (১৯৫৩), তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। এছাড়া তিনি ৪১টি পাঠ্যবই লিখেছেন, ২০টি বই সম্পাদনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তাঁর লিখিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের উপর রয়েছে তাঁর ৩৭টি রচনা। অন্যান্য বিষয়ে বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮০টি। এ ছাড়া তিনি তিনটি ছোটগল্প এবং ২৯টি কবিতা ও লিখেছেন।
সম্মাননা: জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ এই জ্ঞানতাপস পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান’। ১৯৬৭ সালে ফরাসী সরকার তাঁকে ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্স’ পদকে ভূষিত করেন। ১৯৮০ সালের সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পদকে ভূষিত করেন। এছাড়া তিনি আদমজী ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী সভাপতিরূপে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।
কর্মজীবন : মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কর্মজীবন বহুধা বিভাজিত। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সে বছরের ২ জুন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে স্থায়ী চাকুরিতে যোগদান করেন। একইসঙ্গে নিখরচে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক বা হাউজ টিউটর নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯২৩ সালের গ্রীষ্মকালে ‘মালাকান’ রাজপুতদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য রাজপুতনা গমন করেন। বছরের শেষ দিকে ‘আঞ্জুমান-ই-ইশা আৎ-ই-ইসলাম’ নামে ইসলাম প্রচার সমিতি গঠন করেন। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯২৬ সনের সেপ্টেম্বরে তিনি ইউরোপে উচ্চ শিক্ষার জন্য গমন করেন। দু’বছর অধ্যায়নের পর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ১৯২৮ সনে ঢাকায় ফিরে এসে তিনি বাংলা ও সংস্কৃতের প্রভাষকের পূর্ব পদে যোগদান করেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষকের দায়িত্ব পুনর্বার গ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের অস্থায়ী প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি রীডার পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত থাকেন। ১৯৩৭ সালে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ স্বতন্ত্র দুই বিভাগে পরিণত হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৪০ সালে তিনি ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালের ৩০ জুন শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ থেকে রীডার ও অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খণ্ডকালীন অধ্যাপক (১৯৫৩-৫৫) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপরে তিনি খণ্ডকালীন হিসেবে ১৯৪৮ সালে ও ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা বিভাগ চালু হয়। এখানে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষা গড়ে তোলার জন্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং এ বছরই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। কিছুদিন পরেই তিনি কলা বিভাগের ডীন হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর ইমেরিটাস নিযুক্ত হন। অধ্যাপনার বাইরে তিনি করাচির উর্দু উন্নয়ন সংস্থার উর্দু অভিধান প্রকল্প (১৯৫৯-৬০), ঢাকায় বাংলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ (১৯৬০) এবং ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্প-এ (১৯৬১-৬৪) সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশনের সদস্য (১৯৬৩-৬৪), ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য (১৯৬৩-৬৪), বাংলা একাডেমীর বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজি সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক (১৯১১) ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন (১৯১৭), ঢাকায় মুসালিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন (১৯২৬), কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুবক সম্মেলন (১৯২৮), হায়াদ্রাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন (ভাষাতত্ত্ব শাখা, ১৯৪১) এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন (১৯৪৮)। মাদ্রাজে Seminar on Traditional Culture in South-East Asia-তে তিনি UNESCO-র প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এর চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
তথ্যসূত্র:
১. সংসদ বাঙালা চরিতাবিধান; সাহিত্য সংসদ;
২. আচার্য সুনীত কুমার চট্টোপাধ্যায়; বাংলা সাহিত্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ. বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি;
৩. চরিতাবিধান, বাংলা একাডেমি;
৪. “ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও আমি”; মাহযূযা হক, ২০০০ প্রকাশিত।
লেখক : হোসাইন মোঃ আল-জুনায়েদ