বাবা কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলভক্ত। কিন্তু সন্জীদা খাতুন গেলেন রবীন্দ্রসংগীতের দিকে। নজরুলের সেই উদ্দাম দিনগুলোই মানুষকে নজরুলভক্ত করেছিল। যখন তিনি বিদ্রোহী লিখেছেন, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নজরুলের ভক্ত হয়েছে। এরই কিছুকাল পরে কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হলো। বর্ধমান হাউসেই কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে ছিলেন নজরুল। সন্জীদা খাতুনের বড় বোন যোবায়দা মির্যা নজরুলের কোলে বসে গান শিখেছেন। সে গান তিনি অনুষ্ঠানেও গেয়েছেন। নজরুল এই পরিবারের এক বিশেষ একজন হয়ে গিয়েছিলেন। সন্জীদা খাতুনের মনে আছে, ভোরবেলায় তাঁর বাবা পায়চারি করতে করতে রবীন্দ্র-নজরুলের গান গাইতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘যদি বারণ কর তবে গাহিব না ‘, ‘মম যৌবননিকুঞ্জে গাহে পাখি—’। নজরুলের গানের মধ্যে উনি কত গান যে গাইতেন! ভুলি কেমনে আজো যে মনে’, ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে’।
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তিনি খুব একটা ভাবেননি তখনো। বকতেন, ‘একি রে, এ রকম পেঁয়াজবেচা মুখ করে গান করিস? হাসি নেই, সহজতা নেই, এ কি ভালো?’ খুবই বকতেন।
তবে একদিন তিনি হাতে গীতবিতানটা নিয়ে বললেন, ‘দেখি তো, তোরা কী গান করিস।’ উল্টেপাল্টে দেখলেন, তারপর পুরোটা পড়ে ফেললেন। বললেন, ‘তাই তো রে! ইনিও তো ভালো লিখেছেন!’কোনো একটা একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শান্তি নিকেতনে হয়েছিল সাহিত্য সভা। সেখানে অতিথি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। সেখানে যাওয়ার আগে তিনি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অনেক পড়ালেখা করলেন। লেখাটাও লিখলেন খুব রসিয়ে। হিন্দু- মুসলমান বিরোধ নিয়ে। উনি বললেন, ‘জলপাই ছেড়ে কি পানিপাই বলব? জলপানি ছেড়ে কি পানিপানি বলব?’ লোকে খুব হেসেছিল। এমনি করে উনি রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মটা বুঝলেন।এহেস বাবার মেয়ে সন্জীদা খাতুন কী করে রবীন্দ্রপ্রেমী হলেন?সন্জীদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হলেন। ক্লাসে সৈয়দ আলী আহ্সান রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতেন। সেই কবিতা পড়ে তাঁর মন এমন হয়ে গেল, তিনি তখন রবীন্দ্রনাথের গান শিখতে চাইলেন। কিন্তু কোথায় শিখবেন? বাড়িতে শিক্ষক ছিলেন—সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে সন্জীদা খাতুন অসংখ্য নজরুলগীতি, আধুনিক, পল্লিগীতি শিখেছেন। রবীন্দ্রসংগীত শিখতে তাই তিনি সেগুনবাগান থেকে প্রেসক্লাবের মোড়ে এসে বাসে চড়ে আজিমপুরে হুসনা বানু খানমের কাছে যেতেন। তিনি যে স্বরলিপি থেকে গান শেখাতেন, তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখতেন সন্জীদা। খুব দ্রুত গান তুলে নিতে পারতেন তিনি। বাড়িতে ফিরেও গানগুলো গাইতেন। মাঝে মাঝে সুর ভুলে যেতেন, কিন্তু কীভাবে কে জানে, মাঝরাতে সুরগুলো আবার ফিরে আসত।
তার আগের কথাও কিছুটা বলা হোক। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে যখন বাড়িতে বসে আছেন সন্জীদা খাতুন, তখন মনে ইচ্ছে জাগল মুকুল ফৌজের সঙ্গে যুক্ত হবে। সে সময় কাজী মোতাহার হোসেনের বাড়ি ফজলুল হক হলের পশ্চিম গেটহাউসে। বাবাকে গিয়ে মুকুল ফৌজে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা জানালেন সন্জীদা। বললেন, ‘বিকেল বেলায় তো কিছু করার থাকে না—ঢাকা হলের পশ্চিম দিকে লিটন হলের উত্তরে মসজিদ সংলগ্ন মাঠটাতে ওরা প্যারেড, ব্রতচারী এ সব শরীরচর্চা করে—ওদের সঙ্গে থাকব।’ কাজী মোতাহার হোসেন মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা। তিনি এতে বাধা দেন কী করে? শুধু বললেন, ‘তোমার মায়ের ঘরের কাজে সাহায্য–টাহায্য করে যদি সময় পাও, তো যেয়ো।’মুকুল ফৌজে গিয়ে ‘দরদী বোন’ হয়ে গেলেন। বিকেলে প্যারেড ব্রতচারী দেখতেন। আবদুল লতিফের গানের ক্লাসে যেতেন আগ্রহ নিয়ে। পটুয়া কামরুল হাসানের কাছেও গান শিখেছেন সেখানে। মেয়েদের ব্রতচারী গান ছিল, ‘বাংলাভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইল পাগল/এই বাংলাসেবায় ঢালমু আমার দেহমনের বল গো?’ আরো ছিল, ‘কাইয়ে ধান খাইলোরে খেদানের মানুষ নাই/ খাওয়ার বেলায় আছে মানুষ কামের বেলায় নাই ‘।তখনই রবীন্দ্র সংগীতের ভালো সংগ্রহ ছিল সন্জীদা খাতুনের। পঞ্চাশ সালের দিকে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে রমনা মুকুল ফৌজের ভাইবোনদের দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ালেন সন্জীদা। গানের ক্লাসে গান শিখিয়ে রেডিওর খেলাঘর অনুষ্ঠানে সম্মেলক গান গাইয়েছেন।বাহান্ন সালেই বাংলায় অনার্সে ভর্তি হলেন সন্জীদা খাতুন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে না, এ রকমই মনে হতো তখন। তাই এই বাংলা ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কুল্যে পাঁচ জন। এর মধ্যে মেয়ে একমাত্র সন্জীদা।বাহান্ন সালে মনে হলো মুকুল ফৌজে আর কাজ করবেন না। এক বৃহস্পতিবার পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে ফিরলেন। মন খারাপ। বিকেলে শুনলেন রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেছে অনেক ছাত্র। সন্ধ্যার মধ্যে একাধিক দৈনিকের সান্ধ্য সংখ্যা বের হলো। এর মধ্যে যে আজাদকে বলা হতো মুসলিমলীগ সরকারের তাবেদার, সে পত্রিকাই গুলিবর্ষণের নিন্দা করল। সন্জীদা সে পত্রিকা পড়লেন।বায়ান্ন সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয়েছে, তখন তো মোটামুটি কাছাকাছি থেকেই তিনি জেনেছেন আন্দোলনের কথা।
২১ ফেব্রুয়ারি ক্লাসের পর বাড়ি চলে এসেছিলেন। বিকেলবেলায় শুনলেন, গুলি হয়েছে। আজাদ পত্রিকার সান্ধ্য সংখ্যা বেরিয়েছিল। সেটায় দেখলেন, মেয়েদের একটা সভা হবে ২২ ফেব্রুয়ারি কামরুন্নেসা স্কুলের গলিতে। টিকাটুলিতে। সন্জীদার মা তাঁকে নিয়ে ভয় পেতেন। সন্জীদা সে সভায় যাচ্ছেন শুনে মা–ও তাঁর সঙ্গে গেলেন। পথে সেনারা পা দাপিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। মা উল্টো দিকে দৌড় দিচ্ছেন। আবার মেয়ের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন। সেই সভায় সন্জীদা জীবনের প্রথম বক্তৃতা করেন। বলেন, ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।’ সে সভায় অনেক নারীনেত্রী ছিলেন, কিন্তু রক্তপাতের আশঙ্কায় কেউই সভাপতি হতে রাজি হননি। শেষপর্যন্ত সে সভায় সভাপতিত্ব করেন সন্জীদার মা! সে সময়েই তাঁরা ‘সোনার বাংলা’ গাইতেন। আন্দোলনে আন্দোলনে গাইতে গাইতেই এটা আমাদের জাতীয় সংগীত হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে এই গান গেয়েছেন তাঁরা।
তখন অনার্সের ছাত্রী। চিঠি লিখলেন শান্তিনিকেতনে। বিদ্যাভবন থেকে চিঠি দিল, ভর্তি হয়ে গেছে সন্জীদার। সে অনুযায়ী একটা সময় মাকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে গেলেন তিনি। অনার্স পরীক্ষা শেষ হয় হয়। শান্তিনিকেতনে একাই ঘুরে বেড়াতেন তিনি। এক বান্ধবী ছিল, অজন্তার গুহাচিত্রের মতো সুন্দরী, নাম কেকা মুখোপাধ্যায়। তাঁরা দুজন মাঝে মাঝে কোথায় কোথায় যে যেতেন! হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনের ধার দিয়ে প্রান্তিক রেলস্টেশন পর্যন্ত চলে যেতেন। একটা জায়গায় বসে বসে কত গল্প! ঢাকায় বাংলায় অনার্স পড়েছেন। দেখা গেল, আর্টস ফ্যাকাল্টিতে সন্জীদার নম্বর সবচেয়ে বেশি। সেই সময় মহিলা সমিতি বলে বোধ হয় কিছু ছিল, তারা বলল, ফ্যাকাল্টিতে সবচেয়ে বেশি নম্বর যার, তাকে আমরা স্বর্ণপদক দেব। নজরুল স্বর্ণপদক। সন্জীদা সেটা পেয়েছিলেন। সেটা ১৯৫৪ সালের কথা।শান্তিনিকেতনে এমএতেও সন্জীদার ফলটা ভালো হয়, ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। তাঁর সে থিসিস কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বই আকারে তখনই ছাপা হয়ে যায়, সন্জীদা চাকরিতে ঢোকার আগেই। সেটা তাঁর বাবা বের করেছিলেন। এমএ করে দেশে ফিরে এলেন সন্জীদা। ওরা বারবার বলেছিল, ‘তুমি পিএইচডিটা করে ফেলো একবারে।’ কিন্তু সন্জীদার মন তাতে সায় দেয়নি। তাঁর ভাল্লাগে না। তিনি ফিরে এলেন বাড়ি। ঢুকলেন চাকরিতে। শুরুতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। অনেকেই বলছিল, শান্তিনিকেতনের ডিগ্রিটা নাকি স্বীকৃত নয়। কিন্তু খবর নিয়ে দেখা গেল, ১৯৫১ সাল থেকেই এই ডিগ্রি স্বীকৃত। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনেই এটা। ইডেন কলেজে পড়ালেন বেশ কিছুদিন। ইডেনে থাকতেই ছায়ানট আন্দোলনটা গড়ে উঠল।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকীর সঙ্গে তো ছায়ানট গঠনের একটা সম্পর্ক আছে। ১৯৬১ সালে সবাই একসাথ হয়েছিলেন রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালন করবেন বলে। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী চিঠি দিয়েছিলেন সন্জীদাকে যাওয়ার জন্য। জি সি দেবের বাড়িতে এই সভা হয়েছিল। তারপর সবাই মহড়া করছে। ডা. নন্দীর বাড়িতে রিহার্সেল হচ্ছে। সন্জীদা সেই রিহার্সেল দেখতেন। শ্যামার মহড়া দেখতেন। মাঝে মাঝে বলতেন, এই জায়গাটা এ রকম না। শ্যামা যখন প্রেমের ভাবে গান গাইছে ‘নহে নহে এ নহে কৌতুক’ তখন যে মেয়েটি নাচছে, সে খুব বিষণ্নভাবে নাচছে। বলতেন, না, এটা বিষণ্ন নয়। ও একটু ছলের ভাবে ঘুরে ঘুরে নাচছে। তো, বুঝেছিল তারা কথাটা। র্যাংকিন স্ট্রিটে মোখলেসুর রহমান সিধু ভাইয়ের বাড়িতে যেতেন সন্জীদা। সরকারি চাকরি করেন তিনি, তাই ওয়াহিদুল হকের পিছনে পিছনে থাকেন। হঠাৎ একবার দেখা গেল, চিত্রাঙ্গদার গান গাওয়ার কেউ নেই। বাফা থেকে চিত্রাঙ্গদা হবে। দুদিনের নোটিশে গান তৈরি করে গাইতে হলো সন্জীদাকে।এসব অনুষ্ঠানের পর সিধু ভাই বললেন, ‘চলো আমরা সবাই মিলে একটা সংগঠন গড়ি, না হলে হবে না।’ জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন সবাই বনভোজনে। খাওয়াদাওয়ার পর সিধু ভাই বলে উঠলেন, সন্জীদা যেন এই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক হন। সন্জীদা রাজি হলেন না। বললেন, ‘সিধু ভাই, আমি সরকারি চাকরি করি, আমি পারব না।’ সাধারণ সম্পাদক হলেন ফরিদা হাসান, সাইদুল হাসানের স্ত্রী।ছায়ানটে প্রথমে শ্রোতার আসর হতো। প্রথম আসরে গাইলেন ফিরোজা বেগম। দ্বিতীয়টায় গাইল ফাহমিদা খাতুন। এরপর বারীণ মজুমদার, ইলা মজুমদার। কখনো সেতার বাজালেন খাদেম হোসেন খান। এ রকম হয়েছে। এগুলো হওয়ার পরে একসময় অনুভব করা গেল, আর বিশেষ শিল্পী নেই, যাঁদের দিয়ে গান গাওয়ানো যায়। সন্জীদা কিন্তু কখনো গাইতেন না। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা করতাম। ওয়াহিদুল হক বলে বসলেন, ‘আমরা একটা স্কুল করব।’ এ কথা সভায় পাস করানো কঠিন। হাতে তো নেই কানাকড়ি। চলে সিধু ভাইয়ের টাকায়। ওয়াহিদুল হক বললেন, ‘আমরা সবাই চাঁদা দেব।’ আস্তে আস্তে কে কত দেবেন, কথা হলো। প্রস্তাবটা পাস হয়ে গেল। এইভাবে ছায়ানট সংগীতবিদ্যায়তন হলো। সেই সংগীত বিদ্যায়তনে যে কেবল রবীন্দ্রসংগীতচর্চা করা হচ্ছে, তা নয়। তত দিনে সন্জীদারা বুঝে গেছেন, বাঙালি সংস্কৃতিটাই একটা বিপদের মুখে পড়েছে।
পাকিস্তানিরা আমাদের পাকিস্তানি মুসলমান বানাতে চায়, বাঙালি বলে স্বীকার করতে রাজি নয়। এটা বুঝতে পেরে তাঁরা এই স্কুলে নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নানা রকম যন্ত্র, রাগসংগীত শুরু করলেন। স্বাধীনতার পরে শুরু করা হলো পল্লিগীতি। গণসংগীতেরও চর্চা করা হতো। শেখ লুৎফর রহমান এখানে এসে অনেক গণসংগীত শিখিয়েছেন।১৯৬৩ সাল, বাংলায় যা ১৩৭০, উদ্বোধন হলো ছায়ানট সংগীতবিদ্যায়তনের। দিনটি ছিল পয়লা বৈশাখ। যে শ্রোতার আসর চালু করা হয়েছিল, তা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। শিল্পী পাওয়া যাচ্ছিল না। বিদ্যায়তন হলে শিল্পী পাওয়া যাবে। কিন্তু ১৯৬৪ সালেই বার্ষিক অনুষ্ঠানে টের পাওয়া গেল, বিদ্যায়তনের কতোটা উন্নতি হচ্ছে, সে ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কম, সবাই চায় নববর্ষের আবাহনী উৎসবে যোগ দিতে। মানুষের দাবি, বাঙালির নববর্ষকে বরণ করে নেওয়া হোক উপযুক্তভাবে।১৯৬৭ সাল, বাংলায় যা ১৩৭৪, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের জন্য নতুন করে ভাবতে হলো। নওয়াজেশ আহমেদ খবর দিলেন রমনা রেস্তোরাঁর। সে এলাকা ঘুরে এলেন সবাই। লেকের ধারে পাকুড় গাছের তলাটি মনে ধরল। তলাটা ঘিরে বাঁধানোও আছে।ভোর ছটায় আবিদ হোসেন খানের রাগের আলাপের মাধ্যমে নববর্ষের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সেবার। সন্জীদারা গেয়েছিলেন ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ গানটি। চলল অন্তত ঊনিশ–কুড়িটি গান। গানের শেষে সবাই মিলে লুচি– তরকারি খাওয়া। মেলা। এ হয়ে উঠল বন্ধু সম্মিলনের ঠিকানা।এরপর থেকে প্রতি বছর নববর্ষের অনুষ্ঠান হয়েছে এই পাকুড়তলায়, যা বটমূল নামেই পরিচিত। শুধু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছরটিতেই হতে পারেনি এ অনুষ্ঠান।
একাত্তরের ২৫ মার্চের পর পালিয়ে ভারতে চলে গেলেন। ওখানে যাওয়ার পর লুৎফর রহমানের শেখানো গান ‘জনতার সংগ্রাম’, ‘বিপ্লবের রক্তরাঙা ‘, ‘ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’—এই গানগুলোর চর্চা করলেন। তারপর শিল্পী রফিকুল আলম, ওর বড় ভাই সারওয়ার জাহান এল সেখানে। তখন ওরাও গান করল। এমনি করেই পুরো দেশের রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতিকে মিলিয়ে একটা নতুন জিনিস দাঁড়াল। কলকাতায় একটা দল করেছিলেন তাঁরা। ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটা গীতি আলেখ্য হয়েছিল। লিখেছিল শাহরিয়ার কবীর। জহির রায়হান স্টপ জেনোসাইড নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সে আলেখ্য অনেক পরিবর্তন হয় পরে। রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে এসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র সবাই গেয়েছেন। এই করে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার জন্য টাকা তোলা হয়। ব্যক্তিগতভাবে যেখানেই গান গাইতেন, সে সম্মানী এনে কেন্দ্রীয়ভাবে জমা দিতেন।
ছায়ানট শব্দটা শুনলেই রমনা বটমূলের কথা এসে যায়। ১৯৬৭ সাল থেকেই রমনা বটমূলে অনুষ্ঠান করছে ছায়ানট। সে সময় তেমন বাধা পাননি। পয়লা বৈশাখটা আমাদের সংস্কৃতিগতভাবে জাতিকে সচেতন করার একটা অনুষ্ঠান। প্রথমদিকে খুব কম লোক হতো। কিন্তু যারা আসত, তারা খুব আন্তরিকভাবে আসত।স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গান করতে করতেই সন্জীদারা বুঝে গেছেন, সংস্কৃতিটা ঠিক রাজনীতিনিরপেক্ষ নয়। এ ব্যাপারে সন্জীদা খাতুন বললেন, ‘আমরা যদিও মনে করি, সংস্কৃতিটা একটা মস্ত বড় আন্দোলন, রাজনীতির আন্দোলনটাও মস্ত বড়। তার আগে কখনো ৬ দফা কি ১১ দফা যা হয়েছে, তার সঙ্গে আমি অন্তত যুক্ত হইনি। আমি একেবারেই গানের মানুষ। কখনোই রাজনীতি বুঝিনি, রাজনীতি করিনি।’সন্জীদা খাতুনের এখন ধ্যানজ্ঞান ছায়ানট। ছায়ানটে শিশুদের স্কুলটা অভিনব। সেটা নিয়ে তিনি খুব গর্বিত। তিনি সে স্কুলের শিক্ষকদের পড়ান। তা ছাড়াও আমরা অনেকগুলো এভিনিউ খুলেছেন এখানে। একটির নাম ভাষার আলাপ। দ্বিতীয় পর্বে সাহিত্যপাঠ। এখানে অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার একটা ক্লাস থাকে। নাম দিয়েছেন ‘সুরের জাদু, রঙের জাদু’। একটা পত্রিকা বের করেন, ত্রৈমাসিক। ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ নামে। অনেকগুলো উৎসব করেন। একটা হচ্ছে ‘দেশঘরের গান’। লোকসংগীতের উৎসব। শুদ্ধসংগীতের উৎসব। নজরুলগীতির উৎসব। রবীন্দ্রসংগীতের উৎসব। পঞ্চমটা হচ্ছে নৃত্যউৎসব। এইগুলো করে যাচ্ছেন। এখন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কণ্ঠশীলন। আবৃত্তির এই সংগঠনটিকে নিয়েও ভাবনা আছে তাঁর।নালন্দা নিয়েও আশাবাদী সন্জীদা খাতুন। ২০০১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা পড়ল।
এটা খুব কষ্ট দিয়েছিল সন্জীদা খাতুনসহ ছায়ানটের সকলকে। এই কষ্ট থেকেই তাঁরা নালন্দা বিদ্যালয় খুললেন। বুঝতে পারছিলেন, আমাদের দেশের মানুষই আমাদের চেতনার সঙ্গে যুক্ত নয়। দেশের মানুষকে সচেতন করতে হলে বিদ্যার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। একটা স্কুল দিয়ে তা হয় না। তবে আশপাশে আরও অনেক স্কুল হয়ে গেছে এখন। বিভিন্ন জায়গায় এ রকম স্কুল হচ্ছে। নালন্দায় বাংলা মাধ্যমে পড়ানো হয়। কিন্তু এখানে এমনভাবে পড়ানো হয়, যাতে বিজ্ঞানের ওপর, ইংরেজির ওপর, বাংলার ওপর জোর আছে। এ সবটা মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা বিকশিত হয়। কেউ শিখিয়ে দেয় না ওদের।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বললেন সন্জীদা খাতুন, ‘আমরা যারা ধারণ করার চেষ্টা করেছি রবীন্দ্রনাথকে, তাদের তো মূল্যবোধটা বজায় আছে। এমনকি স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো আর তো কারও কাছ থেকে পাইনি। তিনি বলে গেছেন: ভৌগোলিক সীমানাটা আমার হলেই কি দেশ আমার হয়? হয় না। জোর করে যতই আমার স্বদেশ আমার স্বদেশ বলো, স্বদেশ তখনই তোমার হবে, যখন দেশের মানুষের কাছে তুমি যাবে। দেশের মানুষকে স্বনির্ভর করবে। তারা যখন আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে, তখনই দেশটা তোমার দেশ হবে। তোমার যত্ন দিয়ে, শ্রম দিয়ে এ দেশটাকে তোমার নিজের দেশ করতে হবে। শ্রম, সেবা, সত্য, ঐক্য, আনন্দ—গুরুসদয় দত্ত এসব কথা বলেছেন। এগুলোর ভিতর দিয়ে তিনি যে ব্রতচারী আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো কিন্তু তিনি সাধারণ পল্লির সুর নিয়ে করেছেন। এবং পল্লির দিকে যেসব নৃত্যচর্চা আছে, শক্তির চর্চা আছে, তা নিয়ে এসেছেন। এগুলোর চর্চাও আমরা করতে চাই।কাজের কি শেষ আছে সন্জীদা খাতুনের? ছায়ানট, কণ্ঠশীলন ছাড়াও অনেক অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি তিনি।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকগুলো বই আছে তাঁর। এর মধ্যে ‘কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ’, ‘ধ্বনি থেকে কবিতা ‘, ‘অতীত দিনের স্মৃতি’, ‘তোমারি ঝর্ণাতলার নির্জনে’, ‘সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই’ উল্লেখযোগ্য বইয়ের কয়েকটি।
লেখক : জাহীদ রেজা নূর