‘চতুর্থ শ্রেণীর পর একটা বৃত্তি পরীক্ষা ছিল, এবং আমরা যারা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছিলাম, নির্দিষ্ট সময়ে সবাই বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যাবো নিকটবর্তী ঝিনেদা শহরে, সে-ভাবেই প্রস্তুত হচ্ছিলাম। নতুন ওস্তাদজীর থাকার ব্যবস্থা হল আমাদের বহির্বাটিতে, অর্থাৎ খানকায়। দাদাজান আমার পড়াশুনার ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল এই অভিনব ব্যবস্থায়, কারণ শমশের খান অবিলম্বে আমাকে নিয়ে পড়লেন। গণিতে তাঁর দক্ষতা ছিল, সেটা প্রমাণের জন্য তিনি আমাকেই বেছে নিলেন। পরীক্ষায় আমি তাঁর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। তাঁর আশা ছিল, গণিতে আমি একশ’র মধ্যে একশ’ই পাব। দেখা গেল, দুটি প্রশ্নে ভুল করেছি। এই ব্যর্থতায় আমি নিজে তেমন বিচলিত হইনি, কিন্তু আমার ওস্তাদজী কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। সেই দৃশ্য আমাকে বিচলিত করেছিল। ঝিনেদায় আমার চাচার বাসায় আমরা সবাই উঠেছিলাম, আমার চাচা, আমাকে নয়, আমার ওস্তাদজীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, আমি সে দৃশ্য ভুলিনি।’
উপরের এই কথাগুলো বলেছেন এদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। ছেলেবেলাতেই তাঁর ওস্তাদজী তাঁর প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়েছিলেন। আর তাই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি অংকে একশতে একশই পাবেন। একশতে একশ না পাওয়ায় ওস্তাদজী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তবে ছেলেবেলায় ওস্তাদজীর প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলেও পরবর্তীতে তিনি একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ হিসেবে দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন। তিনি শুধু এদেশের অন্যতম শিক্ষাবিদই নন তিনি একজন কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক।
১৯২৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি (১০ ফাল্গুন) জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ঝিনাইদহ জেলার দুর্গাপুর গ্রামে পৈত্রিক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তখন ঝিনাইদহ বৃহত্তর যশোর জেলায় ছিল। তিনি মায়ের প্রথম সন্তান না হলেও একদিক দিয়ে প্রথম, কারণ তাঁরও আগে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর মা। সে মেয়েটি আঁতুড়েই মারা যায়। প্রথম ও চতুর্থ অবস্থানে তাঁরা দুই ভাই, বাকি ছয়জন বোন।
তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারে পরিবার প্রধান ছিলেন তাঁর দাদাজান। দাদী না থাকায় পরিবারে একটা শূন্যতা রয়েই গিয়েছিল। বাড়ির বড়ো বউ হিসেবে অনেকটা দায়িত্ব বর্তেছিল তাঁর মায়ের ওপর। অন্দরমহল পরিচালনার এই দায়িত্ব তাঁর মা ভাগ করে নিতেন তাঁর ফুফুর সঙ্গে। তাঁর বাবা থাকতেন কলকাতার একটি ভাড়া বাসায়। তিনি কলকাতার নর্মাল স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
তিনি যে পাঠশালায় পড়াশুনা করেছেন সেটির প্রতিষ্ঠাতা তাঁর দাদাজান। তাঁদের বাড়ির বহিরাঙ্গনেই পাঠশালার ঘরটি ছিল। তাঁর বাবার যখন স্কুলে যাওয়ার বয়স হল তখনই তাঁর দাদাজান একটি পাঠশালার প্রয়োজন অনুভব করেন এবং এই পাঠশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর বাবা-চাচারা এখানেই পড়াশুনা করেন।
কলকাতার নর্মাল স্কুলে তাঁর বাবা ১৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন। এরপর কলকাতার বাইরে তাঁর পোষ্টিং শুরু হয়। ফলে গ্রামের পাঠশালার পাঠ শেষ করে বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো শুরু হলো। চাকরি সূত্রে তাঁর বাবা যেখানে যান, বই খাতা নিয়ে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, তাঁর মা ও ভাইবোনরাও সেখানে যান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণী তিনি পড়লেন বাঁকুড়া জেলা স্কুলে। এই স্কুলে পড়ার সময় স্কুলের ম্যাগাজিনের দুটি সংখ্যা বের হয়েছিল। প্রথমটিতে তাঁর কবিতা ‘প্রভাত’, দ্বিতীয়টিতে তাঁর প্রবন্ধ ‘যুদ্ধ’ ছাপানো হয়। দুটিতেই রচনার মূল কৃতিত্ব তাঁর বাবার, কারণ, কবিতার ওপর তিনি তাঁর ঘঁষা-মাজার কাজ যেভাবে করেছিলেন, তাতে শেষ পর্যন্ত সেটি আর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর রচনা বলে দাবি করা গেল না। আর প্রবন্ধটিও বলতে গেলে যৌথ রচনা, মূল কাঠামো তাঁর, আর পরিণত রূপ তাঁর বাবার। ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে যে শিক্ষকেরা ছিলেন, তাঁদের মনেও সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। এক বিকেলে খেলার মাঠ থেকে ডেকে নিয়ে তাঁরা তাঁকে সোজা জিজ্ঞেস করলেন, প্রবন্ধটি তাঁরই লেখা কিনা। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই হাঁ-সূচক জবাব দিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। কারণ এর সঙ্গে তাঁর বাবার সম্মান জড়িত ছিল।
বাঁকুড়ায় স্কুলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানও ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপার। সেই অনুষ্ঠানেই তিনি প্রথম কবিতা আবৃত্তির সুযোগ পান, নজরুলের ‘শাতিল আরব’। যেমন কবিতায়, প্রবন্ধ রচনায়, তেমনি আবৃত্তিতেও তাঁর শিক্ষক ছিলেন তাঁর বাবা।
১৯৪০-৪১ সালে তাঁর বাবা আবার বদলি হলেন জলপাইগুড়ি। ১৯৪১ সালে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়লেন যশোর জেলা স্কুলে। ১৯৪৫ সালে দিলেন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা। স্টার মার্কসসহ ১ম বিভাগ পেয়ে ভর্তি হলেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে, আই.এ. ক্লাসে। তখন থাকতেন বউবাজার মোড়ে অবস্থিত টেইলর হোস্টেলে। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে ভয়াবহ দাঙ্গা হলো কলকাতায়। অরক্ষিত হয়ে পড়লেন তাঁরা। তখনকার ভয়াবহতা ও অসহায়ত্বের কথা এখনও ভুলতে পারেন না তিনি। হোস্টেল ছেড়ে কয়েকমাস নিরাশ্রয় জীবনযাপন শেষে মীর্জাপুর স্ট্রিটের মুসলমান ছাত্রদের কলেজ হোস্টেলে থাকলেন ৩ মাস।
আই.এ. পরীক্ষা দিলেন ১৯৪৭ সালে। লাভ করলেন প্রথম বিভাগ। দেশভাগের পর চলে এলেন ঢাকায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ. অনার্স ক্লাসে ভর্তি হলেন। আর থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে।
১৯৫০ সালে বি.এ. অনার্স পরীক্ষায় ইংরেজি সাহিত্যের একমাত্র প্রথম শ্রেণীটি তিনিই লাভ করেছিলেন। ১৯৫১ সালের এম.এ. পরীক্ষায়ও একমাত্র প্রথম শ্রেণীটি তাঁর দখলে এলো। এম.এ. পাস করার পর ১৯৫২ সালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে প্রোগ্রাম সহকারী হিসেবে কাজ করলেন ৩-৪ মাস। ১৯৫১ সালেই বিয়ে করেন তিনি। ময়মনসিংহ শহরের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, প্রাক্তন এমএলএ আবদুল মজিদের কন্যা কায়সারকে। এই দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ে।
১৯৫২ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ডে গেলেন। পড়লেন অনার্স কোর্স। ১৯৫৪ সালে সমুদ্রপথে ফিরে এলেন দেশে। ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা শুরু করলেন। ঢাকা কলেজে তাঁর নিযুক্তি ছিল সরাসরি প্রফেসর পদে অক্সফোর্ডের ডিগ্রির সুবাদে। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদানের পর পদোন্নতি পেয়ে বিভাগের রিডার ও বিভাগীয় প্রধান হলেন। ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিমন্ত্রণে দুইমাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সঙ্গে মিলে প্রকাশ করেন ত্রৈমাসিক ‘পূর্বমেঘ’। ১৯৬৭ সালে বাবা ফজলুর রহমান সিদ্দিকী মারা যান গ্রামের বাড়িতে। এ বছরই মিল্টনের বিখ্যাত গদ্যরচনা অ্যারিওপ্যাজিটিকার অনুবাদ করেন তিনি। ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের খণ্ডকালীন পরিচালক।
১৯৭৩ সালে ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে মিল্টনের মৃত্যুর ত্রিশতবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নেন। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের রিগায় গিয়েছিলেন লেখক/কবি সম্মেলনে অংশ নিতে। সে সময় মস্কো, লেনিনগ্রাদ, তিবিলিসি, কিয়েভসহ অনেক শহরেই সফর করেছেন। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে ৪ বছরের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেখানেই ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে পুনর্বার যোগ দেন। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৯৯৫ সালের জানুয়ারির সময়টা ছিলেন বিশ্বভারতীর ভিজিটিং প্রফেসর। ২০০০ সালে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একজন কর্মী।
এতসব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চলতে থাকে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর লেখালেখি। কবিতা তাঁকে ছাত্রজীবন থেকেই টানত। স্কুলের আবৃত্তিতে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল নিয়মিত। দু-এক দিনের মধ্যে তিনি দীর্ঘ কবিতা মুখস্থ করে ফেলতেন। পরবর্তীতে তিনি শেক্সপীয়রের ১৫৪টি সনেট তিনি অনুবাদ করেন। পাশাপাশি নিজের কবিতা লেখাও অব্যাহত রাখেন। তাঁর নিজের বিবেচনায়, তাঁর লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখের দাবি রাখে একটি দীর্ঘ কবিতা, ‘ফালগুন-চৈত্রের কবিতা’। এই কবিতায় তিনি নিজেকে যে সম্পূর্ণতায়, যে নিবিড়তায় দেখতে পান, তেমন আর কোন কবিতায় নয়। কেউ যদি তাঁকে প্রশ্ন করেন, কোন একটি কবিতা আপনার নিজের কাছে প্রিয়, তিনি সহজেই বলবেন, ‘ফালগুন-চৈত্রের কবিতা’। এটি আছে তাঁর ‘আসন্ন বাস্তিল্’ গ্রন্থে।
১৯৫০ সালের দিকে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী যখন অনার্স ৩য় বর্ষে, তখন আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খানের সম্পাদনায় বের হয় ‘নতুন কবিতা’ নামে কবিতা সঙ্কলন । ১২ বা ১৩ জন কবির কারো ৫টা, কারো ৬টা কবিতা স্থান পায় সে সংকলনে। প্রত্যেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে বইয়ের মুদ্রণ ব্যয় বহন করলেন। সে সংকলন অনেকের নজরে পড়ল। বিশেষ করে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা তাঁদের সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। ওই সময় আবদুল গণি হাজারী ও মাহবুব জামাল জাহেদীর সম্পাদনায় ‘মুক্তি’ বলে একটি সাহিত্য পত্রিকা বেরিয়েছিল। এর পিছনে ছিলেন জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। সেখানে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়।
যদিও অন্যের কবিতার অনুবাদ, তবু ‘শেক্সপীয়রের সনেট’ তিনি তাঁর সমগ্র কবি কর্মেরই অংশ বলে মনে করেন। আর এই অনুবাদ কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি শেক্সপীয়রকে যেভাবে চিনেছেন, তাঁর মনের ও তাঁর কবিকর্মের যে ঘনিষ্ঠ পরিচয় পেয়েছেন, সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। কবিতা লেখা ও ‘শেক্সপীয়রের সনেট’ অনুবাদের পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর প্রবন্ধ লেখার কাজ। বেশকিছু প্রবন্ধের বইও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।
তাঁর প্রকাশিত বইগুলো হলো-১৯৭১ সালে অ্যারিওপ্যাজেটিকা অনুবাদ, ভূমিকা, টিকা; ১৯৭৩ সালে স্যামসন অ্যাগনিমটিজ মিল্টন, কাব্যানুবাদ; ১৯৭৫ সালে হৃদয়ে জনপদে কবিতা; ১৯৭৬ সালে শব্দের সীমানা প্রবন্ধ; ১৯৭৬ সালে মুহূর্তের কবিতা : ফররুখ আহমেদ-সম্পাদনা; ১৯৭৭ সালে শেক্সপীয়রের সনেট ভূমিকা ও কাব্যানুবাদসহ; ১৯৭৮ সালে হে বন্য স্বপ্নেরা ফররুখ আহমেদ-সম্পাদনা; ১৯৮৩ সালে Literature of Bangladesh and other essays; ১৯৮৪ সালে আমার দেশ আমার ভাষা প্রবন্ধ সংকলন; ১৯৮৪ সালে চাঁদ ডুবে গেলে কবিতা; ১৯৮৫ অনুবাদ (ভাষা শহীদ গ্রন্থপালা সিরিজ); ১৯৮৫ সালে দ্যা টেম্পেস্ট শেক্সপীয়র, ভূমিকাসহ অনুবাদ; ১৯৮৬ সালে পৃথিবী ও পাসপোর্ট রম্যরচনা; ১৯৮৬ সালে বাংলা প্রবন্ধ পরিচয় সংকলক ও সম্পাদক; ১৯৮৮ সালে আসন্ন বাস্তিল কবিতা; ১৯৮৯ সালে শান্তিনিকেতনে তিনমাস জার্নাল; ১৯৯১ সালে বাঙালীর আত্মপরিচয় প্রবন্ধ; ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি ইংলিশ-বেঙ্গলি ডিকশেনারি সম্পাদক; ১৯৯৪ সালে প্রবাসে প্রতিদিন ভ্রমণ দিনলিপি; ১৯৯৭ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলাম; ১৯৯৭ সালে Visions and revisions; ২০০০ সালে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা: সংকট ও সম্ভাবনা; ২০০১ সালে কবিতা সংগ্রহ; ২০০১ সালে Quest For a Civil Society নির্বাচিত প্রবন্ধ; ২০০৩ সালে আমার চলার পথে আত্মজীবনী; ২০০৪ সালে গ্রামের নাম খিদিরপুর প্রবন্ধ ।
প্রবলতম গণ আন্দোলনের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে গেলেন এরশাদ। তাঁর পতনের পর দেশে প্রতিষ্ঠিত হল অন্তবর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তিনজোটের রূপরেখা ঘোষিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের ১৮ই নভেম্বর। তিনজোটের মনোনীত সরকার প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। এজন্য এর আগে, উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদকে পদত্যাগ করতে হল। সবই হল পূর্বনির্ধারিত ফর্মূলা মোতাবেক: প্রথমে উপ-রাষ্ট্রপতি, অতঃপর রাষ্ট্রপতি এরশাদের পদত্যাগ এবং তাঁর শূন্যপদে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। প্রধান বিচারপতির শূন্য আসনে এলেন সুপ্রীম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান। যে কোন দেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এ এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। নব্বই দিনের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকবে এক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
যখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তখনও জানতেন না, তাঁর সরকারে তাঁকে যোগ দিতে হবে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে হবে। ১৯৯০ সালের ৯ ডিসেম্বর তাঁরা নতুন উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রথম ৬ জন সদস্য শপথ গ্রহণ করলেন। নব্বই দিনের মেয়াদ শেষে ১৯৯১ সালে’র ১৪ মার্চ উপদেষ্টা পরিষদের বিলুপ্তির ও সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ সূচক চিঠি পেলেন তিনি। জাতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে তিন মাসের বিশেষ ছুটি দিয়েছিল। ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার পর তিনি আবার ফিরে এলেন তাঁর কর্মস্থলে।
বাংলা একাডেমীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ‘৭৩-পরবর্তী তাঁর কর্মজীবনের দ্বিতীয় পর্বে। একাত্তরেই তাঁর প্রথম বই, ‘মিলটনের অ্যারিও প্যাজিটিকা’ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। বোর্ড ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমীর সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ‘৭৩-এ তাঁর দ্বিতীয় মিলটন-অনুবাদ, স্যামসন অ্যাগনিসটিজ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। ছিয়াত্তর-সাতাত্তর-এ তাঁর অনূদিত শেক্সপীয়রের সনেট প্রকাশিত হতে থাকে একাডেমীর পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’-এ। এরপর আশির দশকে একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘অনুবাদ’ ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা সিরিজে এবং তাঁর সম্পাদিত ‘বাংলা প্রবন্ধ পরিচয়’। তবে এই প্রকাশনার ধারায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমী ইংলিশ-বেঙ্গলী ডিকশনারী। এই অভিধানটির সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য ছিলেন তিনি। এটি প্রকাশের সাথে সাথে আশাতীতভাবে সমাদৃত হল এবং অল্পদিনের মধ্যে অভিধানটি বাংলা একাডেমীর সফলতম প্রকাশনা হিসেবে স্বীকৃতি পেল।
১৯৭৭ সালে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লাভ করেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৭৯ সালে কবিতার জন্য পান বাংলা একাডেমী পুরস্কার। ১৯৯০ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ বেগম জেবুন্নিসা ট্রাস্ট পুরস্কার পান। ১৯৯৮ সালে গ্রহণ করেন অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার। ২০১০ সালে তিনি অর্জন করেন স্বাধীনতা পুরস্কার।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম:১৯২৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি (১০ ফাল্গুন) জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ঝিনাইদহ জেলার দুর্গাপুর গ্রামে পৈত্রিক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা-মা: বাবা মরহুম ফজলুর রহমান সিদ্দিকী এবং মা হালিমা খাতুন।
পড়াশুনা: গ্রামের পাঠশালায় তাঁর পড়াশুনার শুরু। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণী তিনি পড়লেন বাঁকুড়া জেলা স্কুলে। ১৯৪১ সালে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী । ৮ম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়লেন যশোর জেলা স্কুলে। ১৯৪৫ সালে দিলেন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা। স্টার মার্কসসহ ১ম বিভাগ পেয়ে ভর্তি হলেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে, আই.এ. ক্লাসে। আই.এ. পরীক্ষা দিলেন ১৯৪৭ সালে। লাভ করলেন ১ম বিভাগ। দেশভাগের পর চলে এলেন ঢাকায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ. অনার্স ক্লাসে ভর্তি হলেন। আর থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। ১৯৫০ সালে বি.এ. অনার্স পরীক্ষায় ইংরেজি সাহিত্যের একমাত্র প্রথম শ্রেণীটি তিনিই লাভ করেছিলেন। ১৯৫১ সালের এম.এ. পরীক্ষায়ও একমাত্র প্রথম শ্রেণীটি তাঁর দখলে এল। ১৯৫২ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ডে গেলেন। পড়লেন অনার্স কোর্স।
কর্মজীবন: এম.এ. পাস করার পর ১৯৫২ সালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে প্রোগ্রাম সহকারী হিসেবে কাজ করলেন ৩-৪ মাস। অক্সফোর্ড থেকে দেশে ফেরার পর ঢাকা কলেজে যোগ দিলেন। ঢাকা কলেজে তাঁর নিযুক্তি ছিল সরাসরি প্রফেসর পদে তাঁর অক্সফোর্ডের ডিগ্রির সুবাদে। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদানের পর পদোন্নতি পেয়ে বিভাগের রিডার ও বিভাগীয় প্রধান হলেন। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেন।১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের খণ্ডকালীন পরিচালক। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে ৪ বছরের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে অবসরগ্রহণ করেন। সেখানেই ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে পুনর্বার যোগ দেন। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৯৯৫ সালের জানুয়ারির সময়টা ছিলেন বিশ্বভারতীর ভিজিটিং প্রফেসর। ২০০০ সালে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একজন কর্মী।
সংসার জীবন: ১৯৫১ সালেই বিয়ে করেন তিনি। ময়মনসিংহ শহরের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, প্রাক্তন এমএলএ আবদুল মজিদের কন্যা কায়সারকে। এই দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ে।
মৃত্যু : ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর।
তথ্যসূত্র: ‘আমার চলার পথে’ লেখক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, প্রকাশক: কমলকান্তি দাস, মোরশেদ আলম, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৩।
লেখক: মৌরী তানিয়া