গভীর রাতে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আয়েশা ফায়েজের। শঙ্কিত মন নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন তিনি। এসে দেখেন তাঁর মেজো ছেলে ইকবাল কাঁদছে। সেই কান্নার শব্দে আস্তে আস্তে বাড়ির সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং সবাই উঠে এলেন ইকবালের কাছে। ইকবাল কাঁদছে কারণ- আশি বছর পর তাকে মরে যেতে হবে। ঘুমাতে যাবার আগে তার বাবা তার হাত দেখে বলেছেন- ‘তুমি তো দীর্ঘজীবী। প্রায় আশি বছর আয়ু তোমার।’ আশি বছর পর সে মরে যাবে, এ কথা ভাবতেই ইকবালের কান্না পাচ্ছে। ইকবালের কান্না দেখে তার বাবা আবার তার হাতটা টেনে নিয়ে ভাল করে দেখলেন এবং তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘তুমি একশ বছর বাঁচবে।’ একশ সংখ্যাটি বালক ইকবালের কাছে অনেক বেশি মনে হওয়ায় মুহুর্তেই খুশি হয়ে উঠল সে।
সেদিনের ইকবাল নামের সেই ছোট্ট ছেলেটিই আজ বাংলাদেশের অন্যতম লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। যাঁর লেখক হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু সেই মানুষটিই লেখালেখি দিয়ে তৈরি করেছেন দেশজোড়া খ্যাতি। জাফর ইকবালের প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘ছেলেমানুষ’ নামে একটি গল্প। সায়েন্স ফিকশন তিনি লিখবেন এমন কোন ইচ্ছা তখনও মনের গোপনে স্থায়ী বাসা বাঁধেনি। ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ গল্পটি অল্প একটু লেখা হয়েছে এমন সময়ে বড়ো ভাই হুমায়ূন আহমেদ এলেন, দেখলেন, পড়লেন। মুখে বললেন, ‘তুই নিজে লিখেছিস না ট্রানস্লেট করেছিস?’ গল্পটির লেখক উত্তরে জানালেন যে, তিনি নিজেই লিখেছেন। বড়ভাই হুমায়ূন আহমেদ ছোটভাই-এর চমত্কার লেখায় মনে মনে সেদিনই মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘বেশ ভালো হচ্ছে’ ওই শুরু। কিন্তু ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ গল্পটি তখনকার একমাত্র ম্যাগাজিন ‘বিচিত্রা’-তে প্রকাশিত হলে এক পাঠক প্রতিবাদ জানায় যে, লেখাটি নকল করে লেখা। বিষয়টি জাফর ইকবালের আত্মসম্মানে লাগে। আসলে এটি একটি রোবটের গল্প। তিনি এর প্রতিবাদ করার জন্য অভিনব পদ্ধতি বের করলেন। আরো কয়েকটি সায়েন্স ফিকশন লিখে ‘কপোট্রনিক’ সিরিজ করলেন। নকল করে তো একটা লেখা যায় কিন্তু অনেকগুলো লেখা যায় না। বের হলো তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘কপোট্রনিকের সুখ দুঃখ’। এর পরপরই ‘হাত কাটা রবিন’-এর কাজ শেষ করেন। তারপর ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘তিন্নী ও বন্যা’, ‘নয় নয় শূন্য তিন’, ‘জলমানব’, ‘অবনীল’সহ আরও অনেক মজার মজার বই শিশু-কিশোররা জাফর ইকবালের কাছ থেকে পেতে থাকে। এভাবে শিশু-কিশারদের জন্য একের পর এক বই সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের ভুবনে জাফর ইকবাল হয়ে ওঠেন এক অবশ্যম্ভাবী নাম।
২০০৬ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাফর ইকবালের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০৪টি। জাফর ইকবালের ‘দীপু নাম্বার টু’-উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম-এর তৈরি চলচ্চিত্র খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘দস্যি দু’জন’সহ বেশকিছু জনপ্রিয় নাটকের রচয়িতা জাফর ইকবাল। বিটিভির সিসিমপুরের নিয়মিত লেখক তিনি।
কেবল শিশুসাহিত্য নয় জাফর ইকবাল কলম ধরেছেন বড়দের জন্যও। ফলে একজন কলামিস্ট জাফর ইকবালের কলম অথবা কলাম আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে সমাজকে দেখিয়েছে পথ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় তাঁর লেখনি সোচ্চার হয়ে ওঠে। জাফর ইকবাল কখোনোই সমাজের অসংগতিগুলোকেও নীরবে মেনে নেননা। কানসার্টে পুলিশের গুলিতে নিহত কিশোর আনোয়ারের রক্ত মাখা শার্ট নিয়ে তাঁর অনবদ্য কলাম কারো চোখ এড়িয়ে যায়নি। শিক্ষকদের অনশন বিষয়ে কারো যখন মাথাব্যথা ছিল না তখন তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে জাফর ইকবালের কলাম। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি খারাপ ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে আবার শংকিত হয়ে কলামও তিনি লিখেছেন। তিনি যেন সমাজের মানুষকে সচেতনতার দিকে এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ছেলেবেলায় প্রচুর বই পড়ার নেশা ছিল জাফর ইকবালের। ‘স্বপন কুমার’, ‘দস্যু বাহারাম’, ‘মাসুদ রানা’সহ দেশি-বিদেশী অনেক লেখকের বই পড়তে পড়তে বড় হয়েছেন তিনি। আর এসব বই পড়তে পড়তে একসময় তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তিনি পড়ার এই অভ্যাসটা পেয়েছেন বাবা ও তাঁর বড় ভাই জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকেই। কারণ তাঁদের নেশার বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল বই পড়া। ছেলেবেলা থেকে একটা সম্পদের ছড়াছড়ি দেখে বড় হয়েছেন জাফর ইকবাল, আর তা হলো বই।
জাফর ইকবালের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুরে। কিন্তু সেখানে স্থির থাকেননি তিনি। বাবা পুলিশ অফিসার হওয়ায় ছেলেবেলা কেটেছে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে। বাবার চাকরির সুবাদে বাবা-মা এবং ভাইবোনদের সাথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সিলেটের কিশোর মোহন পাঠশালায় পড়াশুনার শুরু হলেও সেখানে বেশি দিন স্থির হননি। বাবার বদলির কারণে ঘুরতে হয়েছে বিভিন্ন স্কুলে। চলতি পথে অনেক সহপাঠীদের সাথে হয়েছে বন্ধুত্ব। সিলেটের বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে চলে যান জগদ্দল, দিনাজপুর। সেখান থেকে চলে যান পঞ্চগড়। তারপর প্রথমে রাঙামাটি, পরে বান্দরবান। বান্দরবান থেকে চট্টগ্রাম। এরপর যান বগুড়া, সেখান থেকে কুমিল্লা। কুমিল্লা থেকে সোজা পিরোজপুর। সেখানে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সব শেষে চলে আসেন ঢাকায়। জাফর ইকবালের নিজের ভাষায় – “‘দীপু নাম্বার টু’- বই-এ দীপু যেসব জায়গায় গিয়েছিল আমার স্কুলগুলোর নাম ওইখানে দেওয়া আছে।”
বিভিন্ন স্কুল ঘুরে মাধ্যমিক পাশের পর উচ্চমাধ্যমিকে এসে স্থির হন ঢাকা কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ। ১৯৭৩ সালে অনার্স-এ দুই নম্বরের ব্যবধানে প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৭৪ সালে লাভ করেন মাস্টার্স ডিগ্রি।
যুক্তরাষ্ট্রে PhD. করার সুযোগটাও মেধা দিয়ে জয় করেছিলেন জাফর ইকবাল। সে সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকেরা ফেলোশিপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আসতেন সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা ভাইভা নিতে এলে অনেকের সাথে জাফর ইকবালও সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কয়েকমাস পরের ঘটনা। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে PhD করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠায়। ঠিক করেন যুক্তরাষ্ট্র যাবেন। কিন্তু যাবেন যে, সমস্যা হলো প্লেন ভাড়া। এতগুলো টাকা কোথায় পাবেন! জাপান প্রবাসী এক বন্ধু এগিয়ে এলেন। সেই বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে জাফর ইকবাল পৌঁছলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে৷ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে মেধাবী ছাত্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতির সাথে সাথে ১৯৮২ সালে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সে অর্জন করলেন PhD ডিগ্রি। তাঁর বিষয় ছিল – ‘Parity violation in Hydrogen Atom.
PhD ডিগ্রি অর্জনের পর একজন তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তরুণ সফল গবেষকের স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন ছিল সেখানে। পনেরো বছরের নিশ্চিন্ত জীবন ছিল তাঁর। উপার্জনও ছিল অনেক ভালো। কিন্তু অন্যদেশে রাজার মতো জীবন কাটাতে তাঁর মন টানেনি। মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য ছটফট করেছেন প্রতি মুহূর্তে। স্বজনেরা দেশে ফিরে আসতে না করেছেন বারবার। সেই সময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন দীর্ঘসময়ের বন্ধু, স্ত্রী ইয়াসমিন হক। বিদেশের মাটিতে নানা সময়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-University of Washington– এ Research Assistant হিসেবে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের Caltech– এ Research Faculty তে ছিলেন ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বে সঙ্গে ‘Member of Technical staff ‘- এর দায়িত্ব পালন করেছেন Bell Communications Research এ। এরপর পরই মাতৃভূমির টানে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশে চলে আসেন। বর্তমানে তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব ছাড়াও তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালকের পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের Research Journal ‘SUST Studies’ এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। Research Initiatives Bangladesh এবংFreedom Foundation এর বোর্ড মেম্বার হিসেবে আছেন। ‘বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ‘Bangladesh Informatics Olympiad Committee-র প্রেসিডেন্ট পদে আসীন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাঙালি জাতিকে গল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে জাফর ইকবালের অবদান অনস্বীকার্য। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি দেশপ্রেমিক, ইতিহাস সচেতন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বল মানুষ তৈরি করার ক্ষেত্রেও এই ব্যক্তিত্বের অবদান আজ সর্বজনবিদিত। যারা মুক্তযুদ্ধ দেখেনি তাদের জন্য জাফর ইকবাল ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন’ নামে এক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। তাঁর মতে- নিজের দেশকে চিনতে হবে, জানতে হবে এই দেশটির বাংলাদেশ হয়ে ওঠার সঠিক ইতিহাস। আর ইতিহাস জানা মানেই শুধু কিছু দিন, তারিখ এবং কিছু মানুষের নাম মুখস্থ করা নয়। শুধুমাত্র এ জন্যই এতগুলো জীবন থেকে রক্ত ঝরেনি। নতুন প্রজন্মের কাছে তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত তথ্য নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করাতে, তাদের উপলদ্ধিতে সেদিনের ত্যাগ, বীরত্ব, নির্যাতনের নির্মমতা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে শুরু করেছিলেন এই অভিনব কার্যক্রম। আর এই অনুষ্ঠানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা এই অনুষ্ঠানে এসে শিশু-কিশোরদের সামনে স্বীয় অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে। শিশু-কিশোররা বিভিন্ন প্রশ্ন করে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে। নতুন প্রজন্ম সেইসব দিন মনের জগতে কল্পনায় সাজিয়ে নেয়, উপলদ্ধি করে।
একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণসচেতনা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। সচেতন সমাজের সমর্থন আদায় করে এটি প্রতিরোধ করেন জাফর ইকবাল। দেশের সাধারণ মানুষ, শিক্ষক সবাই তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিল। সাংবাদিক সম্মেলন করে, কলাম লিখে দেশের মানুষকে একমুখী শিক্ষা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে শিক্ষার সর্বনাশ রোধ করতে সমর্থ হয়েছেন। আবার জাফর ইকবাল গণিতের মতো কঠিন বিষয়ের ওপর সাধারণ জনগণের আগ্রহ তৈরি করেছেন। গণিতের সাথে যেন বাঙালিদের আড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের গণিতের সাথে দুরত্ব নিজেই উপলদ্ধি করেছেন। কিন্তু ভালো সায়েন্টিস্ট বা ভালো ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে বিজ্ঞানের পাশাপাশি ভালোভাবে অংকের ওপর দক্ষতার প্রয়োজন। তাই অংক ভীতি দূর করতে বন্ধু কায়কোবাদকে সাথে নিয়ে প্রথমদিকে শিশু-কিশোরদের জন্য ‘দৈনিক প্রথম আলো’ তে গণিত বিষয়ে পাঁচটি করে প্রশ্ন দিতেন। ‘দৈনিক প্রথম আলো’তে ‘নিউরনে অনুরণন’ নামের এই অংশটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরে এ দলে মুনির হাসান যোগ দেন।
ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের গণিতে আগ্রহী করার জন্য পরবর্তীতে শুরু করেন ‘গণিত অলিম্পিয়াড’ কার্যক্রম। ধীরে ধীরে এই গণিত অলিম্পিয়াড কার্যক্রমটি গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মহা উত্সাহ নিয়ে জটিল জটিল অংকের সমাধান করছে। মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে তাই দেখতে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে চলেছেন জাফর ইকবাল। তিনি শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। কখনো প্রশ্ন জটিল হলে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন এই ভেবে যে, কঠিন দেখে ছেলে-মেয়েরা যদি উত্সাহ হারিয়ে ফেলে। আবার ছেলে-মেয়েদের অংক বিষয়ে উত্সাহ দিতে ‘আমি তপু’র মতো গল্পও লিখেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ‘আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড’ এ অংশগ্রহণ করছে। গণিত অলিম্পিয়াড এর মাধ্যমে তিনি এদেশের শিশু কিশোরদের মনে তৈরি করেছেন গণিতের প্রতি ভালোবাসা। দূর করেছেন গণিতের প্রতি মানুষের আজীবনের ভয়। আজ তারা গণিতের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বপ্নকে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছে।
লেখক জাফর ইকবালের সাহিত্যিক জীবনে ছড়িয়ে আছে প্রেরণার এবং মজাদার অনেক কাহিনী। প্রেরণার একটি হলো- ১৯৭৫ সালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক পত্রিকায় শহীদ বাবাকে নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন তিনি। লেখাটি প্রকাশের কিছুদিন পরেই বাংলা সাহিত্যের আরেক স্তম্ভ আহমেদ ছফার সাথে রাস্তায় দেখা। তিনি জাফর ইকবালের রিকশা থামিয়ে বললেন, ‘তোমার লেখাটা আমার ভালো লেগেছে। নাও, এক টাকা নাও।’ লেখা থেকে সেই প্রথম উপার্জন। জাফর ইকবাল সেদিন অসম্ভব অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন অগ্রজের এই স্বীকৃতিতে। অপরদিকে মজার কাহিনী হলো তাঁর জন্মদিন এবং পিতৃদত্ত নামটি নিয়ে। প্রত্যেক মানুষের তো জন্মদিন একটা। তাঁর কিন্তু দু’টো। স্কুলের শিক্ষকেরা জাফর ইকবাল নামের ছাত্রটির জন্ম তারিখের স্থানে ১৯৫৩ সালের ৩ অক্টোবর দিয়ে দেন। তবে তিনি নিজের সাহিত্যকর্মে বা সাক্ষাত্কারে আসল জন্মদিনটা উল্লেখ করেন। আর সেটা ভাষা আন্দোলনের বছর, ১৯৫২-র ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের মীরা বাজারে। দুই জন্মদিনের বিষয়টা বেশ উপভোগ করেন জাফর ইকবাল। নামের ক্ষেত্রে হয়েছে আরেক ঘটনা। আগে নামের বানানে তিনি ‘মোহাম্মদ’ লিখতেন। আহমেদ ছফা তাঁকে বললেন, ‘এভাবে লিখলে চলবে না। ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ যেভাবে লেখে সেভাবে লেখো।’ তারপর থেকে নিজের নামের বানানে ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল’ লিখতে শুরু করেন।
শুধুমাত্র দেশেই নয় ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের বাইরেও একটি পরিচিত নাম। আর তাঁর সে পরিচয়টা বিজ্ঞানী হিসেবে। এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিদ্যায় তাঁর দক্ষতা ও মেধার স্ফূরণ দেখে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড্যামলেট তাঁকে নিজের সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ক্যালটেকের বেল ল্যাবরেটরিতে তাঁর সহকর্মী ছিলেন বারোজন নোবেল লরেট। তিনি নিযুক্ত ছিলেন ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে তৈরির কাজে। তাঁর উদ্ভাবিত টাইম প্রজেকশন সুইজারল্যান্ডের এক পাহাড়ের নিচে বহুদিন যাবত্ ডাটা সংগ্রহের কাজ করছে। গবেষণার কাজকে প্রচণ্ড আনন্দদায়ক বলে মনে হয় এই গবেষকের কাছে। বিজ্ঞানী জাফর ইকবালElectronics, Computer Science and Engineering, Bangla Computerization, Networking, Non-Linear Optics এবং পদার্থ বিজ্ঞানের ওপর বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজ করেছেন।
এই সফল মানুষটির জীবনেও রয়েছে বেদনার গভীর ক্ষত। যে বেদনাকে তিনি ধারণ করেন গর্বের সাথে। ঘটনাটি ১৯৭১ সালের। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার বছর। জাফর ইকবাল তখন প্রায় আঠারো বছরের তরুণ। ১৯৭১ সালে তাঁর বাবার পোস্টিং ছিল পিরোজপুরে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অপরাধে তাঁর পুলিশ অফিসার বাবাকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করার পর মৃতদেহ ফেলে দেয় ধলেশ্বরীর পানিতে। পিরোজপুর ভাটি অঞ্চল। নদীর জোয়ার ভাটায় সেই মৃত শরীর একবার এদিক আরেকবার ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছিল। কখনও ঠেকে যাচ্ছিল পাড়ে। নদী থেকে সেই মৃত শরীরটি তুলে আশপাশের মানুষজন নদীর পাড়েই দাফন করে। আর জুতো জোড়া রেখে দেয় পরিবারের লোকজনকে দেখানোর জন্য। যুদ্ধ শেষে জাফর ইকবাল বাবার মৃতদেহ শনাক্ত করে মায়ের কাছে নিয়ে আসে। তাই মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাবাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট, আর কোনদিন বাবাকে দেখতে না পাওয়ার গভীর যন্ত্রণা।
নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার বিখ্যাত পীর জাঙ্গির মুনশি’র ছেলে মৌলানা আজিমুদ্দিন মুহম্মদ জাফর ইকবালের দাদা। তিনি ছিলেন একজন উঁচুদরের আলেম এবং মৌলানা। জাফর ইকবালের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং মা গৃহিনী। তিন ভাই দুই বোনের মাঝে তিনি দ্বিতীয়। তাঁর বড়ভাই বাংলাদেশের লেখালেখির ভূবনে প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ। গত ত্রিশ বছর ধরেই তাঁর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট এবং রম্য লেখক। দেশের একমাত্র রম্য পত্রিকা উন্মাদ’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক। জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমীন হক। ব্যাক্তিগত জীবনে ড. ইয়াসমীন হক জাফর ইকবালের সহপাঠী। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এম.এসসি. শেষে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। এই দম্পতির দু’সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে নাবিল ইকবাল এবং একমাত্র মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল৷
জাফর ইকবাল ২০০২ সালে কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক পান। ১৪১০-এ খালেদা চৌধুরি সাহিত্য পদক লাভ করেন। ২০০৩ সালে লাভ করেন শেলটেক সাহিত্য পদক। এরপরের বছর অর্থাত্ ২০০৪ সালে শিশু সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাফর ইকবালকে ইউরো শিশুসাহিত্য পদক দেওয়া হয়। জনগণের ভোটের মাধ্যমে ২০০৫ সালে জীবিত ১০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে জাফর ইকবালের নাম উঠে এসেছে। ২০০৫ সালে তাঁর সাহিত্য জিতে নেয় মোহা. মুদাব্বর-হুসনে আরা সাহিত্য পদক। এই বছরই মার্কেন্টাইল ব্যাংক তাঁকে সম্মাননা পদক প্রদান করে। একই বছরে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বড় স্বীকৃতি জাফর ইকবালের ভাণ্ডারে জমা হয়। বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ২০০৫ লাভ করেন তিনি। ২০০৫ সালে আমেরিকা এল্যাইমনি এ্যসোসিয়েসন পদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালাইমনি এ্যাসোসিয়েসন পদক ‘০৫ লাভ করেন।
তিনি কখনই অন্যায় এর সাথে আপোষ করেননা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার হয়ে ওঠেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। সমাজে কোনো অন্যায় দেখার সাথে সাথে তাঁর কলম সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ওঠে। আর এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁর বাড়িতে বোমা মারা হয়েছে। পাঠানো হয়েছে কাফনের কাপড়। ছেলেবেলায় একদিন যে বালকটি মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে কেঁদে সারা হয়েছিল বড় হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সাথে পথ চলতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি একমুহুর্তের জন্যও থেমে যাননি। হাজারও হুমকি-ধামকি আর কাফনের কাপড়ের মধ্যে বাস করেও ছেলেবেলার সেই ছোট্ট ইকবাল মৃত্যু ভয়ে ভীত না হয়ে পথ চলছেন নির্ভয়ে। আর অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বলিষ্ঠকন্ঠে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: জাফর ইকবালের প্রকৃত জন্ম তারিখ ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। এ দিনটিতেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় শিক্ষকরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো সেটা করেছেন ১৯৫৩ সালের ৬ অক্টোবর। আর শিক্ষকদের দেওয়া এই তারিখটিই তাঁকে বহন করতে হয়েছে সব সার্টিফিকেটে, পাসপোর্টে এবং সবধরনের দাপ্তরিক কাজে।
বাবা-মা: জাফর ইকবালের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং মা আয়েশা ফায়েজ গৃহিনী। তিন ভাই দুই বোনের মাঝে তিনি দ্বিতীয়।
পড়াশুনা: সিলেটের কিশোর মোহন পাঠশালায় পড়াশুনার শুরু হলেও সেখানে বেশি দিন স্থির হননি। বাবার বদলির কারণে ঘুরতে হয়েছে বিভিন্ন স্কুলে। বিভিন্ন স্কুল ঘুরে মাধ্যমিক পাশের পর উচ্চমাধ্যমিকে এসে স্থির হন ঢাকা কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ। ১৯৭৩ সালে অনার্স-এ দুই নম্বরের ব্যবধানে প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৭৪ সালে লাভ করেন মাস্টার্স ডিগ্রি। এরপর ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮২ সালে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স অর্জন করলেন PhD ডিগ্রি। তাঁর বিষয় ছিল – ‘Parity violation in Hydrogen Atom.
কর্মজীবন: PhD ডিগ্রি অর্জনের পর একজন তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বিদেশের মাটিতে নানা সময়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- University of Washington– এ Research Assistant হিসেবে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের Caltech– এ Research Faculty তে ছিলেন ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বে সঙ্গে ‘Member of Technical staff ‘- এর দায়িত্ব পালন করেছেন Bell Communications Research এ। এরপর পরই মাতৃভূমির টানে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশে চলে আসেন। বর্তমানে তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব ছাড়াও তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালকের পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের Research Journal ‘SUST Studies’ এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। Research Initiatives BangladeshএবংFreedom Foundation এর বোর্ড মেম্বার হিসেবে আছেন। ‘বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ‘Bangladesh Informatics Olympiad Committee-র প্রেসিডেন্ট পদে আসীন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে: জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমীন হক। ব্যাক্তিগত জীবনে ড. ইয়াসমীন হক জাফর ইকবালের সহপাঠী। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এম.এসসি. শেষে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। এই দম্পতির দু’সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে নাবিল ইকবাল এবং একমাত্র মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল।
মূল লেখক : আয়েশা সিদ্দিকা রাত্রি
পুনর্লিখন : গুণীজন দল