বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের প্রকৌশল-শিক্ষা জগতে যে নামটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চরিত হয়, নিজ কর্মক্ষেত্রের পরিধি ছাড়িয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জগতেও যিনি সমানভাবে অবদান রেখেছেন, তিনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. এম. এ. রশীদ – বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাচিত একমাত্র বাংলাদেশী সভাপতি।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
ড. এম. এ. রশীদ (মুহাম্মদ আবদুর রশীদ) ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারী সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ মহকুমার বগাডুবি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মুহম্মদ সা’দ। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ড. রশীদ ছিলেন প্রথম। তাঁর পিতা একজন ধার্মিক ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। মাতা কুলসুমা খাতুনও ছিলেন একজন ধার্মিক, নামাজী ও পর্দানশীন মহিলা। ড. রশীদের পিতার পেশা ছিল মূলত কৃষিকাজ এবং ব্যবসা। এছাড়া গ্রামের সালিশি ও পঞ্চায়েতসমূহ পরিচালনা করতেন তিনি। তিনি খুব সাহসী লোক ছিলেন। গ্রামের অন্য সব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই ছিল তাঁর সংসার। তবে বাবা-মা দু’জনেই সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন এবং চেষ্টা করেছেন সাধ্যমতো।
শিক্ষাজীবন
ড. রশীদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাজারবাজার মধ্যবঙ্গ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরুর মধ্য দিয়ে। এখানেই তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৩৬ সালে তিনি হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ম্যাট্রিক শেষ করে তিনি সিলেট শহরে এসে মুরারী চাঁদ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে তিনি এই কলেজ থেকে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে প্রথম বিভাগে আই.এস.সি. পাশ করেন। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি ঐ বছরই কলকাতায় পাড়ি জমান এবং শিবপুরে অবস্থিত বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পুরাকৌশল(Civil Engineering)বিভাগে ভর্তি হন। কলেজের প্রথম দিনগুলিতে রশীদ ছিলেন অন্য সবার মতোই সাধারণ, শিক্ষকদের অনেকটা অগোচরেই। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে এসে শিক্ষকদের কাছে আত্মপ্রকাশ করলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী ও নিষ্ঠাবান ছাত্র হিসেবে। ১৯৪১ সালে পুরাকৌশল বিভাগে তৃতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায়ই তিনি পড়ালেখায় স্বীকৃতিস্বরূপ স্লেটার মেমোরিয়াল গোল্ডমেডেল ও টেট মেমোরিয়াল মেডেল পান। একই কলেজ থেকে ১৯৪২ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পুরাকৌশলে বি. ই. ডিগ্রী লাভ করেন এবং এই ফলাফলের জন্য ট্রেভর মেমোরিয়াল পুরস্কার ও মেডেল লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি প্রকৌশল বিদ্যায় ভারত সরকারের ‘অল ইন্ডিয়া স্টেট স্কলারশিপ’ লাভ করেন এবং একই বছরের নভেম্বর মাসে এই বৃত্তিতে (বিভাগীয় ডেপুটেশনে) উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গে অবস্থিত কার্নেগি ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে (বর্তমান কার্নেগিমেলন ইউনিভার্সিটি) পুরাকৌশল বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ- এম.এস. (মাস্টার অব সায়েন্স) ডিগ্রি লাভ করেন। পরের বছর ১৯৪৮ সালের ২৭ জুন তিনি একই প্রতিষ্ঠান থেকে ডি. এসসি. (ডক্টর অব সায়েন্স) ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। সে সময়ে এদেশে প্রকৌশল বিদ্যায় কারো ডক্টরেট ছিল না। ডি.এসসি.-তে তাঁর অভিসন্দর্ভের(Thesis )শিরোনাম ছিল- “Mechanics of Prestressed Reinforced Concrete Beams in Bending”। আজকালকার নির্মাণকাজ Prestressed Concrete। এর ব্যবহার সুপ্রচলিত হলেও সেই সময়ে তা ছিল অজানার অন্ধকারে। উচ্চশিক্ষা শেষে ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন
ড. রশীদের কর্মজীবনের শুরু হয় ১৯৪২ সালে আসাম সরকারের গণপূর্ত বিভাগে আবিদ রেজা চৌধুরী সাহেবের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার মধ্য দিয়ে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ বিভাগেই চাকুরী করেন। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে তাঁকে শিলচরে বদলী করা হয় এবং তিনি কাছাড় ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলীর অধীনে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ঢাকায় ফিরে আসেন, ঢাকা তখন পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী। ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পুরাকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পদের জন্য ড. এম. এ. রশীদ ঐ বছরের ২৬ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। অধ্যাপক পদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্বেও শুধু শিক্ষকতার পূর্ব অভিজ্ঞাতা না থাকার কারণে তাঁকে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন জনশিক্ষা পরিচালক আশাহত ড. রশীদকে প্রারম্ভিক উঁচু বেতনের আশ্বাস দেন এবং ড. রশীদ ১৯৪৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর আইসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পুরাকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কয়েক মাস পরে ১৯৪৯ সালে কলেজের তত্কালীন অধ্যক্ষ জনাব হাকিম আলী ড. রশীদকে পুরাকৌশল বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন। ড. রশীদ বিভাগের পূর্ববর্তী ভারপ্রাপ্ত প্রধান কবীরউদ্দিন আহমেদ (বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক)-এর কাছ থেকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব বুঝে নেন। ১৯৫২ সালে তিনি পুরাকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং তিনিই ছিলেন ঐ বিভাগের প্রথম অধ্যাপক। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি পুরাকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্তি লাভ করেন এবং ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই পদেই দায়িত্ব পালন করেন। ড. রশীদই ছিলেন ঐ কলেজের প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষ।
১৯৫৪ সালেই তিনি টেক্সাস এ অ্যান্ড এম কলেজ -এর সাথে যুগান্তকারী শিক্ষা চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন যার ফলে টেক্সাস এ অ্যান্ড এম সহ আমেরিকার বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ অধ্যাপক আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যোগ দেন এবং এদেশ থেকে বেশ কিছু শিক্ষকের বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে আগত শিক্ষকদের মধ্য থেকে ড. রশীদ আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রত্যেক বিভাগে একজন করে শিক্ষক নিযুক্ত করেন। তাঁরা পড়ানোর পাশাপাশি কলেজের কোর্স সিলেবাসকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা করতেন। তখনই ড. রশীদের উদ্যোগে সব শিক্ষকের সহযোগিতায় পূর্বের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক মানের সেমিস্টার পদ্ধতির পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করেন। এর পাশাপাশি প্রতি বছরই পাঠ্যসূচী পরিবর্তন ও পরিমার্জনার সুযোগ তিনি রেখেছিলেন।
১৯৫৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর ড. রশীদ পাকিস্তানের আইয়ুব খান সরকারের জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য মনোনীত হন। কমিশনের সদস্য থাকা অবস্থায় তিনি সরকারের কাছ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষকদের বেতনের জন্য বিশেষ পে- স্কেলের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একটি করে প্রকৗশল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার সুপারিশ করেন। এই সুপারিশের ভিত্তিতেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একটি করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ কাজের জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকার ড. রশীদকে গঠিত প্রজেক্ট কমিটির সদস্য মনোনীত করে এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনকানুন ও অধ্যাদেশ প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ইতিমধ্যে ১৯৬১ সালের ১ এপ্রিল ড. রশীদ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে প্রথম কারিগরী শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই সময়ে তিনি নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় -এর উপাচার্য মনোনীত হন এবং ১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি কারিগরি শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্বের অতিরিক্ত উপাচার্যের (খণ্ডকালীন) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কয়েক মাস পরে কারিগরি শিক্ষা পরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে ড. রশীদ ১৯৬২ সালের ১ জুন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পূর্ণকালীন) উপাচার্যের দায়িত্ব নেন। তাঁর নিরলস শ্রম ও সুযোগ্য নেতৃত্বে প্রাথমিক বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে এ বিশ্ববিদ্যালয় একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬৬ সালের ১ জুন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। কিন্তু চার বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবার পূর্বেই তিনি পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং ১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ ঐ পদে যোগ দেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ পদে কর্মরত থাকেন।
১৯৬৬ সালে ড. রশীদ ব্যাংককে অবস্থিত এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজীর আজীবন ট্রাস্টি হবার গৌরব অর্জন করেন। সে সময়ে ঐ ইনস্টিটিউটের নাম ছিল SEATO Graduate School of Engineering। তিনি দীর্ঘ বারো বছর ঐ প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৮ সালে স্বেচ্ছায় সেখান থেকে ফিরে আসেন।
১৯৭৫ সালে ড. এম. এ. রশীদ বাংলাদেশ সরকারের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ও বিচারপতি সায়েম সাহেবের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন এবং তাঁকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। সরকারের উপদেষ্টাস্বরূপ কাজ করতে গিয়ে তিনি ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতি’র সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির পদে যোগদান করেন এবং তিনি ড. রশীদকে আবারও উপদেষ্টা পরিষদের দায়িত্বে নিয়োগ করেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই ড. রশীদ ঐ পদ থেকে সরে আসেন।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন উপাচার্য (যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ’পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়’-কে ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসাবে নামকরণ করা হয়।)অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন আহমেদ প্রাক্তন উপাচার্য ড. এম. এ. রশীদকে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাকৌশল বিভাগে ব্যক্তিগত প্রফেসর পদে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনি এ প্রস্তাবে সানন্দে সম্মত হন এবং ১৯৭৯ সালের ১৫ জানুয়ারী তিনি ঐ পদে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঐ পদ অলংকৃত করেন।
১৯৮০ সালে ড. রশীদ জনতা ব্যাংকের বোর্ড অব ডাইরেক্টরস্-এর চেয়ারম্যন পদে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে সিডনীতে অনুষ্ঠিত কমন্ওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রপ্রধানরা ড. এম. এ. রশীদকে কমন্ওয়েলথ্ ফাউন্ডেশনের সভাপতি মনোনীত করেন। এরই প্রেক্ষিতে ৭-১০-৮১ তারিখে কমন্ওয়েলথ্ ফাউন্ডেশনের তত্কালীন সেক্রেটারি জেনারেল জনাব শ্রীদাথ্ রামপাল ড. রশীদকে একটি আমন্ত্রণপত্র পাঠান এবং ১৯৮২ সালের ১ জানুয়ারি তাঁকে উক্ত দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব করেন। ড. রশীদ সে দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হন। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য এটা ছিল এক দুর্লভ সম্মান।
ড. এম. এ. রশীদ তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্মানীত সদস্য হিসেবেও কাজ করেন:
১. ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান সরকারের জনশক্তি ও শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।
২. ১৯৬৮ সালের আগস্টে সিডনিতে অনুষ্ঠিত এসোসিয়েশন অব কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ এর দশম পঞ্চবার্ষিক কংগ্রেসে ড. রশীদ অংশগ্রহণ করেন এবং উক্ত এসোসিয়েশনের ১৯৬৯ সালের কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
৩. ১৯৭০ সালে তিনি জাতীয় পরীক্ষা কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হন।
৪. তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমিশনের সদস্য ছিলেন।
৫. ১৯৭২ সালের শেষ দিকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হন এবং এ কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব জার্মানী সফর করেন।
৬. ১৯৭৩ সালে তিনি শিল্প কারখানার শ্রমিকদের মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
ড. রশীদ আমেরিকার সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারস-এর বিশেষ সম্মানসূচক অনারারী ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ ব্রিজ ফেডারেশনের প্রথম সভাপতি ছিলেন।
একজন আদর্শ শিক্ষক
সততা, আদর্শ ও কর্মনিষ্ঠার সমন্বয়ে একজন শিক্ষক হিসেবে ড. রশীদ ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। ছাত্রদের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। অত্যন্ত দুর্বোধ্য, জটিল বিষয়বস্তুকে তিনি করে তুলতেন সহজ ও প্রাঞ্জল। তাঁর একজন ছাত্র এবং পরে একই প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা সূত্রে সহকর্মী ড. স. হ. খ. ইউসুফজাই-এর ভাষায়, “অত্যন্ত ধীরে ধীরে তিনি আমাদেরকে বিষয়বস্তুর গভীরে নিয়ে যেতেন। মনে হতো যেন কোনো পিতা তার পুত্রের হাত ধরে তাকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন এক অজানা রাজ্যের রত্নসম্ভার। এতটা দরদ দিয়ে তিনি পড়াতেন যে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনতাম।”
ছাত্রদের অনেক বকাবকি করলেও তাদের প্রতিভার উপর তাঁর যথেষ্ট আস্থা যেমন ছিল তেমনি ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। সবসময় তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভাবতেন, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার খোঁজ খবর রাখতেন। তিনি কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন একবার হোস্টেলে সিট সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দিলে তিনি তাঁর বিশাল সরকারি বাসভবনের নিচতলার বেশ ক’টি কক্ষ ছেড়ে দেন ছাত্রদের থাকার জন্য।
জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি একজন ছাত্রকে মানুষের মতো মানুষ হতে হলে তার আর যে সব মানবিক গুণাবলীর বিকাশ অত্যাবশ্যক তার যথাযথ প্রস্ফুটন ও পরিচর্যায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। তিনি চেয়েছিলেন প্রতিটি ছাত্র ‘মানুষ’ হয়ে উঠুক – শুধু অর্থোপার্জনকারী যন্ত্র যেন না হয়।
সুদক্ষ সংগঠক
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় যে সুনীতি ও নিয়ম শৃঙ্খলার এক আদর্শ পীঠস্থান হিসেবে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তা ড. রশীদের সততা, আদর্শ আর সুযোগ্য নেতৃত্বেরই ফসল। তিনি নবগঠিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন দুই মেয়াদে এবং সেই সুদীর্ঘ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। প্রতিবছর তিনি নবীন স্নাতকদের মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালো ফলাফলের কয়েকজনকে নির্বাচন করে তাদেরকে কিছুদিনের জন্য নীচের ক্লাশে শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত করতেন এবং অত্যন্ত সতর্কভাবে তাদের শিক্ষক হওয়ার সুপ্তশক্তি পরীক্ষা করতেন। এ কাজের জন্য তিনি মাঝে মাঝে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদের পিছনের আসনে বসে থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করতেন। এভাবে নয় মাস যাচাই করার পর তিনি তাদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য পূর্ণ বেতন দিয়ে ডেপুটেশনে টেক্সাসের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসা ছাত্রদের একটি সমন্বয় ঘটাতেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে। একজন প্রকৌশলী হয়েও ড. রশীদ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য অনুষদ প্রতিষ্ঠা করেন। আমেরিকার টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ভ্রুম্যানকে এই অনুষদের ডীনের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন, অনুষদের জন্য দক্ষ শিক্ষকশ্রেণী গড়ে তুলতে তিনি সচেষ্ট হন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই স্থাপত্য বিভাগ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন তিনি ভর্তি পরীক্ষাকে এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যে একমাত্র উপযুক্তরাই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত। ছাত্রদের লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধার নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টিতে ড. রশীদ সবসময় সক্রিয় ছিলেন। টেক্সাস এ এন্ড এম কলেজের সাথে শিক্ষাচুক্তি চলাকালীন আমেরিকার প্রফেসরদের সহযোগিতায় অনেকগুলি বই সাহায্য হিসেবে পান তিনি। সেই বইগুলি দিয়ে তিনি স্থাপন করেন ‘রেন্টাল লাইব্রেরী’ – যা এখনও ছাত্রছাত্রীদের পু্স্তক সমস্যার সমাধানে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও বিকাশের জন্য তিনি কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন, এবং প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদেরকে অন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করার সুযোগ সৃষ্টি করেন। এর পাশাপাশি তিনি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন।
পারিবারিক জীবন
১৯৪১ সালে শিবপুরস্থ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় ড. রশীদ মোসাম্মত্ তানজুন্নেসা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী তানজুন্নেসা খাতুন ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিনী। ড. রশীদ চার পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
জীবনের পুরোটা সময় নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা ভুলে ড. রশীদ কাজ করেছেন শুধু মানুষের জন্য, জাতির জন্য। জাতির প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ সেবার কথা মনে রেখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৬ সালে ড. রশীদকে সিতারা-এ পাকিস্তান খেতাব ও পদকে সম্মানিত করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ও মহান অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৮২ (মরণোত্তর) প্রদান করে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৩০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ড. এম. এ. রশীদ ভবন’ নামে একটি অ্যাকাডেমিক ভবন এবং ‘ড. এম. এ. রশীদ হল’ নামে একটি আবাসিক হল তৈরি করা হয়েছে। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬১ সালের স্নাতকদের সংগঠন সিটি ওয়ান ক্লাব ড. রশীদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে ১৯৮৪ সালের ২৮ জানুয়ারি বুয়েটের সহযোগিতায় “শুদ্ধতা, বিনয় ও ভক্তি” – এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে ‘ড. রশীদ ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৌশল গোষ্ঠী ও মুক্ত সমাজের মধ্যে অপেক্ষাকৃত উদার উপলব্ধি, বোঝাপড়া ও যোগাযোগ স্থাপন করা এবং একইসাথে শিক্ষা ও প্রকৌশল পেশার মধ্যে অধিকতর বিনিময়, সমন্বয় ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বজায় রাখা। ড. রশীদ ফাউন্ডেশন-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সম্মানসূচক ‘ড. রশীদ চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ফাউন্ডেশন-এর অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ড. রশীদ স্মরণ বক্তৃতা এবং ড. রশীদ অ্যাওয়ার্ডসমূহ যার মধ্যে রয়েছে ড. রশীদ ফেলোশীপ এবং সেরা পিএইচডি থিসিসের জন্য ড. রশীদ স্বর্ণপদক। ড. রশীদের পরিবারের পক্ষ থেকে স্থাপত্য অনুষদে মেধার ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘ড. রশীদ অ্যাওয়ার্ড’ ও প্রকৌশল অনুষদে গরীব ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘ড. রশীদ স্কালারশিপ’ নামে বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং শিক্ষকতায় যথার্থ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ সেরা শিক্ষক হিসেবে মনোনীত শিক্ষককে ‘ড. রশীদ গোল্ড মেডেল’ নামক সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আকস্মিক মৃত্যু
১৯৮১ সালের ৬ নভেম্বর অপরাহ্নে এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র ৬২ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর পরের দিন ৭ নভেম্বর সকাল আটটায় ক্ষণজন্মা এই মহান মনীষীর নিজ স্বপ্নভূমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে নামাজ-এ-জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত সবার অনুরোধে জানাজা নামাজ পড়ান অধ্যাপক মওলানা মোঃ সালাহ্উদ্দিন। ঐদিনই তাঁর মৃতদেহ দাফনের জন্য তাঁর গ্রামের বাড়ী সিলেটের হবিগঞ্জের বগাডুবিতে হেলিকপ্টারযোগে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
শেষকথা
সমাজের একজন একনিষ্ঠ সেবক এবং সর্বগুণে গুণান্বিত এই মহাপুরুষ সারা জীবনে নিজের জন্য কিছুই করেননি, অন্যদের জন্য উত্সর্গ করে গেছেন তাঁর নিজের জীবন। দিশেহারা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে, তাদের সঠিক পথের সন্ধান দিতেই যেন তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল এবং সেই কাজটি করে গেছেন অত্যন্ত যত্নসহকারে। নিজের নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও আদর্শ দিয়ে সকলকে তিনি যেন সমৃদ্ধ একটি দেশ এবং সেই দেশের জন্য আদর্শ মানুষ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন। আজও তিনি বেঁচে আছেন তাঁর অগণিত ছাত্র-সহকর্মীদের অণুপ্রেরণার সার্বক্ষণিক উত্স হয়ে।
তথ্যপঞ্জি
১. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ১৯৯৭; বাংলা একাডেমী
২. স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৮০-৮৫); গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
বিশেষ কৃতজ্ঞতা
১. মুহাম্মদ বদরুল হুদা (ড. এম. এ. রশীদের ছেলে)
আন্তরিক ধন্যবাদ:
১. মোঃ শাহ্ আলম, সহকারী পরিচালক, তথ্য ও প্রকাশনা, Directorate of Advisory & Research Services (DAERS),বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক : মোঃ কুতুব উদ্দিন সজিব