বিশ শতকের যে সময়টিতে সমগ্র বিশ্বে বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটে চলেছিল, সেই সময়কার একজন সফল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এ.এম. হারুন অর রশীদ। বাংলার সহজ প্রকৃতি তাঁকে জীবন দান করেছিল অন্য সকল সাধারণ মানুষের মতোই। এই প্রকৃতির মাঝে থেকে তিনি জীবন গড়েছেন সততা-শৃঙ্খলা-ন্যায়বোধ-মহানুভবতা-আপোষহীনতা আর দেশপ্রেমকে সঙ্গী করে; তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের নানাবিধ শাখায় বিচরণ করে, দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে সুযোগ্য উত্তরাধিকার সৃষ্টির অঙ্গীকারে; একইসঙ্গে মহাসংগীতের সুরপাবনে অবগাহন করে, ‘উদাসী হাওয়ার পথে পথে’ ঝরে-পড়া মুকুলগুলি কুড়িয়ে নিয়ে। ছোটোবেলা থেকেই সকল ধর্মের সকল মানুষের সঙ্গে সাবলীলভাবে মিশে-যাওয়া এই মনীষীর চরিত্রে পরিপূর্ণতা দান করেছে যেন সকল মহত্তম গুণ। অক্লান্ত গবেষণায় পদার্থবিজ্ঞানে অশেষ অবদানের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান-ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তিনি যেমন গৌরবময় শিখরে উন্নীত করেছেন, দেশও তাঁকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করেছে একুশে পদক, রাষ্ট্রপতি পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে।হারুন অর রশীদের জীবনের শুরুটি হয়েছিল বরিশাল জেলার নলছিটি উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে মাতুলালয়ে।
১৯৩৩ সালের ১ মে মকসুদ আলী ও জাহানারা বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন প্রথম সন্তান এ. এম. হারুন অর রশীদ। পুরো নাম আবুল মকসুদ হারুন অর রশীদ। বাবা মকসুদ আলী বরিশাল জেলার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলায় কৃষ্ণনগর কলেজের শিক্ষক ছিলেন তিনি। বাংলা বিভাগ-এর পর তিনি ঢাকা কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা, এবং পরে রংপুর কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করেন। সেখান থেকে পুনরায় ঢাকায় এসে সহকারী জনশিক্ষা পরিচালক (এডিপিআই) নিযুক্ত হয়েছিলেন। সারা জীবন সততা আর আদর্শের সঙ্গে পথ চলে প্রায় ৬৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর বছর দুয়েক পরে মৃত্যুবরণ করেন ড. রশীদের মা জাহানারা বেগম।হারুন অর রশীদের দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে মেজভাই এ.এম. জাহাঙ্গীর কবীর, আর ছোটোভাই এ.এম. জাহিদ রেজা। পেশাগত জীবনে প্রথমজন প্রকৌশলী, দ্বিতীয়জন ডাক্তার। পাঁচ বোন রানী, মীরা, বীনা, খুকু ও শেফু। একমাত্র মামা শামসুদ্দীন আবুল কালাম ছিলেন উভয় বাংলায় অত্যন্ত পরিচিত বাংলা সাহিত্যের একমাত্র মুসলমান গল্পলেখক এবং খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক।
বাবা জনাব মকসুদ আলী এবং মা জাহানারা বেগম দুজনেই ছিলেন সংস্কৃতমনা উদার বিদগ্ধ মনের মানুষ। কৃষ্ণনগরের ধর্মীয় ভেদাভেদহীন উদার ঋদ্ধ পরিবেশ, আর বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বালক হারুনের চরিত্র গঠনের প্রাথমিক পর্বটি শুরু হয়েছিল। সংগীত-রসিক বাবার খুব ইচ্ছে ছিল ছেলেকে গান শেখাবেন। সরোজ আচার্য্য নামে একজন গানের শিক্ষকও রেখে দিয়েছিলেন ছেলের জন্য। তাঁর কাছে বেশ কিছুদিন গান শিখেছিলেন ড. রশীদ। ছোটো ভাইবোনদের কথামতো খালি গলায় তিনি ‘ভালোই গাইতেন’। কৃষ্ণনগর কলেজে বাবার শিক্ষকতার সূত্র ধরে ড. রশীদের শৈশব কেটেছে পশ্চিমবাংলার কৃষ্ণনগর শহরে। বাড়িতে বাবার কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ির পর ছয় বছর বয়সে কৃষ্ণনগরের রামবক্স প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। কয়েক বছর পর বাবা তাঁকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন। সেই অঞ্চলে বেশ নামকরা এই স্কুলটি ছিল তাঁদের বাড়ির কাছেই। স্কুলের যে বিরাট ভবনটায় ক্লাস হতো, সেটা মনমোহন বসু নামে একজন ব্যারিস্টারের বাড়ি ছিল যা তিনি মৃত্যুর আগে স্কুলে দান করেছিলেন। স্কুলে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকজন।
স্কুলের সবার কাছে ড. রশীদ পরিচিত ছিলেন লেখাপড়ায় ভালো ও মেধাবী বলে, আর শিক্ষকদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। বন্ধু নিশাপতি মুখার্জী, ক্ষিতিশচন্দ্র চক্রবর্তী, দেবদাস ভট্টাচার্য, রজত মুখার্জী ইত্যাদি সবার কাছেই ছিলেন ভালোবাসার পাত্র। স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য বা ক্লাসে শতভাগ উপস্থিতির জন্য প্রতিবারই বিভিন্ন বই পুরস্কার পেয়েছেন ড. রশীদ। সেগুলির মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের ‘আম আটির ভেঁপু’ বইটি ছিল তাঁর খুবই প্রিয়। লেখাপড়ায় অত্যন্ত মনোযোগী হারুন অর রশীদ তাঁর স্কুল ও কলেজের কোনো পরীক্ষায় কখনো দ্বিতীয় হননি। তবে, পড়াশোনার পাশাপাশি নানাবিধ খেলায় মেতে থাকতে খুব ভালো লাগত কিশোর হারুনের। কলেজিয়েট স্কুলের বিশাল খেলার মাঠটিতে নিয়মিতই খেলা হতো ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ইত্যাদি। স্কুলের টিমে ভালো খেলোয়াড় হিসেবে জনপ্রিয়তাও ছিল বেশ। প্রায় সব রকমের খেলা খেললেও জীবনে কখনো তাস খেলেননি তিনি।
শৈশবের দিনগুলিতে বাড়তি আনন্দের যোগ হতো গ্রীষ্মের ছুটিতে। গ্রীষ্মের ছুটিতে কলেজ যখন বন্ধ হতো, তখন তাঁর বাবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে কৃষ্ণনগর থেকে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। গ্রামের বাড়িতে আসতে হলে কৃষ্ণনগর থেকে ট্রেনে করে খুলনা আসতে হতো, খুলনায় স্টিমার ধরে বরিশালে, তারপর সেখান থেকে নৌকা করে গ্রামে। স্টিমারে করে নদী পার হওয়ার সময়ে মায়ের কাছে-শোনা গল্পগুলি স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে আছে যেন চিরদিনের জন্য। গ্রামে যাওয়া বলতে আসা হতো মূলত নানার বাড়ি বাহাদুরপুর গ্রামে। নানাজির কাছে তিনি ছিলেন পরম আদুরে। নানার বাড়ি থেকে একটু দূরেই ছিল দাদার বাড়ি। গোয়াইলবাড়ি নামের এ-গ্রামটিতে যেতে হতো নৌকা করে। নানার বাড়িতে গেলেই দাদি এসে তাঁকে কিছুদিনের জন্য নিয়ে যেতেন সেই বাড়িতে। দাদা না থাকলেও দাদির সঙ্গে দিনগুলি তাঁর অত্যন্ত আনন্দে কাটত।
১৯৪৭ সালে বাংলা বিভাগ হলে মকসুদ আলী সাহেবকে ঢাকায় বদলি করা হয়। ঢাকা এসে তিনি ঢাকা কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপনায় যোগদান করেন। পরিবারের বাকিরা তখনো কৃষ্ণনগরেই থেকে যান। বাবার অনুপস্থিতিতে তখন পরিবারের অভিভাবক হতে হয় পরিবারের বড়ো ছেলে, কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত হারুন অর রশীদকে। বছরখানেক পরে, ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাবা ঢাকায় আসেন। ফলে, দশম শ্রেণির পাঠ শেষ করার আগেই আরেকবার স্কুলবদল করতে হয় হারুন অর রশীদকে। ঢাকা এসে তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। কিন্তু এখানে কোনোকিছুই ভালো লাগত না তাঁর, কৃষ্ণনগরের সেই স্কুলটার কথাই মনে পড়ত ফিরে ফিরে। নতুন স্কুলে খেলার জায়গা কম আর পড়াশোনার অধিক চাপের দরুন খেলাধুলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হলো। ছোটোবেলাকার গান শেখার পর্বটিও শেষ হয়েছিল এখানে এসে। ট্রেনে করে ঢাকায় আসবার সময়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘আম আটির ভেঁপু’ সহ স্কুল থেকে উপহার পাওয়া অন্য সবগুলি বই হারিয়ে যায়।ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময়ে তাঁর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার মাত্র তিন মাস বাকি ছিল।
নতুন স্কুলে ক্লাস তেমন একটা করা হয়নি। পরীক্ষার কিছুদিন আগে তিনি চিকেন পক্স-এ আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সে বছরই, ১৯৪৮ সালে, তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং স্টার মার্কসসহ তিনটি বিষয়ে লেটার-মার্কস পেয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম শ্রেণিতে চতুর্থ স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এই কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পরীক্ষায় তিনি স্টার মার্কসসহ ইংরেজি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতে লেটার-মার্কস পেয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে উওীর্ণ হন। সে-সময়ে ইংরেজিতে লেটার-মার্কস পাওয়াটা ছিল বিরল ঘটনা। ম্যাট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েট উভয় পরীক্ষাতেই কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য তিনি প্রথম গ্রেড সরকারি বৃত্তি লাভ করেন।কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়বার সময়ে ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাস এবং আরও অনেক বড়ো বড়ো ব্যারিস্টারের নাম শুনে হারুন অর রশীদের ইচ্ছে হয়েছিল বড়ো হয়ে ব্যারিস্টার হবেন। তবে কলেজে আসার পর থেকেই তিনি পদার্থবিজ্ঞান পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ-সিদ্ধান্তের মূল প্রেরণা ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক বাবা মকসুদ আলী।
সে সূত্রেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ড. রশীদ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৫৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে বি.এসসি. সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন স্থায়ী দাগ কাটে তাঁর মনে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে গাজিউল হকের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করা, পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল আর এলোপাতাড়ি গুলিতে সকলের ছুটোছুটি, এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিজের চোখে-দেখা শহিদদের ছিন্নভিন্ন দেহ তাঁকে স্তম্ভিত করে। পরের দিনও শহিদদের জানাজায় অংশগ্রহণ ও দ্বিতীয়বার পুলিশের গুলির মধ্যে দিয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েও প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
বি.এসসি. সম্মান ডিগ্রিলাভের পরের বছর হারুন অর রশীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্নাতকের মধ্যে সমন্বিতভাবে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজা কালীনারায়ণ বৃত্তি লাভ করেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এসসি. ডিগ্রির জন্য লেখাপড়া শুরু করেন। এ-ডিগ্রির প্রয়োজনীয় কাজগুলির অংশ হিসেবে এক্স-রে মেথড-এর মাধ্যমে ট্রাই ফিনাইল মিথেনের স্ফটিক গঠনের ওপরে একটি থিসিস প্রস্তুত করে ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এসসি. ডিগ্রি অর্জন করেন। এই ফলাফলের জন্য তিনি যুক্তরাজ্য প্রদত্ত ওভারসীস বৃত্তি লাভ করে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য গমন করেন। সেখানে প্রফেসর আর.জি. মুরহাউজ এবং প্রফেসর বি.এইচ. ব্রান্সডেন-এর তত্ত্বাবধানে তিনি ক্ষেত্র-তত্ত্বে ট্যাম-ডানকফ আসন্নমান ব্যবহার করে কে-মেসন নিউক্লিয়ন বিচ্ছুরণ (K-Meson Nucleon Scattering using Tamm-Dancoff Approximation in Field Theory) শীর্ষক গবেষণা-অভিসন্দর্ভ প্রস্তুত করেন। যথাসময়ে গবেষণা-অভিসন্দর্ভ উপস্থাপন করে ১৯৬০ সালে তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. হারুন অর রশীদের সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন শুরু হয় ১৯৫৬ সালে।
এম.এসসি. পাস করার পর পরই বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শচীন মিত্রের কথামতো তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। একই বছর তিনি যুক্তরাজ্যের হারওয়েলে অবস্থিত এটমিক এনার্জি রিসার্চ এসটাব্লিশমেন্ট থেকে রিয়্যাক্টর ফিজিক্স-এর ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে লেকচারার ছিলেন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। এরপর তিনি ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কমিশনে যোগদান করেন এবং ১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রথমে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ও পরে প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে-বছরই তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট-এ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ফিজিক্স ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদে উন্নীত হন এবং ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত থাকেন।১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ-এর জন্ম হয়। ড. রশীদ তখন স্বীয় ক্ষেত্র থেকে নিজ দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংল্যান্ডের ইম্পেরিয়াল কলেজে দুবছর থাকার পর তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ-এর পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হন এবং ১৯৮১ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ-দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের নিয়মিত অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এর আগেই ড. রশীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত সম্মানীয় বোস অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি ইউজিসি প্রফেসর (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অধ্যাপক) নিযুক্ত হন।এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য, বাংলা একাডেমীর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল কারিকুলাম কমিটি ও এক্সামিনেশন রিফর্মস কমিটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নোবেল প্রাইজ নমিনেশন কমিটির সদস্য ছিলেন ১৯৭২, ১৯৮৬ ও ১৯৯৩ সালে।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সহসভাপতি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর ফেলো ও সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অব সায়েন্সেস-এর ফেলো নিযুক্ত হন। ঢাকা ফিজিক্স গ্রুপ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি।অধ্যাপনার পাশাপাশি ড. হারুন অর রশীদ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসপার্সন রিলেশন-এর উপরে সামার ইন্সটিটিউটে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ট্রিয়েস্টে অধ্যাপক আব্দুস সালাম আয়োজিত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ওপর অনুষ্ঠিত প্রথম সামার সেমিনার-এ অংশগ্রহণ করেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন Karlsruhe-Gi Institute fur Theoretische Kernphysik -এ (১৯৬৩, ১৯৬৪), ট্রিয়েস্টের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স (১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৭৪), লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (১৯৭১, ১৯৭২), ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সেন্টার ফর পার্টিকেল থিওরি (১৯৭৫), লস এঞ্জেল্স ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯১) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া তিনি ট্রিয়েস্টের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স-এর প্রথমে একজন অ্যাসোসিয়েট এবং পরে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ছিলেন।
তিন মাস মেয়াদে ঐ সেন্টারে কর্মরত ছিলেন ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৮৫ ও ১৯৯৩ সালে। তিনি লন্ডন, ভিয়েনা, কিয়েভ, টোকিও, হ্যামবুর্গ, বারি এবং অন্যান্য শহরে হাই-এনার্জি ফিজিক্স কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি স্ট্রিং থিওরির ওপর এডিনবরা স্কটিশ সামার স্কুলে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে অংশগ্রহণ করেন টোকিও ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ফিজিক্যাল সোসাইটিতে।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণা-শিক্ষকতার পাশাপাশি হারুন অর রশীদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিল বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎলাভ ও মনোজ্ঞ আলাপচারিতা। পিএইচ.ডি. ডিগ্রি সম্পন্ন করে দেশে ফেরার সময়ে তিনি সাক্ষাৎলাভ করেন তখনকার সময়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একমাত্র মুসলমান পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আবদুস সালামের। এর দশ বছর পর লন্ডন ত্যাগ করার দিনে, একটি রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজের সময় আবদুস সালামের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলেছিলেন ড. রশীদ।
আবদুল সালামের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন একজন সংবেদী, সহানুভূতিশীল অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে – বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের জন্য সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ীভাবে কিছু করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব মনে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৮০ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হারুন অর রশীদ নিজ উদ্যোগে আবদুস সালামকে ঢাকায় আসবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সানন্দে সে-আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন আবদুস সালাম। বিখ্যাত আর-এক পদার্থবিজ্ঞানী হাইসেনবার্গ-এর বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল ড. রশীদের। পদার্থবিজ্ঞানের অপর দিকপাল ডিরাক-এর বক্তৃতা শুনেছেন অন্তত দুইবার। এঁদের ছাড়াও পরে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সুইংগার-এর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলেন তিনি। সত্যেন্দ্রনাথ বোসের অশীতিতম জন্মবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎলাভ করেন এই গুরুদেবের সঙ্গে। কলকাতার রাজভবনে তাঁর পাশে বসে অনেকক্ষণের আলাপে কোয়ান্টাম সংখ্যাতত্ত্বের সত্যেন-বোস উদ্ভাবিত মৌলিক কণার কণা-নির্ভর সমাধানের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন ড. রশীদ। সত্যেন বোস স্নেহের সুরে ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর নিজস্ব ধারণার উৎপত্তির ইতিহাসের কথা।
সত্যেন বোস-সালাম-হাইসেনবার্গ-ডিরাক-সুইংগার প্রমুখ মনীষীগণের কাছ থেকে জীবনের পাথেয়রূপে যে-প্রেরণা হারুন অর রশীদ পেয়েছিলেন এবং যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই তিনি প্রয়োগ করেছেন তাঁর সমগ্র শিক্ষকতা ও গবেষণার জীবনে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছেন গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান (Mathematical Physics), উচ্চশক্তির পদার্থবিজ্ঞান (High-Energy Physics), মেসন-এর ফটো প্রোডাকশন (Meson Photo Production), কাইরাল ল্যাগরেনজিয়ান তত্ত্ব (Chiral Lagrangian Theory), উচ্চ সিমেট্রি মডেল (Higher Symmetry Model), রেজ্জে-ভেনেজিয়ানো মডেল (Regge-Veneziano Model) ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চাঙ্গের বৈজ্ঞানিক অবদানের জন্য। দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে তিনি দেশ ও দেশের বাইরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে পদার্থবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। বি.এসসি. সম্মান, এম.এসসি. ও এম.ফিল. স্তরের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিয়েছেন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডিনামিক্স, আপেক্ষিকতার বিশেষ ও সাধারণ তত্ত্ব, ইলেক্ট্রিসিটি ও ম্যাগনেটিজম, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, স্ট্যাটিসটিক্যাল ফিজিক্স ইলেক্ট্রোডিনামিক্স, সলিড স্টেট ফিজিক্স ইত্যাদি বিষয়ে।
এর পাশাপাশি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত ছাত্রছাত্রীর পিএইচ.ডি. স্তরের গবেষণাকাজে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অত্যন্ত সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ড. হারুন অর রশীদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৮৫- র বেশি। এসবের অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে উচ্চমানসম্পন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে। এছাড়া তাঁর বেশ কিছু পর্যালোচনাপত্র প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ হারুন অর রশীদের অন্যতম অবদান তাঁর প্রণীত গ্রন্থসমূহ। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ওপর ৩০টির বেশি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন তিনি। প্রাঞ্জল বাংলায় লেখা তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে আইনস্টাইন ও আপেক্ষিক তত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব, কম্পিউটারের কাহিনী, আকাশ-ভরা সূর্য-তারা, চিরায়ত বলবিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন, গ্যাসো-সালাম-ভাইনবার্গ তত্ত্ব, সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ও বিশ্বসৃষ্টি তত্ত্ব, ঘুরে ফিরে দেখা আমাদের মহাবিশ্ব, মৌলিক কণা, পরিসংখ্যান বলবিজ্ঞান, বিদ্যুৎ ও চুম্বক তত্ত্ব, আধুনিক নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান, বিজ্ঞানে আমাদের উত্তরাধিকার ইত্যাদি।
ইংরেজিতে প্রণীত গ্রন্থগুলি হলো Nuclear Structure, Quantum Mechanics, Satyen Bose in Dhaka, Complex Variable and Special Functions of Mathematical Physics, Geometrical Methods in Physics, Our Physics Heritage and the New Millennium, Quantum Field Theory, Introduction to Particle Physics ইত্যাদি। এ ছাড়া তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Bangladesh Vision-2021, Our Alma Mater: From Bose-Einstein to Salam-Weinberg and Beyond ইত্যাদি।ড. হারুন অর রশীদ পারিবারিক জীবন শুরু করেছিলেন ১৯৬০ সালে। লন্ডন থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভের পর তিনি তখন সদ্য দেশে ফিরেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তাপের পরে ঢাকা তখন খুব শান্ত। পুরানা পল্টনের একটি বাসায় বাবা-মার সঙ্গে থাকতেন তিনি। এর কিছু দূরেই সেগুন বাগিচা। পারিবারিক পরিবেশে সেগুন বাগিচায় বসবাসরত মির্জা সিরাজুল হক ও রাফিয়া মির্জার কন্যা যূথী মির্জার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। যূথী মির্জা তখন ঢাকা বেতারের একজন সুগায়িকা ছিলেন।
ড. রশীদ-যূথী মির্জা দম্পতি দুই কন্যাসন্তানের জনক-জননী। পদার্থবিজ্ঞানী-গুণী শিল্পী দম্পতির জ্ঞানৈশ্বর্য ও সুর-শৃঙ্খলিত পরিবারে বেড়ে-ওঠা দুই কন্যা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বড়ো মেয়ে তাহমিনা জয় রশীদ ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি বিষয়ে পিএইচ.ডি. সম্পন্ন করেছেন। ছোটো মেয়ে রুখসানা দীপা রশীদ ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করে সেখানেই পরিবার নিয়ে বাস করছেন।ড. হারুন অর রশীদ ১৯৯১ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রণালয় ড. রশীদের সামগ্রিক গবেষণা ও প্রকাশনা কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে ‘বিজ্ঞান গ্রন্থবর্ষ ২০০৫’ উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমী প্রদত্ত ভৌতবিজ্ঞান শাখায় ‘বিজ্ঞান লেখক স্বর্ণপদক’ প্রদান করেন।
২০০৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৯’ প্রদান করে সম্মানিত করেন। গবেষণা কর্মে অবদানের জন্য ২০১০ সালে তিনি লাভ করেন ‘রাষ্ট্রপতি পদক’।জীবনের নানা সময়ে অর্জন-করা সকল সঞ্চয় দিয়ে অধ্যাপক হারুন অর রশীদ সুদীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে অসংখ্য কৃতি শিক্ষার্থী সৃষ্টি করেছেন – যাঁরা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গবেষণাকর্মে যুক্ত থেকে তাঁদের প্রিয় শিক্ষকের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। মেধাবী ছাত্রছাত্রী পেয়ে তিনিও কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার কাছে। ২০০৬ সালে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর শরীর কিছুটা ক্লান্ত হলেও বিজ্ঞানের নানাবিধ গবেষণা এবং লেখালেখিতে তিনি অক্লান্ত। অবসরের সঙ্গী বই-পড়া, রবীন্দ্রনাথের গান এবং বেটোফেন ও মোৎসার্টের অনবদ্য সৃষ্টিগুলি। এ-সবকিছুর সঙ্গে নিজের দেশ, দেশের মেধাবী তরুণ-তরুণী, আপামর জনসাধারণের কথা ভাবিয়ে তোলে তাঁকে। যথার্থ বিজ্ঞানচর্চায় সুপ্রতিষ্ঠিত, একটি স্বনির্ভর সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন এ.এম. হারুন অর রশীদ।
জীবনী সংক্ষেপ
পূর্ণনাম: এ.এম. হারুন অর রশীদ (আবুল মকসুদ হারুন অর রশীদ)। জন্ম, জন্মস্থান: ১৯৩৩ সালের ১ মে বরিশাল জেলার নলছিটি উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে মাতুলালয়ে। পিতা-মাতা: মকসুদ আলী ও জাহানারা বেগম। স্ত্রী: যূথী মির্জা। সন্তান-সন্ততি: দুই কন্যা। বড়ো মেয়ে তাহমিনা জয় রশীদ ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি বিষয়ে পিএইচ.ডি. সম্পন্ন করেছেন। ছোটো মেয়ে রুখসানা দীপা রশীদ ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করেছেন।শিক্ষা: ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) – ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল (১৯৪৮); স্টার মার্কসসহ তিনটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম শ্রেণিতে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন; আইএসসি (উচ্চ মাধ্যমিক) – ঢাকা কলেজ (১৯৫০); স্টার মার্কসসহ ইংরেজি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতে লেটার মার্কসসহ সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন; ম্যাট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েট উভয় পরীক্ষাতেই কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য প্রথম গ্রেড সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। স্নাতক (সম্মান) – বি.এসসি., পদার্থবিজ্ঞানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩); এই পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন; পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্নাতকের মধ্যে সমন্বিতভাবে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজা কালীনারায়ণ বৃত্তি লাভ করেন।
স্নাতকোত্তর – এম.এসসি., পদার্থবিজ্ঞনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬); এম.এসসি.তে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য যুক্তরাজ্য প্রদত্ত ওভারসীস বৃত্তি লাভ করেন। পিএইচডি-তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য (১৯৬০)। পিএইচডি ডিগ্রির গবেষণা-অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ক্ষেত্র-তত্ত্বে ট্যাম-ডানকফ আসন্নমান ব্যবহার করে কে-মেসন নিউক্লিয়ন বিচ্ছুরণ (K-Meson Nucleon Scattering using Tamm-Dancoff Approximation in Field Theory)।কর্মজীবন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান (১৯৫৬); একই বছর যুক্তরাজ্যের হারওয়েলে অবস্থিত এটমিক এনার্জি রিসার্চ এসটাব্লিশমেন্ট থেকে রিয়্যাক্টর ফিজিক্স-এর ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ; এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসপার্সন রিলেশন-এর উপরে সামার ইন্সটিটিউটে অংশগ্রহণ (১৯৬০); ট্রিয়েস্টে অধ্যাপক আবদুস সালাম আয়োজিত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ওপর অনুষ্ঠিত প্রথম সামার সেমিনার-এ অংশগ্রহণ (১৯৬২)। ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কমিশনে যোগদান, প্রথমে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এবং পরে প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার (১৯৬২-১৯৬৭); পাকিস্তানের ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট-এ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক (১৯৬২); পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানের ফিজিক্স ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদে উন্নীত হয়ে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক (১৯৭২); একইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ-এর পরিচালক নিযুক্ত; পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (১৯৭৯-১৯৮১)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক (১৯৮৫); ১৯৯৩ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের নিয়মিত অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য, বাংলা একাডেমীর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল কারিকুলাম কমিটি ও এক্সামিনেশন রিফর্মস কমিটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন। নোবেল প্রাইজ নমিনেশন কমিটির সদস্য (১৯৭২, ১৯৮৬, ১৯৯৩)। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সহসভাপতি (১৯৯২-১৯৯৩)। থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অব সায়েন্সেস-এর ফেলো নির্বাচিত (১৯৯২)। বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর ফেলো ও সহসভাপতি। ঢাকা ফিজিক্স গ্রুপ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সম্মানিত সদস্য। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন Karlsruhe-Gi Institute fur Theoretische Kernphysik-এ (১৯৬৩, ১৯৬৪), ট্রিয়েস্টের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স (১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৭৪), লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (১৯৭১, ১৯৭২), ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সেন্টার ফর পার্টিকেল থিওরি (১৯৭৫), লস এঞ্জেল্স ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯১) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে। ট্রিয়েস্টের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স-এর প্রথমে একজন অ্যাসোসিয়েট এবং পরে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট নিযুক্ত।
১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৮৫ এবং ১৯৯৩ সালে তিন মাসের জন্য ওই সেন্টারে কর্মরত। লন্ডন, ভিয়েনা, কিয়েভ, টোকিও, হ্যামবুর্গ, বারি এবং অন্যান্য অঞ্চলে হাই এনার্জি ফিজিক্স কনফারেন্সে যোগদান। স্ট্রিং থিওরির ওপর এডিনবরা স্কটিশ সামার স্কুলে অংশগ্রহণ (১৯৮৫)। ১৯৯৫ সালে অংশগ্রহণ করেন টোকিও ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ফিজিক্যাল সোসাইটিতে।গবেষণা: গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান (Mathematical Physics), উচ্চশক্তির পদার্থবিজ্ঞান (High-Energy Physics), মেসন-এর ফটো প্রোডাকশন (Meson Photo Production), কাইরাল ল্যাগরেনজিয়ান তত্ত্ব (Chiral Lagrangian Theory), উচ্চ সিমেট্রি মডেল (Higher Symmetry Model), রেজ্জে-ভেনেজিয়ানো মডেল (Regge-Veneziano Model) ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চাঙ্গের বৈজ্ঞানিক অবদানের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছেন।প্রকাশনা: তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৮৫।
এ-সবের অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে উচ্চমানসম্পন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে। এছাড়া বেশকিছু পর্যালোচনাপত্র প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ওপর ৩০টির বেশি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে Nuclear Structure (A. Hossain I M. Islam এর সঙ্গে) (১৯৬৭), আইনস্টাইন ও আপেক্ষিক তত্ত্ব (১৯৮৪), বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান (বাংলা একাডেমী বক্তৃতা) (১৯৮৭), পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব (১৯৮৭), Quantum Mechanics (১৯৮৮), কম্পিউটারের কাহিনী (১৯৮৮), আকাশ-ভরা সূর্য-তারা (১৯৮৮), চিরায়ত বলবিজ্ঞান (১৯৯০), বিজ্ঞান ও দর্শন (১৯৯১), গ্যাসো-সালাম-ভাইনবার্গ তত্ত্ব (১৯৯২), চিরায়ত বিদ্যুৎ বলবিজ্ঞান (১৯৯২), উপমহাদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানী (১৯৯২), বস্তুর সাধারণ ধর্ম (১৯৯৩), Satyen Bose in Dhaka (১৯৯৪), আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকজন স্রষ্টা (১৯৯৫), সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ও বিশ্বসৃষ্টি তত্ত্ব (১৯৯৬), জগদীশচন্দ্রের পত্রাবলী (১৯৯৮), Complex Variable and Special Functions of Mathematical Physics (১৯৯৯), Geometrical Methods in Physics (২০০০), ঘুরে ফিরে দেখা আমাদের মহাবিশ্ব, নতুন শতাব্দীর নতুন দিগন্ত, মৌলিক কণা, পরিসংখ্যান বলবিজ্ঞান, গ্রুপ তত্ত্ব ও পরিসংখ্যানে এর প্রয়োগ (২০০২), বিদ্যুৎ ও চুম্বক তত্ত্ব, আধুনিক নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান (২০০৩), বিজ্ঞানে আমাদের উত্তরাধিকার (২০০৮), সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব (এ. লতীফ চৌধুরীর সঙ্গে, ২০০৮), বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব (এ. লতীফ চৌধুরীর সঙ্গে, ২০০৮), Our Physics Heritage and the New Millennium, Quantum Field Theory, Quantum Field Theory (২০০৯), Introduction to Particle Physics (২০১১)। এ ছাড়া তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Bangladesh Vision-2021 (Proceedings of the National Symposium on Science and Technology held January 5-7, 2001), Collected Papers on Development of Science and Technology in Bangladesh by Prof. Dr. M. Innas Ali, Our Alma Mater: From Bose-Einstein to Salam-Weinberg and Beyond ইত্যাদি।
সম্মাননা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোস অধ্যাপক (১৯৯৩); ইউজিসি প্রফেসর (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অধ্যাপক) (২০০৬); শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ (১৯৯১); সামগ্রিক গবেষণা ও প্রকাশনা কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘বিজ্ঞান গ্রন্থবর্ষ ২০০৫’ উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমী প্রদত্ত ভৌতবিজ্ঞান শাখায় ‘বিজ্ঞান লেখক স্বর্ণপদক’ (২০০৫); গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৯’ (২০০৯); গবেষণা কর্মে অবদানের জন্য ‘রাষ্ট্রপতি পদক’ (২০১০)।
তথ্যসূত্র:
১. সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. এ.এম. হারুন অর রশীদ; সাক্ষাৎকার গ্রহণ: সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ২০০৬। ২. অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত – Biographical Information of Bose Professor A.M. Harun ar Rashid; ৩. A.M. Hamende, Editor. From A Vision To A System, The International Centre for Theoretical Physics of Trieste (1964-1994), A tribute to Abdus Salam, Nobel Laureate, Founder, First Director and Honorary President of the ICTP, On the occasion of the thirteith anniversary of the Centre, pp. 252-261.
বিশেষ কৃতজ্ঞতা :
অপরেশ কুমার ব্যানার্জী
উপ পরিচালক, বাংলা একাডেমী
ধন্যবাদ :
এ. কে. এম. সাজেদুল ইসলাম
সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ (Centre of Excellence for Scientific Research), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।