কিংবদন্তির কথামালা
নজরুল ইনস্টিটিউট নিয়ে তাঁর মনে রয়েছে গভীর এক ক্ষত। নজরুল ইনস্টিটিউট এর জন্ম নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একদিন ডেকে পাঠিয়ে আমার ইচ্ছের কথা জানতে চেয়েছিলেন। আমি নিজের স্বাচ্ছন্দ্য নয়, নজরুলের গানের জন্যই কিছু একটা করার ইচ্ছে প্রকাশ করি। তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যাও শোনেন। সেটা কোথায় হবে, কেমনভাবে হবে তাও আমার কাছ থেকে জানেন। আমি চেয়েছিলাম ইনস্টিটিউট হোক পাস্থপথের মুখে। আমি আমার ভাইদের সঙ্গে আলাপ করে তাঁকে প্রকল্পের প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর অকাল প্রয়াণের জন্য তা কখনোই বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। নজরুলের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আর আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। তিনি আমাকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। পরে একই প্রকল্প আমি এরশাদ সাহেবকেও দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি কোন উচ্চবাচ্য করেননি। উপরন্তু আমাকে কবিভবন থেকে উৎখাত করে সেখানে নিজে নজরুল ইনস্টিটিউটের ভিত্তি গড়েন। সেই অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকাও হয়নি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁকে অনুরোধ করেও অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারতাম আমি।’
জাতীয় কবির সম্মান দেয়া হলেও নজরুলের গানের জন্য কোন সরকারই সেভাবে কিছু্ই করেনি। কোন টেলিভিশনে তাঁর গানের অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করার তাগিদও কেউ অনুভব করে না। এসব নিয়েও তাঁর হতাশা অনিঃশেষ।
এই সুযোগে আরো কিছু তথ্য না জানালেই নয়। এক নাগাড়ে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় সঙ্গীত সাধনার নজির পৃথিবীতে আর নেই। এজন্য তাঁর নাম অনেক অগেই গিনেস বুকে ওঠা উচিত ছিল। সারাবিশ্ব তিনি পরিভ্রমণ করেছেন নজরুলের গান নিয়ে। একক অনুষ্ঠান করেছেন ৩৮০টির মত। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে তাঁকে নজরুল সঙ্গীত ও অতুলপ্রসাদের গান শিখিয়েছেন ফিরোজা।
এই মেঘছোঁয়া খ্যাতি তাঁকে কখনোই বিচলিত করতে পারেনি। কখোনোই তিনি বিত্তের পিছনে ছোটেননি। তাই তো সারাজীবন প্লেব্যাকের মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন।
কখনো রূপসদনে যাননি তিনি। এমন মন্তব্যে অবাক না হয়ে কি পারা যায়। অথচ কী পরিপাটি তিনি। তাঁকে স্টাইল আইকন অভিহিত করলে একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না। সেই ছেলেবেলা থেকেই তিনি নিজের ব্যাপারে সচেতন। পুরানো ছবিগুলোতে বাঙ্গময় তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভা। অথচ অনুকরণীয় নৈপুণ্যে নিভৃত যতনে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন সব সময়েই প্রচারের উজ্জ্বল আলো থেকে। পাদপ্রদীপের আলোয় কেবল খেলা করে জ্যোৎস্নার মতো নরম অথচ হৃদয়ছোঁয়া কণ্ঠমাধুর্য। এক সময় সাঁতার কাটা তাঁর শখ ছিল। তিনি আর তাঁর ছোটভাই আসফউদ্দৌলাই করতেন যত দুঃসাহসিক কাজ। ‘ও অনেক ভাল গানও গায়। সিএসপি অফিসার হওয়া সত্ত্বেও ভাল শিল্পীও সে।’
এখনো নিয়মিত কবিতা পড়েন ফিরোজা বেগম। বাগান করেন। এ দুটোও তাঁর ক্যানভাস। এখনও নিয়ম করেই রেওয়াজ করেন এই সুর-তাপসী। আরও রয়েছে কিছু পাখি। তাদের কলকাকলি, নজরুলের গান, হৃদয়পাত্র উছলে পড়া মাধুরীময় স্মৃতিরাজিই এখন তাঁর নিত্য সহচর।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
ত্রিশের দশক। ব্রিটিশ ভারত। চারিদিকে আন্দোলনের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও তা দাবানলে রূপ নিলেও ইংরেজ সাম্রাজ্যের পতনের অশনি সংকেত তখনও বাজেনি। ফরিদপুরের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবার। সেই বাড়িতে স্থানীয় ব্রিটিশ অফিসার কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের নিত্য আনাগোনা। গল্পগুজব, শলাপরামর্শে পার হয় অখণ্ড সময়। ভেতর থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় আসে চা-জলখাবার। অভিজাত ঐ পরিবারে এমন দৃশ্যই তো স্বাভাবিক। পরিবার প্রধান খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল বৃটিশ সরকারের কৌঁসুলি। তিনিই প্রথম মুসলমান সরকারি কৌঁসুলি। খান বাহাদুর সাহেবের স্ত্রী সুগৃহিণী বেগম কওকাবুন্নেসা। এই দম্পতির তিন ছেলে, চার মেয়ে। সবাই যে যার পৃথিবীতে ব্যস্ত। দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে- ফিরছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, খেলাধুলো করছে। সাঁঝ হলে পড়তে বসছে। বাবা কিংবা মায়ের অতটা অবসর নেই সবার প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দেয়ার। এঁদের তৃতীয় কন্যাটি আবার একটু অন্যরকম। ওঁর জন্ম ১২ শ্রাবণ, ২৮ জুলাই, এক পূর্ণিমার রাতে। তখন কেই বা ভেবেছিল এ মেয়ে একদিন সঙ্গীতাকাশে জাজ্বল্যমান চন্দ্রিমা হয়ে বিরাজমান থাকবে। শ্রাবণে জন্ম বলে আদর করে কেউ কেউ শ্রাবণী বলে। ফর্সা টুকটুকে বলে কেউবা ডাকে আনার। কারো কাছে সে আসমানী। আর কাজের লোকেদের কাছে প্রিয় সেজবু।
শৈশব
এ মেয়ে একেবারেই অন্তর্মূখী। নিজের জগতেই তাঁর বসবাস। পড়ালেখা, খেলাধুলা, গান, অভিনয়, আঁককষা, নাচ সবকিছুই করছে। বাদ যাচ্ছে না কিছুই। সব কিছুতেই সে প্রথম। সাফল্যলক্ষ্ণী গড়াগড়ি যাচ্ছে তাঁর পায়ে। অথচ তাঁকে যে কেউ কিছু শেখাচ্ছে তাও নয়। নিজেই শিখছে। ভুল হলে নিজেই শুধরে নিচ্ছে। নিজেই যেন নিজের শিক্ষক। আসলে সেই শেখার মধ্যে রয়েছে অনন্য নিবিষ্টতা। হার মানাটা যে তাঁর ধাতে সয় না! সইবেই বা কেন? সিংহ রাশির জাতিকা যে! স্কুলের পুরস্কার বিতরণীতে মেয়ের দু’হাত উপচে পড়ছে পুরস্কারে। পুরস্কার নেয়ার জন্য মঞ্চে উঠতে গিয়ে অতিথিদের চেয়ারে বসা দুই ব্রিটিশ অফিসার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আর ডিষ্ট্রিক্ট জাজের পাশে বাবাকে দেখে ভয়ে উল্টোদিকে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে সে। শিক্ষক মহাশয় অভয় দিয়ে তাঁকে আবার পাঠাচ্ছেন মঞ্চে। তাঁর দিকেই সবার দৃষ্টি। বাবাও তাকাচ্ছেন মুগ্ধ বিস্ময়ে। কারণ এতকিছু তো তাঁরও জানা নেই। ব্যস্ত মানুষ, জানবেনই বা কখন।
বাড়ির সঙ্গে শান বাঁধানো পুকুর। পেল্লায় এক হিজল গাছ সেখানে। পাশের বুড়ো আমগাছটায় একটা দোলনা টাঙানো। মন খারাপ হলে মেয়েটি চলে যাচ্ছে পুকুর পাড়ে। দুলছে দোদুল দোলে। আপন মনে গুনগুনিয়ে যাচ্ছে। হিজলের ফুলরেণু বৃষ্টির মতো ঝরছে তাঁর বিমনা বালিকা শরীরে। মেয়েটি কেবল গাইছেই না, ভাবছেও। হিজল ফুলের অবিরাম ঝরে পড়ার বিষয়টি তাঁকে ভাবাচ্ছে। এইযে ফুলগুলো এখন ঝড়ছে এরা ফোটে কখন? ফুল ঝরার যেমন বিরাম নেই, বিরাম নেই তাঁর দুলে যাওয়ার। দোলনাটাও বেশ বড়। ঝুলন দোলায় সহজে তাই অনেক দূরে পৌছে যায় তাঁর মন। সেখানে পা ছুয়ে যায় সবুজ ধানের গাছে। সে এক অনির্বাচনীয় অনুভূতি।
সবকিছুর মধ্যেও গান শোনার এক অদ্ভুত নেশা তাঁকে তাড়িয়ে ফেরে। রক্ষণশীল বাড়ি না হলেও গানের চর্চা ছিলনা বাড়িতে। সেই সময়ে মেয়েদের পড়াশোনা, স্কুলে যাওয়ার চলই ছিল না। তেমন পরিবেশে গান শেখার অবকাশ না থাকলেও বাবা- মায়ের সঙ্গীতপ্রীতি যে ছিল তা বলাই বাহুল্য। এটাই ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গীত আগ্রহে অনুঘটক হয়েছে। তাদের ভাঁড়ার ঘরে রয়েছে বেশকিছু পুরনো রেকর্ড। একটি বেশ পুরনো কলের গানও। সেটার পিনটাও ঠিক নেই, অথচ তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে সঙ্গীত পাগল মেয়েটি। একাকী নিবিষ্ট চিত্তে সে গান শোনে। কেউ তাঁকে বিরক্ত করেনা। ফলে গানের ভুবনে হারিয়ে যেতে তাঁর মানাও নেই। স্টোররুমে যে কেবল ওগুলো আছে তা নয়। সেখানে আরশোলা, ইঁদুর, টিকটিকি সহ আরো অনেক কিছুই রয়েছে। কিন্তু সে মেয়ের তাতে পারোয়া নেই। তাঁর চাই গান শোনা।
এমনি একদিন গান শুনতে শুনতে সে এতটাই আনমনা ছিল যে কাজের লোকেরা কখন ভাঁড়ার ঘর তালাবন্ধ করে দিয়েছে খেয়ালও করেনি। পরে বুঝতে পারলেও তাতে তাঁর কোন চিন্তা হয়নি বরং ভেবেছে, মন্দ কি? একা একা গান তো শোনা হবে! এদিকে সন্ধ্যায় সবাই পড়তে বসেছে। কেবল সে নেই। অভ্যাসবশত প্রতিদিনের মতো চোখ বোলাতে গিয়ে ঠিকই মা দেখেছেন একটা চেয়ার খালি। অন্যান্যদের জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু কেউই বলতে পারলনা সে কোথায়। কাজের মেয়েরাও না। মায়ের মনে কু-গায়। মেয়েটা ডুবে গেল না তো আবার? মা জানেন রাতবিরেতে মেয়ের আবার পুকুর পাড়ে যাওয়ার বাতিক আছে। এদিকে ভাঁড়ার ঘরে বসে সে উপভোগ করছিল এই নাটক। তারপর এক সময়ে নিজেই চিৎকার করে বলল সে কোথায় আছে। এবার মায়ের সব রাগ গিয়ে পড়ল কাজের লোকদের ওপর, ‘তোরা একবার দেখলিও না, মেয়েটা ওখানে রয়েছে। জানিস তো সে ওখানে বসে গান শোনে।’
মেয়েটির প্রতি বাবার রয়েছে প্রশ্রয় আর মায়ের প্রচ্ছন্ন স্নেহ। অনেক উদ্ভট প্রশ্ন মাকে শুনাতে হতো। কিছু তিনি উত্তর দিতে পারতেন কিছু পারতেন না। এই যেমন, রাতে চাঁদ উঠলে শাপলা কেন ফোটে- দিনে কেন নয়? রাতে ফোটা সব ফুল কেন সাদা হয়, তারা কেনইবা সন্ধ্যার পর সুরভি ছড়ায়? মা অবাক হয়ে বলছেন, ‘তুই কী করে জানলি?’ মেয়ের উত্তর, ‘কেন আমি তো রাতে পুকুর পাড়ে গিয়ে শাপলা ফুটতে দেখেছি।’ নিজের মনে উদ্গত শঙ্কা চেপে রেখে মা অনুযোগ করছেন, ‘রাতবিরেতে তুই যে পুকুর ঘাটে যাস, সেটা কি ঠিক? তুই না বড় হচ্ছিস!’
আবার পড়তে পড়তে হঠাৎ কোন গান মনে এসেছে। কিন্তু চিৎকার করে গাওয়া যাচ্ছে না। উঠে গিয়ে গলা ছেড়ে গেয়ে আসছে মেয়ে। পাছে অন্যদের ডিসটার্ব হয়। পরে মা যখন জানতে চাইলেন, ‘ওখানে দাড়িয়ে কী করছিলি?’ মেয়ের সরল জবাব, ‘গানটা যে কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না! কী করব? তাই একটু গলা ছেড়ে গেয়ে এলাম।’ মা বলছেন, পড়া ছেড়ে আবার কিসের গান? অত ঠিক হওয়ার দরকার নেই। পরে ঠিক করো।’ মায়ের কথায় মেয়ের কোনো খেয়ালই নেই, ‘তা হবে কেন? আমি ঠিক করেই ছেড়েছি। শুনবে?’ ছদ্ম উষ্মায় মা বলছেন, ‘আমার শোনার দরকার নেই।’ আবার অনেকদিন যেকোনো কবিতা- বাংলাই হোক বা ইংরেজি, মুখস্থ হয়ে গেলে সুর করে গাইতে আরম্ভ করে দিয়েছে সে।
নজরুলের সাথে প্রথম দেখা
এভাবেই পেরোচ্ছে এককটা দিন। একটু একটু করে বড় হচ্ছে মেয়েটা। আর ক্রমাগত গানের নিশি তাকে তাড়িয়ে ফিরছে। ভেতরে ভেতরে ভাল গান শেখার উদগ্র ইচ্ছায় অস্থির। কিন্তু গান শেখার কোন সুরাহা হচ্ছে না। ঐ সময়ে কোন এক গ্রীষ্মের ছুটিতে ছোট মামা আর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে কলকাতায় গেল সে। ওরা তখন কলকাতায় থাকে। বন্ধুমহলে ভাগ্নীকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত মামা। ভাগ্নীও গান শোনাচ্ছে বোদ্ধাদের। ছোট্ট মেয়ের গায়কীতে মুগ্ধ সবাই। একদিন গুণীজনদের মজলিসে গান শুনিয়ে দারুণ তারিফও পেল সে। বাসায় ফিরে মামা বললেন, ‘জানিস তুই কাকে গান শুনিয়েছিস আজ?’ ‘আমি কী করে জানব? আমি কি ওদের চিনি, দেখেছি নাকি কখনো?’ মামা বললেন, ‘ঐ যে টুপি পরা, বড় চুল, আসরের মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন, তোকে আদর করে পাশে বসালেন, উনি বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’
এভাবেই ছেলেবেলার সেইসব সোনাঝরা দিনগুলো কেটেছে তাঁর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আসলে আমি তখন অনেক ছোট। তাছাড়া এমন পরিবেশে যাইনি কখনো। তাই তাঁকে তো চেনার কথাও নয়। নজরুলের ছবি পাঠ্যবইতেও দেখিনি। কারণ তখনও তাঁর ছবি বইতে ছাপা হয়নি। ফলে আমার মধ্যে আলাদা কোন অনুভূতি হয়নি। সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের একজন মেয়ে গান গাইছে, গান গাইতে চায়, এটা জেনে দারুণ খুশি হয়েছিলেন নজরুল। আমার গান শুনে বলেছেন, ‘এ গান তুমি শিখলে কেমন করে?’ বলেছি, কালো কালো রেকর্ড শুনে নিজে নিজেই শিখেছি। এটা শুনে কেবল তিনি নন, উপস্থিত সবাই অবাক হয়েছেন।” বলাই বাহুল্য, এমন অমূল্য রতনকে চিনে নিতে ভুল হয়নি নজরুলের।
ঐদিন কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি যে গান শুনিয়েছিলেন এত বছর পেরিয়ে এসে তা আজও স্মরণ করতে পারেন। তিনি গেয়েছিলেন- ‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা’। সে যাত্রায় কলকাতা ভ্রমণের এক আনন্দ নিয়ে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন ফরিদপুরে। কলকাতায় গিয়ে আর যেটা লাভ হয়েছিল- অডিশন দিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওর শিশুদের অনুষ্ঠান শিশুমহলে সুযোগ পাওয়া। স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকতে না পারাটাই তাঁর গান শেখার অন্তরায় হয়েছে। তবে যখনই কলকাতা যাচ্ছেন, নজরুলের সান্নিধ্যে গানে শেখা হচ্ছে। চলছে এভাবেই।
প্রথম রেকর্ডিং
১৯৪২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ইসলামী গান নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়েছিল। প্রথম রেকর্ডে চিত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে ছোট্ট ফিরোজা গাইল ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। সাহেব রেকর্ডিস্ট তাই দুরু দুরু বুকে গাইল সে কিন্তু তাতেই বাজিমাত। বাজারে আসার সাথে সাথে হু হু করে সব রেকর্ড বিক্রী হয়ে গেল। সঙ্গীতপ্রেমীদের সাথে সুরের আকাশের এই তারার সেটাই প্রথম পরিচয়। ছোট্ট মেয়েটির গায়কী সঙ্গীতবোদ্ধা এবং সাধারণ শ্রোতা সকলকে মুগ্ধ করেছিল।
কিছুদিন পর নতুন রেকর্ডের জন্য আবার চিঠি দিল কোম্পানি। এবার কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড হবে। সঙ্গীত জগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই সুরকারের হাত ধরে বেরুল দ্বিতীয় রেকর্ড। গান ছিল- ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ’ আর ‘প্রীত শিখানে আয়া’। অন্যদিকে সৃষ্টিকর্তা তখন অন্য হিসেব কষেছেন। সুরস্রষ্টার সঙ্গে শিল্পী জীবনের অনন্য এক মেলবদ্ধ ঘটিয়ে হেসেছেন অলক্ষ্যে।
এই সময়ে বোধহয় ফিরোজার ওপর ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হলো। তাঁর বড় বোন এবং ভগ্নীপতি দিল্লী থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে এলেন। তাদের বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন তিনি। ঐ সময়ে টানা চার বছর তাঁর গান শেখায় সুবিধে হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ফের তাঁকে ফরিদপুর ফিরিয়ে আনে। বন্ধ হয়ে যায় গান শেখা। এরফলে তিনি এতটাই ভেঙে পড়েন যে, এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে কলকাতায় থাকার সময়ে বাড়িতে মেহমান এলে তিনি বাড়ির অদূরে নির্মিত ট্রেঞ্চের ভেতরে বসেই রেওয়াজ করতেন। আজও যা তাঁর জ্বলজ্বলে স্মৃতি। নানা সময়ে নানা বাধাই তাঁর প্রত্যয়কে দৃঢ় করেছে। সবসময় অবিচল লক্ষ্যে এগিয়ে গেলেও একটা প্রশ্ন তাঁকে আজও নাড়া দেয়- কেন তাঁকে এত বাধার সম্মুখীন হতে হলো? কেন ভাগ্য তাঁকে নিয়ে এভাবে খেলছে?
গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড বের করার জন্য যেখানে বড় বড় সব শিল্পীরা হা-পিত্যেশ করে থাকেন, সেখানে এই একরত্তি মেয়ের একের পর এক রেকর্ড বেরিয়ে যাচ্ছে। পর পর চারটি রেকর্ড বেরিয়ে গেল অল্পদিনের মধ্যেই। এত অল্পবয়সে এহেন সাফল্য তো মুখের কথা নয়। যদিও এই সাফল্যে তার খুশি হওয়া দূরের কথা, মনই উঠছে না। গুণীজনদের সাহচর্য এবং স্নেহ পেয়েই তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন। তাছাড়া তাঁর চাই যতসব জটিল সুরের সমাধান। সবার একই জিজ্ঞাসা, কেন তুমি এত কঠিন গান শিখতে চাও?
সেসময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এজন্য সবাই আমাকে নিয়ে মজা করত। আসলে আমি তো আমার সঙ্গীত শিক্ষা নিয়ে খুশি নই। সব সময় আরো ভাল গান শেখার ইচ্ছেটা আকুলি বিকুলি করত। তাই নিজেই একদিন চিত্ত রায়কে বলে বসলাম, গান শিখতে চাই আমি। শুনে তো অবাক চিত্ত রায়। কী বলে এ মেয়ে? সেই থেকে শুরু হলো শিক্ষা। একদিকে চিত্ত রায় অন্যদিকে কমল দাশগুপ্ত। এই দুজনের কাছেই আমি ঋণী। বিশেষত কমল দাশগুপ্তের কাছে। তাঁর কাছে আমি সব ধরনের গান শিখেছি। আমার জীবনের মূল শিক্ষাটাই তো পেয়েছি ওঁর কাছে। ভারতবর্ষে ক্ষণজন্মা এই সুরকার, যাঁর বাজানো যে কোন ইনস্ট্রুমেন্টের একটা ছোট্ট টুকরো শুনলেও আমি বলে দিতে পারি। আজ এই এত বছর পরেও অভিন্ন অনুভব কাজ করে আমার মধ্যে। আজও আমি তৃপ্ত নই। আজও আমার ভাল গান শেখা হয়নি।’
গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুম নিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তি। সেখানকার আবহ ছিল একটা পরিবারের মতো। সেখানে ধ্রুবতারা নজরুল, তাঁকে নিয়ে নক্ষত্রমণ্ডলী। কাজীদা বলতে সবাই অজ্ঞান। তাঁর দুই হাত চিত্ত আর কমল। অন্যতম শিক্ষক ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁ তখন অশক্ত। এই মহড়া ঘরেও চলছে পালাবদল। ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালাদের মতো সুরসূর্যরা অস্তাচলে। সেখানে আত্মপ্রকাশিত হয়ে আলো ছড়াচ্ছে এক নব ইন্দু। স্বরস্বতী যাঁর কণ্ঠে আপন হাতে পরিয়েছেন সুরের বরমাল্য। ক্রমেই তাঁর সুরের যাদুতে মুগ্ধ সুরপিয়াসীরা। একের পর এক রেকর্ড বেরোচ্ছে। তা বলে কিন্তু খ্যাতির তাপ ছুঁতে পারছে না তাঁকে।
কলকাতায় যাওয়া, গান গাওয়া এভাবেই চলছে। বাড়িতে সবাই দারুণ খুশি এমনকি বাবাও। মেয়েকে নিয়ে তিনিও গর্বিত। যদিও বাবা মনে মনে চাইছেন মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু মেয়ে চাইছে গান শিখতে। সেটাই তাঁর ভবিতব্য বেশ বুঝছেন বাবা। তাই চেপে যাচ্ছেন নিজের ইচ্ছের কথা। তিনি জানেন এ মেয়ের ইচ্ছের বিরোধিতা করা যাবে না।
একই সঙ্গে রেডিওতেও তিনি সমান্তরালে নানা ধরনের গান গেয়ে যাচ্ছেন। ততদিনে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত আর আধুনিক গানে সমানভাবে বিখ্যাত। দু-দুইবার আধুনিক গানের ক্ষেত্রে মাসের সেরা শিল্পী হয়েছেন। তাঁর গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে তাঁকে গান শেখানোর জন্য পঙ্কজ মল্লিকের মতো শিল্পী ফিরোজা বেগমের কলকাতার বাড়িতে চলে আসছেন। গুণী শিল্পীরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অন্যদিকে তিনি আব্বাসউদ্দিন এবং পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের কাছে অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য মাঝে মাঝে লোকগীতির তালিম নিচ্ছেন। রেডিওতে পাশাপাশি স্টুডিওতে গান গাইছেন তিনি এবং ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ। ‘আয় না বালম’-এর মতো বিখ্যাত সেই গান রেকর্ড হচ্ছে। দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে, বিনিময় হচ্ছে শুভেচ্ছা।
চৌদ্দ-পনেরোর এক কিশোরী। গান গাইছে, নাচ শিখছে, আবার শরীরচর্চাও করছে। যেমন গলা, দেখতেও তেমনি, আবার মানুষ হিসেবে অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়। ঐ সময়েই শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্প অবলম্বনে নির্মিতব্য ছবিতে আমিনা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল কিন্তু তাঁকে রাজি করানো যায়নি।
নজরুলগীতি এবং ফিরোজা বেগম
নানা গানের ভিড়ে নিজেকে আলাদা করে নেয়ার এক তীব্র ইচ্ছা কাজ করত তাঁর মধ্যে। আর তা অন্য কোন গান নয়- নজরুলগীতি। এটা ছিল তাঁর কাছে এক চ্যালেঞ্জের মতো। তখন নজরুল সঙ্গীত বলা হতো না, বলা হতো আধুনিক গান লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। পরে সেটা থেকে নজরুলগীতি হয়। আর ফিরোজা বেগমের চেষ্টাতেই তা পায় নজরুলগীতির অভিধা। তিনিই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নজরুলের গানের অনুষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক করেন।
নজরুলগীতিকে জনপ্রিয় করার জন্যই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অন্য গান নয়, নজরুলের গানই গাইবেন। গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তারা অবাক। ফিরোজার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। তাদের কথা হল, ‘এত ভাল গলা তোমার! এভাবে নিজের ক্যারিয়ার কেউ নষ্ট করে? তাছাড়া এখন তো আর লোকে সেভাবে নজরুল সঙ্গীত শোনে না। ভেবে দেখ কী করবে!’ কিন্তু ফিরোজা বেগম অবিচল। গাইলে নজরুলগীতি। সেটাই হবে তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। অগত্যা হতাশ হতে হচ্ছে সবাইকে।
সেই সময়ের কথা বলতে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। কত নামীদামী শিল্পী চারপাশে। অথচ প্রতিযোগিতাও কম নয়। তা সত্ত্বেও আমি সহজে সফল হওয়ার সুযোগ হেলায় ঠেলে দিয়ে নজরুলগীতিকে বেছে নিয়েছি। নজরুলের গানে আমার এই সমর্পণের নেপথ্যের কোন রহস্য আমি আজও উদঘাটন করতে পারিনি। এখানে একটা কথা বলতে পারি, ছোটবেলা থেকেই আমার ভেতরে একটা কবি কবি ভাব কাজ করে আসছে। আমার উপলব্ধি সব সময়েই গভীর। কোন চটুল গানের জন্য আমি কখনোই উচাটন হইনি। আমি চেয়েছি জটিল থেকে জটিলতর সব সুরের সমাধান। এর বাইরে এই বিষয়টিকে এক দৈব নির্দেশিত ঘটনা হিসেবেও দেখি আমি। আমার মধ্যে এই গান নিয়ে কিছু করার দায়বদ্ধতা আপনা থেকেই তৈরি হয়েছে। ওঁর গানে অমূল্য যে মণিকাঞ্চণ তা সঙ্গীত পিপাসুদের কাছে পৌছে দেয়া প্রয়োজন বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি। সেই ঐকান্তিক প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে আজও। আমার সারাজীবনে অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তর আমি পাই নজরুলের গানে। এর সুর ও বাণী আমাকে সম্মোহিত করে রাখে অনির্বচনীয় এক ঐশ্বরিক অনুভূতিতে। এই গানের প্রতি আমার রয়েছে এক শিহর-লাগা অনুভব। সেই প্রথমবার নজরুল সঙ্গীত নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে। তার চেয়েও বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি এই আশির দশকে আমার দেশে সেই একই কথা শুনে। আমি কিন্তু কখনোই হাল ছাড়িনি। ওটা আমার ধাতে নেই। নজরুল সঙ্গীত নিয়েই আমি এগিয়েছি, এগিয়েই চলেছি।’
নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত প্রথম রেকর্ডের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি আমার গলায় নজরুলের গান রেকর্ড করতে রাজি হয়। তখন ‘আমি গগন গহনে সন্ধ্যাতারা…’ গেয়েছিলাম। পূজোর রেকর্ডের ক্ষেত্রেও আমি একই সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছি । এজন্য আমাকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত জয় আমারই হয়েছে। কোম্পানি পূজোয় আমার গাওয়া নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড বাজারে ছাড়তে রাজি হয়েছে।’
১৯৬০ সালের পূজোয় সেই রেকর্ড বেরোয়। তবে দুর্গাপূজোর আগে নয় পরে। সেই রেকর্ডে ফিরোজা গাইলেন সর্বকালের জনপ্রিয় দুটি গান ‘দূর দ্বীপরাসিনী’ আর ‘মোমের পুতুল’। ফিরোজার জনপ্রিয়তাকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। পরবর্তি তিনমাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে তাঁর রেকর্ড।
‘১৯৬১ সালে আমার গাওয়া নজরুলসঙ্গীত নিয়ে লংপ্লে রেকর্ড বেরোয়। সেখানে ‘মোর ঘুম ঘোরে’ আর ‘নিরজনে সখি’ গান দুটো গেয়েছিলাম। এটাই ছিল নজরুলের গানের প্রথম লংপ্লে। একইভাবে ১৯৭৬-৮৬তে পাকিস্তানেও প্রথম নজরুলের গানের লংপ্লে আমার। ঐ রেকর্ডে ছিল ‘ওরে শুভ্রবাসনা রজনীগন্ধা’ গানটি। এটি সেই সময়ে খুব সুপারহিট হয়েছিল। এমনকি নজরুলের গজলের প্রথম লংপ্লেও আমার। ১৯৬৮ সালে আমার গাওয়া ‘শাওন রাতে যদি’র রেকর্ড এক সপ্তাহের মধ্যে দু’লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়। এজন্য জাপানের সনি কর্পোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সিবিএস আমাদের গোল্ড ডিক্স দিয়ে সম্মানিত করে।’
নজরুলের গানের জন্য ওপার বাংলা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তিনি নজরুলের গান গাওয়ার জন্য মানবেন্দ্রের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা তাঁকে আজো ব্যথিত করে ।
এখানে একটু বলে রাখা ভাল, ১৯৪৮-৪৯ সালে ফিরোজা বেগম আর তালাত মাহমুদকে অতিথি শিল্পী হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আর তাঁদের গানেই উদ্বোধন করা হয় ঢাকা রেডিওর শর্ট ওয়েভ। জেড এ বোখারী তখন রেডিওর চেয়ারম্যান ছিলেন।
যে কোন গান নিয়ে তাঁর উপলব্ধি প্রণিধানযোগ্য। কবির উপলব্ধিকে আত্মস্থ করে তা পুনর্ব্যক্ত করার মন্ত্রে বিশ্বাস করেন তিনি। তাই তাঁর গান আর গান থাকে না, হয়ে ওঠে ধ্যান। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডও আছে তাঁর। শান্তিদেব ঘোষের অনুমতিতেই তা রেকর্ড হয়েছে। তখনকার দিনে রেকর্ড করে ছাড়পত্রের জন্য শান্তিনিকেতনে গান পাঠাতে হতো। পরে শান্তিদেবের সঙ্গে দেখা হলে তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার গানও পাঠানো হয়েছে, দেখো দেখি কী কাণ্ড! এবার তুমি আমার পরিচালনাতেই গাইবে।’ কিন্তু তাঁর তিরোধানে সেটা আর হয়নি। এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফিরোজার কণ্ঠে এখনো আক্ষেপ ফুটে ওঠে। শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে দু’দুবার সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে তাঁকে। আজও তা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন নজরুল সঙ্গীতের এই রাজেশ্বরী। শান্তিনিকেতনের কথায় তিনি সব সময়ই একটু স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন। শান্তিনিকেতনের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ওখানেই পড়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু বাবা টাকা পাঠানোর কোন ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি বলেই যাওয়া হয়নি। হলে হয়ত আমার আজকের অবস্থান একেবারে অন্যরকম হতো।’
পারিবারিক জীবন
১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ টানা ১৩ বছর ছিলেন কলকাতায়। এই সময়টাকে তিনি নির্বাসন হিসেবেই দেখেন। ঐ সময়েই ১৯৫৬ সালে বিরলপ্রজ সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি তাঁর পরিবার। কিন্তু নিজের সত্যকেই তিনি সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কলকাতেই জন্মেছে তাঁর তিন সন্তান- তাহসিন, হামীন ও শাফীন। ঐ সময়ে স্বর্ণযুগ স্বর্ণকণ্ঠী ফিরোজার। অথচ টানা পাঁচ বছর স্বামী-সন্তান-সংসার সামলাতে গিয়ে গান গাইতে পারেননি তিনি। আজও ঐ ঘটনা এক নিদারুণ কষ্টের বোধে আচ্ছন্ন করে তাঁকে। এগিয়ে চলা সময়ের সঙ্গে তাঁদের দুর্ভাগ্যও এগিয়ে এসেছে। অসুস্থ হয়ে পড়লেন কমলবাবু। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই পিজি হাসপতালে মৃত্যু হয় কমল দাশগুপ্তের। যতি পড়ে মাত্র ১৮ বছরের সুরময় দাম্পত্যের।
বাচ্চাদের কথা, স্বামীর চিকিৎসার কথা ভেবে ‘৬৭তে দেশে ফিরলেন। আসতে না আসতেই পড়েছিলেন দুর্বিপাকে। তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাঁকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছিল উপর্যুপরি টেলিগ্রাম। দুঃসহ সেইসব স্মৃতি আজও তাঁকে কষ্ট দেয়। তিনি বলেন, ‘ব্ল্যাক লিস্টেডও করা হয়েছিল আমাকে। এখানকার অনেক শিল্পীও আমার সঙ্গে ভীষণ রকমের শত্রুতা করেছে। আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগানো হয়েছিল। কী দুর্বিসহ যে ছিল সে জীবন, যা বলার নয়।’ কিন্তু বরাবরের মতো এবারও আত্মপ্রত্যয়ে অবিচল নিজের সঙ্কট নিজেই মোচন করেছেন ফিরোজা। পাকিস্তান সরকার অবশেষে প্রকৃত বিষয় অনুধাবন করেছিল। এমন ব্যক্তিত্বকে দেশ ত্যাগ করতে বলাটা যে মূর্খামি তা বুঝতে তাদেরও বিলম্ব হয়নি। ‘ঐ সময়ে অবশ্য আমার বাবা এবং ভাইরা আমাকে দেশে রাখার জন্য দারুণ লড়াই করেছেন, চিঠি চালাচালি করেছেন। তাদের সেই ভূমিকা আমি আজও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।’
সেই ১২ বছর বয়সে যে মেয়ের রেকর্ড বেরিয়েছে, উপমহাদেশ যিনি মাতিয়েছেন, তিনি ১৯৭২ সালের আগে কখনোই মঞ্চে ওঠেননি। ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর কলকাতার রবীন্দ্রসদনে তিনি পাবলিক পারফরমেন্স করেন। সেটাই ছিল সেখানে কোন শিল্পীর করা প্রথম এককানুষ্ঠান। ঐ আসর নিয়ে অন্তত একপক্ষ কাল ধরে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। ঐ সময়ের আগে তাঁর কোন ছবি রেকর্ডেও ছাপা হতো না। এর অনুমতিই ছিল না। খ্যাতিকে তিনি সব সময়েই নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছেন। এজন্যই তিনি পরম আত্মবিশ্বাসে বলতে পারেন, ‘আমি আছি আর আছে মোর তানপুরা’। কলকাতা নিয়ে তাঁর রয়েছে অন্যরকম এক দুর্বলতা, স্বর্ণালি স্মৃতির উপচে পড়া ঝাপি। ১৯৮৪ সালে কলকাতায় তাঁর একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে করি দিতেই স্মৃতির প্রকোষ্ঠে জমা করে রাখা তথ্য থেকে ঠিকই জানিয়ে দিলেন- সেটা ছিল তালাত মাহমুদের কলকাতায় শেষ অনুষ্ঠান।
১৯৬৮-৬৯ ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধন। গান গাইতে হবে ফিরোজা বেগমকে। তাঁকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু ফিরোজার এক কথা, ‘আগে আমি বাংলা গাইব তারপর উর্দু। নইলে যাব না।’ তখনকার তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ঐ শর্তেই রাজি। তিনি গাইলেন- ‘ও ভাই খাটি সোনার চেয়ে খাটি আমার দেশের মাটি’। সত্তরে দেশ ফুঁসছে আর সে সময় করাচীতে ইএমআই পাকিস্তানে তিনি ‘জয়, জয়, জয় বাংলার জয়’ আর ‘জন্ম আমার ধন্য হল মাগো’ এই বাংলা গানগুলো রেকর্ড করেন। ‘এই গান গাওয়ার অপরাধে দেশে ফেরার পর একদিন রেডিও স্টেশন থেকে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল চারটায় আমাকে একটি বন্ধ গাড়িতে করে নিয়ে যায়। কোথায় নেয়া হচ্ছে বুঝতে পারিনি। জিজ্ঞাসাবাদের পর রাত একটায় আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায় বাসায়। আমি তাদের যুক্তি দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। তবে গানের মূল রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়। স্বাধীনতার পর অন্য শিল্পী ঐ গান রেকর্ড করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাধিকবার আমার বাড়ি তল্লাশি করা হয়েছে। চেষ্টা করেছে আমাকে মেরে ফেলার। ১৪ ডিসেম্বর তো একটুর জন্য বেঁচে যাই।’
সম্মাননা
বিভিন্ন সময়ে নানা সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্বাধীনতা পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, সত্যজিৎ রায় স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার। তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন বাংলা ১৪০০ সালে কলকাতার সাহিত্যিক-শিল্পীদের দেয়া সংবর্ধনা। সেবার একই বৃন্তে দুটি কুসুম শিরোনামে দুই অসামান্য কণ্ঠমাধুর্যের অধিকারী নজরুল সঙ্গীতে ফিরোজা বেগম এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুচিত্রা মিত্রকে সম্মান জানানো হয়।
সঙ্গীত ভুবনের এই সম্রাজ্ঞীর জীবন কখনোই কুসুম বিছানো ছিলনা। প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাঁকে। আজও তা অব্যাহত বলেই মনে করেন তিনি। এ প্রশ্ন সঙ্গত দেশে কি তাঁকে যথাযথ সম্মান দিতে পেরেছে? ভাবলে অবাক লাগে, গত পঁচিশ বছরে কোন বিদেশ সফরে তাঁকে নেয়া হয়নি। সরকারী কোন অনুষ্ঠানোপলক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয় পাঠায়নি কোন আমন্ত্রণপত্র। ভারত আর পাকিস্তান মিলিয়ে যেখানে এই কিংবদন্তির রেকর্ডসংখ্যা ১,৬০০, সেখানে বাংলাদেশে হাতেগোনা তিন কি চারটা।
নজরুল ইনস্টিটিউট এবং ফিরোজা বেগম
নজরুল ইনস্টিটিউট নিয়ে তাঁর মনে রয়েছে গভীর এক ক্ষত। নজরুল ইনস্টিটিউট এর জন্ম নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একদিন ডেকে পাঠিয়ে আমার ইচ্ছের কথা জানতে চেয়েছিলেন। আমি নিজের স্বাচ্ছন্দ্য নয়, নজরুলের গানের জন্যই কিছু একটা করার ইচ্ছে প্রকাশ করি। তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যাও শোনেন। সেটা কোথায় হবে, কেমনভাবে হবে তাও আমার কাছ থেকে জানেন। আমি চেয়েছিলাম ইনস্টিটিউট হোক পাস্থপথের মুখে। আমি আমার ভাইদের সঙ্গে আলাপ করে তাঁকে প্রকল্পের প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর অকাল প্রয়াণের জন্য তা কখনোই বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। নজরুলের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আর আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। তিনি আমাকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। পরে একই প্রকল্প আমি এরশাদ সাহেবকেও দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি কোন উচ্চবাচ্য করেননি। উপরন্তু আমাকে কবিভবন থেকে উৎখাত করে সেখানে নিজে নজরুল ইনস্টিটিউটের ভিত্তি গড়েন। সেই অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকাও হয়নি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁকে অনুরোধ করেও অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারতাম আমি।’
জাতীয় কবির সম্মান দেয়া হলেও নজরুলের গানের জন্য কোন সরকারই সেভাবে কিছু্ই করেনি। কোন টেলিভিশনে তাঁর গানের অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করার তাগিদও কেউ অনুভব করে না। এসব নিয়েও তাঁর হতাশা অনিঃশেষ।
এই সুযোগে আরো কিছু তথ্য না জানালেই নয়। এক নাগাড়ে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় সঙ্গীত সাধনার নজির পৃথিবীতে আর নেই। এজন্য তাঁর নাম অনেক অগেই গিনেস বুকে ওঠা উচিত ছিল। সারাবিশ্ব তিনি পরিভ্রমণ করেছেন নজরুলের গান নিয়ে। একক অনুষ্ঠান করেছেন ৩৮০টির মত। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে তাঁকে নজরুল সঙ্গীত ও অতুলপ্রসাদের গান শিখিয়েছেন ফিরোজা।
এই মেঘছোঁয়া খ্যাতি তাঁকে কখনোই বিচলিত করতে পারেনি। কখনোই তিনি বিত্তের পিছনে ছোটেননি। তাই তো সারাজীবন প্লেব্যাকের মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন।
কখনো রূপসদনে যাননি তিনি। এমন মন্তব্যে অবাক না হয়ে কি পারা যায়। অথচ কী পরিপাটি তিনি। তাঁকে স্টাইল আইকন অভিহিত করলে একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না। সেই ছেলেবেলা থেকেই তিনি নিজের ব্যাপারে সচেতন। পুরানো ছবিগুলোতে বাঙ্গময় তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভা। অথচ অনুকরণীয় নৈপুণ্যে নিভৃত যতনে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন সব সময়েই প্রচারের উজ্জ্বল আলো থেকে। পাদপ্রদীপের আলোয় কেবল খেলা করে জ্যোৎস্নার মতো নরম অথচ হৃদয়ছোঁয়া কণ্ঠমাধুর্য। এক সময় সাঁতার কাটা তাঁর শখ ছিল। তিনি আর তাঁর ছোটভাই আসফউদ্দৌলাই করতেন যত দুঃসাহসিক কাজ। ‘ও অনেক ভাল গানও গায়। সিএসপি অফিসার হওয়া সত্ত্বেও ভাল শিল্পীও সে।’
নিয়মিত কবিতা পড়তেন ফিরোজা বেগম। বাগান করতেন। এ দুটোও তাঁর ক্যানভাস ছিল। নিয়ম করেই রেওয়াজ করতেন এই সুর-তাপসী। আরও ছিল কিছু পাখি। তাদের কলকাকলি, নজরুলের গান, হৃদয়পাত্র উছলে পড়া মাধুরীময় স্মৃতিরাজিই ছিল তাঁর শেষ দিনগুলির নিত্য সহচর।
মৃত্যু
২০১৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফিরোজা বেগম।
শেষ কথা
অনেক কিছু নিয়েই তাঁর ছিল অনুযোগ, অভিযোগ আর আক্ষেপ। ফলে প্রচারের উজ্জ্বল আলোও তাঁকে মোহিত করে না কখনো। অথচ সেই অভিমানী মানুষটি সেদিন শেষ শীতের বিকেলে আমাদের সামনে খুলে বসেছিলেন তাঁর জীবনখাতা। প্রতিটি পাতাই যেন একেকটি ক্যানভাস। পরতে পরতে উম্মোচিত জীবনের নানা চড়াই আর উতরাই। সেখানে রঙের এর বৈচিত্র আর এতটাই উজ্জ্বলতা যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাঁর জীবন তো নয়, যেন মার্গ সঙ্গীতের আসরে মধুর কোন রাগ পরিবেশনেরই নামান্তর, যা আলাপ থেকে স্থায়ী হয়ে অন্তরা আর সঞ্চারীর পথ বেয়ে আভোগে সমাপতিত। গুনতে হয় মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
লেখক : শেখ সাইফুর রহমান