বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে ১৯৬৭ সালে যোগাযোগ হয় তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের নেতা সিরাজ সিকদারের সাথে। তিনিও তখন সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর। টেনে নিলেন আনোয়ার হোসেনকে। রাজনৈতিক লেখাপড়া, প্রশিক্ষণ যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা হতে থাকে আনোয়ার হোসেনের বড়ভাই আবু ইউসুফের বাসা থেকেই। এক পর্যায়ে এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হন আনোয়ার হোসেনের আরেক ভাই আবু তাহেরও। আবু তাহের তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত। কিন্তু ছুটিতে এসেই তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ দিতেন ‘বিপ্লবী দলের’ ছেলেমেয়েদের।
বিপ্লবের নেশায় আনোয়ার হোসেন ও তাঁর ভাই আবু সাঈদসহ পনের জনের একটি দল চলে যান পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীণ অরণ্যে। আনোয়ার হোসেন ছেড়ে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া। আর ভাই আবু সাঈদ ছেড়ে দিলেন নিজের ব্যবসা। বেরিয়ে যাবার সময় মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখে পোস্ট করে দিলেন। তাতে লেখা ছিল-‘দেশের কাজে যাচ্ছি। পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করতে হবে। দেখা হবে সময়মতো’। তাঁরা ঠিক করেন সেখান থেকেই বিপ্লবের কাজ শুরু করবেন এবং সেইসাথে বার্মার কমিউনিস্ট গেরিলাদের মাধ্যমে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলবেন। তারপর চীনই অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবে। কিন্তু প্রথম ধাক্কাতেই বাতিল হয়ে যায় ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ স্বপ্ন। কিছুদিন জঙ্গলে বিরূপ পরিস্থিতিতে থেকে ভাই আবু সাঈদকে অজানার পথে রেখে আনোয়ার হোসেন গহীণ অরণ্য ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হলেন।
কিন্তু আনোয়ার হোসেন বাড়ি ফিরবেন কীভাবে? একদিকে লেখাপড়া ছেড়ে চলে গেলেন, অপরদিকে ভাই আবু সাঈদ নিখোঁজ। এমন পরিস্থিতিতে ঠিক করলেন, বাড়ি ফিরে যাবেন না। পথে যখন একবার বেরিয়ে পড়েছেন, পথকেই সাথী করতে হবে। চট্টগ্রামে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী ছাত্র কাজ করছে রেস্টুরেন্টের বয় হিসেবে। পরে সেখান থেকে আবার চলে যান সেই গহীণ জঙ্গলে, ভাইয়ের খোঁজে। কাকতালীয়ভাবে ফিরেও পান ভাই আবু সাঈদকে। তারপর ফিরে আসেন অবার ঢাকায়। আপাতত প্রথম বিপ্লবের কাজ ব্যাহত হয়। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে সেই একই চিন্তা। বিপ্লব এবং বিপ্লব।
ঢাকায় ফিরে আবার যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও সেবার বিভাগীয় চেয়ারম্যান কামালউদ্দিন স্যারকে পুনঃভর্তির জন্য অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ভাই আবু তাহের। কিন্তু ১৯৬৯ সালে আবার বিপ্লবের নেশায় ছেড়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়। সেবারও ব্যর্থ হয় পরিকল্পনা। মাঝখানে দলও ভেঙ্গে যায়। কিন্তু বিপ্লবের নেশায় বিভোর আনোয়ার হোসেনের পরিবারের সদস্যদের কারোরই মন ভাঙ্গেনি। নানাভাবে নিজেদের সক্রিয় রাখেন পূর্ববাংলার মানুষকে জালেমের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য।
ড. আনোয়ার হোসেনের পরিবারের সদস্যদের যেন একক কোনো সত্তা নেই। সবাই মিলে যেন একটি যৌথ পরিবার। যেকোন কাজে পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কী হবে না হবে তা পরের চিন্তা। আগে সবাই হাত লাগাও, কাজ সমাধা কর।
মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। আবু তাহের পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত অবস্থায় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে দায়িত্ব নিলেন ১১ নং সেক্টরের। ভাইবোনেরাও তখন তাঁর সাথে যুদ্ধে নেমে গেছে। গোটা পরিবার যুদ্ধের ময়দানে হাজির। ছেলেমেয়েরা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এই অপরাধে বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসব ভাবতে নেই। ভাবতে হবে দেশের কথা, দেশের মানুষের মুক্তির কথা। কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছিলেন ভিন্ন এক আঙ্গিকে। যেখানে যুদ্ধ হবে জীবনের অংশ। প্রতিটি মানুষ সেই যুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধ করবে। ড. আনোয়ার হোসেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন তাহেরের সাথে কামালপুরে। তিনি হলেন সেক্টর কমান্ডারের অপারেশন অফিসার। অন্য ভাইবোনেরাও দায়িত্ব পালন করছেন একই সেক্টরে। কর্নেল তাহের কামালপুরেই সম্মুখ সমরে আহত হন। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে অব্যাহতভাবে লড়ে গেছেন আনোয়ার হোসেনসহ অন্য ভাইবোনেরা। এর ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এই পরিবারের চারজন সদস্য রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হন। যা বোধ হয় বিরল ঘটনাই।
আমরা এতক্ষণ বিপ্লবের নেশায় বিভোর তরুণ ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের গল্প শুনলাম। এবার শুনব একজন সফল বিজ্ঞানী ও সফল শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের গল্প। ব্যক্তিগত জীবনে একজন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী হিসেবেই তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। এদেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চায় তাঁর অবদান অপরিসীম, একজন শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনা উজ্জ্বল করে রেখেছেন তিনি। এছাড়া একজন রাজনীতিবিদ, সফল প্রশাসক, বিজ্ঞান চেতনা আন্দোলনের পুরোধা যে কোনো অভিধায়ই হয়তো ড. আনোয়ার হোসেনকে অভিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি ভালবাসেন নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে। কারণ তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম নয়। তিনি সেই ছেলেবেলা থেকেই মানুষের মুক্তির যে আকাঙ্খার বীজ নিজের মনে বপন করেছিলেন তাকে স্বার্থক করার একটা উপযুক্ত মাধ্যম ছিল মুক্তিযুদ্ধ।
ড. আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৩০ আগষ্ট মৌলভীবাজার জেলার জুড়িতে। বাবা মহিউদ্দিন আহমদ। মা আশরাফুন্নেসা। তাঁরা সাত ভাই, তিন বোন। ভাইবোনেরা হলেন আরিফুর রহমান, আবু ইউসুফ, আবু তাহের, আবু সাঈদ, শেলি, মোয়াজ্জেম হোসেন, আনোয়ার হোসেন, সাখাওয়াত হোসেন বাহার, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, ডালিয়া, জুলিয়া। পরিবারের সবারই একটি করে ডাক নাম ছিল। আনোয়ার হোসেনের ডাক নাম মনু।
তাঁর বাবা মহিউদ্দিন আহমদ ছিলেন সরকারি চাকুরে, ষ্টেশন মাস্টার। তাঁদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। কিন্তু বদলির চাকরি হওয়ায় তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে জীবন কাটিয়েছেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা তেমন করতে পারেননি মহিউদ্দিন আহমদ। অল্প বয়সেই তাঁর বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়েই তাঁকে উপার্জনের পথে পা বাড়াতে হয়। সততা আর আদর্শনিষ্ঠতার জন্য তিনি ব্রিটিশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন।
ড. আনোয়ার হোসেনের মা আশরাফুন্নেসা ছিলেন স্বশিক্ষিত। পড়ার আগ্রহ, জানার আগ্রহ ছিল তাঁর প্রবল। যে কোন ধরনের বই পড়া তাঁর কাছে ছিল নেশার মতো। মহিউদ্দিনের সাথে বিয়ের পূর্বে আশরাফুন্নেসার আরেকটি সংসার ছিল। এক ছেলে আরিফুর রহমান হীরুকে রেখে তাঁর প্রথম স্বামী জটিল টাইফয়েডে মারা যান। মহিউদ্দিনের সঙ্গে বিয়ের পর তাঁর ছেলে হীরু তাঁদের সাথেই থাকে। কিন্তু ড. আনোয়ার হোসেনসহ তাঁর ভাইবোনরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত জানতেই পারেননি যে, হীরু তাঁদের সৎ ভাই।
স্বাভাবিকভাবেই স্টেশন মাস্টার হিসেবে মহিউদ্দিনের আর্থিক সংগতি ছিল সীমাবদ্ধ। ছেলেমেয়েদের সব সাধ-আহ্লাদ পূরণ করা সম্ভব হতো না। বছরে একবার কী দু’বার পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যেতেন। তবে প্রায় সময়ই আশরাফুন্নেসার উৎসাহে পরিবারে বসত গানের আসর। ছেলেমেয়েরাই গান কবিতা নাটক ইত্যাদি পারফর্ম করত। কেউ কেউ আবার তখন রাজনীতির অলিগলিতেও হাঁটা শুরু করেছেন। বিশেষত আবু তাহেরের উৎসাহে ষ্টেশন কোয়ার্টারে নিয়মিত চলত ছেলেমেয়েদের শরীর চর্চা। সেটার একটা রাজনৈতিক অভিলক্ষ্যও ছিল।
আর একটি কাজ নিয়মিত করতে হতো পরিবারের ছেলেমেয়েদের সেটা হল বাড়ির কাজে হাত লাগানো। গরুর খাবার জোগাড়, বাড়ি পরিষ্কার, রান্নাবান্নাসহ সব কাজের দায়িত্বই ছেলেমেয়েদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন আশরাফুন্নেসা। যদিও ষ্টেশন মাস্টারের কাজ করে দেয়ার জন্য লোকের অভাব ছিল না। তবু বাবা-মা দু’জনই চাইতেন ছেলেমেয়েরাই এসব কাজ করুক। এমন একটি কর্মোদীপ্ত-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক আবহেই বড় হয়ে উঠেছেন ড. আনোয়ার হোসেন। সারা জীবন সেই বোধ ও স্বত্তা নিয়েই নীরবে দেশের জন্য কাজ করে চলেছেন তিনি।
রেলের চাকরির কারণে মহিউদ্দিন আহমেদকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়াতে হয়েছে। ফলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করেছেন বিভিন্ন স্কুলে। আনোয়ার হোসেন অন্য ভাইদের মতো প্রথমে বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু করেন। পরে টিলাগাঁও স্টেশনে একটি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। এরপর চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ সহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি. পাশ করেন। পরে চলে আসেন ঢাকায়, ভর্তি হন সরকারি বিজ্ঞান কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। একই বছর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে।
১৯৭২ সালে ড. আনোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর পরই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা কামালউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে শুরু করেন গবেষণার কাজ। জীবনে সেই প্রথম গবেষণা। ফলে উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ উভয়েই কাজ করে তাঁর মাঝে। গবেষণার বিষয় হিসাবে কামালউদ্দিন বেছে নিলেন এমন একটি ইস্টকে যা ভিটামিন ‘এ’ তৈরি করে। কামালউদ্দিন স্যার তাঁর হাতে সেই ইস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এর মধ্যে কী আছে তা বের করতে হবে। সেটা দেখতে অনেকটা গাজর বা পাকা আমের মতো লালাভ। এই গবেষণার গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। কারণ আমাদের দেশে শিশুরা ব্যাপকভাবে ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতিজনিত রোগে ভোগে। এ কারণে অনেক শিশুই চিরকালের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আনোয়ার হোসেন সেই গবেষণায় ব্যাপক সাফল্য পান। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে গবেষণা করেন সেটির গুরুত্ব আরো বেশি করে বুঝতে পারেন ১৯৮২ সালে, যখন জাপানে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান গবেষণা করতে। তখন জানতে পারেন জাপানেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন বিজ্ঞানী গবেষণা করে একই ফল পান। তাঁর আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়।
তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ণ বিভাগে যোগদান করেন। পরে একটি রাজনৈতিক মামলায় তথাকথিত সামরিক আদালতে তিনি পাঁচ বছর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটান। একই মামলায় তাঁর ভাই সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের বীরউত্তমকে তৎকালীন সামরিক শাসক ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। জেলে বন্দি-জীবন কাটানোর সময়েই আনোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে আবেদন পাঠান। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সেই আবেদন গ্রহণ না করে সাজার মেয়াদ শেষ হবার পর তাঁকে পুনরায় যোগ দিতে বলে। ড. আনোয়ার হোসেন মনে করেন, সেদিন সেটি সম্ভব হয়েছিল একমাত্র দেশটা স্বাধীন ছিল বলেই। স্বাধীনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এমন একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে যেখানে ‘বন্দুকের নলের’ ক্ষমতা অতি নগণ্য।
জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৮২ সালে একটি স্কলারশিপ পান জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল সালোকসংশ্লেষেণ। উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান হলো অক্সিজেন। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষনের মধ্য দিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। সেই অক্সিজেনই প্রাণীকূলের বেঁচে থাকার অনিবার্য অনুসঙ্গ। কিন্তু এই অক্সিজেন আবার প্রকারভেদে বিষও হতে পারে। তা থেকে কতগুলো মারাত্বক বিষও তৈরি হয়। ফলে বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই উদ্ভিদকে এই বিষসম-অক্সিজেনকে নিষ্ক্রিয় করতে হয়। আনোয়ার হোসেনের কাজ ছিল উদ্ভিদ কীভাবে এই বিষসম-অক্সিজেনকে নিষ্ক্রিয় করে তা বের করা। ড. আনোয়ার হোসেন গবেষণা করে সেই কাঙ্খিত বস্তুটিকে সনাক্ত করেন। তিনিই প্রথম দেখান উদ্ভিদ মূলত এক ধরনের অনুঘটক বা এনজাইমের মাধ্যমে এই বিষসম-অক্সিজেনের নিষ্ক্রিয়তার কাজটি করে থাকে। এটি ছিল বিজ্ঞানের জগতে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এজন্য তিনি পুরস্কার লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করেন।
নব্বই-এর দশকের প্রথম দিকে ড. আনোয়ার হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যা সহনশীল ধানের উপর গবেষণা করেন। এই গবেষণাটি করতে গিয়ে কয়েকটি বিষয় আবিষ্কার করেন তিনি। যার একটি আমেরিকায় পেটেন্টও হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বন্যা-সহনশীল ধানের যে আবাদ হচ্ছে তার সূচনা হয় সেই ফলাফলের উপর ভিত্তি করে।
এছাড়াও ড. আনোয়ার হোসেন আরেকটি চিত্তাকর্ষক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাঙালি বলতেই আমরা বলে থাকি ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। এই সময়ে এসে বাঙালির সেই লালিত প্রবাদ যেন নানা অভাব-অনটনে একেবারে মুছে যেতে শুরু করেছে। আমাদের সন্তানরা হয়তো কষ্ট করে ভাত খাচ্ছে, কিন্তু দুধ যেন দিন দিনই ওঠে যাচ্ছে শিশুর খাবার তালিকা থেকে। ড. আনায়ার হোসেন চেষ্টা করলেন এমন এক প্রজাতির ধান আবিষ্কার করতে যার মধ্যে দুধের পুষ্টিমান থাকবে। অর্থাৎ শিশু যখন ভাত খাবে তখন সে স্বাভাবিকভাবেই দুধের পুষ্টিমানও এর মধ্য দিয়ে লাভ করবে। কিন্তু গবেষণা শেষ হবার পর দেখা গেল তিনি যে প্রত্যাশিত ফলাফল চেয়েছিলেন তা পাওয়া যায়নি। এতে ধানের ফলন কমে গেল। এটা করতে গেলে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ দেখায়। কারণ ধানের জন্য দুধের পুষ্টির প্রয়োজন হয় না। তবে ড. আনোয়ার হোসেনের দৃঢ় বিশ্বাস অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্থ না করেই বাঙালির এই প্রবাদ বাক্যকে বাস্তবে রূপ দেবে।
ড. আনোয়ার হোসেনের গবেষণাপত্র বিশ্বের নামকরা সব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ‘জার্নাল অফ বায়োলজিক্যাল কেমেস্ট্রি’, ‘প্ল্যান্ট ফিজিওলজি’, ‘প্ল্যান্ট মলিকিউলার বায়োলজি’, ‘থিয়োরিটিক্যাল এন্ড অ্যাপলাইড জেনেটিক্স’ অন্যতম। গবেষণা কাজে অবদান রাখার জন্য শ্রেষ্ঠ প্রকাশনায় বিজ্ঞানী ড. আনোয়ার হোসেন ১৯৮৫ সালে ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৩ সালে তাঁকে বিচারপতি ইব্রাহিম স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। ড. আনোয়ার হোসেন জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান অ্যাডভান্স ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি-তে ভিজিটিং প্রফেসর এবং ভিজিটিং সাইন্টিস্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি’র প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের সাথে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। ড. আনোয়ার হোসেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর থমাস কে হজেজ, প্রফেসর জেমস সি পিকক, প্রফেসর কোজি আসাদা, প্রফেসর ইইচি তামাইয়া, প্রফেসর ইয়ং তাই লি প্রমুখদের সান্নিধ্যে কাজ করেছেন। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ ও অ্যাওয়ার্ড পান। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, হল প্রভোস্ট, সিনেট সদস্য, সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ আরো অনেক ক্ষেত্রেই তিনি দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জীববিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি জাপান, ইটালি, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন।
ড. আনোয়ার হোসেন ১৯৮৩ সালে বিয়ে করেন আয়েশা আক্তারকে। আয়েশা আক্তার শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত। আনোয়ার-আয়েশা দম্পত্তির এক ছেলে সঞ্জীব হোসেন ও এক মেয়ে দীপান্বীতা হোসেন।
ড. আনোয়ার হোসেন রাজনৈতিক মামলায় প্রথমবার ১৯৭৯ সালে এক তথাকথিত সামরিক আদালতে দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে কাটান। পরে ২০০৮ সালে আবারো সামরিক সরকার তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। এসময় সিএমএম কোর্টে তিনি যে রাজনৈতিক-জবানবন্দী দেন তা ছিল তরুণদের কাছে লড়াইয়ের ব্যাপক অনুপ্রেরণা। এছাড়া ড. আনোয়ার হোসেন তাঁর জেল জীবন, রাজনৈতিক জীবন, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ অন্যান্য বিষয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। তাঁর তিনটি জনপ্রিয় ও মৌলিক গ্রন্থ রয়েছে, যা আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বই তিনটি হচ্ছে- ‘সিএমএম কোর্টে জবানবন্দি’, ‘রিমান্ড ও কারাগারের দিনগুলি’, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী’।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: ড. আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৩০ আগষ্ট মৌলভীবাজার জেলার জুড়িতে।
বাবা-মা: বাবা মহিউদ্দিন আহমদ। মা আশরাফুন্নেসা।
পড়াশুনা: ১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি. পাশ করেন। পরে চলে আসেন ঢাকায়, ভর্তি হন সরকারি বিজ্ঞান কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। একই বছর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে।
১৯৭২ সালে ড. আনোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। ১৯৮২ সালে একটি স্কলারশিপ পান জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে। নব্বই-এর দশকের প্রথম দিকে ড. আনোয়ার হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যা সহনশীল ধানের উপর গবেষণা করেন।
কর্মজীবন: তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ রসায়ণ বিভাগে যোগাদান করেন। পরে একটি রাজনৈতিক মামলায় তথাকথিত সামরিক আদালতে তিনি পাঁচ বছর করাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে কাটান। একই মামলায় তাঁর ভাই সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের বীরউত্তমকে তৎকালীন সামরিক শাসক ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। জেলে বন্দি-জীবন কাটানোর সময়েই আনোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে আবেদন পাঠান। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সেই আবেদন গ্রহণ না করে সাজার মেয়াদ শেষ হবার পর তাঁকে পুনরায় যোগ দিতে বলে। জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৮২ সালে একটি স্কলারশিপ পান জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে ফিরে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করেন।
ড. আনোয়ার হোসেন জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান অ্যাডভান্স ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি-তে ভিজিটিং প্রফেসর এবং ভিজিটিং সাইন্টিস্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি’র প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের সাথে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, হল প্রভোস্ট, সিনেট সদস্য, সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সহ আরো অনেক ক্ষেত্রেই তিনি দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তথ্যসূত্র: ফেব্রুয়ারী, ২০১০-এ ড. আনোয়ার হোসেনের সাক্ষাৎকার, তাঁর রচিত তিনটি বই-‘সিএমএম কোর্টে জবানবন্দি’, ‘রিমান্ড ও কারাগারের দিনগুলি’, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী’ ও কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ থেকে তথ্য-সাহায্য নেয়া হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়