১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে জগন্নাথ কলেজ একটি ঘাঁটি হিসেবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবং ছেলেদের বাংলা ভাষার দাবিতে রাজপথে নামানোর ক্ষেত্রে কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অজিত গুহের যে হাত ছিল এ কথা বুঝতে কারোর বাকি রইল না। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে আটক করে পাকিস্তান সরকার। একনাগাড়ে দুই বছরের বেশি সময় তিনি কারাগারে আটক থাকার পর মুক্ত হন। এর কয়েক মাস পর পূর্ব বাংলায় ৯২ক ধারা প্রবর্তিত হলে আবার তাঁকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। প্রায় বছর খানেক কারাগারে আটক থাকার পর তিনি মুক্ত হন। কিন্তু ততদিনে তাঁর শারীরিক অবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। জেলখানাতেই তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ হওয়ায় পাকিস্তান সরকার তাঁকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা করে।
জেলখানায় গিয়ে সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব তাঁকে সরকারি খরচে ভারতে চিকিৎসার লোভনীয় প্রলোভন দেয়। কিন্তু অজিত গুহ সবই বুঝতে পারেন। একবার সরকার তাঁকে ভারতে পাঠাতে পারলে আর এমুখো হতে দিবে না। তিনি তৎক্ষণাৎ এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। একবার তাঁকে জেলখানায় কী একটা কারণে পরীক্ষা না করেই এ.টি.এস. দেয়া হয়। কিন্তু তাতে ব্যাপক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয়। জেলখানার ডাক্তার ভয় পেয়ে যান। একপর্যায়ে তারা অজিত গুহের জীবনের আশা ছেড়ে দেন। কিন্তু জেলখানায় যদি অজিত গুহ মারা যান তাহলে সে দায় জেল কর্তৃপক্ষের উপরই বর্তাবে। ফলে জেলখানার কর্তৃপক্ষ হত্যার দায় থেকে নিষ্কৃতি পেতে একদিন অজিত গুহকে তড়িঘড়ি করে মুক্তি দিয়ে স্ট্রেচারে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় রেখে যান। কিন্তু সেখানেই ডাক্তার ও নার্সদের আন্তরিক সেবায় সুস্থ হয়ে উঠেন জনপ্রিয় এই শিক্ষাবিদ। কিন্তু সারা জীবনেও সেই স্বাস্থ্য আর উদ্ধার করতে পারেননি তিনি।
অজিত গুহের জন্ম ১৯১৪ সালের ১৫ এপ্রিল কুমিল্লা শহরের সুপারিবাগানের এক সভ্রান্ত গুহ পরিবারে। বাবা নৃপেন্দ্রমোহন গুহ। মাতা বিঁধুমুখী গুহ। অজিত গুহের বয়স যখন মাত্র ১৪/১৫ বছর তখন তাঁর মা মারা যান। তারপর অজিত গুহকে মানুষ করে তোলেন তাঁর কাকীমা শৈবালিনী গুহ। কুমিল্লার সুপারিবাগানে গুহ পরিবারের চার পুরুষের বাস। অজিত গুহের ছোটবেলায় কুমিল্লা ছিল নানা কারণেই বিখ্যাত। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার উর্বর ভূমি হিসেবে তখন কুমিল্লার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কুমিল্লায় তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জোয়ার বইছে। যার নেতৃত্বে ছিল তখনকার অভয় আশ্রম।
ভারত জুড়ে তখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব ক্রমাগতই বাড়ছিল। কিন্তু তখনো কুমিল্লায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়নি। ফলে উভয়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য ছিল খুবই চমৎকার। অজিত গুহ এই পরিমন্ডলেই জন্মেছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন।
সুপারি বাগানেই শরৎ পন্ডিত পরিচালিত একটি পাঠশালা ছিল। পাঠশালাটি ছিল একটি বেল গাছের নীচে, এজন্য অনেকেই একে বেলতলার পাঠশালা বলে ডাকত। শরৎ পন্ডিতের এই পাঠশালার ব্যবস্থা করেছিলেন গুহ পরিবারই। কিন্তু সেখানে শুধু গুহ পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়াশুনা করত না। অন্যরাও পড়ার সুযোগ পেত। অজিত গুহের প্রাথমিক শিক্ষা এখানেই শুরু হয়। শরৎ পন্ডিত ছিলেন একটু কড়া শাসনের শিক্ষক। অমনোযোগী ছাত্রদের তিনি কড়া শাসন করতেন। অজিত গুহ একবার পড়ায় বসে অমনোযোগী হয়ে পড়েন। তখন শরৎ পন্ডিত রাগ করে নারকেল গাছে তাঁর মাথা ঠুকে দেন। তাতে অজিত গুহের মাথা ফেটে যায়। তাঁকে এই দাগ সারা জীবনই বহন করতে হয়।
শরৎ পন্ডিতের এই শাস্তি গুহ পরিবারের কারো চোখে ভাল লাগেনি। তাই অজিত গুহ শরৎবাবুর পাঠশালা ছেড়ে দিয়ে বিখ্যাত ঈশ্বর পাঠশালায় গিয়ে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয় থেকেই তিনি ১৯৩০ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯২৯ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু যখন কুমিল্লায় আসেন তখন তাঁকে ঈশ্বর পাঠশালার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। অজিত গুহ সেই সংবর্ধনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন। বেশ নজর কাড়েন সকলের। অজিত গুহ প্রবেশিকা পাশের পর কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৩২ সালে আই.এ. এবং ১৯৩৪ সালে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ. পাশ করার পর অজিত গুহের পড়াশোনা কিছুকাল বন্ধ ছিল। তখন তিনি কিছুদিন কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন বলে শোনা য়ায়।
১৯৩৬ সালে পড়াশোনার জন্য তিনি কলকাতায় চলে আসেন। বড় বোন বিমলা ও তাঁর স্বামীর উৎসাহে তাঁদের বাসায় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডিয়ান ভারনাকুলারস-এ ভর্তি হন। সেখানে স্পেশাল সাবজেক্ট ছিল বাংলা। বাংলায় তাঁর প্রধান বিষয় ছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এবং ভাষাতত্ত্ব। ১৯৩৮ সালে এম.এ. পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় অজিত গুহ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। তখন কলকাতা শহরে এ রোগ ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। সবাই শহর ছেড়ে চলে যায়। অজিত গুহ সেবছর পরীক্ষা না দিয়ে কুমিল্লায় চলে আসেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৯ সালে তিনি এম.এ. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উর্ত্তীর্ণ হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়ে তিনি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। সেসময় তিনি এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এম.এ. ডিগ্রি লাভের পর তিনি বি.টি. পড়েন এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এরপর তিনি ১৯৪০-৪২ সাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে অবস্থান করেন। শান্তিনিকেতনে অবস্থান তাঁর জীবনের অনেক বন্ধ দুয়ার খুলে দেয়। তখন থেকেই তিনি মনে-প্রাণে, আদর্শে-আচরণে, বিশ্বাসে ও অনুধ্যানে রবীন্দ্রানুসারী হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কলকাতা আরো উপ্তত্ত হয়ে ওঠে। তিনি কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। গুহ পরিবার তখন ঢাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করছিল। ১৯৪২ সালে অজিত গুহ প্রিয়নাথ হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই স্কুলে তিনি একনাগাড়ে প্রায় ছয় বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি ঢাকার প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের একজন উৎসাহী সদস্য হিসেবে কাজ করতেন। সেই সুখ্যাতির কারণেই ১৯৪৮ সালের ১৬ আগষ্ট অজিত গুহ জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। দীর্ঘ ২০ বছর চাকরী করার পর কলেজের প্রাদেশিকীকরণের কারণে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিনি এখানে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি কিছুকাল বেকার ছিলেন। পরে তাঁর পূর্ব পরিচিত টিএন্ডটি কলেজে যোগদান করেন। কিন্তু কলেজের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলাদলি এবং ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ তাঁর একটি লেখা প্রকাশ করাকে কেন্দ্র করে সহকর্মীদের সাথে বিতর্কের সূত্র ধরে অজিত গুহ সেই চাকরি থেকেও পদত্যাগ করেন।
তিনি তাঁর মার্জিত রুচিবোধ আর প্রজ্ঞার কারণে শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। শোনা যায়, সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র তাঁর ক্লাস করার জন্য নিয়মিত জগন্নাথ কলেজে যেতেন। তিনি ১৯৫৭-৫৮ সাল পর্যন্ত একবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন তিনি সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজেও খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন। তাঁর সময় কেউ ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে এ ঘটনা বিরল। ক্লাসে তিনি ছাত্রদের বলতেন, ‘তোমাদের কাক্ষিত বিদ্যা তো দিতে পারি না। শুধু পার্সেন্টেজ দিতে পারি। পার্সেন্টেজের জন্য যারা আস তারা না এলেও পার। পরে আমি তাদের পুষিয়ে দেব।’ তিনি সুলতিত রসবোধে বলতেন, “কেউ দেরীতে এলে কিংবা আগে চলে যেতে চাইলে কোনো কথা না বলে আসা-যাওয়া করো। আমার পড়াশোনার মাঝে বিজাতীয় ভাষায় ‘মে আই কাম ইন স্যার’ বলে চিৎকার করে কিংবা চলে যাবার অনুমতি চেয়ে আমার চিন্তার বা বলার স্রোতে বাধা দিয়ো না।”
ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক। তিনি শুধু শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালের জন্য শিক্ষা দিতেন না। তিনি তাদেরকে সারা জীবন শিক্ষাচর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতেন। ক্লাসে তিনি সেভাবেই ছাত্রছাত্রীদের প্রভাবিত করতেন। অন্য শিক্ষকদেরও সেভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন। কবি হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন অজিত গুহের বিভাগেরই একজন অনুজ সহকর্মী। তাঁকে তিনি বলতেন, “তুমি কীভাবে দাঁড়িয়ে কেমন ভঙ্গিতে ছেলেদের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছ, একজন সফল শিক্ষক হওয়ার জন্য তা-ও ধর্তব্য। মনে রেখো, হাসান, প্রথম প্রথম লেসন বাড়িতে আগেই তৈরি করে রাখবে।”
অজিত গুহ ছাত্রদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। কারো পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করার টাকা নেই, যাও অজিত স্যারের কাছে। তিনি সুপারিশ করে হোক আর নিজের পকেটের টাকা দিয়ে হোক ব্যবস্থা করে দেবেন। ছাত্রদের মধ্যে আবার কেউ কেউ তাঁর কাছ থেকে টাকা ধারও নিত। কিন্তু ইচ্ছা করে না দিলে তিনি কারো কাছে সেই টাকা চাইতেন না। মানুষের জন্য খরচ করেই তিনি প্রভূত আনন্দ পেতেন। জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন। কোনোদিন অভাব দেখেননি। কিন্তু জীবনের শেষ বয়সে এসে প্রচণ্ড আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েন। যে কারণে তাঁকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। যদিও তাঁর আর যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কারণ তার আগেই তিনি এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। সেদিন ১৯৬৯ সালের ১২ নভেম্বর, অজিত গুহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদানের জন্য প্রথমে কুমিল্লা যান। তারপর দিনই তাঁর চট্টগ্রাম যাবার কথা। কিন্তু সেদিন রাতেই আকস্মিকভাবে তিনি কুমিল্লায় তাঁর নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অজিত গুহ সরাসরি কোনো রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন দেশপ্রেম ও গণচেতনায় উদ্বুদ্ধচিত্ত। বাংলা ভাষা ছিল তাঁর রক্তের প্রতিটি কণিকায়। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর থেকেই তিনি একের পর এক মুক্তবুদ্ধির বিরোধীতাকারীদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হন। ‘জগন্নাথ কলেজ বাংলা সংস্কৃতি সংসদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। অজিত গুহ ছিলেন এই সংগঠনটির প্রাণ। পাকিস্তানের শুরুর দিকে বাংলা সংস্কৃতির ব্যাপারটাই ছিল ভয়াবহ দোষের। এই প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে তাঁকে কলেজের পাকিস্তানপন্থী শিক্ষকদের কাছ থেকে বিরূপ মন্তব্য সহ্য করতে হয়েছে। পাকিস্তান সরকার যখন আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ নিয়েছিল তখন তার ব্যাপক বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। এছাড়া সেসময় সরকার নিয়োজিত পূর্ববঙ্গ ভাষা সংস্কার কমিটির সদস্য হিসেবে তাঁর সক্রিয়তা অনেকেই পছন্দ করেনি। এছাড়াও তিনি তখন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ, কচি-কাঁচার মেলা এবং বুলবুল ললিতকলার কাজে যুক্ত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। প্রগতিশীল মহলের সাথে এই যোগাযোগের কারণেই তিনি বাংলা একাডেমির প্রথম নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের অনুরোধে ‘রক্তকপোত’ নামে একটি প্রকাশনার ভূমিকা লিখে দেয়ায় তাঁকে আদালতে অভিযুক্তও হতে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর কোনো অনুশোচনা ছিল না।
অজিত গুহ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ ও ‘সঞ্চয়িতা’ সম্পাদনা এবং পরে ফয়জুন্নেসা বেগমের সঙ্গে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। যা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে রেডিওতে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘সাহিত্য বাসর’, যা প্রতি রবিবার সকালে প্রচারিত হতো। অজিত গুহ নিয়মিত সেই অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও আলোচনা করতেন। ১৯৫০-৫১ সালে ঢাকায় প্রথম যখন নজরুল জন্মজয়ন্তী পালিত হয় তখন অনুষ্ঠানগুলির প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে বিষয় ঠিক করে দিয়েছিলেন অজিত গুহ।
অজিত গুহ ছিলেন প্রচন্ড রসিক ও ভোজন প্রিয়। তিনি নিজে রান্না করে মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। রন্ধন শিল্পে তিনি ছিলেন পাকা। তাঁর ভাড়া বাসায় মাঝে মাঝেই প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের খাদ্যসমেত আড্ডা বসত। সেখানে নানা রসিকতাও হতো। অজিত গুহ ছিলেন চিরকুমার। তিনি তাঁর বাসাটাকে পরিণত করেছিলেন মুক্তশিক্ষার পরীক্ষামূলক পরীক্ষাগারে। ঘর সবসময় ছিমছাম করে রাখতেন। এই অভ্যাস তাঁর জেলখানাতেও ছিল। জেলখানায় অজিত গুহ ঘুম থেকে উঠতেন ভোর চারটায়। তারপর নিজে পড়াশোনা করতেন। পরে কারাগারে যারা ছাত্র-বন্দী ছিলেন, সামনে পরীক্ষা, তাদের পড়াতেন। জেলখানায় তিনি যে ওয়ার্ডে থাকতেন সেখানে একটি স্টোভ আনিয়ে নিয়েছিলেন। জেলখানায় ভাল বাজার এলেই তিনি নিজ দায়িত্বে সেগুলো ওয়ার্ডে আনিয়ে রান্না করতেন। এজন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত মসলাপাতি নিজের টাকায় বাইরে থেকে আনাতেন। নিজের টাকায় ঘি, ময়দা, ডিম, মাংস কিনে এনে ওয়ার্ডে পরোটা, মাংস, সিঙাড়া ইত্যাদি তৈরি করে সকলকে খাওয়াতেন। কারো পেটের অসুখ থাকলে তার জন্য আবার আলাদা রান্না করে খাওয়াতেন। তিনি কখনোই কোনো মানুষকে ছোট করে দেখতেন না। কাউকে ঘৃণা করতেন না। তাঁর সংবেদনশীল মন, উদার ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং অত্যন্ত রুচিশীল জীবনযাত্রা তাঁকে একজন অসাধারণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।
১৯৪৮ সালে ঢাকায় যখন প্রথম আর্ট ইন্সস্টিটিউট গড়ে ওঠে তার পর থেকেই এখানে শিল্প আন্দোলন চাঙ্গা হতে থাকে। জয়নুল আবেদীন ততদিনে করাচি থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার নিয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই মূলত তখন গড়ে উঠে ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’। জয়নুল আবেদীন ছিলেন এর সভাপতি। সেখানে অজিত গুহ যথেষ্ট দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
এক সময় জগন্নাথ কলেজে এই পন্ডিত মানুষটির ছাত্র ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। যিনি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, জেনেছেন। তিনি অজিত গুহের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, “মানুষের জীবন গ্লানিমুক্ত হোক, ভাষা তার স্বাভাবিক স্থান অধিকার করুক, গড়ে উঠুক সুস্থ সাহিত্য, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে দেশ অব্যাহতি লাভ করুক,এই ছিল তাঁর কামনা। জনপ্রিয় শিক্ষকরূপে, সচেতন নাগরিকরূপে, উৎসাহী সংস্কৃতিসেবীরূপে এই প্রেরণা তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের। এই সত্যনিষ্ঠ আদর্শপ্রিয় মানুষের সেই দান আমাদের চিত্তে স্থায়ী হয়ে রইল।” সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: অজিত গুহের জন্ম ১৯১৪ সালের ১৫ এপ্রিল কুমিল্লা শহরের সুপারি বাগানের এক সভ্রান্ত গুহ পরিবারে।
বাবা-মা: বাবা নৃপেন্দ্রমোহন গুহ। মাতা বিঁধূমুখী গুহ।
পড়াশুনা: অজিত গুহের প্রথমিক শিক্ষা সুপারি বাগানে শরৎ পন্ডিত পরিচালিত একটি পাঠশালায় শুরু হয়। এরপর অজিত গুহ এই পাঠশালা ছেড়ে দিয়ে বিখ্যাত ঈশ্বর পাঠশালায় গিয়ে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয় থেকেই তিনি ১৯৩০ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পাশ করেন। অজিত গুহ প্রবেশিকা পাশের পর কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৩২ সালে আই.এ. এবং ১৯৩৪ সালে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ পাশ করার পর অজিত গুহের পড়াশোনা কিছুকাল বন্ধ ছিল। তখন তিনি কিছুদিন কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন বলে শোনা য়ায়।
১৯৩৬ সালে পড়াশোনার জন্য তিনি কলকাতায় চলে আসেন। বড় বোন বিমলা ও তাঁর স্বামীর উৎসাহে তাঁদের বাসায় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডিয়ান ভারনাকুলারস-এ ভর্তি হন। সেখানে স্পেশাল সাবজেক্ট ছিল বাংলা। বাংলায় তাঁর প্রধান বিষয় ছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এবং ভাষাতত্ত্ব। ১৯৩৮ সালে এম. এ. পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় অজিত গুহ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। অজিত গুহ সেবছর পরীক্ষা না দিয়ে কুমিল্লায় চলে আসেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৯ সালে তিনি এম.এ. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উর্ত্তীর্ণ হন।
কর্মজীবন: ১৯৪২ সালে অজিত গুহ প্রিয়নাথ হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই স্কুলে তিনি একনাগাড়ে প্রায় ছয় বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি ঢাকার প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের একজন উৎসাহী সদস্য হিসেবে কাজ করতেন। সেই সুখ্যাতির কারণেই ১৯৪৮ সালের ১৬ আগষ্ট অজিত গুহ জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। দীর্ঘ ২০ বছর চাকরী করার পর কলেজের প্রাদেশিকীকরণের কারণে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিনি এখানে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি কিছুকাল বেকার ছিলেন। পরে তাঁর পূর্ব পরিচিত টিএন্ডটি কলেজে যোগদান করেন। কিন্তু কলেজের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলাদলি এবং দৈনিক ইত্তেফাকে তাঁর একটি লেখা প্রকাশ করাকে কেন্দ্র করে সহকর্মীদের সাথে বিতর্কের সূত্র ধরে অজিত গুহ সেই চাকরি থেকেও পদত্যাগ করেন।
তিনি তাঁর মার্জিত রুচিবোধ আর প্রজ্ঞার কারণে শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। শোনা যায়, সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র তাঁর ক্লাস করার জন্য নিয়মিত জগন্নাথ কলেজে যেতেন। তিনি ১৯৫৭-৫৮ সাল পর্যন্ত একবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন তিনি সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজেও খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন।
বিয়ে: অজিত গুহ ছিলেন চিরকুমার।
মৃত্যু: ১৯৬৯ সালের ১২ নভেম্বর, অজিত গুহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদানের জন্য প্রথমে কুমিল্লা যান। তারপর দিনই তাঁর চট্টগ্রাম যাবার কথা। কিন্তু সেদিন রাতেই আকস্মিকভাবে তিনি কুমিল্লায় তাঁর নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র: এই লেখাটি তৈরি করার জন্য অজিত গুহের সহকর্মী ড. সালাউদ্দিন আহমেদ ও অজিত গুহ স্মারক গ্রন্থের সাহায্য নেয়া হয়েছে।
লেখক : চন্দন সাহা রায়