বাংলাদেশে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং নিজের জীবন সঙ্গীত সাধনায় সমর্পণ করেছেন সুধীন দাশ তাঁদের একজন। সুধীন দাশ আমাদের সঙ্গীত জগতের একজন অন্যতম শিল্পী গড়ার কারিগরও। শিল্পী গড়ার পাশাপাশি তিনি গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন যা বোদ্ধা মহলে সুপ্রশংসিত। সঙ্গীতের প্রতিটি শাখায় তিনি সদর্পে বিচরণ করে নিজেকে সঙ্গীতের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। সুধীন দাশকে প্রখ্যাত শিল্পী, সুরকার, স্বরলিপিকার ও সঙ্গীত পরিচালকের অভিধায় অভিষিক্ত করলেই তার পুরো পরিচয় দেয়া হয় না। বাংলা গানকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসীম। বিশেষত নজরুল সংগীত চর্চায় তাঁর অবদান উপমহাদেশের অন্য দশজন স্বরলিপিকারের চেয়ে কম নয়। তাঁর বিশেষত্ব হচ্ছে নজরুল সঙ্গীতের আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের বানী ও সুর অনুসারে স্বরলিপি গ্রন্থ লেখা। সুধীন দাশ এ পর্যন্ত নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে ১৬টি ও নজরুল একাডেমী থেকে ৫টি মোট ২১টি খন্ডের নজরুলের গানের স্বরলিপি গ্রন্থ বের করেছেন। তাঁর স্বরলিপির বিশুদ্ধতা প্রকাশ করেছে সঙ্গীতে তাঁর বিশেষত্ব ও মনোনিবিষ্টতা। লালনগীতির ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। তিনিই এদেশে প্রথম লালনগীতির স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
সুধীন দাশ ১৯৩০ সালে কুমিল্লা তালপুকুর পাড়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নিশিকান্ত দাশ ও মা হেমপ্রভা দাশের দশ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন তিনি। তাঁর পর্বপুরুষের বাস ছিল বিক্রমপুরে। সুধীন দাশের বাবা বিক্রমপুর থেকে কুমিল্লায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সুধীন দাশের স্ত্রী নীলিমা দাশ কুমিল্লার মেয়ে। তিনি সুধীন দাশের বড় ভাই সুরেন দাশের কাছে গানের তালিম নিতেন। অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীর মতো নীলিমা দাশও সুরেন দাশের কাছে ভয়ে গানের কোন বিষয় নিয়ে শিখতে যেতেন না। তিনি সুধীন দাশের কাছে এসে গানের সমস্যার জায়গা গুলো বুঝে নিতেন। এভাবেই সুধীন দাশ ও নীলিমা দাশের পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রণয় এবং অবশেষে বিয়ে। নীলিমা দাশের সুখ্যাতিও সবার জানা। তিনি বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ও নজরুল সঙ্গীত প্রশিক্ষক। সুধীন দাশ ও নীলিমা দাশ এ শিল্পী দম্পতির সংসার খুবই সুখের। একমাত্র পুত্র গীটারিস্ট নিলয় দাশ ও রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী কন্যা সুপর্ণা দাশ তাঁদের মতোই শিল্পগুনে গুণান্বিত। তবে ২০০৬ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁদের ছেলে নিলয় মারা যান। নিলয় দাশের অকাল মৃত্যু তাঁদের শোক সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এর মধ্যেই গান নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান তাঁরা।
বাল্যকাল
বাল্যকালে সুধীন দাশের বাড়িতে চমৎকার এক সঙ্গীতিক পরিবেশ ছিল। সুধীন দাশের বড় ভাই ছিল সঙ্গীতাচার্য সুরেন দাশ। সুধীন দাশের খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর গানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। বড় ভাই সুরেন দাশ থাকতেন কলকাতায়। মাঝে মাঝে কুমিল্লার বাড়িতে এলে বাড়িতে বসত গানের আসর। স্থানীয় শিল্পীদের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো তাদের বাড়ি। সঙ্গীত পিপাসু, শিক্ষার্থীসহ সব ধরনের সঙ্গীত প্রিয় মানুষের আনাগোনাও থাকতো খুব। ছোটবেলা থেকে এসব দেখতে দেখতেই গানের প্রতি ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন সুধীন দাশ। সুরেন দাশ কলকাতার ওই সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ গিরিজা শংকর চক্রবর্তীর ছাত্র ছিলেন। একবার কলকাতায় সুরেন দাশ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেন এবং কুমিল্লায় এসে বসবাস শুরু করেন। এসময় সুধীন দাশ সুরেন দাশের কাছে গানের তালিম নেয়া শুরু করেন।
শিক্ষা জীবন
চল্লিশ দশকের দিকে সুধীন দাশ ঈশ্বর পাঠশালায় হাতেখড়ি নেন। একই সঙ্গে তাঁর গানের চর্চারও হাতেখড়ি হয়। তিনি যখন সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। সে সময় কুমিল্লায় বোমা পড়বে এমন একটা আশংকায় কুমিল্লা শহরের সব অফিস-কাচারি স্থানান্তরিত হয়ে যায়। আর সে সময় কুমিল্লা শহর থেকে ঈশ্বর পাঠশালার স্থানান্তর হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। ফলে সুধীন দাশের পক্ষে আর ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে তিনি কুমিল্লা জেলা স্কুলে ভর্তি হলেন। যেহেতু তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন সেহেতু জেলা স্কুলে ভর্তি হতে বেগ পেতে হয়নি। সে সময় যিনি হেডমাস্টার ছিলেন, তাঁর নাম ছিল ইন্দুভূষণ বড়ুয়া। তিনি তৎকালীন আইসিএস। তখন কুমিল্লা জেলা স্কুলে অন্যান্য যারা শিক্ষক ছিলেন তাঁরাও স্কলার ছিলেন। হেড মাস্টার ইন্দুভূষণ বড়ুয়া সঙ্গীত ভীষণ পছন্দ করতেন। তিনি যখন জানলেন সুধীন দাশ সঙ্গীতচর্চা করেন সেই থেকে তাঁকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। সুধীন দাশ ১৯৪৬ সালে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে যায়। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি.এ. পরীক্ষার্থী ছিলেন সুধীন দাশ। পাশাপাশি গানের ভেতরও পুরোপুরি প্রবেশ করেন। গান তাঁকে নেশার মতো আচ্ছন্ন করে ফেলে। ১৯৫০ সালে ঠিকই বি.এ. পরীক্ষা দিতে গেলেন, কিন্তু দুই পেপার পরীক্ষা দেয়ার পর আর পরীক্ষা দিতে যাননি। এরপর আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি আর পড়াশুনাও সমাপ্ত হয়ে যায় এখানেই।
সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ
সুধীন দাশ প্রথম গান শেখা শুরু করেন বড় ভাই সুরেন দাশের কাছে। সঙ্গীত গুরু ও সঙ্গীতার্চায সুরেন দাশ দীর্ঘ দিন তাঁকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম দেন। তবে এই তালিম নেয়া সহজ হয়নি সুধীন দাশের জন্য। সুরেন দাশ প্রথম দিকে ভাই এর গানের প্রতি ঝুঁকে পরাকে ভালো চোখে দেখেননি। তিনি চাইতেন সুধীন পড়াশুনা করুক। তারপর গান ভালো লাগলে গাওয়া যাবে। তাই বাড়িতে বাইরের ছেলেমেয়েদের গান শেখালেও সুধীন দাশকে তিনি কাছে ভিড়তে দিতেন না। কিন্তু গানের প্রতি যার নেশা তাকে যে গান থেকে দূরে রাখা যায় না তার আদর্শ উদাহরণ সুধীন দাশ। যেখানে গানের ক্লাস হতো তার আশেপাশে গোপনে ঘোরাফেরা করতেন সুধীন দাশ। গোপনে শুনে শুনে গান শিখতেন। ব্যাপারটা এক সময় আর লুকানো থাকলো না। সুরেন দাশ ঠিকই লক্ষ্য করতেন। একদিন তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের উপর রেগে গিয়ে বললেন, ‘কি শিখছ তোমরা! এই যে সামনে বসিয়ে এক একটা লাইন তোমাদের এতবার বলে দিচ্ছি, তোমরা তবুও পার না। অথচ ঘরের পেছনে যারা ঘুরে বেড়ায়, তারা গান শিখে ফেলেছে ঠিকই।’ এ কথা শুনে সুধীন দাশ সেখান থেকে দ্রুত চলে যান। অবশ্য গোপনে সুরেন দাশ খুশি হতেন সুধীন দাশের এই আগ্রহ দেখে। এটা সুধীন দাশ বুঝতে পেরেছিলেন পরে সুরেন দাশের অন্য সব আচরণ থেকে। এভাবেই কিন্তু গানের শিক্ষা নেয়া বড় ভাইয়ের কাছ থেকে। এ সময় আরও একটা জিনিস অঙ্কুরিত হয় সুধীন দাশের মধ্যে। সুরেন দাশের অনেক গানের খাতা-পত্র ছিল। অর্থাৎ গানের স্বরলিপি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসিদ্ধ বন্দেশগুলোর স্বরলিপি করা ছিল। সুধীন দাশ দেখতে পেলেন তাঁর গানের খাতায় অনেক গানের স্বরলিপি লেখা আছে। সুরেন দাশ যখন বাড়ির বাইরে যেতেন, তখন তাঁর আলমারি খুলে চুরি করে সে সব দেখতেন সুধীন দাশ। এ ব্যাপারে বৌদি বেলা দাশ খুব সাহায্য করতেন। তিনি সঙ্গীত সমঝদার ছিলেন। ওই স্বরলিপি থেকে গান তুলতে তুলতে সুধীন দাশ বুঝতে পারেন স্বরলিপির গুরুত্ব কতটুকু। পরবর্তীতে নিজের ভালো লাগা আর ভালোবাসা দিয়ে তিনি গেয়ে গেছেন গান।
গানের স্কুল আর সুধীন দাশ
১৯৫০ সালে কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায় সুধীন দাশের একটা গানের স্কুল ছিল। নাম সুর মন্দির। তখন তিনি একদিকে স্কুলে গান নিয়ে মেতে উঠেছেন, আর অন্যদিকে তার দাবা খেলার প্রচন্ড নেশা ছিল। গানের স্কুলেই গানের পাশাপাশি দাবা নিয়ে মেতে থাকতেন। এরই মধ্যে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পরে কুমিল্লার সব জায়গায়। যত সুনাম ছড়াতে লাগলো ততই গানের স্কুলে শিক্ষার্থীর ভিড় বাড়তে লাগলো। বড় ভাই সুরেন দাশের ছাত্র-ছাত্রীও তার কাছে আসতে শুরু করে। উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর বড় ভাই এর কাছে যা শিখেছে তা আরও নিখুঁত করে শিখে নেওয়া।
প্রসঙ্গ, নজরুল সঙ্গীত
সুধীন দাশ বাংলা গানের বহু শাখায় পরিভ্রমণ করেছেন। তবে নজরুল সঙ্গীতের শুদ্ধ স্বরলিপিকার হিসেবে তিনি অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তিনি সব সময় দিয়েই আনন্দ পান, নিয়ে নয়। নিজেকে নিয়ে তার কোন ভাবনা ছিল না সে জন্যই হয়ত তার গানের অ্যালবামের সংখ্যা কম। বিশেষ করে ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সুধীন দাশের মাথায় কেবল একটাই চিন্তা শুদ্ধ সুর ও বাণীতে নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি কীভাবে তৈরি করবেন, কীভাবে নতুন প্রজন্মকে শেখাবেন এসব করতে করতে নিজের দিকে আর তাকানো হয়নি। শুধু সুর ও বাণীতে নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার আলোকে সুধীন দাশ মনে করেন, স্বরলিপি ছাড়া গান সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই। তবে সুধীন দাশ যখন নজরুলের গানের স্বরলিপি শুরু করেন তখন দেখতে পান নজরুল অনুমোদিত ও নজরুলের তত্ত্বাবধানে স্বরলিপির বই ছিল মাত্র তিন খানা। সেসব স্বরলিপিরও কদর অতটা ছিল না। যেখানে নজরুলের গানের সংখ্যা কয়েক হাজার সেখানে ২৫/৩০টি গানের স্বরলিপি থাকার কারণে নজরুল সঙ্গীত যে যেমন ইচ্ছে তেমন গাইতেন। এছাড়া নজরুলের গানের পরিবর্তন তাঁর গান সম্বন্ধে সুধীন দাশকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। তিনি নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি করার কাজে লেগে পড়েন। নজরুলের জীবদ্দশায় যেসব গান রেকর্ড হয়েছে সেসব রেকর্ড থেকে গান নিয়ে সুধীন দাশ ৫৫০টি গানের বিশুদ্ধ স্বরলিপি তৈরি করেছেন। সুধীন দাশ বলেন, তাঁর স্বরলিপি করা গানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন নজরুল সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ জগৎ ঘটক, ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তিনি তাঁর স্বরলিপির কাজে সহায়তা করার জন্য কবি তালিম হোসেন ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কবি মাহফুজ উল্লাহর কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে নজরুলের গান বিশুদ্ধভাবে গাওয়া হচ্ছে এবং নতুন প্রজন্মও নজরুলের শুদ্ধ সুরকে গ্রহণ করেছে। এটি সুধীন দাশকে ভীষণভাবে আপ্লুত করে। কারণ নজরুলের গানের বিশুদ্ধ সুর তৈরির জন্য তিনি জীবনকে গানের প্রতি সপেঁ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন আজকের গানের এই পরিবেশ তাঁর ও তাঁর মতো অজস্র নজরুল ভক্তের নিবেদনের ফল। নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি করে সুখ্যাতি করলেও সুধীন দাশই এদেশে লালনগীতির প্রথম স্বরলিপিকার। লালনগীতির যে প্রথম এক খন্ড স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে তা সুধীন দাশের করা। উপমহাদেশে সঙ্গীতকে বিকশিত করার ব্যাপারে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কেন নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি করতে উৎসাহী হলেন
এই প্রশ্নের জবাবে সুধীন দাশ বলেন, “রবীন্দ্রনাথের গানের কোন ক্যাসেট বের করতে হলে বিশ্ব ভারতীর অনুমতি প্রয়োজন। কিন্তু নজরুলের গানের ব্যাপারে তেমন কোন নিয়মনীতি নেই। একটা সময়ে আমাদের দেশে যখন নজরুলের গান ভীষণ জনপ্রিয় হতে শুরু করলো এবং আমরা যারা গান গাইতে যেতাম রেডিওতে (কারণ সে সময় টেলিভিশন ছিলো না) দেখতাম নজরুলের গান একেক জন একেক সুরে গাইতো। আর সে গানের সংখ্যাও ছিল সীমিত। যে ক’জন আমরা নজরুলের গান গাইতাম আমাদের সবার সম্মিলিত সংগ্রহ ছিল বড়জোর ২৫-৩০টি গান এবং সে গানগুলোর সুর আমরা একেক জন একেক রকমে গাইতাম। নজরুলে গানের এই অনিয়ম আমার মনের উপর গভীর দাগ কাটে। আমি ভাবলাম, এই সব হচ্ছে কেন? এবং তখন খোঁজ নিয়ে দেখলাম নজরুল অনুমোদিত ও নজরুলের তত্ত্বাবধানে মাত্র তিনখানা বই প্রকাশিত হয়েছিল। ৩টি গ্রন্থে আর কয়টি গানের স্বরলিপিই বা আছে? যেখানে নজরুরের গানের সংখ্যা কয়েক হাজার, সেখানে আমরা ২৫-৩০টি গান নিয়ে থাকবো কেন? এবং সেই ২৫-৩০টি গানের স্বরলিপিরও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। একমাত্র নজরুলের গানের স্বরলিপির ৩টি বইতে যে গানগুলোর কাঠামো আছে, সেই গানগুলোরও মূল সুর পরিবর্তন করে ভিন্ন সুরে গাওয়া হয়। এই সব ঘটনাই আমার ভিতর নজরুলের গানের স্বরলিপি করার জন্য উৎসাহ তৈরি করে। আমি দেখলাম, নানাভাবে নজরুলের গান পরিবর্তন করা হচ্ছে, অথচ রবীন্দ্রনাথের গান পরিবর্তন করার উপায় নেই। কার রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশাই মূল সুর ঠিক রাখার জন্য সব ব্যবস্থা করে গেছেন। বিশ্ব ভারতীর কাছে রবীন্দ্রনাথের গানের সমস্ত স্বরলিপির কপিরাইট। তাদের অনুমোদন ছাড়া কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু নজরুলের বেলায় কিছুই ছিল না। এখন অবশ্য সত্যিকার অর্থে নজরুলের গানসহ সব কিছু নিয়ে বাংলাদেশেই চমৎকার কাজ হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহচর যারা নজরুলের সঙ্গে ছিলেন, নজরুল নির্বাক হয়ে যাওয়ার পর তারাই নজরুলের গান পরিবর্তন করেছেন এবং বানিজ্যিকভাবে সেই সব পরিবর্তিত গানে নজরুলের কিছুই নেই। নজরুলের সুর করা গানগুলোকে তাঁরা নিজেরা ভিন্ন সুর দিয়েছেন। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে যারা নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে গর্ববোধ করতেন, তাঁরাই নজরুলের সৃষ্টিকে পরিবর্তন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের যে গান হয় তার প্রায় অধিকাংশ পরিবর্তিত স্বরলিপির। অবশ্য বর্তমানে এ অবস্থার অনেক পরির্বতন হয়েছে। ছোটবেলায় বাড়িতে রেকর্ডে নজরুলের যে গান শুনতাম পরে রেডিওতে গান করতে গিয়ে দেখতাম সে সুর আর নেই। দেখতাম অন্য রকম সুর। তখন আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম, এই সুর আসলো কোথা থেকে? এই কৌতুহল থেকেই বস্তুত নজরুলের গানের স্বরলিপি তৈরিতে আমি উৎসাহিত হই। এই সব নৈরাজ্যের মধ্য দিয়েই কলকাতা থেকে নজরুলের ৯শ গানের ৯ খন্ড স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় যার অধিকাংশ ছিল পরিবর্তিত। তখন আমি একবার কলকাতায় গিয়ে ওই স্বরলিপির প্রকাশককে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। আমি ওই প্রকাশনীর মালিককে বললাম, ‘আপনারা যে এই স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, নজরুলের গানের মূল স্বরলিপি সর্ম্পকে আপনাদের কোন ধারণা আছে?’ তিনি জানালেন, ‘কেন থাকবে না? যেহেতু নজরুলের ঘনিষ্ঠ জনেরাই ওই সব স্বরলিপি করেছে সুতরাং সেখানে পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না।’ তিনি এভাবেই আমাকে বললেন। আমি হাতে কলমে দেখালাম ওই স্বরলিপির প্রায় অধিকাংশ ভুল। এতে উল্টো ওই প্রকাশক আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এটা ১৯৮২/৮৩ সালের কথা। আমি ওই প্রকাশককে ভুলগুলো দেখিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু কাজ কিছু হলো না। নতুন নতুন সংস্কারণে ওই ভুলগুলোই ছাপা হতে লাগলো। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নজরুল সঙ্গীতকে যদি রক্ষা করতে হয় তাহলে আমাদের বাংলাদেশেই চেষ্টা করতে হবে। কারন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নজরুল প্রেমে কোন খাদ নেই।
শুরুতে আমি নজরুলের গানের স্বরলিপি তৈরির চেষ্টা শুরু করলাম নজরুল একাডেমীর মাধ্যমে। নজরুল একাডেমীর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রখ্যাত কবি তালিম হোসেন, তাঁর সঙ্গে কথা বললাম, তাঁরও একই আগ্রহ, নজরুলের গানের শুদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশিত হোক। নজরুল একাডেমীতে তাঁর কাছে কিছু আদি গ্রামোফোন রেকর্ড ছিলো, আমার সংগ্রহেও কিছু আদি গ্রামোফোন রের্কড ছিল। তার ভিত্তিতেই আমরা নজরুলের গানের স্বরলিপি তৈরির চেষ্টা শুরু করলাম। সে সময় নজরুলের যে গান করা হতো তার সঙ্গে আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের কোন মিল ছিল না। এই বিষয়টি নিয়ে কবি তালিম হোসেন পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর্যন্ত এদেশের সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনেকগুলো মিটিং করেছিলেন। কিন্তু কেউই প্রকৃতপক্ষে নজরুলের গানের স্বরলিপি তৈরি করার জন্য এগিয়ে আসেননি। এই সব পরিস্থিতিতে কবি তালিম হেসেন খুব হতাশ হলেন। কারণ কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। সে সময় আমি তাঁকে একটা প্রস্তাব দিলাম। প্রস্তাবটি হলো আমি স্বরলিপি করতে চাই। কিন্তু আমার একার প্রস্তাবে তিনি খুশি হননি। তিনি বললেন, ‘আপনি একা স্বরলিপি করবেন, তাতে তো ভীষণ সমালোচনা হবে।’ আমি বললাম, আমার সমালোচনা হয় তো হোক। আমার কাছে যে সব সংগৃহীত রেকর্ড আছে, আমার পদ্ধতিটা হবে এই গ্রমোফোন রেকর্ড বাজিয়ে গান শুনে সেই মতো হুবহু স্বরলিপি তৈরি করা এবং স্বরলিপির বইয়ে প্রতিটি গানের নীচে রেকর্ড নাম্বার, রেকর্ড লেভেল দেয়া। আর গান নির্ধারণ করা হবে – ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। যতদিন নজরুল সুস্থ ছিলেন এবং সুস্থ অবস্থায় যে সব রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে সে সব রেকর্ডের হুবহু স্বরলিপি করা হবে। এতে কোন সঙ্গীতশিল্পী কিংবা বিশেষজ্ঞ যদি বলে এই স্বরলিপি ভুল, তাহলে মুখে বললে হবে না, তাকে প্রমাণ নিয়ে আসতে হবে। একাডেমীতে প্রতিটি গানের স্বরলিপি টেপ করা আছে এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম স্বরলিপি বইয়ের প্রতি খন্ডে ২৫টি করে গান থাকবে। সেই থেকে এই পর্যন্ত আমি প্রায় ৫৫০টি নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরি করেছি। কলকাতার স্বরলিপির সঙ্গে আমাদের স্বরলিপির পার্থক্য হলো, তাদের স্বরলিপিতে কোন তথ্য নেই, ওরা মন গড়া স্বরলিপি করেছে। আর আমাদের স্বরলিপি পুরোপুরি তথ্য নির্ভর। আমরা গ্রামোফোন রেকর্ড অনুসরণ করে স্বরলিপি প্রমাণীকরণ করেছি এবং আমার স্বরলিপি সরকার কর্তৃক নির্বাচিত প্রমাণীকরণ পরিষদের দ্বারা অনুমোদিত। বিশেষ করে নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর সেখানে নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি প্রমাণীকরণের জন্য সরকার দেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করেন। ওখানকার নিয়ম একটি গানের স্বরলিপি তৈরি করে তা বিশেষজ্ঞ বোর্ড এর সামনে টেপরেকর্ড বাজিয়ে স্বরলিপিটি অনুমোদন করে নিতে হয়। বোর্ড ওই স্বরলিপি অনুমোদন করলেই শুধু স্বরলিপিগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে পারে। এই ব্যবস্থায় নজরুলের গানের স্বরলিপি পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা নেই।”
পাশে থেকে যারা উৎসাহ দিয়েছেন
এ প্রসঙ্গে সুধীন দাশ, ‘বাংলাদেশে নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরির প্রচেষ্টায় কবি তালিম হোসেন একটি উজ্জ্বল নাম। তাঁর প্রচেষ্টা না থাকলে আমি কোনদিন এই কাজগুলো করতে পারতাম না। আর নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যিনি আমাকে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহিত করেছিলেন-তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক কবি মুহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। আজ নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে এই যে এত খন্ড স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে এর জন্য মুহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর অবদান কোন অংশেই কম নয়। নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি প্রণয়নের জন্য আমি কৃতজ্ঞচিত্তে এই দু’জন মানুষের কথা আমৃত্যু স্মরণ করবো। এছাড়াও নজরুল স্বরলিপি প্রণয়নে আমি যাদের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে চাই তাঁরা হলেন-কামরুজ্জামান মনি, আবদুল আহাদ, দেবু ভট্টার্চায, খান আতা, ওমর ফারুক প্রমুখ। আমি বলতে চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক নামকরা নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এখন আমাদের স্বরলিপি অনুসরণ করে নজরুল সঙ্গীত চর্চা করছে এবং এ কথা আমরা বলতে পারি বর্তমানে বাংলাদেশে নজরুলের গান শুদ্ধ সুরেই পরিবেশন করা হচ্ছে। এর ব্যতিক্রমও আছে কিছু কিছু। ব্যতিক্রম সব সময় থাকেই। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের কিছু নেই। নতুন প্রজন্ম নজরুলের শুদ্ধ সুরকেই গ্রহণ করেছে।’
অবদান
সুধীন দাশ সরকার কর্তৃক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদ-এর অন্যতম সদস্য ছাড়াও তিনি নজরুল ইন্সটিটিউট ও নজরুল একাডেমীর সঙ্গীত প্রশিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (বি. এ. অনার্স, এম. মিউজিকের) ব্যবহারিক সঙ্গীত বিষয়ের বহিরাগত পরীক্ষক। বাংলাদেশ টেক্সট বোর্ড-এর সঙ্গীত বিষয়ক সিলেবাস কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য এবং নজরুল সঙ্গীত প্রশিক্ষণ উপ-কমিটির আহ্বায়ক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নজরুল সঙ্গীত বিষয়ক অডিশন বোর্ডের সম্মানিত বিচারক। তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পাদিত সাংস্কৃতিক চুক্তি বিনিময় কার্যক্রমের প্রার্থী বাছাই কমিটির সদস্য ছিলেন। সরকার কর্তৃক সংস্কৃতিসেবীদের ভাতা প্রদান সংক্রান্ত কমিটির সদস্য। এ দেশের প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ শিল্পীই তার ছাত্র-ছাত্রী।
গণমাধ্যমে প্রথম গান, পুরস্কার ও সম্মাননা
সুধীন দাশ বাংলাদেশ বেতারে প্রথম গান গেয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ এবং টেলিভিশনে প্রথম গান ১৯৬৫ সালে গেয়েছিলেন। সঙ্গীতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি র্স্বণপদক, ১৯৮৭ সালে নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, ১৯৮৮ সালে মহান একুশে পদক ও ১৯৯২ সালে বেগম জেবুন্নেছা মাহাবুবুল্লাহ্ ট্রাস্ট স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলা একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমীসহ বহু প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংবর্ধিত হয়েছেন। ১৯৯৮ সালে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের অন্যতম প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ কর্তৃক প্রদত্ত বিশেষ ‘সম্মাননা প্রতীক’ও তিনি লাভ করেন। ১৯৯৯ সনে নজরুল ইন্সটিটিউট প্রবর্তিত নজরুল পদক, ২০০৪ সনে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী প্রদত্ত সম্মাননা ও ২০০৫ সনে কবিতীর্থ চুরুলিয়া নজরুল একাডেমী কর্তৃক নজরুল পুরস্কার ২০০৫- এ ভূষিত হন। ২০০৭ সনে জাতিসংঘের বাংলাদেশ সমিতি কর্তৃক জাতিসংঘ সম্মাননাসূচক ২০০৭ লাভ করেন।
বিদেশ ভ্রমণ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ড. ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের নিকট থেকে নজরুল সঙ্গীতের আদি রেকর্ডের গান সংগ্রহের জন্য সরকারীভাবে ১৯৯৮ সালে সুধীন দাশ ভারত ভ্রমন করেন।
লেখক : কামরুন ঝুমুর