শৈশব থেকেই গণমাধ্যমের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল ক আ ই ম নুরউদ্দিনের। ছোট মামার বাসায় রেডিও দেখে বাবার কাছে আবদার করলেন রেডিও কেনার জন্য। দেশ বিভাগের পর বাবা একটি ফিলিপ্স রেডিও কিনে দিলেন। প্রায় সারাদিনই রেডিও শুনতেন। প্রধানত গান আর সংবাদ। প্রতিবেশীরাও তাঁদের বাড়িতে রেডিও শুনতে আসতেন। কলকাতায় থাকাকালীন বাবা বাসায় স্টেটসম্যান, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড কিংবা অমৃতবাজার পত্রিকা নিয়মিত রাখতেন। নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন তিনি।
সিনেমা দেখার পোকা ছিলেন নুরউদ্দিন। শৈশবে শুরু হয় সিনেমা দেখা। কলকাতার এক হল মালিক ছিলেন তাঁর বাবার বন্ধু। বন্ধুরা মিলে তাঁকে গিয়ে অনুরোধ করতেন সিনেমা দেখার। পয়সা লাগত না। রিটার্ন অব তুফান মেইল তাঁর দেখা প্রথম সিনেমা। তারপর কত সিনেমা যে দেখেছেন তার কোনো হিসাব নেই। ছোটবেলায় উদয়ের পথে ছবিটি তাঁর মনে ভীষণ দাগ কেটেছিল।
কবিতা আর সঙ্গীতেও ভীষণ ঝঁোক ছিল তাঁর। রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব পছন্দ করতেন। উর্দু কবি ও গীতিকার শাহির লুধিয়ানির প্রচণ্ড ভক্ত ছিলেন। তালাত মাহমুদ, মেহেদি হাসান, গুলাম আলীর গজল শুনতেন। মোহাম্মদ রফি, মান্না দে ও আশা ভঁোসলের গানও ছিল তাঁর খুব প্রিয়। গানের অনুষ্ঠান হলে ছুটে যেতেন সেখানে। ছাত্র-ছাত্রীদেরও উৎসাহ দিতেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলা-ধুলায়। খুবই আনন্দিত হতেন এ জাতীয় কোনো বিষয়ে তাঁর শিক্ষার্থীদের সাফল্যে।
তাঁর এই সহজাত পছন্দের বিষয়গুলো তাঁকে পরিণত করে- একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষ হিসেবে; একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের শিক্ষক হিসেবে; একজন নির্মল আনন্দময় সঙ্গদানকারী বন্ধু-স্বজন হিসেবে।
ক আ ই ম নুরউদ্দিন ( কিউ এ আই এম নুরউদ্দিন) নামটি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক তিনি। অভিজাত, চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, অসাম্প্রদায়িক আর ভীষণ বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষ ছিলেন তিনি। আর পুরনো কলাভবনের অপরিসর কক্ষে সূচিত হওয়া যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা শিক্ষা এই মানুষটির হাত ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগে পরিণত হয়েছে।
ক আ ই ম নুরউদ্দিনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ জুন কলকাতায়। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ। ডাক নাম ইমাম। পুরো নাম কাজী আবু ইমাম মোহাম্মদ নুরউদ্দিন। বাবা কাজী আলফাজ উদ্দিন। মা বেগম হামিদা বানু। বাবা ছিলেন কলকাতা প্রভিন্সের পুলিশ ইন্সপেক্টর। মা চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাটের খান বাহাদুর গোলাম কাশেমের ছোট কন্যা। ছোট মামা খান বাহাদুর আবদুর রহমান অবিভক্ত ভারতের মন্ত্রী ছিলেন। পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার রামপাল ইউনিয়নের কাজিকসবা গ্রামে। শৈশব কেটেছে কলকাতায়। কথা বলার ভঙ্গিতে কলকাতার টান ছিল তাঁর। কলকাতার বাঙালি মুসলমানদের মতো করে বাংলা বলতে পারতেন। উর্দুতেও ছিলেন খুব পারদর্শী। ছোটবেলায় বাসায় বসে উর্দু শিখেছিলেন তিনি।
কলকাতার বাগবাজার মহারাজা কাশিম বাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন। এই বছর বাবা অবসরে যান। পরিবারের সবাই চলে আসেন মুন্সিগঞ্জে। মুন্সিগঞ্জে এসে ভর্তি হন নাফিসি বেগম মেমোরিয়াল হাইস্কুলে। ১৯৪৭ সাল পুরোটা এই স্কুলে কেটেছে। এ সময় প্রাইভেট টিউটর বঙ্কিমচন্দ্র দে-র কাছে ইংরেজি পড়তেন। নুরউদ্দিনের চমৎকার ইংরেজি-দক্ষতার পেছনে এই বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান অনেকখানি। অবশ্য ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় জাপানিরা বোমা ফেললে বাবা তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সে সময় কিছুদিন আবদুল্লাহপুর হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন।
১৯৪৮ সালের মে মাসে পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে আসেন। তবে কোনো স্কুলে ভর্তি হননি তিনি। এর কারণ ছিল ঢাকা বোর্ড ও ইস্ট বেঙ্গল বোর্ডের সিলেবাসের পার্থক্য। নুরউদ্দিন ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল বোর্ডের অধীনে। ঢাকা বোর্ডের অধীনে ভর্তি হতে হলে এক ক্লাস নিচে ভর্তি হতে হতো। তাই নওয়াবপুরের বাসায় প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়াশোনা চালিয়ে যান। মুন্সিগঞ্জের স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতেন। এভাবেই ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশের পর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর একই কলেজে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি ও ১৯৫৬ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল।
১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতায় সান্ধ্যকালীন ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে। এ সময় নুরউদ্দিন ঢাকা কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক। নিজের এবং বড় ভাই কাজী সালাহউদ্দিনের আগ্রহে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় প্রথম হন। ঢাকা কলেজ থেকে অনুমতি নিয়ে বিকেলে ক্লাস করতেন। ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা লাভ করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে রওশন আরার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। একমাত্র সন্তান কাকলী। নুরউদ্দিন ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনসংখ্যা, যোগাযোগ, শিক্ষা, মূল্যায়ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি (পিআইএ)-এ এস্টাব্লিশমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন নুরউদ্দিন। চার বছর পিআইএ-তে চাকরি করেন। ১৯৬০ সালের নভেম্বরে ডিপিআইডি-তে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রাম কলেজ। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এখানে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালে বাবার মৃত্যুর পর মা ভীষণ একা হয়ে পড়েন। মায়ের কথা চিন্তা করে জানুয়ারির মাঝামাঝি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকা কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২, এবং ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ তিন বার সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর এই বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৫ সালে নতুন যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে ইউনেস্কোর গবেষণাকর্মে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশনাল একচেঞ্জ অব স্কলারস্ (সিআইইএস)-এর ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর রিসার্চ বোর্ড অব এ্যাডভাইজরস্-এ সম্মানসূচক নিয়োগ পান।
১৯৯৮ সালে এশিয়ান মিডিয়া ইনফরমেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন সেন্টারের (এমিক) কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে (নিমকো) বিভিন্ন সময়ে অতিথি বক্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট- পিআইবি’র পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। আশির দশক থেকে ২০০১ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেন্সর বোর্ডের এ্যাফিলিয়েট বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০১ সালে ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির বেস্ট রিপোর্টিং এ্যাওয়ার্ড-এর জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রতিটি পর্যায়েই তিনি অনন্য। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা আর অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব সব ক্ষেত্রেই যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।
তবে কর্মজীবনে একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর প্রধান এবং প্রিয় কর্মক্ষেত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। পঞ্চাশের দশকে সাংবাদিকতার সাথে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের পক্ষ থেকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করার দাবি ওঠে। তখন পাকিস্তানে শুধু পাঞ্জাবের লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার পাঠক্রম চালু ছিল। সামরিক আইন জারির পর আইয়ুব খান পাকিস্তানে প্রথম প্রেস কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন ঢাকা ও সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ খোলার সুপারিশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালের ২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন আতিকুজ্জামান। তিনিই ছিলেন বিভাগের একমাত্র পূর্ণকালীন শিক্ষক। বাকিরা ছিলেন খণ্ডকালীন।
আতিকুজ্জামানের হাত ধরে পুরনো কলাভবনের (বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ) সর্বদক্ষিণে পূর্ব কোণে একটা দোতলা ভবনে ভাঙাচোরা চেয়ার-টেবিল নিয়ে শুরু হওয়া সাংবাদিকতা বিভাগের একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগে পরিণত হওয়ার পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন নুরউদ্দিন।
সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র নুরউদ্দিন ডিপ্লোমা শেষ করার পর ১৯৬৪ সালে এই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি যোগদান করার পর এই বিভাগের ডিপ্লোমা কোর্সটিকে এমএ এবং স্নাতক সম্মান কোর্সে উন্নীত করা হয় এবং সাংবাদিকতা বিভাগটির নাম পরিবর্তন করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ করা হয়। পুরনো কলাভবনের অপরিসর নড়বড়ে কক্ষ থেকে এই বিভাগটি স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান কলাভবনে পরিপূর্ণ একটি বিভাগ হিসেবে বিকশিত হয়। ষোলজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু হওয়া এই বিভাগটি বর্তমানে কয়েকশ’ ছাত্রছাত্রীর পদচারণায় মুখরিত। সবখানেই অবদান নুরউদ্দিনের। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বিভাগটিকে নিজ হাতে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তিনি। স্বাধীনতার পর আতিকুজ্জামান চাকরী থেকে চলে যাওয়ায় বিভাগটিকে টেনে নেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। আজ সাংবাদিকতা বিভাগ যে পর্যায়ে এসেছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব নুরউদ্দিনের।
সাংবাদিকতা বিভাগটি গড়ে তোলার কাজে তিনি এতটাই ব্যাপৃত ছিলেন যে, বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্যে একাধিকবার স্কলারশিপ পেয়েও তিনি যোগ দেননি। আতিকুজ্জামান ও নুরউদ্দিনের প্রচেষ্টায় ১৯৬৭-৬৮ সালে বিভাগে দু’বছরের এমএ কোর্স চালু হয়। প্রথমবার ৩০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয় এই কোর্সে। একইসাথে ডিপ্লোমাও চলতে থাকে। ১৯৭৭-৭৮ সালে শুরু হয় স্নাতক সম্মান কোর্স। সম্মান কোর্স খুলতে গিয়ে অধ্যাপক নুরউদ্দিন ও তাঁর সহকর্মীরা নানা জায়গায় বিরোধিতার সম্মুখীন হন। পরে এ নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির কাছে কোর্সের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে গিয়ে অধ্যাপক নুরউদ্দিন ও তাঁর সহকর্মীদের প্রচুর কষ্টকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। সম্মান কোর্স চালু হলে ডিপ্লোমা কোর্স উঠিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) জন্মলগ্ন থেকে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। পিআইবিকে গড়ে তোলার কাজেও অসামান্য অবদান রাখেন নুরউদ্দিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ জনসংযোগ সমিতি, পিআইবিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জার্নালে নিয়মিত লিখতেন নুরউদ্দিন । লেখার বিষয়ের মধ্যে ছিল যোগাযোগবিদ্যা, সাংবাদিকতা, জনসংযোগ, বিজ্ঞাপনকলা ইত্যাদি। বহুমুখী ছিলো তাঁর লেখার বিষয়। অনেক জটিল বিষয়ও তিনি সবার বোঝার মতো সহজ এবং আকর্ষণীয়ভাবে লিখেছেন। আর এটি সম্ভব হয়েছে তাঁর গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং অসাধারণ প্রাঞ্জল ভাষাজ্ঞানের কারণে। অবশ্য তাঁর স্বজনদের মতে, লেখার চাইতে বলার মধ্য দিয়েই অধ্যাপক নুরউদ্দিন তাঁর ভাবনা প্রকাশ করতে বেশি ভালোবাসতেন। আর তাই তাঁর অসাধারণ লেখাগুলো অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়নি।
২০০০ সালে অবসরে যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মিডিয়া সেন্টারের নামকরণ করা হয়। রাষ্ট্রীয় কিংবা অনেক বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির তালিকা পাওয়া যায় না অধ্যাপক নুরউদ্দিনের জীবনপঞ্জিতে। নিজের কাজ, শিক্ষার্থী, সহকর্মী আর চারপাশের মানুষের মধ্যেই ছিলো তাঁর জীবন। তাই হয়তো অনেক সময়ই অনেকের অলক্ষ্যে থাকতেন তিনি। বড় বড় স্বীকৃতি, সম্মাননা কিংবা পদক প্রদানের সময় তাই উঠে আসেনি এই গুণীজন, এই মহান শিক্ষাবিদ আর দেশের অন্যতম পথিকৃত যোগাযোগবিদের নাম। কিন্তু কেবল প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির মানদণ্ডে যে তাঁকে মাপা যায় না, তার প্রমাণ অগণিত শিক্ষার্থী, সহকর্মী আর স্বজনের মনে তাঁর অবস্থান এবং তাদের দৃষ্টিতে তাঁর মূল্যায়ন। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সংবর্ধনায় শিক্ষার্থী, সহকর্মী, স্বজনসহ বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, তাদের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ মানুষের মনে তাঁর স্বীকৃতির এক ঐতিহাসিক প্রমাণ হয়ে আছে। সংবর্ধনা উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরে সবার মন্তব্যগুলো আজও এর সাক্ষ্য দেয়।
সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম ডিপ্লোমা কোর্সে নুরউদ্দিনের সতীর্থ ও এমএ কোর্সের প্রথম ব্যাচের ছাত্র এবং পরবর্তীতে সহকর্মী অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান বলেন, “তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক, উপদেষ্টা, কল্যাণকামী, পথপ্রদর্শক, দার্শনিক এবং সর্বোপরি উপকারী বন্ধু। ….তিনি ছিলেন ছায়াদানকারী বটবৃক্ষের মতো, বিভাগে আমাদের সকলের অভিভাবক।” তাঁর সম্পর্কে ছাত্র ও সাংবাদিকতা বিভাগে সহকর্মী শিক্ষক ড. গোলাম রহমানের মূল্যায়ন, “Prof.Nuruddin opened our minds and touched our hearts – এমন করে সকল শিক্ষকই কি আমাদের মনকে প্রসারিত আর হৃদয়কে ছুঁতে পারেন? হয়তো কেউ কেউ পারেন। নুরউদ্দিন স্যার তাঁদের মধ্যে অনন্য। বিশাল মাপের হিমালয় সদৃশ ব্যক্তিত্ব- যোগাযোগ শিক্ষার এই পথিকৃৎকে আমরা নতুন করে খুঁজে পাই পুরানো স্মৃতির মাঝে।”
আরেক ছাত্র ও সাংবাদিকের মন্তব্য, “যোগাযোগবিদ্যার পথচলায় আমার হাত ধরে থাকেন একজন- তিনি নুরউদ্দিন স্যর। সন্তানের হাত ধরে যেমন পথ চলতে শেখান একজন বাবা। আজও কখনো একটু অসতর্ক হলে, একটু বিচ্যুত হলে কানে বাজে নুরউদ্দিন স্যরের শাসন,’মারা পড়বে তো’। আর তখনই মনে হয়, যার কাঁধে একজন নুরউদ্দিন স্যরের আশীর্বাদ আছে, তাকে জীবনে কখনোই মারা পড়তে হবে না।”
এরকম আরো অনেক হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা ভাষ্য চেষ্টা করে যায় অধ্যাপক নুরউদ্দিনের মতো বহুমাত্রিক মানুষের একটি ছবি তুলে রাখার। তবু শেষ পর্যন্ত এসব কেবল আংশিক, কেবল খণ্ডিতই থেকে যায়। শব্দের পর শব্দ কিংবা বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে ধরা যায় না তাঁর মতো মানুষের বিশালতা। তবু এই সব শব্দ-বাক্যই মানুষের মনে তাঁর অবস্থান আর স্বীকৃতির সরল সাক্ষ্য।
১৯ মে ২০০২। ছাত্রছাত্রী, গুণগ্রাহী, সহকর্মী আর স্বজনরা হতবাক হয়ে শোনেন, নুরউদ্দিন স্যার আর বেঁচে নেই। ১৮ তারিখ রাতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আগেভাগে খেয়ে শুয়ে পড়েন। আর জাগেননি তিনি। ডাক্তার বলেছিলেন, ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট। সবাইকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে তিনি পরলোকে যাত্রা করেন। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয় তাঁকে। পেছনে পড়ে থাকে হাজারো প্রিয় মানুষ আর তাঁর প্রিয়তম কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম:ক আ ই ম নুরউদ্দিনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ জুন কলকাতায়। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ। ডাক নাম ইমাম। পুরো নাম কাজী আবু ইমাম মোহাম্মদ নুরউদ্দিন। বাবা কাজী আলফাজ উদ্দিন। মা বেগম হামিদা বানু। বাবা ছিলেন কলকাতা প্রভিন্সের পুলিশ ইন্সপেক্টর। মা চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাটের খান বাহাদুর গোলাম কাশেমের ছোট কন্যা। ছোট মামা খান বাহাদুর আবদুর রহমান অবিভক্ত ভারতের মন্ত্রী ছিলেন। পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার রামপাল ইউনিয়নের কাজিকসবা গ্রামে। শৈশব কেটেছে কলকাতায়।
পড়াশুনা: কলকাতার বাগবাজার মহারাজা কাশিম বাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন। এই বছর বাবা অবসরে যান। পরিবারের সবাই চলে আসেন মুন্সিগঞ্জে। মুন্সিগঞ্জে এসে ভর্তি হন নাফিসি বেগম মেমোরিয়াল হাইস্কুলে। ১৯৪৭ সাল পুরোটা এই স্কুলে কেটেছে। এ সময় প্রাইভেট টিউটর বঙ্কিমচন্দ্র দে-র কাছে ইংরেজি পড়তেন। নুরউদ্দিনের চমৎকার ইংরেজি-দক্ষতার পেছনে এই বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান অনেকখানি। অবশ্য ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় জাপানিরা বোমা ফেললে বাবা তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সে সময় কিছুদিন আবদুল্লাহপুর হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন।
১৯৪৮ সালের মে মাসে পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে আসেন। তবে কোনো স্কুলে ভর্তি হননি তিনি। এর কারণ ছিল ঢাকা বোর্ড ও ইস্ট বেঙ্গল বোর্ডের সিলেবাসের পার্থক্য। নুরউদ্দিন ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল বোর্ডের অধীনে। ঢাকা বোর্ডের অধীনে ভর্তি হতে হলে এক ক্লাস নিচে ভর্তি হতে হতো। তাই নওয়াবপুরের বাসায় প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়াশোনা চালিয়ে যান। মুন্সিগঞ্জের স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতেন। এভাবেই ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশের পর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর একই কলেজে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি ও ১৯৫৬ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল।
১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতায় সান্ধ্যকালীন ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে। এ সময় নুরউদ্দিন ঢাকা কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক। নিজের এবং বড় ভাই কাজী সালাহউদ্দিনের আগ্রহে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় প্রথম হন। ঢাকা কলেজ থেকে অনুমতি নিয়ে বিকেলে ক্লাস করতেন। ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনসংখ্যা, যোগাযোগ, শিক্ষা, মূল্যায়ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন: এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি (পিআইএ)-এ এস্টাব্লিশমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন নুরউদ্দিন। চার বছর পিআইএ-তে চাকরি করেন। ১৯৬০ সালের নভেম্বরে ডিপিআইডি-তে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রাম কলেজ। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এখানে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালে বাবার মৃত্যুর পর মা ভীষণ একা হয়ে পড়েন। মায়ের কথা চিন্তা করে জানুয়ারির মাঝামাঝি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকা কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২, এবং ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ তিন বার সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর এই বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৫ সালে নতুন যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে ইউনেস্কোর গবেষণাকর্মে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশনাল একচেঞ্জ অব স্কলারস্ (সিআইইএস)-এর ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর রিসার্চ বোর্ড অব এ্যাডভাইজরস্-এ সম্মানসূচক নিয়োগ পান।
১৯৯৮ সালে এশিয়ান মিডিয়া ইনফরমেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন সেন্টারের (এমিক) কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে (নিমকো) বিভিন্ন সময়ে অতিথি বক্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট- পিআইবি’র পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। আশির দশক থেকে ২০০১ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেন্সর বোর্ডের এ্যাফিলিয়েট বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০১ সালে ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির বেস্ট রিপোর্টিং এ্যাওয়ার্ড-এর জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রতিটি পর্যায়েই তিনি অনন্য। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা আর অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব সব ক্ষেত্রেই যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।
পরিবার: ১৯৬৮ সালে রওশন আরার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। একমাত্র সন্তান কাকলী।
মৃত্যু: ১৯ মে ২০০২। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয় তাঁকে।
তথ্য সহায়তা:
বেগম রওশন আরা নুরউদ্দিন
ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
ড. শেখ আবদুস সালাম
রোবায়েত ফেরদৌস
রেজাউল হক
পথিকৃৎ- অধ্যাপক নুরউদ্দিনের অবসর গ্রহণোত্তর সংবর্ধনা উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনির-২০০০
মূল লেখক: মীর মাসরুর জামান
পুনর্লিখন : গুণীজন দল