বাংলাদেশের আপামর-সাধারণের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই লালন সঙ্গীত এবং ফরিদা পারভীন পরস্পর পরিপূরক এবং অবিচ্ছিন্ন দু’টি নাম। লালন সাঁইজির গানের প্রসঙ্গ উঠলেই বাঙালীর মন-কানে প্রথমেই যাঁর কন্ঠস্বর ও সুর বেজে ওঠে, তা নিশ্চিতভাবেই ফরিদা পারভীনের। দীর্ঘদিন তিনি দূর কুষ্টিয়া শহরে বসে লালন সঙ্গীতের চর্চা করেছেন এবং সেখান থেকেই তাঁর প্রতিষ্ঠা। দূর মফস্বল শহরে বাস করে লালন সঙ্গীতের মতো একটি বিশেষ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে ফরিদা পারভীন ছাড়া আর কারো নেই। কুষ্টিয়াতে অবস্থানকালেই তিনি লালন সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক এবং অনন্ত প্রেম ছবিতে ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটি গেয়ে ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
লালন সঙ্গীতের এই অতুলনীয় ও অদ্বিতীয় কন্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীনের জন্ম ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর নাটোর জেলার সিংড়া থানার শাঔঁল গ্রামে। শাঔঁল হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সুন্দর একটা গ্রাম কলম-এর অংশ। কলম গ্রামের মতো এত সুন্দর গ্রাম আজও নাকি তামাম উত্তরবঙ্গে নেই। এ প্রসঙ্গে ফরিদা পারভীন ওই অঞ্চলে প্রচলিত একটা ছন্দ-প্রবাদের উদ্ধৃতি দেন- ‘বিল দেখতে চলন। গ্রাম দেখতে কলম।’ সেই সুন্দর গ্রামাঞ্চলে তাঁর জন্ম।
পারিবারিক পরিচয়
ফরিদা পারভীনের বাবা প্রয়াত দেলোয়ার হোসেন পেশায় ছিলেন সাধারণ চিকিত্সক। মা রৌফা বেগম
শৈশবকাল
ছোটবেলায় ফরিদা পারভীন ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। প্রায় সারাক্ষণ তিনি দৌড়-ঝাঁপ আর খেলাধুলা করে বেড়াতেন। তাঁর দাদা এবং নানার বাড়ির মাঝখানে ছিল একটি নদী। আত্রাইয়ের সেই শাখা নদীর নাম ছিল গুর। ওই নদীটি পার হয়ে অধিকাংশ দিন বালিকা ফরিদা দাদার বাড়ি থেকে নানার বাড়িতে চলে যেতেন। আর নানার বাড়ির পাশে ছিল বিরাট একটা বিল। নদী পার হয়েও তাই তাঁর অবসর ছিল না। বালিকাবেলার খেলার সাথী মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে শাপলা তুলতে যেতেন সেই বিলে। শুধু তাই-ই নয় বিলের মধ্যে থাকতো ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। ওই সব নৌকাতে চেপে ফরিদারা সাধারণত বিল থেকে শাপলা তুলে আনতেন। এর বাইরে বালিকা ফরিদা সাথীদের সাথে যেতেন পাখির বাসা দেখতে এবং মাঠের পর মাঠ হইচই করতে। খুব বেশি গরমের সময় হলে ফরিদা তাঁর নানা বাড়ির আমবাগানের নীচে পাটি বিছিয়ে মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে শুয়ে থাকতেন। সে সময় ফরিদা ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। আবার ছোটবেলা থেকেই একটু আধটু গানও করতেন যে কারণে মামা-খালারা তাঁকে খুব ভালবাসতেন।
বালিকা বয়সে ফরিদা পারভীন যখন গ্রামে ছিলেন, তখন গান কিন্তু সবসময় তাঁর মুখে লেগেই থাকত, সে যেকোনো গান হোক না কেন। ছোটবেলা থেকেই ফরিদার ভালো লাগতো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। তখন তিনি বুঝতেনও না যে উনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কিন্তু রেডিও ছেড়ে দিয়ে তাঁর গান শুনে তিনি শিহরিত হতেন। ফরিদা রেডিওতে সন্ধ্যা’র উচ্চারণ খেয়াল করতেন। আজকের ফরিদা পারভীন স্বীকার করেন-উচ্চারণে তিনি ইনহেরিটেজ, শুনতে শুনতে তাঁর উচ্চারণ শেখা। তখন আকাশ বাণী বেতারে সকাল পৌঁনে ন’টায় আধুনিক গানের একটা অনুষ্ঠান হত। বালিকা ফরিদা একদিন রেডিও শুনতে শুনতে আকাশ বাণী ধরেন। তখন তিনি সঙ্গীতের বিষয়গুলোর কিছুই বুঝতেন না। পরবর্তীতে জেনেছেন যে, তাঁর শোনা আকাশ বাণীর ওই অনুষ্ঠানে আধুনিক গানের সঙ্গে ওস্তাদ আলী হোসাইন তার সানাই বাজাতেন। অসাধারণ সেই সুরটা ফরিদাকে মুগ্ধ করতো। তখনকার দিনে ফরিদার জীবনে এমনও হয়েছে যে, তিনি গান শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেছেন, গলা সাধতে সাধতেও কেঁদে ফেলেছেন। সুরটা ফরিদাকে প্রথম থেকে আবেগাপ্লুত করতো, ফরিদার ভিতরে অনুরণন ঘটাত।
ফরিদার বড় মামা ভীষণ গানের ভক্ত ছিলেন। উনি গান করতেন না, কিন্তু গানের আসর যেখানে যা হবে, তিনি যাবেনই। যেহেতু ফরিদার নানা-দাদার বাড়ি সংলগ্ন হিন্দু সমাজের একটা প্রভাব ছিল, তাঁদের সঙ্গে তাঁর মামাদের বন্ধুত্ব ছিল। তখন ধর্মের কথা ভেবে কারো মধ্যেই তেমন কোনো কুসংস্কার ছিল না, বরং বন্ধুত্ব এত বেশি ছিল যে তারা ফরিদার মামাদের বাড়িতে আসতেন, অনুষ্ঠান হলে তাঁর মামারাও যেতেন ওদের বাড়ি। কোনদিন মামা হয়তো কোথা থেকে একটা হারমোনিয়াম নিয়ে এসে বলতেন,- ‘ফরিদা গান করত দেখি।’ অমনি ফরিদা আনন্দের সঙ্গে গান গাইতেন। ফরিদা নানার বাড়িতে গেলে সন্ধ্যার পর উঠানে পাটি পেতে গানের আসর বসত। ফরিদার গান শুনে তার বড় মামা বলতেন, ‘আমার ফরিদার মতো আর গলা দেখি না। দেখিস রৌফা (ফরিদার মা ছিলেন সবার ছোট, মায়ের নাম ধরে বলতেন) আমার ফরিদা যা হবে না।’
ছুটির দিনে ফরিদার প্রিয় স্থান ছিল মামাদের আম বাগান, ওই বাগানে ফরিদা খেলতে যেতেন। অন্যদিকে, বিলে না গেলেও তাঁর ভালো লাগত না। আর বিলে পানি না থাকলেও তাঁর ভালো লাগত না। কাজেই বারোমাস বিলে পানি থাকতেই হবে। কেননা, সে পানিতে শাপলা ফোটে। এর মাঝে গ্রামের স্কুলেও তিনি কিছুদূর পড়াশোনা করেন।
তবে ফরিদা পারভীনের বেড়ে ওঠাটা একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামে নয়। কারণ তাঁর বাবা মেডিকেলে চাকরি করতেন, আর তাঁর চাকরির বদলির সুবাদে বিভিন্ন সময়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ফরিদাকেও বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। এ কারণে ফরিদার বেড়ে উঠাতে বিভিন্ন জায়গার ছাপ পড়েছে।
শিক্ষা জীবন
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
ফরিদা পারভীনের স্কুল জীবন কেটেছে বিভিন্ন শহরে। তবে তাঁর স্কুল জীবনের সূচনা হয়েছিল মাগুরায়। তারপর একে একে কুষ্টিয়া গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল, কুষ্টিয়ার মীর মোশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় এবং মেহেরপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলে অধ্যয়ন করেন। তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন মীর মোশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে। এরপর কলেজ জীবনে তিনি কুষ্টিয়াতে পড়ালেখা করেছেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচ.এসসি. পাশ করেন এবং একই কলেজ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৬-৭৯ খ্রিস্টাব্দে অনার্স পাশ করেন।
গানের শিক্ষা
ফরিদা পারভীনের গানের হাতেখড়ি মাগুরা জেলায়। সেটা ১৯৫৭-৫৮ সালের কথা, তখন ফরিদা মাত্র চার-পাঁচ বছরের মেয়ে। সে সময় মাগুরায় ফরিদাকে গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। এরপর যেখানেই তিনি থেকেছেন সেখানেই তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে গানের তালিম নিয়েছেন। মাগুরা গার্লস স্কুল থেকে যখন তিনি কুষ্টিয়া গার্লস স্কুলে আসেন, তখন ওস্তাদ ইব্রাহিম ছিলেন তাঁর স্কুলের গানের টিচার। ফরিদার গান শুনে তিনি তাঁকে ক্ল্যাসিক্যাল শিখতে পরামর্শ দেন। তখন তিনি ক্লাস থ্রি’র ছাত্রী। ওস্তাদ ইব্রাহিমের পরামর্শ মোতাবেক ফরিদা উনার কাছেই ক্ল্যাসিক্যাল শিখতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি আরেকটু বড় হয়ে কুষ্টিয়ার তখনকার গানের ওস্তাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস এবং ওসমান গণি’র কাছে ক্ল্যাসিক্যাল শেখেন। প্রায় ছয়-সাত বছর তানপুরার সঙ্গে ক্ল্যাসিক্যাল চর্চা করবার পর তিনি নজরুল সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন। তাঁর নজরুল সঙ্গীতের প্রথম গুরু হচ্ছেন কুষ্টিয়ার ওস্তাদ আবদুল কাদের। এরপর তিনি মেহেরপুরে মীর মোজাফফর আলী’র কাছেও নজরুল সঙ্গীত শেখেন। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কন্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলী’র কাছেই প্রথম শেখেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে ফরিদার যোগাযোগ। তখন তিনি কুষ্টিয়াতে থাকতেন। সেখানে তাঁদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন গুরু মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা তাঁর কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শিক্ষার মাধ্যমে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন। পরে মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালন সঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন।
কর্মজীবন
ফরিদা পারভীনের কর্মজীবন সঙ্গীতময়। শুধু লালনের গান নয়, তিনি একাধারে গেয়েছেন আধুনিক এবং দেশাত্মবোধক গান। ফরিদা পারভীনের গাওয়া আধুনিক, দেশাত্মবোধক কিংবা লালন সাঁইয়ের গান সমান ভাবেই জনপ্রিয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে উদযাপনসহ যে কোনো জাতীয় দিবস পালনের সন্ধিক্ষণ এলে এদেশের সর্বত্র ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদীর তটে’ গানটি অবধারিতভাবেই শোনা যায়। আবার আধুনিক গানের প্রসঙ্গ উঠলে এদেশের মানুষ এক বাক্যে স্মরণে আনে ফরিদার গাওয়া- ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’ এবং ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে প্রেমের কী সাধ আছে বলো’ গান দুটিকে। তবে, সব ছাড়িয়ে বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে ফরিদা পারভীনের প্রধান পরিচয় লালন সঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে। তাঁর গায়কীর কারণেই লালনের গান আজ আমাদের সবার কাছে এত প্রিয়।
স্বাধীনতার পর ফরিদা পারভীন ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর গাওয়া গান দিয়ে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস শুরু হলো। মোকছেদ আলী সাঁই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন। তিনি ফরিদাকে ঢাকায় কিছু লালনের গান গাইতে বলেন। তাঁর অনুরোধে তিনি তখন ‘খাঁচার ভিতর’, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’ এই গানগুলো গাইলেন। তখন তিনি কুষ্টিয়া থেকে এসে মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনের গান শিখে ট্রান্সক্রিপশনে রেকর্ডিং করতে থাকেন।
পারিবারিক জীবন
ফরিদা পারভীনের স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার ও কন্ঠশিল্পী আবু জাফর। ফরিদা পারভীন চার সন্তানের জননী। এক মেয়ে জিহান ফারিয়া আর তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ইমাম নিমেরি উপল, মেজ ছেলে ইমাম নাহিল সুমন এবং ছোট ছেলে ইমাম নোমানি রাব্বি।
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
লালন সাঁইজির গানের বাণী ও সুরকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। বর্তমান শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের দরবারেও তিনি এখন লালন সাঁইজির বাণী ও সুরকে প্রচারের কাজে আত্মনিবেদিত আছেন। ইতোমধ্যে তিনি জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ আরো বহু দেশে লালন সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।
সম্মান, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা
ফরিদা পারভীন লালন সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক পান। এর বাইরে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র ‘অন্ধ প্রেম’-এ সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
ফরিদা পারভীনের গানের অ্যালবাম
* ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘অচিন পাখি’ নামে একটি লংপ্লে রেকর্ড বের হয়। স্পন্সার করে শ্রোতার আসর (বর্তমানে এসিআই কোম্পানি)
* ডন কোম্পানি থেকে ‘লালনগীতি’
* সারগাম থেকে ‘লালনের গান’
* দোয়েল প্রডাক্টস থেকে ‘দেশাত্মবোধক/আধুনিক/লালন’ মিলে একটা ক্যাসেট
* আরশিনগর-এর ব্যানারে লালনের গান ‘আমারে কি রাখবেন গুরু চরণে’
* বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’
* আবুল উলাইয়ার পরিবেশনায় ‘আশা পূর্ণ হলো না’
* ‘লাইভ কনসার্ট ইন জাপান’ নামে একটা এ্যালবাম বের করছে আবুল উলাইয়া
* তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না
* সমুদ্রের কূলেতে বসে
* হিট সঙস অব ফরিদা পারভীন : মিলেনিয়াম /বহুদিন হলো ভেংগেছি ঘর
* লাইভ কনসার্ট ইন ফ্রান্স
এবং আরো অন্যান্য।
ফরিদা পারভীনের একটি সাক্ষাত্কার
* প্রথম সুরটা কিভাবে এলো আপনার ভিতরে?
ফরিদা পারভীন : আমি যখন মায়ের দুধ খাই, তখনই প্রথম আমার ভেতর সুরটা যায়। সে সময় আমার সেন্স একটু একটু কাজ করতো। আমি কিন্তু অনেক বড় হয়েও মায়ের দুধ খেয়েছি। এক মেয়ে ছিলাম, ঘুম পাড়ানোর সময় মা’র দুধ খেতাম, আর মা গান করতেন। মায়ের সেই সুরটাই আমার ভেতর রয়ে গেছে, সেই সুরটা এখনো আমি ভুলতে পারি না। তখনকার হিন্দি গান, লতাজির অনেক গান মা গাইতেন। সিনেমা দেখতেন তো খুব, তখনকার সিনেমার ওইসব গান গাইতেন। আমার মায়ের কিন্তু খুব ভালো গানের গলা ছিল।’
* ছোটবেলায় গানের জন্যে তাঁর আলাদা কোনো সময় লাগতো কি?
ফরিদা পারভীন : গান তো আমার মুখে লেগেই আছে। গানের সুর আমার ভেতরে সব সময়। খেলা করছি, পড়ছি, সব সময় গানের সুর ভেতরে ছিল। পড়তে পড়তে একটা গান মনে এল জোরে জোরে গাইতে শুরু করলাম।
বন্ধুরা প্রায়ই আমার কাছে জোর করত-‘তুই ওই গানটা কর না।’ পড়ালেখায় আমার কোনো দিনই মন লাগতো না, তবে পড়ালেখায় আমি ভালো ছিলাম। খুবই ভালো ছিলাম। যেমন একটা ঘটনা বলি-মাগুরায় যখন পড়ি, ওয়ান থেকে টুতে উঠছি, তখন এক মার্কের জন্য আমাকে সেকেন্ড করে দিল। তখন আমার জেদটা ভীষণ কাজ করতো, যেটা হবে এক নম্বরই হবে, দুই নম্বর হবে না, এক নম্বরই হতে হবে। তারপর আমার সে কী কান্নাকাটি। কান্নাকাটি করে বললাম যে, আমি পড়বোই না।
* গানের ক্ষেত্রে এই জেদটা কিভাবে কাজ করেছে?
ফরিদা পারভীন : (হেসে) তাহলে, আরেকটা মজার ঘটনা বলি, যেটা ওই মাগুরাতেই, আমার বাবার সঙ্গে জেদ করছি আমার হারমোনিয়াম বানিয়ে দাও, আমি হাতেখড়ি দেব, আমি গান শিখব। গান ছাড়া আমার জীবন বলেন, আমার যা কিছু বলেন, আমার তখন মনে হতো এগুলো সব বাতুলতা, এগুলো কোনো কাজ না, গান শিখলেই আমি সবকিছু করতে পারব, এই রকম। মাগুরায় আমরা তখন ভাড়া বাসায় থাকি, পাশেই আরো দু-একজন ভাড়াটিয়া আছে। তাদের একজনার বাসায় হারমোনিয়াম আছে, আমার হারমোনিয়াম নেই, বোঝেন ঠেলা আমার!
আমাদের বাসা থেকে ওই বাসায় যেতে একটা উঠোন মতো আছে, বাইরের উঠোনে সেখানে জাংলা দিয়ে শিমের গাছ আছে, ওর ভেতর দিয়ে যেতে হয়। দু’পাশে শিমের জাংলা দেওয়া, মাঝখান দিয়ে রাস্তা। একদিন রাতের বেলা ওই বাসায় হারমোনিয়ামের বাজনা শুনে আমি দৌড়ে গেলাম, আমি গিয়ে ওদের কিছুই বলছি না, দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে দেখছি, হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। আমার ভেতরে ভেতরে রাগ হচ্ছে। আমি জানি আমাকে সবাই ভালোবাসে, আমি চাইলেই আমাকে হারমোনিয়াম বাজাতে দেবে। কিন্তু আমি ওদেরকে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে আমার মা আমাকে না পেয়ে এঘরে ওঘরে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তারপর আব্বা এসে আমাকে খুঁজে নিয়ে গেলেন। মা বুঝতে পেরেছিলেন যে হারমোনিয়াম ওইদিকে বাজছে, সুতরাং আমি ওইদিকেই গেছি।’
* এরপর বালিকা ফরিদা আর কতদিন হারমোনিয়ামহীন ছিলেন?
ফরিদা পারভীন : আমি ভীষণ অভিমানী ছিলাম। অভিমান-জেদ ভীষণভাবে আমার ভেতরে কাজ করতো। এখনো করে। কিন্তু এখন আর ওই রকমভাবে করে না, বয়স হয়েছে তো আস্তে আস্তে জেদ স্তিমিত হচ্ছে। ওই ঘটনার পর আমার আব্বাকে বললাম, ‘আমার হারমোনিয়াম যদি না বানিয়ে দাও, তাহলে আমি পড়বও না, খাবও না, গোসল করব না, কিছুই করব না। তারপর কলকাতা থেকে সবকিছু নিয়ে এসে বাসায় মিস্ত্রি দিয়ে হারমোনিয়াম তৈরি করা হলো। সেই হারমোনিয়ামটাই এখন পর্যন্ত আছে। আমার মা যত্ন করে নেপথলিন দিয়ে রেখে দিয়েছে। কারণ, যুদ্ধের বছরে শুধু হারমোনিয়ামটা-ই নিয়ে গিয়েছিলাম আর কিছুই নিইনি। হারমোনিয়ামটা মিলিটারি দেখলে আমাকে হয়তো রেডিওতে গান করতে নিয়ে যাবে-এই ভয়ে হারমোনিয়ামটা এক সময় মাটির নীচে পুঁতেও রেখেছিলাম। যাতে তারা দেখতে না পায়। এই হচ্ছে আমার প্রথম দিকের সঙ্গীতের জীবন।
* আপনার সেই প্রথম হারমোনিয়ামটা যেহেতু আজও বর্তমান। সেহেতু সেই হারমোনিয়ামটার সাথে আজ একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে আপনার সম্পর্কটা কেমন?
ফরিদা পারভীন : দীর্ঘদিন ওটার কোনো টিউনিং ছিল না, তারপর টিউনিং করে পরিষ্কার করে মা বড় একটা বাক্সের মধ্যে নেপথলিন দিয়ে তুলে রেখেছে। আমি গেলে আবার একটু বের করে, মা যদি গান শুনতে চায়, তখন শোনাই। একদিন হয়েছে কি জানেন, ওই হারমোনিয়ামটা নিয়ে অন্য একটা জায়গায় গেছি, আমার মা আর আব্বা তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। আমি ফিরে এলে বলে যে, ‘না না, এটা ঠিক না, তুই নাই, আমার এই হারমোনিয়ামটা তো তোকে বহন করে।’
* লালনের গানের সঙ্গে আপনার প্রথম যোগাযোগ হল কীভাবে?
ফরিদা : ১৯৭৩ সালে কুষ্টিয়ায় একজন ডাক্তার ছিলেন। সে আবার লালনের আখড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ওই ডাক্তারের নামটা এখন আমার মনে নেই। সেই প্রথম আসছিল আমার কাছে। আমাদের কুষ্টিয়ার হসপিটালের বাসায় এসে আমার আব্বাকে বললেন,-‘লালনের আখড়ায় দোল পূর্ণিমায় সেই মহাসমাবেশটা হবে, মেয়েটা যদি একটা-দুটো গান করতো, তাহলে তো ভালো হতো। পূর্ণদাস বাউলও আসবে।’ তখন আব্বা বললেন-‘ওরে একটু জিজ্ঞেস করে নিই, ও তো পাগলি, ওর মন কখন কী বলে, ওর মনের সঙ্গে আমি সায় না দিয়ে পারিনে।’ আব্বা এসে আমাকে বলল। আমি বললাম,-‘দূর লালন ফকিরের গান করব এটা একটা কথা হল! আমি তো নজরুলের গান করি। সেই আমি ফকিরের গান করব!’ তখন আমি শুধু জানতাম যে লালনের ওখানে একটা উত্সব হচ্ছে। কিন্তু কোনোদিন ওই বিষয় নিয়ে আমার কোন আগ্রহ জন্মেনি। তখন উনি, ওই ডাক্তার আমাকে ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটার একটু টাচ দিলেন। তারপর মোকছেদ কাকা এলেন। উনি সব শুনে বললেন, ঠিক আছে আমি না হয় গানটা তুলে দেব।
আমার কিন্তু মন টানছে না। আমার আব্বা তখন বলল,-‘দু-একটা গান শিখে রাখলে অসুবিধা কী, তুমি তো নজরুলের পাশাপাশি আধুনিক গান করো।’ সে সময়ে আবু জাফর সাহেবও ওই শহরের মধ্যেই থাকতেন, মাঝে মধ্যে আমাদের বাসায় আসতেন, একটা-দুটো আধুনিক গান আমাকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। যদিও আমার নজরুলের প্রতিই বেশি ভালবাসা ছিল। আব্বা এবং মোকছেদ কাকা বললেন,-‘একটা শিখে তুমি লালনের আখড়ায় যেয়ে এবার গাও।’ তখন আমি বললাম যে, ‘একটা গান শিখে কি মঞ্চে ওঠা যায়?’ আমার কথা শুনে গুরু বললেন যে, ‘আগে তুই একটা কর। তারপর যদি ভালো লাগে তাহলে আরো শিখানো যাবে। অসুবিধা কী!’ ঘটনা কিন্তু তাত্ক্ষণিকভাবে তাই ঘটে গেল। মঞ্চে উঠে যখন আমি ‘সত্য বল সুপথে চল’ এই গানটি করলাম, তখন লোক পাগলের মতো ‘আরেকটা হোক’, ‘আরেকটা হোক’ করতে লাগল। আমি বললাম যে, ‘ভাই আবার শিখে আসি, তারপর আরো গান গাইবো।’ এই যে গানটা করার পর আমি শিহরিত হয়েছি। সেটা লালন ফকিরের কারণে না অন্য কারণে, আমি জানি না।
তারপর আমার চিন্তার মধ্যে এল যে, আমি নজরুলের গান গেয়ে তো ফিরোজা বেগম হতে পারব না। (তখন ফিরোজা বেগম একটা আদর্শ ছিল, নজরুলের গান শুনে ফিরোজা বেগম, কমলা ঝরিয়া ইনাদের নামই সবার মনে আসতো।) আমি দেখি লালন গেয়ে কিছু হওয়া যায় কি-না? তখন আমি কেবল ম্যাট্রিক পাস করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছি। আমার কেন যেন মনে হল আমাকে লালনের গানই গাইতে হবে। সে সময় মূলত পুরুষেরাই লালনের গান গাইতো। মেয়েরা যে লালনের গান করতে পারে, এটা আমাকে দিয়েই ভঙ্গ হয়েছে।
* লালন সাঁইজির গানগুলো মূলত তত্ত্ব-নির্ভর। সেই তত্ত্ব-নির্ভর গানগুলোতে আধুনিক সুর-তাল সংযোজনার যৌক্তিকতা কি?
ফরিদা পারভীন : হ্যাঁ, লালনের গানগুলো তত্ত্ব-নির্ভর। সুর এবং লয় কিন্তু মানুষকে আলোড়িত করে। যেমন ‘মিলন হবে কতদিনে’ এটা একটা আকুতির গান। কিন্তু এই গানটার রিদম মানুষকে নাচিয়ে তোলে। এই ভেবে আমি এখন লালনের গানকে বৈতালিকে গেয়ে নতুন একটা কিছু সংযোজন করতে চাচ্ছি। কারণ, গানের সুর এবং কথার মাদকতা লয়টা দিলে নষ্ট হয়ে যায়। যেমন- ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ এটা কিন্তু একচ্ছত্রভাবে আমি বৈতালিকে করেছি। আমি দেখেছি গানের বাণীটা একরকম আর সুর-তাল আরেক রকম। তাই আমি গানটা শুধু সুরে বৈতালিকে গাইলাম, এর সুরের দিকটা আরেকটু আলোড়িত করে।
* আপনি তো রাজশাহী বেতারের নজরুল সঙ্গীতের তালিকাভুক্ত শিল্পী। তাছাড়া আপনার সঙ্গীতজীবনের শুরুর দিকে আপনি নজরুল সঙ্গীতই গাইতেন। তারপর গাইতে শুরু করলেন লালন সঙ্গীত। এখন লালনের গানই সাধারণত আপনি গেয়ে থাকেন। আমার জানতে ইচ্ছে করে- এখন কি আপনি নজরুল সঙ্গীত ভুলে গেছেন?
ফরিদা পারভীন : না, নজরুল সঙ্গীত ভুলে যাইনি, লালনের চর্চা করতে গিয়ে এর চর্চাটা কমে গেল। এখনো যে গাইতে পারব না, এমন নয়। একটা কথা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, যার গলায় সুর আছে, প্রেম আছে, সে যেকোনো গানই গাইতে পারবে। যদি নিষ্ঠা, প্রেম এবং সততা থাকে তাহলে তার গান অবশ্যই সুন্দর হবে।
* আপনার লালন সঙ্গীত নিয়ে লালনপন্থী কিছু সাধুদের একটা অংশের আপত্তির কথা কি জানেন?
ফরিদা পারভীন : একটা কথা কিন্তু মনে রাখবেন, আমি গুরু ধরেই লালনের গান শিখছি- মোকছেদ সাঁই, খোদাবক্স সাঁই, করিম সাঁই আমার লালন সঙ্গীতের গুরু। করিম সাঁই তো এখনও বেঁচে আছেন। তবে এটা বলতে পারেন যে, যখন একটি গান আরেকটি পরিশীলিত গলা ধারণ করে, তখন তার চেহারাটা একটু আলাদা হয় বৈকি। যেমন একটা সাধারণ মেয়েকে আপনি কানে দুল পরাবেন, নাকে নাকফুল পরাবেন তখন সেগুলো তার সৌন্দর্য একটু বৃদ্ধি করবে বৈকি। কারণ আমি তো সঙ্গীতের মানুষ, সঙ্গীত চর্চা করেই লালন সঙ্গীতে এসেছি। সেখানে আমার কন্ঠে গানটি গাওয়ার পর আলাদা একটা দ্যুতি আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এখন আমি যে সুরে গাইছি, বড় বড় গুরুরা তো আমার সুরেই গাইছেন।’
* গুরুরা তো শিষ্য পরম্পরায় বিশ্বাসী?
ফরিদা পারভীন : ‘ওরা তত্ত্বের গুরু মানে, আমি সঙ্গীতের গুরু ধরে গান শিখেছি।’
* লালন সাঁইজির সঙ্গীতে নিজেকে নিবেদন করে আপনার অর্জনগুলোতে আপনি কি তৃপ্ত?
ফরিদা পারভীন : ‘তৃপ্তি তো অবশ্যই আছে, লালন সঙ্গীত গেয়েই আমার জাতীয় পুরস্কার এসেছে। লালন সঙ্গীত করেই আমার দেশ-বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। জাপানে একটা বড় ব্যাপার হয়েছে ‘ফরিদা পারভীন প্রজেক্ট কমিটি’ এক মাসের জন্য আমাকে সেখানে নিয়ে গেছে। আমি বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে লালন সাঁইজির গানকে পরিচয় করিয়েছি। ২০০১ সালের আগস্ট মাস জুড়ে আমি জাপানে ছিলাম।
* লালন সাঁইজির গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা কী?
ফরিদা পারভীন : লালনের গানকে নিয়ে বর্তমানে স্বরলিপি করছি এবং চিন্তাভাবনার মধ্যে স্টাফ নোটেশন। স্বরলিপির কাজ করার উদ্দেশ্য লালনের গানের গায়কীটা ধরে রাখা। ‘ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট’ হতে যাচ্ছে। ট্রাস্টের পরিকল্পনায় আছে- লালনের গান সংগ্রহ, স্বরলিপি, স্টাফ নোটেশন, লালনের গানের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের আর্কাইভস, অন্যান্য ফোক গানও প্রিজার্ভ করা হবে এবং বছরে একটা করে অন্তত লালন সঙ্গীতের সম্মেলন করা। এখন লালন নিয়েই আমার সকল চিন্তা। আরেকটা স্বপ্ন আমার নিজের মধ্যে আছে একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে, সেটা হচ্ছে, গান গেয়ে সন্ত্রাসীদের সুপথে আনা। সবাই বলে এটা কি করে সম্ভব? আমি বলি, একজন সন্ত্রাসীকে যদি লালনের গান শোনানো হয়, তাহলে সে নিশ্চয় ফিরে আসবে। এটা আমি একবার হলেও করতে চাই।
* জীবনের কোনো আনন্দের ঘটনার কথা বলবেন।
ফরিদা পারভীন : চোখে অসংখ্য স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে, যেমন একটি স্মৃতির কথা বলি। ঘটনাটা ১৯৮৪-৮৫ সালের কথা। আমরা বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে ডেলিগেটস গিয়েছিলাম। সুইডেনের রাণীর গ্রামের বাড়িতে আমাদের নিয়ে গেছেন, সেখানে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানটা গাইছি। তিনি হাউমাউ করে কাঁদছেন। রাণী তো কথা বুঝতে পারছেন না। সে শুধু একটা কথাই বলল, ‘ওর গায়কী, ওর সুরের যে ডেপথ, তাতে আমার মনে হলো ওর কন্ঠের মধ্যে ঈশ্বর বাস করছে। আমি আর কিছু বুঝতে পারলাম না। ওর কথা বোঝার আমার দরকার নেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ওর সুরের ভেতর একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে, সেই কষ্টটা আমার কষ্টের সঙ্গে মিলে গেছে।’ সেই কথাটা তো আমি রাণীকে বুঝিয়ে দেইনি। এখানেই লালনের সার্থকতা।
* হালের তরুণ-তরুণীরা লালন সঙ্গীত গাইছে, এসম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ফরিদা পারভীন : এক কথায় জবাব হল প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ। আসলে লালনের গান ভক্তি দিয়ে শিখে গাইতে হবে। লালন সঙ্গীতের গুরু ধরে গাইতে হবে। শুনে শুনে নিজের মতো করে গাইলাম, তাহলে কিন্তু এ গান হবে না। রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী যেটা করতো। ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট থেকে কিন্তু এটাও করা হবে, অর্থাত্ লালনের গানের অথেন্টিসিটি যেটা বলে। শিখে গান করো, আধুনিক যন্ত্র দিয়েই গান করো, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু গানগুলো সঠিক ওয়েতে করো। এটা হচ্ছে আমার কথা।
* লালন নিয়ে কি কিছু করার কথা ভাবছেন?
ফরিদা পারভীন : খুব শিগগিরই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট। এর কার্যক্রমের মধ্যে থাকছে লালনের ৮শ’ গানের স্টাফ নোটেশন সংগ্রহ করে পর্যায়ক্রমে আধুনিক প্রযুক্তিতে সিডিতে সংরক্ষণ। এছাড়া যেসব লোকজগান, বাদ্যযন্ত্র, হারিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো সংরক্ষণ করাও হবে এই ট্রাস্টের কাজ। লালন সঙ্গীতের শিল্পী তৈরী করাও হবে এই ট্রাস্টের কাজ। এর পাশাপাশি মানব কল্যানে করণীয় কার্যক্রমেও এই ট্রাস্ট ভূমিকা রাখবে।
ফরিদা পারভীনের লালনসঙ্গীত সম্পর্কে লালনপন্থী সাধু-গুরু ও শিল্পীদের মূল্যায়ন
লালন সাঁইজির গানগুলো মূলত লালনপন্থী সাধুদের জীবন বিধান। সাঁইজির গানের বাণী মেনে এখনো একটা ক্ষুদ্র অংশের লালনপন্থী সাধুরা তাদের জীবনযাপন করে থাকেন। সাধু সমাজে লালন সাঁইজির গানের চর্চা সেই জীবনযাপনের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা। একটা সময় পর্যন্ত লালনের গানগুলো তাই সাধারণ জনসমাজে তরিকা বহির্ভূত শিল্পীদের দ্বারা তেমন ভাবে গীত হতো না। আজ সাধু পরিমণ্ডলের গণ্ডি পেরিয়ে লালনের গান বৃহত্তর জনসমাজেও সমাদৃত হয়েছে। আর এই সমাদর প্রতিষ্ঠায় ফরিদা পারভীনের কন্ঠের এবং গায়কীর বিশাল একটা অবদান সর্বসমাজে স্বীকৃত। কিন্তু সাধু সমাজে ফরিদা পারভীনে লালন সঙ্গীত সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া কেমন? সেই প্রতিক্রিয়া জানতে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত সাধু-গুরু-শিল্পীদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করা হয়।
বাদের শাহ ওরফে ফকির আবদুল গনি শাহ (লালনপন্থী গুরু ও সঙ্গীতশিল্পী)
দেশবাসী ফরিদা পারভীনের গান পছন্দ করে-ভালো, এতে অন্যায় কিছু নাই। এখন সবাই তালে গায়, কিন্তু সাঁইজির গান তো ভাবের গান, এত তাল সেই জায়গা আসবি কোথা থিকে। শুনি ফরিদার সুরে সবাই মাতোয়ারা হয়ে যায়। সাঁইজির গানের সুর? সুরির কথা আর কি বলবো। সাঁইজির অরিজিনাল সুর আর হয় না। অরিজিনাল সুরিতো আমরা কেউ গাইতি পারিনি। অরিজিনাল সুরডা ধরে রাখার দায়িত্বডা আমাদের ছিলো। আমরা তা পারিনি। কিছু কিছু পারিছি, সব পারিনি। এই জন্যি ফরিদার দোষ দিয়ে আর হোবি কি।
করিম শাহ (লালনপন্থী সাধুগুরু, বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও ফরিদা পারভীনের সঙ্গীতগুরু)
ফরিদা পারভীন শিল্পী হিসেবে তুলনাহীন। তার তুলনা কি আর দেবো। তবে সে তার নিজের সুরে নিজের ভাবে লালনের গান গায়। যদিও সে আমাদের কাছেই তালিম নিয়েছে। আমাদেরই শিল্পী ভাই মকছেদ আলী সাঁই, খোদবক্স সাঁই ফরিদা পারভীনের গানের গুরু। তাছাড়া, সে আমার কাছেও গানের তালিম নিয়েছে। ফরিদার গলায় সুর আছে, তাই সে যা গায়, তা-ই ভালো লাগে, শিল্পী হিসেবে সে সাংঘাতিক গুণী।
হিরু শাহ (তরিকাপন্থী কন্ঠশিল্পী)
লালনের গান হচ্ছে ভাবের গান, ভাব ছাড়া কি গান হয়? তরিকায় দাখিল না হলে গান হবে না। ফরিদা পারভীন সাধুদের কাছ থেকে সুর নিয়ে মডার্ন করেছে। তবে, মডার্ন করলেও মন্দ না, গলায় রস আছে।
রব শাহ (লালনপন্থী সাধু ও প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী)
ফরিদা পারভীন হচ্ছে লালনের গানের বড় সম্রাট (সম্রাজ্ঞী)। যে সাধুরা ফরিদার সমালোচনা করে, সে সাধুরা কুসংস্কারে আছে। উনি লালনের গানের একজন দেবী, মাতাজী। ইদানীং ফরিদা পারভীন আরো দিওয়ানা হয়ে গেছে, এখন সে আরো মজা করে লালনের গান গাচ্ছে।
বলাই শাহ (লালনপন্থী তরুণ কন্ঠশিল্পী)
লালন সাঁইজির গান সারা বাংলাদেশের জনগণের কান পর্যন্ত পৌঁচ্ছে দেবার অবদান ফরিদা পারভীনের। আজ থেকে পনের-বিশ বছর আগে স্টেজে গান করতে গিয়ে সাধুরা ঢিল খেয়েছে, দর্শক শুনতে চেয়েছে আজম খানের গান। কিন্তু ফরিদা পারভীন লালন গাইবার পর থেকে জনগণ সাধুদের গানকে গ্রহণ করে নিয়েছে। আমরা এখন গান গেয়ে খাই। আজ গান গেয়ে যে দুটো ভাত খাচ্ছি, সেটা ফরিদা পারভীনের জন্যে। ফরিদা পারভীন সাধুদের ভক্তি করেন। এখনো করিম শাহকে ফরিদা প্রণাম করেন। কোনো সুরশিল্পী যদি ফরিদা পারভীনকে অসম্মান করে, তবে আমি তাকে ঘৃণা করি।
লেখক : সাইমন জাকারিয়া